অজ্ঞাতনামা আসামি
- ড. মাহবুব হাসান
- ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২০:৪২
গত ১২ ফেব্রুয়ারি শনিবার ছিল বিএনপির তৃণমূলের অর্থাৎ ইউনিয়ন স্তরে পদযাত্রার কর্মসূচি। ওই কর্মসূচিতে বিএনপির কর্মীরা যেমন অংশ নিয়েছে তেমনি সাধারণ মানুষও তাদের সাথে পদযাত্রায় শামিল হয়েছিল। কেন্দ্রীয় নেতারা এই পদযাত্রা থেকে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি ও তৃণমূলে তাদের কর্মী-সমর্থক কেমন আছে তা পরখ করে দেখছেন বা দেখলেন। পুলিশি বাধা, আওয়ামী নেতাকর্মীদের হামলা, বিএনপির মঞ্চ দখল করে নিয়ে সেখানে তাদের রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও শান্তি সমাবেশ করা এবং দেশব্যাপী নেতাকর্মীরা মাঠে থাকবে বলে আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ঘোষণা ইত্যাদির পর এই সত্যই বেরিয়ে আসছে যে, সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক হামলার মৌসুম ঘনিয়ে আসছে। রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি ধীরে ধীরে অন্ধকার কানাগলিতে ঢুকে পড়ছে, সেই আলামতই দেখতে পাচ্ছি আমরা।
বিএনপি নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা করবে এবং করছে- তাদের সেই পদযাত্রার মিছিল সহিংস হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আওয়ামী নেতারা বলছেন, তারা সারা বছরের কর্মসূচি ঘোষণা করে বসে আছেন। সেই কর্মসূচিগুলোর অংশই হলো বিএনপি যেদিন যে এলাকায় পদযাত্রা করবে, তারাও সেই এলাকায় শান্তি মিছিল করবেন। ফলে রাজনৈতিক বিষয়টি হয়েছে ক্ষমতাসীনদের দাপট ও শক্তি প্রদর্শনের কর্মসূচি। আমরা বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ পায়ে পাড়া দিয়ে বিএনপির সাথে সংঘর্ষে নামার কর্মসূচি নেয়নি, কিন্তু তাদের কর্মীদের অসহ্য ও আগ্রাসী চেতনাই বলে দিচ্ছে তারা বিএনপির পদযাত্রা ভেঙে ফেলতে চাইছে। সে কারণেই অনেক জেলায় বিএনপির পদযাত্রায় হামলা করেছে আওয়ামী কর্মীরা। আর যথারীতি বিএনপির কর্মীরা বিশ্ঙ্খৃলা করেছে সেই পুরোনো অভিযোগ করে আওয়ামী লীগের নেতা বা কর্মী এবং পুলিশ মামলা করেছে। সে সব মামলায় নাম ধরে ধরে যেমন আসামি করা হয়েছে, তেমনি অনামি বা বেনামি বা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদেরও আসামি করা হয়েছে।
গত শনিবার ইউনিয়ন পর্যায়ে বিএনপি পদযাত্রা ও আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ করে। এই কর্মসূচি ঘিরে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও গুলির ঘটনা ঘটে। এসব সঙ্ঘাতের জন্য দুই দলই পরস্পরকে দায়ী করছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় মনে করছে, শনিবার সারা দেশে বিএনপির পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তি সমাবেশ করে দলের নেতাকর্মীদের দারুণভাবে উজ্জীবিত করা গেছে। নেতাকর্মীরা আগের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত দলের তৃণমূলে এ ঐক্য ধরে রাখতে পারলে নির্বাচনেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। (কালের কণ্ঠ/১১/০২/২৩) আর বিএনপির নেতারা মনে করছেন, ‘বাধা সত্ত্বেও মাঠে থাকাই সফলতা। জেলা-উপজেলা পর্যায়েও পদযাত্রা করবে বিএনপি। হামলা, ভাঙচুর ও বাধার পরও নেতাকর্মীরা মাঠ ছেড়ে যাননি। এ-কথা বিএনপি নেতা আলালের। ‘তৃণমূলে বিএনপির নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা রোধ করা গেছে, তেমনি নির্বাচনী প্রচারও শুরু করা গেছে’-আওয়মী নেতা বাহাউদ্দিন নাছিম।
দুই পক্ষের এই রাজনৈতিক বিতর্কের ভেতরে রয়ে গেছে মনোলগ-এর কাহিনী। সরকারি দলের মূল উদ্দেশ্য যে বিএনপির পদযাত্রা প্রতিহত ও প্রতিরোধ করা এটা পুরোপুরিই বোঝা গেছে। সরকারি দলের দাবি হচ্ছে বিএনপি বিশ্ঙ্খৃলা করতে যাচ্ছিল, শান্তি মিছিল করে তা রোধ করা গেছে। এটা যে কত বড় রাজনৈতিক মিথ্যাচার তা যদি তারা উপলব্ধি করতে পারত-কথাগুলো উভয়পক্ষের নেতাদের উদ্দেশেই বলা হলো, তাহলে আমাদের রাজনৈতিক ধর্ম এতটা অন্তঃসারশূন্য হতো না।
প্রথমত বিএনপি তৃণমূলে পদযাত্রা করবে, সেই কর্মসূচি আগেই ঘোষিত হয়েছে। সেই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ তাদের কর্মসূচি রচনা করেছে। ফলে দুই পক্ষ মুখোমুখি হয়েছে। সাধারণ্যে একটি কথা চালু আছে ঢিলটি মারলে/ফিরে আসে পাটকেল হয়ে। না, বিএনপি পাটকেল মারেনি বটে, তবে হামলা চালাতে এলে তাদের প্রতিরোধ কি খালি হাতে করা সম্ভব? লাঠির বদলে লাঠি, ইটের বদলে ইট-এটাই তো সব দেশের সর্বকালের স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি। তবে, এটা মানতেই হবে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতটা নারকীয় হয়ে ওঠেনি এখনো। কোনো মানুষ মারা যায়নি। তবে আহত তো হয়েছেই। সরকারি পক্ষের কেউ আহত না হলেও তারা মামলা করেছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। বিএনপি কোনো মামলা করেছে বলে রিপোর্ট করেনি পত্রিকাগুলো। সরকারি দলের মামলায় শত শত মানুষ আসামি হয়েছে। কয়েকজনকে পুলিশ আটক করেছে। বাকিদের ধরার চেষ্টা করছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতা মির্জা আব্বাস বলেছেন, আপনারা ঢাকার কর্মসূচি ঘোষণা করেন, আমরা সেই দিনগুলো বাদ দিয়ে পদযাত্রা করব। তার এই প্রস্তাব থেকেই বোঝা যায়, বিএনপি কোনো রকম সঙ্ঘাতে যেতে চায় না। আমরা জানি, আওয়ামী নেতারা বলবেন, বিএনপির রাজনৈতিক শক্তি নিঃশেষ। তাই এই রকম প্রস্তাব দিয়েছে। আসলে বিএনপি যে তার রাজনৈতিক স্ট্যাটেজি চেঞ্জ করছে, তাদের প্রকাশিত রাষ্ট্রসংস্কার রূপরেখায় তার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা আছে। তারা যে একটি গণমনস্ক ও গণসাংস্কৃতিক রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি করতে চায় ইতিবাচক একটি রাজনীতির সূচনা করতে, যুক্তিহীন বিরোধিতা নয়, গলাবাজি নয়, সেটা জনগণ উপলব্ধি করলেও শাসক দল আওয়ামী লীগ তা করে না বা করতে রাজি নয় বা তাদের রাজনৈতিক চেতনাই বিলুপ্ত হয়েছে। না হলে, ঘোষিত শান্তিপূর্ণ পদযাত্রাকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টার অপবাদ দিয়ে শাসক দল যে নারকীয় পন্থা নিয়েছে, তা বর্বরতার শামিল। বিএনপির পদযাত্রাকে সহজেই পথ করে দিতে পারত শাসক দল। তা না দিয়ে পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাধানোর অতি ক্লিশে একটি ধারণা বহন করছে তারা। এই যে পদযাত্রার মিছিলে হামলা করে নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা প্রমাণ করল আওয়ামী লীগ এবং এর ফলে বিএনপির জনপ্রিয়তায়ও একটি পালক যুক্ত করে দিল সেটা হিসেবে করে না। করলে এই রকম মাস্তানি কর্মসূচি নিয়ে নিজেদের মাসল প্রদর্শনের এমন ব্যর্থ প্রয়াস নিত না।
এটা আমাদের হিসাব। কিন্তু আওয়ামী চৈতন্যে আছে, মাঠ দখলে রেখে, প্রতিপক্ষকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করাই তাদের রাজনৈতিক বীরত্ব। এই বীরত্ব যে রংহেডেড সিদ্ধান্তের ফল তা বোঝার মতো রাজনৈতিক বুদ্ধি তাদের মাথায় নেই। এ-কারণেই লীগের সাধারণ সম্পাদক হুংকার ছাড়েন খেলা হবে!
এখনো সময় আছে, লীগকে ফিরে আসতে হবে রাজনৈতিক ইতিবাচকতায়, যেখানে কেবল মেধা ও প্রজ্ঞার সাথে যুক্তিই হবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অস্ত্র। লাঠিসোটা, পিস্তল বন্দুক দিয়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের দিন শেষ।
২.
‘অনামি আসামি’ মামলা করার সময় এই টার্মটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার উপাদান হিসেবে রাখা হয়, যাতে কোনো কেন্দ্রীয় নেতাকেও আসামি করা যায় এবং তাদেরকে জেলে পোরা যায়; কথিত ময়লার গাড়িতে হামলা চালানোর অজুহাতে যেমন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জেলে পোরা হয়েছিল।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, এবারের কর্মসূচিতে প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের হামলা, বাধা, পুলিশের গুলি- সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল। এরপরও নেতাকর্মীরা মাঠে ছিলেন। পুলিশি বাধা অতিক্রম করার চেষ্টা করেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে মাঠে লড়াই করেছেন। এই সব কিছু দলের এই কর্মসূচির অর্জন।
সংঘর্ষের ঘটনায় জামালপুর, খুলনা, নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, ধামরাই, ভালুকাসহ বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি নেতাকর্মীদের আসামি করে মামলা করা হয়েছে। গাজীপুরের শ্রীপুরে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি থেকে অস্ত্র উঁচিয়ে স্লোগান দেয়া জাহিদ হোসেনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বিএনপি গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছে, ৪৩ জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের কর্মসূচিতে হামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় দুই শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার এবং পাঁচ শতাধিক আহত হয়েছেন। বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মীর বাড়িঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, আজ সোমবার রাতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মসূচি নিয়ে পর্যালোচনা এবং পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা হবে।
দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কর্মসূচি পালনে নেতাকর্মীদের দৃঢ়তায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, হাট, বাজার ও গ্রামে গ্রামে বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে সাধারণ জনগণও কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। মানুষ তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে মাঠে নেমেছে। এতে প্রমাণ হয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারবিরোধী জনমত গড়ে উঠেছে।
আমাদের পাঠক-অভিজ্ঞা বলছে ওই সব মামলায় অবশ্যই লেজুড় হিসেবে অজ্ঞাত আসামির টার্ম থাকবে। সরকারি দল ও পুলিশকে এই অন্ধ টানেল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ ওই টানেলটি একটি ঔপনিবেশিক ধারণাজাত। আজকে যারা সরকারের বিরোধিতা করছে তারা কোনো দেশের উপনিবেশের মানুষ নয়। তারা কেবল রাজনৈতিক সরকারের ঔপনিবেশিক চেতনার ধারায় বন্দী। এই বন্দিত্ব ঘুচাতে না পারলে দেশের প্রকৃত গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা কায়েম করা যাবে না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা