২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ওয়াশিংটন আরভিং ও পশ্চিমা ইসলামবিচারে নয়া মাত্রা

ওয়াশিংটন আরভিং ও পশ্চিমা ইসলামবিচারে নয়া মাত্রা। - ছবি : সংগৃহীত

ইরভিংটন একটি সম্প্রদায়, যার নামকরণ করা হয়েছে আমেরিকান গল্পকার ওয়াশিংটন আরভিং (১৭৭৩-১৮৫৯) এর নামে। আরভিংয়ের ‘দ্য লেজেন্ড অব স্লিপি’ হলো (১৮২০) গল্পে প্রতিফলিত শহর ও জীবনচিত্রের ভিত্তিতে ইরভিংটন সম্প্রদায়ের নির্মাতারা একটি জনগোষ্ঠীর কল্পনা করেন। এ সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রধানত বসবাস করেন ইন্ডিয়ানাপলিসে আরভিংয়ের নামে নামকরণ করা জনপদে। আরভিংয়ের প্রতি সম্মান জানাতে নিউ ইয়র্কের dearman এলাকা ১৮৫৪ সালে ইরভিংটন নাম ধারণ করে। টেক্সাসের নিকারবোকার শহরটিও ওয়াশিংটন আরভিংয়ের সম্মানে নিজের নাম বদলায়। হয়ে ওঠে ইরভিং। নিউজার্সির ক্লিনটন টাউনশিপের যে এলাকাটি ইরভিংটন হয়ে ওঠে, সান ফ্রান্সিসকোতে যে ইরভিং স্ট্রিট গড়ে ওঠে, কিংবা শিকাগোর গোটা এক মহকুমা নিজেকে যে ইরভিংটন বানিয়ে ফেলে, সবই ওয়াশিংটন আরভিংয়ের সম্মানে, ভালোবাসায়।

আমেরিকায় বহু এলাকা, পার্ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ওয়াশিংটন আরভিংয়ের নাম ধারণ করছে। কিন্তু এটাই আরভিংয়ের প্রভাব পুরোপুরি ব্যক্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ আমেরিকার সমাজ-সংস্কৃতি, সাহিত্য, আর্ট তো বটেই, এমনকি ধর্মীয় উদযাপনে ওয়াশিংটন আরভিংয়ের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। তার রিপ ভ্যান উইঙ্কল (১৮১৯) জাদুকরি সেই চরিত্র, যার সদাহাস্যময় অলস চরিত্রটির মায়ায় আটকা পড়েছে আমেরিকান মন, বহু শতক ধরে। জেফ্রি ক্রেয়নসহ বিভিন্ন ছদ্মনাম ছিল তার। ১৮০৯ সালে ওলন্দাজ ইতিহাসবেত্তা ডিয়েড্রিখ নিকারবোকার নামে তিনি প্রকাশ করেন তার রচিত গ্রন্থ আ হিস্টরি অব নিউ ইয়র্ক। তিনি তখন লেখক হিসেবে বিখ্যাত নন। নিকারবোকার ছিলেন বিখ্যাত ও জনপ্রিয়। তার নামে বইটি প্রকাশিত হলে খুব চলবে। অরভিং তাই একটি চালাকি করলেন। বইটি প্রকাশের আগে নিউ ইয়র্কের সংবাদপত্রে ছাপালেন এক হারানো সংবাদ। ডিয়েড্রিখ নিকারবোকার নামক ওলন্দাজ ইতিহাসবেত্তা নিউ ইয়র্ক সিটির এক হোটেল থেকে হারিয়ে গেছেন। হোটেল মালিকের সাথে বুদ্ধি করে প্রচার করলেন এক ঘোষণা : যদি তিনি ফিরে এসে হোটেলের বিল পরিশোধ না করেন, তাহলে তার ফেলে যাওয়া এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করা হবে! লোকেরা গল্পটা বিশ্বাস করল এবং অনতিবিলম্বে নিকারবোকারের নামে প্রকাশিত হলো অরভিংয়ের বইটি। অরভিং ছিলেন কৌতুকময় ও বিদ্রূপাত্মক। তার রচনার মতো তার ব্যক্তিত্বেও ছিল সূক্ষ্ম তার সমাহার!
১৭৮৩ সালের ৩ এপ্রিল নিউ ইয়র্কে যখন তিনি জন্মগ্রহণ করেন, তখন শহরটি ছিল মাত্র ২৩ হাজার অধিবাসীর ক্ষুদ্র এক জনপদ। আমেরিকা সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে ব্রিটেনের অধীনতা থেকে। তার পিতা উইলিয়াম ছিলেন একজন বণিক, মা সারাহ ছিলেন ইংরেজ চার্চম্যানের কন্যা। মা-বাবার ১১তম সন্তান ছিলেন তিনি। জর্জ ওয়াশিংটনের নামানুসারে তার নামকরণ করা হয়। কৈশোরে রবিনসন ত্রুসো ও সিন্দাবাদ দ্য সেইলর ছিল তার প্রিয় পাঠ্য। পরবর্তী জীবনে তিনি হন নানা ক্ষেত্রে সফল। কিন্তু স্থির ছিলেন না কোনো এক জায়গায়। অভিযাত্রা তাকে এক দেশ থেকে নিয়ে গেছে অন্য দেশে। ১৮৫৯ সালের ২৮ নভেম্বর নিউ ইয়র্কের ট্যারিটাউনে আরভিংয়ের মৃত্যুর আগেই তিনি হয়ে ওঠেন নিউইয়র্কের মনে ও চরিত্রে আন্তর্জাতিকতার নেশা ধরানোর প্রথম দিকের মহান কারিগর।
নিউ ইয়র্ক ক্রনিকলে তার লেখনি বিদ্রূপ, রস, মেধা ও উজ্জ্বল দৃষ্টিকোণের বিভা দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। নিউইয়র্কের শহরের ডাকনাম গোথাম (ছাগলের শহর) এর প্রবর্তন, ডলারকে সর্বশক্তিমান বলে আখ্যাদান, আমেরিকায় ক্রিসমাস উদযাপনের উপায় প্রবর্তন ওয়াশিংটন আরভিংয়ের প্রভাবের কিছু দিক উপস্থাপন করে। বস্তুত একজন ক‚টনীতিক, প্রাবন্ধিক, ঐতিহাসিক, সাংবাদিক, ভ্রামণিক জীবনীকার ও কথাশিল্পী হলেও ওয়াশিংটন আরভিং ছিলেন নিজেই এক পদ্ধতি, দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবসম্পন্ন এক জীবনবোধ! লর্ড বায়রন (১৭৮৮-১৮২৪), টমাস ক্যাম্পবেল (১৭৭৭-১৮৪৪), চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০), ফ্রান্সিস জেফ্রি (১৭৭৩-১৮৫০), ওয়াল্টার স্কটসহ (১৭৭১-১৮৩২) সমকালীন ইংরেজি ও স্পেনিশ ভাষার প্রধান বহু সাহিত্যিক তাঁর প্রশংসায় থেকেছেন সোচ্চার।

ওয়াশিংটন আরভিং প্রথম বিশ্ববিখ্যাত আমেরিকান লেখক, যিনি উন্নত সাহিত্যশৈলী অবলম্বন করে ইসলাম প্রসঙ্গে সঞ্চারি আলোকপাত করেন আমেরিকায়। তার বিখ্যাত The Life of Mahomet গ্রন্থটি প্রকাশিত ১৮৫০ সালে। আমেরিকায় মহানবীর সা: প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন কাজের পথিকৃত হচ্ছে এ বই। ইসলামী সংস্কৃতির নানা নিদর্শন হরণ করেছিল আরভিংয়ের মন। মুসলিম স্পেনের মহিমা ও অনুপমার তিনি ছিলেন প্রেমিক। ক্রিস্টোফার কলম্বাস ১৪৯২ সালে স্পেন থেকে মুসলিম বিজ্ঞানের সমুদ্র অধ্যয়নের নীতি ও ফসলকে অবলম্বন করে পাড়ি দিয়েছিলেন আমেরিকায়। এর সাড়ে তিন শত বছর পরে ওয়াশিংটন আরভিং স্পেনিশ উপদ্বীপে প্রবেশ করে মুসলিমদের গৌরবময় সংস্কৃতিকে পুনরায় খুঁজে বের করে পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে তুলে ধরলেন।

১৮২৫ সালে তিনি মাদ্রিদে আমেরিকান লিগেশনের একটি চাকরি পান। চাকরির পাশাপাশি কলম্বাসের জীবন নিয়ে চলে তার অনুসন্ধান। এর ফলাফল প্রকাশিত হয় ১৮২৮ সালে লাইফ অব কলম্বাস নামক গ্রন্থে।

১৮২৯ সালের মে মাসে তিনি প্রবেশ করেন রোমান্টিক শহর গ্রানাডায়। বসন্তে তখন গ্রানাডা সেজেছে আপন খেয়ালে। সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার মাথায় প্রখর রোদে জ্বলজ্বল করছে তুষারের শিহরিত চূড়া। আকর্ষণীয় সব দুর্গবেষ্টিত প্রাসাদ, পানীয় জল সরবরাহের প্রাচীন নালা, বিশালাকার সৌধ এবং আন্দালুসীয় রূপকথা ও স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষের বিচূর্ণ মুখ! এখানে সঙ্গীতের সংস্কৃতির ওপর দিয়ে যেন বয়ে যাচ্ছে ম্যুরিস আবহাওয়া, যেমনটি বয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী জীবনযাপনের ওপর দিয়ে। আরভিং সেখানে থাকেন গভর্নরের আতিথ্যে, আল হামরা প্রাসাদে বসবাস করতে দেয়া হয় তাকে। বিশ্বের মুকুট ছিল গ্রানাডা, আর মুকুটের মুক্তো ছিল আল হামরা!

৮৮৯ সালে আওয়ার ইবনে হামদুন নামের আন্দালুসীয় এক গোত্রপতি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এসে আশ্রয় নেন ধ্বংসপ্রাপ্ত এক অখ্যাত দুর্গে। নিজের থাকার প্রয়োজনে মেরামত করে দুর্গটি ব্যবহার করতে থাকেন। একে ঘিরে এক সময় জনপদের আকার বাড়তে থাকে, গোড়াপত্তন হয় ছোট শহর গ্রানাডার। ইবনে হামদুনের হাতে আল হামরা নির্মিত হলেও এর বিকাশ ঘটে ১২৩৮ সালে গ্রানাডায় বিজয়ী হিসেবে প্রবেশকারী মুর সুলতান মোহাম্মদ ইবনে নাসর এর হাত দিয়ে। গ্রানাডা তার আমলে বিশ্বসেরা নগরী হয়ে ওঠে। গ্রানাডার পশ্চিমে সাবিক পাহাড়। তার মাথার সবুজের বিচিত্র অনুপমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্থাপত্যের বিস্ময় আল হামরা। প্রাসাদের বাঁ দিক দিয়ে বয়ে গেছে দারো নদী। পরিকল্পিত নির্মাণ, জটিল ও কারুকার্যময় সাজসজ্জার লুপ্তপ্রায় চিহ্নগুলো বিলাপ করছে। আল হামরার আসল সুন্দরতা কয়েক শতাব্দীর নিষ্ঠুরতায় কবরস্থ হয়েছে। তার মনোমুগ্ধকর সব কারুকাজ, ঝর্ণা, প্রবাহিত পানি ও স্বচ্ছ পুকুরগুলো ধ্বংস হয়েছে এবং হারিয়ে গেছে নান্দনিক সজ্জার জটিল স্থাপত্যশৈলী, অসংখ্য তোরণ, বিচিত্র সিলিংয়ের সাজ, দেয়ালের নানারকম জটিল জ্যামিতিক কারুকাজ এবং অ্যারাবেস্ক; ছন্দময় রৈখিক প্যাটার্নে আপতিত সরল রেখা, পরস্পর জড়াজড়ি করে থাকা ফুলপাতার নকশা, আলকাটাডো টাইলসের বিন্যাস, গাণিতিক নকশা, ল্যাসেরিয়ার কাজ, স্টাকো এবং ফোলিয়েট অর্নামেন্টসের কাজ। সুন্দর লাল ইটগুলোও তখন খসে খসে পড়ছে!

১৪৯২ সালে স্পেনে মুসলিমদের পতনের পরে শতবর্ষের অবহেলা, বিদ্বেষ ও ঘৃণার কারণে আল হামরা তখন ধ্বংসের অবশেষ। প্রাসাদটি হয়ে উঠেছে পূর্বের জাঁকজমক ও সৌন্দর্যের কঙ্কাল। জিপসি, কৃষক আর বন্য ও গৃহপালিত প্রাণীদের দ্বারা সে নোংরা হচ্ছিল যুগ যুগ ধরে। নেপোলিয়নের সৈন্যরা ধ্বংস করে দিয়েছিল তার একটি টাওয়ার। আরো আগে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম চার্লস ভেঙে দিয়েছিলেন এর নানা অংশ। তারপরও মহান স্মৃতির সেই ভগ্নস্তূপে যে সময়টা কাটালেন আরভিং, সেটা ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম চিত্তপ্রসাদ! তিনি বলেন, আমার জীবনে এর চেয়ে সুখকর বাসস্থান কখনো পাইনি, এর চেয়ে সুস্বাদু বাসভবন আশাও করা যায় না। সেই সুখকর সময়টা এমন ছিল যে, তখন অন্যের সাথে দেখা করার কথাও ভাবা যাচ্ছিল না!

অবহেলিত সৌন্দর্যের প্রতি আরভিংয়ের প্রতিক্রিয়া ছিল তার ‘টেলস অব আলহমরা’ গ্রন্থ। স্পেনে তখন মুসলিম আন্দালুসিয়ার প্রতি সীমাহীন উপেক্ষা, ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য। কেউই এর প্রতি আগ্রহী বা শ্রদ্ধাশীল নয়। এর সব নিদর্শন ধ্বংসের প্রতিযোগিতা শেষ প্রান্তে। এরই মধ্যে আরভিংয়ের এ গ্রন্থ থেকে বইতে থাকল পালাবদলের হাওয়া। বইটির প্রভাব ছিল প্রবল। পশ্চিমা বিশ্বের সহানুভূতি লাভ করল গ্রানাডা; আল হামরা। এমনকি মুসলিম স্পেন।
ইতঃপূর্বে পশ্চিমের বয়ানে ও চোখে মুসলিম স্পেন ছিল এক অবধারিত শত্রুতার অধ্যায়। তাদের সব কিছু ছিল নিকৃষ্টতায় আচ্ছন্ন। তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল নির্মম তাচ্ছিল্য। আরভিংয়ের আলহামরা টেলস এবং এর পরে প্রকাশিত ‘দ্য কনকোয়েস্ট অব গ্রানাডা’ ও ‘লিজেন্ডস অব দ্য কনকোয়েস্ট অব স্পেন’ পশ্চিমের এই অন্ধত্বকে কেবল তিরস্কার করল তা-ই নয়। বরং আন্দালুসিয়ার গৌরবকে জীবন্ত করল প্রাণ মাতানো চিত্রায়নে, গদ্যের লালিত্যে; স্মৃতির বিলাপ ও মৃত মহিমার প্রাণের প্রতিধ্বনির মধ্য দিয়ে। মুসলিম সভ্যতাকে দেখার প্রশ্নে সঠিকতার কাছাকাছি আসার চেষ্টা হিসেবে এগুলো ছিল প্রথম পশ্চিমা বই।

ইসলামের প্রতি আরভিংয়ের নিমজ্জন অচিরেই তাকে ইসলামের কেন্দ্রীয় ঠিকানার দিকে নিয়ে গেল। সেটা ছিল মহানবী সা:-এর জীবনী। যে জীবনীর নামে পশ্চিমে তখন কেবলই বৈরী চিত্রায়ন চলছিল। কেবলই দেখানো হচ্ছিল প্রতিকারহীন এক প্রতিপক্ষের মুখ, সেখানে পশ্চিমের আঁকা সেই মুখের ওপর থেকে অন্ধকার সরিয়ে নবীজীকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি হাতে নিলেন ওয়াশিংটন আরভিং। এর ফলাফল প্রকাশিত হয় ঐতিহাসিক এক পালাবদলের মধ্য দিয়ে।

ঞযব খরভব ড়ভ গধযড়সবঃ গ্রন্থে আরভিংয়ের শক্তিশালী কলম মহানবী সা:-এর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের একটি প্রাণবন্ত ও চমকপ্রদ ছবি এঁকেছে। তিনি মহানবীর সা: প্রশংসা করেছেন অকৃত্রিম সরলতার জন্য। প্রাণবন্ত সততার জন্য। তিনি কোনো স্বার্থপর উদ্দেশ্যে চালিত ছিলেন না এবং ক্ষমতা অর্জন করেও তিনি ছিলেন আল্লাহর সমীপে একান্ত বিনয়ী। চরম ব্যথিত মুহূর্তগুলোও তার সুদৃঢ় কিন্তু সংবেদনশীল স্থিরতাকে বিচলিত করতে পারেনি। সেটা হোক পুত্রকে দাফন করার মুহূর্তে কিংবা যুদ্ধের ময়দানে চরমভাবে আহত হওয়ার সময়ে। আবার যখন তার বিজয় সর্বোচ্চ মাত্রা স্পর্শ করেছে, তখনো তিনি খোদার সমীপে দাসত্ব নিয়ে হাজির, সব কৃতিত্ব নিবেদন করছেন তাঁরই সমীপে। শত্রুদের প্রতি প্রদর্শন করছেন পরম ক্ষমা।

তার পোশাক-আশাক, খাদ্য, চলাফেরা, জীবনযাপনের নানা মাত্রা একটি মহান পবিত্রতা উদযাপনের ইতিবৃত্ত হয়ে ওঠে। আরভিং সেটা দেখান। উচ্ছৃঙ্খল আরব জনগোষ্ঠী আত্মনাশা পরিণতির বদলে মহান এক উত্থানের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয় তার হাত ধরে। যার প্রভাব অচিরেই পৃথিবীকে অত্যন্ত গভীরভাবে বদলে দেয়। আরভিং অঙ্কন করেন হৃদয়গ্রাহী ধর্মনিষ্ঠার চিত্র, যেখানে পৃথিবীর সব ধনভাণ্ডারের চাবি মহানবীর হাতে দেয়া হলেও এর প্রতি ভ্রুক্ষেপ নেই তার। বরং যাকে তিনি পরম সত্য হিসেবে বিশ্বাস করেন, তাকে অবলম্বন করে দারিদ্র্য বরণকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন মহানবী। সর্বজনীন আধিপত্যের দিকে তার লক্ষ্য ছিল বটে, কিন্তু সেটা ছিল বিশ্বাসের আধিপত্য। নিজের পকেটে তিনি স্বর্গ ও নরক রেখে কথা বলতেন না। যেমনটি করেন মধ্যযুগের পাদ্রীরা। তিনি বরং নিজের পরকালীন সুখ লাভকে আল্লাহর দয়ার হাতে সমর্পণ করেন। আরভিং উল্লেখ করেন হজরত আয়শা রা: বর্ণিত সেই প্রসঙ্গ, যেখানে তিনি প্রিয় নবীকে সা: প্রশ্ন করলেন, ‘হে নবী, আল্লাহর রহমত ব্যতীত কেউ কি জান্নাতে প্রবেশ করবে না?’ তিনি আন্তরিক এবং জোরালো পুনরাবৃত্তির সাথে উত্তর দিলেন, কেউ না, কেউ না। আয়শা রা: জানতে চাইলেন, ‘কিন্তু হে নবী, আপনি কি তাঁর করুণা ছাড়া প্রবেশ করবেন না?’ মহান গাম্ভীর্যের সাথে, তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি জান্নাতে প্রবেশ করব না, যদি না আল্লাহ আমাকে তার করুণায় আবৃত করেন!’

আত্মার পরিশুদ্ধি, নিরন্তর অনুশীলন, আল্লাহর ওপর ভরসা, নিরঙ্কুশ খোদাভীতি, সৌহার্দ্যপূর্ণ নিয়মাবলি ইত্যাদির জন্য মহানবীর সা: প্রশংসা করেন ওয়াশিংটন। কিন্তু এসব প্রশংসার আশপাশেই থাকে নানা ভ্রান্তি। ইসলাম সম্পর্কে উপলব্ধির বিকার। যেমন তরবারি ইসলামের প্রতিষ্ঠার মুখ্য উপাদান, নানা কুসংস্কারকে জায়গা দিয়েছে ইসলাম, মহানবী সা:-এর ধর্মীয় উপদেষ্টা ছিলেন ওয়ারাকা ইবনে নৌফেল, তিনি তাঁর সাফল্যের পথ গড়ে দেন, নিজের কথাকে তিনি ঈশ্বরের কথা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার উত্তেজনার শিকার ছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো প্রতারণার আশ্রয় নেননি। যেমনটি প্রচার করত তখনকার পাদ্রীরা। তারা মহানবীর নবুয়তকে একটি প্রতারণা হিসেবে দাবি করত। আরভিং সেখানে হাজির করেন ভিন্ন এক তত্ত্ব। তার মতে, হজরত মুহাম্মদ সা: পরিকল্পিতভাবে নিজেকে নবী হিসেবে দাবি করেননি। বরং নিজের মধ্যে স্বর্গীয় প্রভাব মনে করেন, এমন এক মানসিক অসুখের শিকার ছিলেন তিনি। হ্যালুসিনেশনের দ্বারা কবলিত হয়েই তিনি নিজেকে নবী ও নিজের বাক্যকে ওহি দাবি করতেন। তার ছিল অজ্ঞান আবেগ দ্বারা পীড়িত হওয়ার নিয়তি। যার ওপর মৃত্যু হয় তাঁর। এ বক্তব্য দিয়ে উপসংহার টানেন আরভিং। মহানবীকে নবী হিসেবে বিশ্বাস না করার মূল অবস্থান থেকে সরেননি আরভিং। তার পরও তিনি পূর্ববর্তী পশ্চিমা লেখকদের বহু কুসংস্কারের শক্তিশালী প্রতিবাদ করেছেন।

তার কাজের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। পশ্চিমা প্রকাশকরা বইটি প্রকাশ করতে চাননি। আরভিং বহুমুখী শত্রæতার মুখোমুখি হয়েছেন। তাকে আক্রমণ করা হয়েছে নানা দিক থেকে। কারণ এতকাল ইসলাম সম্পর্কে যা প্রচার করা হয়েছিল, জনগণ যা জানত, তিনি হাজির করলেন আলাদা কিছু। পরবর্তী ইতিহাসে অবশ্য আরভিং কৃতজ্ঞতার সাথে বন্দিত হয়েছেন পশ্চিমা পণ্ডিতি পরিসরে। একজন লোকের একক প্রচেষ্টায় একটি ধর্ম ও সভ্যতার ওপর আরোপিত অভিযোগের গ্লানিকর ভার হালকা হয়েছে বলে!

আরভিংয়ের এই প্রয়াসের পরে অচিরেই মহানবীর সা: নামে পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা নতুন এক মাত্রা স্পর্শ করে। এই মাত্রা ছিল অস্বীকৃতি ও শ্রদ্ধার। নবী হিসেবে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন এবং মানুষ হিসেবে নানা ক্ষেত্রে সতর্ক শ্রদ্ধা প্রদর্শন। শ্রদ্ধার আগে বা পরে থাকবে কিছু সমালোচনাও। আরভিংয়ের গ্রন্থ প্রকাশের পরে অনতিবিলম্বে দার্শনিক Ralph waldo Emerson (1803-1882)-এর ১৮৪১ সালের এক বক্তৃতায় মহানবী সা: ও হজরত ওমরের বন্দনাগাথা শোনা যায়। যা গ্রন্থিত হয়ে প্রকাশিত হয় ১৮৪২ সালে; ম্যান দ্য রিফর্মার গ্রন্থে। একই সময়ে, ১৮৪০ সালে এডিনবার্গে টমাস কার্লাইলের বক্তৃতা শোনা যায়। যেখানে জোরালোভাবে পশ্চিমা প্রচারকদের এমন সব মিথ্যাচার খণ্ডন করা হচ্ছে, যা তারা মহানবীর সা: নামে রটনা করেছিল! পরে এই ধারা একতরফা নিন্দার বদলে পশ্চিমের ইসলাম বয়ানের প্রধান ধারায় পরিণত হয়।

লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement