২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রাষ্ট্রের তিন সত্তার বৈশিষ্ট্য অটুট থাকতে হবে

লেখক সালাহউদ্দিন বাবর। - ছবি : নয়া দিগন্ত

যেকোনো দেশের শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র, সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল- এই তিন সত্তা তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলতে পারলে তবে তার অর্থ দাঁড়ায় সে রাষ্ট্র খুব একটা সমস্যায় নেই। এই তিনের ভেতর কেউ যদি তার ‘পেরিফেরি’ বা সীমা অতিক্রম না করে সহাবস্থান করতে পারে, তাহলে সেই দেশে গণতন্ত্র, উন্নয়ন কর্মসূচি, সুশাসন, জবাবদিহিতা সব কিছুই সমান্তরালভাবে এগিয়ে যায়। তবে বিশেষ করে শাসকদলের স্বার্থ কখনো যদি সরকার ও রাষ্ট্রের স্বার্থকে অতিক্রম করে, তখন সে দেশকে টানাপড়েনের মধ্যে পড়তে হবেই। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় দেখা যায় সরকার নিজ দলের অনেক অনৈতিক অনাকাক্সিক্ষত ও আগ্রাসী ভূমিকার সাথে আপস করে ফেলে। তখন রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে উপরে রাখতে পারে না। কোনো সন্দেহ নেই, তখন গোটা রাষ্ট্রাচার নানামুখী সঙ্কট-দ্বন্দ্বের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি এখন সেই দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হচ্ছে কি না, ভেবে দেখা দরকার। তবে এমন জনশ্রুতি রয়েছে যে, আমাদের রাষ্ট্রের তিন শাখা- আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ স্বরূপে বিকশিত হতে পারছে না। তাই চতুর্দিকে নানা ব্যত্যয় লক্ষ করা যাচ্ছে। আর এটি অতি অবশ্যই এই রাষ্ট্রের অসুস্থ হয়ে পড়ার লক্ষণও।

বিচার বিভাগ নিয়ে কোনো কথা বলা খুব স্পর্শকাতর বিষয়। এ নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। তবে আমরা যতটুকু বুঝি ও অতীতে যা দেখেছি, বিচার বিভাগ সবসময় রাজনৈতিক বিষয় এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। অতি সম্প্রতি জাতীয় পার্টির একটি অভ্যন্তরীণ দ্বদ্বের ঘটনা আদালতের পবিত্র দোরগোড়ায় পৌঁছে ছিল। সেখান থেকে প্রথমে যে সিদ্ধান্ত এসেছিল; তাতে শাসকদল হয়তো পুলকিত-উৎফুল্ল হয়। পরে আবার ভিন্ন সিদ্ধান্ত আসায় তারা নিরাশ হতে পারে। পক্ষান্তরে জাতীয় পার্টির একাংশ প্রথমে হতাশ হয় এবং পরে আশাবাদী হয়েছে মনে করা যেতে পারে। কিন্তু শাসকদল তো নাছোড়বান্দা। এ লেখা যখন তৈরি হচ্ছে তখন পর্যন্ত নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তবে শাসকদলের এমন পুলকিত ও নিরাশ হওয়াকে কেউ স্বাভাবিক বলে মনে করেন না। এর অবশ্যই কিন্তু আছে।
এ দিকে অনেক কথাই এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে চাউর রয়েছে যে, শাসন বিভাগ অনেক স্থানেই তাদের সীমানা অতিক্রম করে এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য শাখায় অনাবশ্যক নাক গলায়। এটিকে অনেকেই কর্তৃত্বপরায়ণতা বলে বিবেচনা করছেন। তাদের নিজস্ব বলয়, সেখানে তাদের যোগ্যতা সক্ষমতা নিয়ে অনবরত নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়ে আছে। বিশেষ করে দেশের অর্থনীতি এখন যে শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটি একান্তই সরকারের ভুল পদক্ষেপের জের বলেই খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদদের সুচিন্তিত অভিমত। সে কারণে এখন রাষ্ট্রকে দ্বারে দ্বারে সাহায্যের জন্য ঘুরতে হচ্ছে। কিন্তু সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর সেটিকে তিল থেকে তাল করে দেখিয়ে বাহবা নেয়ার এক অদ্ভুত প্রয়াস চালানো হচ্ছে। এ কথাও বলা হচ্ছে যে, অমুক দেশ চেষ্টা করেও সাহায্য পায়নি, আমরা পেয়েছি। কিন্তু ঋণ করে ঘি খাওয়ার মধ্যে কি কোনো গৌরব আছে! চিন্তার বিষয়, তেমন বোধ বিবেচনা কি হারিয়ে ফেলা হয়েছে। আরো দুর্ভাগ্যের কথা হলো, দেশের নিরন্ন মানুষের ঘাড়েই এই ঋণ পরিশোধের বোঝা চাপানো হলো, সেটিই মোদ্দাকথা। যেকোনো সরকার আজ আছে কাল নেই। কিন্তু সেই সব সাধারণ মানুষ যাদের এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। তারও তো থেকেই যাবে। ধরে নিই আজকের সংসদের সবাই জনগণের সত্যিকার প্রতিনিধি। তাই সেখানে কথা বলেই তো এই সিদ্ধান্ত নেয়া যেত। কিন্তু তা তো হয়নি, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সবাইকে অন্ধকারে রেখে এমন সিদ্ধান্তই হলো। প্রশ্ন হচ্ছে, কার তেলে কে কই ভাজে। দারিদ্র্য থেকে উত্তরণ অবশ্যই গৌরবের ও সাফল্যের কথা, কিন্তু দারিদ্র্য নিয়ে বড়াই করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব বা সম্মান নেই। এ দিকে মানুষকে দারিদ্র্য জয়ের বহু কল্পকাহিনী শোনানো হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সব লবডঙ্কা। স্মরণ করা যেতে পারে অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণকে বিশেষ সহায়তা দিতে সরকার এগিয়ে আসে। কিন্তু গত ১৫ বছরে আমাদের দেশে এমন সহায়তার কথা একবারও শোনা যায়নি। পক্ষান্তরে সম্প্রতি কয়েক দফা গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মানুষকে বারবার অর্থনৈতিক চাপে ফেলতে কুণ্ঠাবোধ করেনি প্রশাসন। কেউ হয়তো বলতে পারেন ওএমএস কর্মসূচির মাধ্যমে কিছু সাশ্রয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। এখানে আমাদের বিনীত আরজ, রাজধানীর বাইরে ওএমএস নিয়ে কী হচ্ছে আমরা জানি না। আর ঢাকাতেও আমরা পুরো শহর চষেও বেড়াইনি। সে জন্য এ ক্ষেত্রে আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। তবে সংবাদপত্রসেবী হিসেবে পত্রিকার পাতায় চোখ রাখা আমাদের নিত্যদিনের নিয়মিত অভ্যাস। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ওএমএস নিয়ে যত খবর এ পর্যন্ত পড়েছি, তাতে কখনো এমন কিছু পড়ার সৌভাগ্য হয়নি, যাকে খুব ইতিবাচক বলা চলে। যেমন অতি প্রত্যুষ থেকে হাজারো মানুষ ওএমএস থেকে মাত্র কিছু নির্ধারিত পণ্য কেনার জন্য দীর্ঘ সারিতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। কখন যে ওএমএসের ট্রাক আসবে সেই অপেক্ষায়। কখনো কখনো বহু অপেক্ষার পর সূর্য মধ্যগগন স্পর্শ করলে ট্রাক আসে। কিন্তু সবার ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত পণ্য কেনা সম্ভব হয় না। লাইনের অর্ধেক মানুষই পণ্য কিনতে পারে না। কারণটা হচ্ছে, পণ্য ফুরিয়ে যাওয়া। তাই বহু মানুষ দিনমান দাঁড়িয়ে থেকে খালি হাতে ঘরে ফেরেন। কোনো দিন ওএমএসের ট্রাকও আসে না মানুষকে অযথা অপেক্ষা করে চলে যেতে হয়। তা ছাড়া এত বড় ঢাকা শহর যেখানে প্রায় দুই কোটির মতো মানুষের বাস। সেখানে কয়টি ট্রাক আর ওএমএসের পণ্য বিক্রির জন্য আসে। আমরা এখন একবারে হালের প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের খবর থেকে ওএমএস-বিষয়ক একটি প্রতিবেদনের কিছু কথা তুলে ধরতে চাই। সেই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘ভোরে ওএমএস যুদ্ধ’। সেখানেও খবরের কিছু মূল পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিল। সেখানে যেমন তুলে ধরা হয়, ‘লাইনে দাঁড়াতে কেউ টুল, কেউ পাতেন ইট।’ ‘ট্রাক আসতেই শুরু ঠেলাঠেলি (জনাধিক্যের কারণে)’, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ছাত্রও সারিতে’ (এর ব্যাখ্যা হলো- এই যুবক অবশ্যই নিম্নবিত্তের যুবক নয়, এখন মধ্যবিত্তের ঘরের চরম অভাব) ‘খালিহাতে ফিরে যান অনেকে’। এসবের বিস্তারিত বর্ণনা ছিল খবরে। কিন্তু এই নিবন্ধের জন্য পত্রিকায় যতটুকু স্পেস বরাদ্দ তাতে পুরো বা আংশিকভাবেও সেই প্রতিবেদন ধরানোর সুযোগ নেই। তাই সংক্ষেপে কিছু মোদ্দাকথা বলেই শেষ করব। এটি আসলে এখন জীবনের বাস্তবতা, তাকে কেউ গ্লানি ও আশাভঙ্গের বিষয় বলতে পারেন। আরো বলতে পারেন প্রশাসনের দেয়া প্রতিশ্রæতি ও প্রাপ্তির কী আকাশ-পাতাল ব্যবধান।

এ দিকে শিল্পাঞ্চল থেকে করুণ আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। জ্বালানির এমন মূল্যস্ফীতির কারণে আজ আর কোনোভাবেই দেশের শিল্প বাঁচানো যাবে না। শিল্প যদি ধ্বংস হয়ে যায় দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদও ধসে পড়বে। লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে পথে দাঁড়াতে বাধ্য হবে। আর অন্য দিকে আমদানি-বাণিজ্যের পরিসর বৃদ্ধির জন্য প্রশাসনের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি হবে। এখন কোনো জরুরি পণ্য আমদানির জন্যও বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু দেশের শিল্প ধ্বংস হলে আমদানি-বাণিজ্যের ওপরও আরো চাপ পড়বে। কেননা জরুরি পণ্যের উৎপাদন হ্রাস পেলে তার চাহিদা পূরণের জন্য আমদানির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখন অতি জরুরি পণ্যও আমদানি করতে বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া যাচ্ছে না। এখন পণ্যের সঙ্কটজনিত কারণে সেইসব পণ্যের মূল্য স্বাভাবিকভাবেই ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। সে ক্ষেত্রে ভোগান্তিটা বাড়বে এককভাবে সাধারণ মানুষের।

এখন তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ঋণদানের পূর্ব শর্ত হিসাবে সব কিছুর ওপর ভর্তুকি তুলে নিতে হবে। তার জন্য এখন দাম বাড়ানো অপরিহার্য ছিল। এটা হতেই পারে, কিন্তু বাড়তি মূল্য দেয়ার জন্য সাধারণ মানুষের আর্থিক সঙ্গতি বৃদ্ধির কোনো প্রচেষ্টাই করা যায়নি। যাই হোক, অর্থলগ্নিকারী সেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অনেক আগেই কিন্তু পরামর্শ দেয়া হয়েছিল নানা ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের জন্য কিন্তু প্রশাসন তাতে তেমন গা করেনি। সেই সময় থেকে সংস্কারের কথা ভাবা এবং জনগণের সঙ্গতি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা সমান্তরালভাবে চলত। তাহলে আজ মানুষকে এমন বিপদে পড়তে হতো না। এসব আসলে প্রশাসনের অদূরদর্শিতারই অভাবই তুলে ধরছে। তা ছাড়া জ্বালানি খাতেও যে অব্যাহত অপচয় সে ব্যাপারে প্রশাসন একেবারে নির্জীব। অথচ এখানে দক্ষতা বৃদ্ধি করে অপচয় কমিয়ে মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় করা যেতে পারত। অপচয়ের একটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হচ্ছে, যা প্রশাসনের অদক্ষতাকে আরো প্রকটভাবে চিত্রিত করছে।

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম হচ্ছে, ওবায়দুল কাদের বলেন, সড়কের অবস্থা ছেঁড়া কাঁথার মতো। সেই খবরের অংশবিশেষ উদ্ধৃতি করা হলে মানুষ বুঝতে পারবে কোথায় কোন কারণে সেতুমন্ত্রী এ কথা বলেছেন। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই সড়কগুলোর বেহাল অবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘নবীনগর-চন্দ্রা চার লেনের সড়ক এক বছর না যেতেই ছেঁড়া কাঁথার মতো জোড়াতালির অবস্থা। এই ফোর লেন দিয়ে কী হবে। এত টাকার অপচয়।’ কাল শেষে এ কথা বলে এখন আর কী লাভ। যখন তদারকির দরকার ছিল, তখন কে কোথায় ছিলেন? এ তো মাত্র একটি উদাহরণ, এমন অপচয়ের হাজারও উদাহরণ সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। এখন বিষাদের সুরে কথা বলে বা অনুতাপ করে কী লাভ। এসব অপচয় রোধ করতে না পারা কি অদক্ষতার প্রমাণ নয়!

ndigantababar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল