ইউক্রেন আগ্রাসন ও জেনেভা কনভেনশন
- তৈমূর আলম খন্দকার
- ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২০:৩৩
যুদ্ধবিগ্রহ পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই হয়ে আসছে। পৃথিবীর জমিনে প্রথম অপরাধ হত্যা যা হজরত আদম ও হাওয়া (আ:) দ্বয়ের পুত্র হাবিল কাবিলের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এ অবস্থা পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ছিল, এখনো বিদ্যমান।
যুগে যুগে মহামানবদের চেষ্টার ফলে কোথাও কোথাও মানবাধিকার সমুন্নত হয়েছে, আবার কোথাও কোথাও অর্থাৎ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ‘মানবাধিকার’ বিষয়টির কোনো প্রকার মূল্যায়ন তো হয়নি, বরং কিছু লোকের জগৎবিখ্যাত হিরো সাজার জন্য হত্যাযজ্ঞের প্রতিযোগিতা হয়েছে। প্রবাদ রয়েছে যে, একজনকে হত্যা করলে হয় ‘খুনি’, হাজারজন হত্যা করলে হয় ‘বীর’।
আল্লাহর আদেশে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর কঠোর নির্দেশাবলীর কারণে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় হয়েছিল। অথচ ইতঃপূর্বে ৬২২ সালে মক্কাবাসীর আক্রোশে পড়ে তিনি ৭০ জন সাহাবি নিয়ে মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালের রিফিউজি কনভেনশন এবং ১৯৬৭ সালের প্রটোকলে প্রদত্ত সংজ্ঞা মোতাবেক হজরত মুহাম্মদ সা: এবং সংশ্লিষ্ট সাহাবিরা ছিলেন রিফিউজি। ওই কনভেনশন ও প্রটোকলে বলা হয়েছে যে, ১. জাতি, ধর্ম, জাতীয়তা বা কোনো বিশেষ মতবাদের গ্রুপে যোগদান বা রাজনৈতিক কারণে জীবন বিপন্ন হওয়ার হুমকির কারণে নিজ মাতৃভূমি ত্যাগকারীকে রিফিউজি বলা হয়, বাংলায় যা ‘শরণার্থী; হিসাবে বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে।
সে সংজ্ঞা মোতাবেক হজরত মুহাম্মদ সা:-এর নেতৃত্বাধীন কাফেলা ইতিহাস স্বীকৃত রিফিউজি। মক্কা করায়ত্ত হওয়ার পর তিনি প্রতিশোধ গ্রহণ না করে নিম্নবর্ণিত নির্দেশনা জারি করেন, যথা : ১. কোনো নারী, শিশু, বৃদ্ধকে হত্যা করা যাবে না ২. কোনো ফলবান গাছ কর্তন করা যাবে না ৩. কোনো লোকালয় ধ্বংস করা যাবে না ৪. খাদ্যের প্রয়োজন ব্যতীত কোনো দুম্বা, গরু, উট জবাই করা যাবে না ৫. কোনো খেজুর বাগান জ্বালিয়ে দেয়া যাবে না ৬. কোনো প্রকার আত্মসাৎ করা যাবে না ৭. কাপুরুষতা প্রদর্শন করা যাবে না।
বিভিন্ন কারণে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি কারণেও মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হয় বা উল্লিখিত কারণে শাসনকর্তার ভয়ে পালিয়ে জীবন রক্ষা করে। প্রবাদ রয়েছে যে, প্রেম ও যুদ্ধে কোনো আইন, নিয়মকানুন চলে না, যেকোনো মূল্যে জয়লাভ করাই কথা। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে অদ্যাবধি আধুনিক যুদ্ধে যে পদ্ধতি প্রয়োগ হয় তা যেকোনো পশুবৃত্তিকে হার মানায়। গণমানুষের জীবন বাঁচানোর চেয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যার অস্ত্র, গোলাবারুদ তৈরি করতে পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্র অধিকহারে বাজেট বরাদ্দ করে। মানুষের রক্ত নিংড়ানো ট্যাক্সের টাকা দিয়ে যুদ্ধের নামে মানুষের রক্ত দিয়ে হোলি খেলা হয়। যুদ্ধে সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষার্থে কিছু আন্তর্জাতিক সনদ তৈরি করা হয়েছে যা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন হিসাবে পরিচিত যা মুখ্য আন্তর্জাতিক আইনের অংশ।
আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রবক্তা Jean Picter-এর বর্ণনা মতে “Humanitarian law is that Considerable Portion of International Law which is inspired by a feeling for huminity and is centered on the protection of the individual in time of war. অর্থাৎ ‘মানবিক আইন’ আন্তর্জাতিক আইনের ওই বিবেচ্য অংশ যা দ্বারা যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বেসামরিক মানুষকে রক্ষা করা যায়।
Jean Picter আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের চারটি নীতিমালা নির্ধারণ করেছেন, যথা :
১. মৌলিক নীতিমালা।
২. মানবাধিকার ও জেনেভা কনভেনশন নীতিমালা।
৩. সঙ্ঘাতে ভিকটিম সম্পর্কিত নীতিমালা।
৪. যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র ও প্রয়োগ সম্পর্কিত নীতিমালা।
আন্তর্জাতিক কনভেনশনের মাধ্যমে ইতঃপূর্বে যুদ্ধ সম্পর্কিত মানবিক বিষয়টি ১৯৪৯ সালের ১২ আগস্ট আন্তর্জাতিক সনদের স্বীকৃতি লাভ করে, যা জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯ নামে পরিচিত। ওই কনভেনশনে নিম্নবর্ণিত চারটি বিষয়ে সনদ অনুমোদিত হয়, যথা :
১. Protection of the wounded and sick in Armed Forces in the War Field.
২. Protection of wounded, sick and ship wrecked Members.
৩. Convention relative to the treatment of prisoners of war.
৪. Protection of civilian persons in time of war.
এছাড়াও জেনেভা কনভেনশনকে সময়োপযোগী ও সমৃদ্ধশালী করার জন্য ১৯৭৭ সালের ৮ জুন দুটি এবং ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর যুদ্ধের নীতিমালা সম্পর্কিত তিনটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়, যথা :
১. Protocol relating to the protection of victim of international Armed Conflict (Protocol-I).
২. Protocol relating to the victim of Non-International Armed Conflict (Protocol-II)
৩. Protocol relating to the adoption of an additional distinctive emblem (Protocol-III)
ওই কনভেনশন ও প্রটোকল মোতাবেক নিম্নবর্ণিত স্থান, স্থাপনা ও চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত বিষয়াদির ওপর যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য বোমা বিস্ফোরণ বা যেকোনো প্রকার আক্রমণকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
১. মেডিক্যাল ইউনিট যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে : (ক) হাসপাতাল (খ) রক্ত শোধনাগার (গ) প্রিভেনটিভ মেডিক্যাল সেন্টার (ঘ) মেডিক্যাল ডিপো বা স্টোর (ঙ) চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত তাঁবু।
২. মেডিক্যাল ট্রান্সপোর্ট যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে : (ক) আকাশ, জল ও স্থলপথে চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত যানবাহন যথা : প্লেন, হেলিকপ্টার, জাহাজ বা অ্যাম্বুলেন্সসহ যেকোনো যানবাহন।
৩. চিকিৎসার জন্য কর্মরত ব্যক্তি : (ক) চিকিৎসক (খ) নার্স (গ) স্ট্রেচার বহনকারী (ঘ) প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত কর্মকর্তাসহ ড্রাইভার, বাবুর্চি (ঙ) ধর্মযাজক বা ধর্মীয় শিক্ষক।
৪. মেডিক্যাল মিশন : ধর্মীয় ও নৈতিকভাবে চিকিৎসার জন্য নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ।
৫. চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত প্রতীক বা পতাকা : রেস ক্রস, জেনেভা ক্রস বা সাদা পতাকাবাহী চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত যেকোনো যানবাহন ও স্থান।
মূলত প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কোনো বেসামরিক ব্যক্তির ওপর হামলা বা আক্রমণ করা যাবে না মর্মে ওই কনভেনশন ও প্রটোকলে কঠোর নির্দেশনা প্রদান করা সত্ত্বেও সভ্যতার দাবিদার যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলো বেসামরিক ব্যক্তি, শিশু, নারী এমনকি হাসপাতালের ওপর বোমা বিস্ফোরণ করছে। ৩০-১-২০২৩ তারিখে মিডিয়াতে প্রকাশ ‘ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে একটি হাসপাতালে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করা হয়েছে। এতে ১৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো ২৪ জন। পূর্ব ইউক্রেনের এ অঞ্চলটি রাশিয়ার দখলে রয়েছে এবং হাসপাতালে হামলার পেছনে ইউক্রেনকে দায়ী করেছে মস্কো। এই খবর নিশ্চিত করেছে আলজাজিরা।
খবরে বলা হয়েছে, পূর্ব ইউক্রেনের রুশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে একটি হাসপাতালে ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণ করার জন্য ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে অভিযুক্ত করেছে রাশিয়া। এ হামলায় ১৪ জন নিহতের পাশাপাশি ২৪ জন রোগী ও চিকিৎসাকর্মী আহত হয়েছে। এ দিকে এ হামলাকে যুদ্ধাপরাধ বলেও দাবি করেছে রাশিয়া। তবে রাশিয়ার এ অভিযোগের বিষয়ে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, পূর্ব ইউক্রেনের রাশিয়ান-নিয়ন্ত্রিত নোভোয়াইডারের একটি হাসপাতালে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা হিমারস রকেট সিস্টেম ব্যবহার করে ইউক্রেন এ আক্রমণটি পরিচালনা করে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পরিচিত কার্যকর বেসামরিক চিকিৎসা স্থাপনায় ইচ্ছাকৃত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিঃসন্দেহে কিয়েভ সরকারের একটি গুরুতর যুদ্ধাপরাধ। এই অপরাধের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সাথে জড়িত সবাইকে খুঁজে বের করে জবাবদিহি করা হবে।’
উল্লিখিত কনভেনশন ও প্রটোকল জাতিসংঘ অনুমোদিত একটি আন্তর্জাতিক আইন যা প্রত্যেকটি সদস্য রাষ্ট্র (জাতিসংঘ অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র) কর্তৃক অবশ্যই পালনীয়। ওই আইনের অনুচ্ছেদ-১ এ বলা হয়েছে যে, ÔThe high contracting parties under take to respect and to ensure respect for the present convention in all circumstances.Õ এখানে উক্ত অনুচ্ছেদের ‘Undertake to respect and to ensure respect’ অংশটুকু প্রণিধানযোগ্য। অর্থাৎ কনভেনশনের অনুমোদনকৃত আইনসমূহকে সম্মান করতে হবে এবং সম্মান করার নিশ্চয়তা নিশ্চিত (ENSURE) করতে হবে।
আইন তা-ই যা নির্দেশনা বা আদেশ, যা অমান্য বা লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। যিনি আইন প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ শাস্তির প্রয়োগ ব্যবস্থাদির নিশ্চয়তা প্রদান করার দায়িত্ব তার ওপরই বর্তায়। হাসপাতালে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শুধু মানবতার লঙ্ঘন হয় নাই বরং কনভেনশন ও প্রটোকল মোতাবেক ‘যুদ্ধপরাধ’ করা হয়েছে। এ যুদ্ধাপরাধীদের আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব জাতিসঙ্ঘের, কিন্তু জাতিসঙ্ঘ একটি দুর্বল ও ঠুঁটো জগন্নাথ সংগঠন বিধায় যত্রতত্র যুদ্ধ ও অপরাধ সংঘটিত হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর বেসামরিক মানুষ, রোগী, নারী, শিশু আজ সবাই নিরাপত্তাহীন। ফলে সভ্যতা এগিয়ে যাওয়ার দাবি যতই জোরদার হোক না কেন, ঘুরেফিরে সেই মতবাদই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ‘জোর যার মুল্লুক তার’ প্রবাদটি পৃথিবী সৃষ্টি থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিল, বর্তমানেও আছে। সর্বক্ষেত্রে অর্থাৎ পরিবার থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত যার হাতে ক্ষমতা তার কাছে আইন ‘কচু পাতার পানি’ বই কিছুই নয়। ক্ষমতাহীন হলে বুঝা যায় যে, আইনের হাত কত লম্বা। উল্লেখ্য, নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার ভেটো পাওয়ার থাকায় জাতিসঙ্ঘ রাশিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না বিধায় আন্তর্জাতিক শান্তি প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার কারণে যুদ্ধ বিলম্বিত হচ্ছে যা বর্ষপূর্তি হয়ে গেল চলতি সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি, এ যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত হয় কিনা, সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা