অবশেষে মুদ্রানীতিতে নয়ছয় সুদহারের ক্যাপ তুলে দিলো
- ড. মো: মিজানুর রহমান
- ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:২৯
ব্যাংক ঋণের সুদ এক অঙ্কের ঘরে নামাতে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ৯ শতাংশ সুদহার বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সাথে আমানতের সুদহারও আড়াই শতাংশ নামিয়ে ৫-৬ করেছিল। মূলত সরকার ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেয়ার জন্য সুদের হার বেঁধে দিয়েছিল বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা যদিও কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে- ব্যাংকের ঋণের উচ্চ সুদহার দেশের শিল্পসহ ব্যবসায় ও সেবা খাতের বিকাশে প্রধান অন্তরায়, কারণ এতে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন খরচ বাড়ে; উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়; ঋণগ্রহীতারা যথাসময়ে ব্যাংকঋণ পরিশোধে সমর্থ হন না। সার্বিকভাবে ঋণের ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হয়।
সুদহার কমানোর পক্ষে যত যুক্তিই দেখানো হোক না কেন, নয়ছয় সুদের হার নির্ধারণ করার সময় দেশের সামগ্রিক বিষয় ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার ছিল; যেমন উন্নত বিশ্বে সুদের হার কম, কারণ ব্যবসার আনুষঙ্গিক অনেক সুবিধা রয়েছে, দুর্নীতি নেই; অন্য দিকে আফ্রিকার কম উন্নত দেশের ব্যাংক সুদের হার এখনো ২০ শতাংশের উপরে। সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাই এখন নীতিনির্ধারক, সুতরাং তারা তাদের স্বার্থে এই সুদের ক্যাপ বসিয়ে নিয়েছেন। ঋণের সুদের হার কমানোর পাশাপাশি আমানতের সুদেও ক্যাপ বসিয়ে দিতে হয়েছে, ফলে ক্ষুদ্র আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নয়ছয় সুদহার রক্ষা করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকেও অনেক চাপ সহ্য করতে হচ্ছিল; পুঁজি হারাচ্ছিল অনেক ব্যাংক।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে ১৫ জানুয়ারি চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) শেষ ছয় মাসের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার পুরোপুরি তুলে নেয়া হয়েছে; পাশাপাশি ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়ানোরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতের সুদহার নিজেদেরই নির্ধারণ করার ক্ষমতা দিয়েছে। এ ছাড়াও, মুদ্রানীতির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি গত মুদ্রানীতি থেকে ১ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়িয়ে ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ এবং পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়িয়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। তবে বাজেটের বিশাল ঘাটতির অর্থায়নে সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমায়নি; বরং বাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে নীতি হার হিসেবে বিবেচিত রেপো সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭৫ থেকে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। রিভার্স রেপোও ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৪ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ১২ দশমিক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশে নামানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন সুদেরহার সীমা তুলল?
প্রথমত ‘মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য’ সুদহার বাড়ানো হয়েছে বলা হয়। অর্থনীতিশাস্ত্র মতে, মূলত দুই ধরনের কারণে মূল্যস্ফীতি হয়, যেমনÑ ‘কস্ট পুশ’ ও ‘ডিমান্ড পুল’। তবে ইদানীং বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার জন্য কোভিডের প্রভাবে আয় কমে যাওয়া এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের সাথে দেশের অর্থনীতির মিস ম্যাচ সামগ্রিকভাবে দায়ী। উন্নত দেশগুলোতে এই পরিস্থিতিতে প্রায় সবাই সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনার চেষ্টা করছে যদিও উদীয়মান ও উন্নত অর্থনীতিগুলোতে এক দাওয়াই দিয়ে পুরো ফল মিলবে না বলে ধারণা করা হয়।
সুদের হার বাড়ানোর দ্বিতীয় কারণ হয়তো ‘ইকোনমিক মিস ম্যাচ’। অর্থাৎ সেন্ট্রাল ব্যাংকের টাকা ছাপাতে হচ্ছে- কারণ সরকার ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেয়ার জন্য লেন্ডিং রেডক্যাপ ৯ শতাংশে বেঁধে দিয়েছিল। এখন লিকুইডিটি ক্রাইসিসের সময় সরকারকে বড় বাজেটের সাপোর্টের জন্য কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে টাকা নিতে হয়। স্বাভাবিক নিয়মে সরকার ঋণ নেয়ার জন্য ট্রেজারি বন্ড বিল ছাড়ে। ব্যাংকগুলো সেখানে অকশনে বিট করে সাধারণত ২ থেকে ৩ শতাংশ রেটে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি সরকার দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার অকশন বিট করে, তবে লিকুইডিটি ক্রাইসিসের জন্য অকশন কল শুরু করল ধরুন সাড়ে ৮ শতাংশ হারে। প্রথম বিটের পর দ্বিতীয় বিটে রেট আরো বেশি, পরের বিটে আরো বেশি। এভাবে দুই হাজার কোটি পর্যন্ত যেতে সুদের হার হয়তো সরকার দেয়া ক্যাপ ৯ শতাংশ ক্রস করে যায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি ভার্বাল ইনস্ট্রাকশন দিয়ে দেয় যে, তারা ৮.৯৫ বিট আসলে স্টপ করে দেবে। কারণ সরকারের বেঁধে দেয়া ঋণের সুদের হার ৯ ক্রস করলে সাধারণ ঋণগ্রহীতার ঋণের হারের সাথে মিস ম্যাচ হয়ে যায়। এতে যেহেতু সরকারের কাছে টাকা রাখা নিরাপদ, বিধায় প্রাইভেট সেক্টর কোনো ঋণই পাবে না, ফলে এই সেক্টর কোনো বিজনেস করতে পারবে না; ইকোনমি খারাপ হয়ে যাবে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হচ্ছে কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে টাকাটা না নিয়ে নিজে ছাপিয়ে সরকারকে দিতে। ঋণের ক্যাপ ১০-১২ শতাংশ হলে সরকার বেশি ঋণ নিতে পারবে; টাকা ছাপাতে হবে না।
নতুন মুদ্রানীতি কি মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানতে যথেষ্ট?
বাংলাদেশে ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতি প্রায় দুই অঙ্কের ঘরে চলে গেলেও সুদের হার বাড়ানোর অস্ত্র প্রয়োগে নীতিনির্ধারক মহলের ছিল অনীহা। অন্য দিকে, এখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে যদিও পরপর তিনবার নীতি সুদ বা রেপোর সুদহার বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার কমেনি। শুধু তা-ই নয়, বাজারে মুদ্রা সরবরাহও কমেনি। উপরন্তু বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েই চলেছে। এ কারণে গত বছরের থেকে এবার প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণের অন্যতম শর্ত- বছরে অন্তত দু’বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা। সরকার দু’টি মুদ্রানীতি ঘোষণা করে আসছে। মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাবাজার ও সুদহার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য নিয়ে এবারের মুদ্রানীতি করা হয়েছে। এতে আগামীতে খেলাপি ঋণ কমানো ও সুশাসন নিশ্চিত করতে কাজ করবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে মুদ্রানীতিতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা সেই লক্ষ্য অর্জনে যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, মুদ্রানীতিতে বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও উদ্যোগের বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করেছে ঠিকই, কিন্তু এর সাপেক্ষে কৌশলী ও টার্গেটেড উদ্যোগ দরকার ছিল, সেই বিষয়গুলো মুদ্রানীতিতে প্রতিফলিত হয়নি। আইএমএফের সাথে সরকার বিভিন্ন শর্তাদি নিয়ে আলোচনা করছে। সে হিসাবে এই মুদ্রানীতিতে যত উদ্যোগ প্রত্যাশা করা হয়েছিল তা পর্যাপ্তভাবে ফুটে ওঠেনি।
বর্তমান অবস্থায় সরকারের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা দরকার। তবে মুদ্রানীতিতে বলা হচ্ছে- যদি অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে তাহলে ব্যাংক ঋণের সুদের হারে সর্বোচ্চ সীমা তুলে দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। ব্যাংক ঋণের সুদের হারে শিথিলতা আনা হলে, সেই সাথে ব্যাংক আমানতের বেঁধে দেয়া সর্বনি¤œ সুদহার তুলে দেয়া হলে, ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই সাথে সরকার এত দিন মুদ্রাবিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন বাজার পরিস্থিতির ওপর ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে। বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে শুধু ২ শতাংশের মতো। যেমন- বাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য ১০০ টাকা করা হলে সরকার সেটিকে হয়তো কমিয়ে ৯৮ টাকা করতে পারে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশের মোট জিডিপির ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং ৫ দশমিক ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ধরে রাখার পরিকল্পনা নির্ধারণ করে সরকার। যদিও বিশ্বব্যাংক বলেছে, প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২০ শতাংশের মধ্যে থাকবে। কিন্তু সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৭১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, আর গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ হয়েছে।
ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের বিষয়টি অনেক আলোচিত হওয়া সত্ত্বেও মুদ্রানীতিতে এ-সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা নেই। সুশাসনগত দুর্বলতার কারণে যে পরিমাণ অর্থ অনাদায়ী হচ্ছে সেটি আমানত ও ঋণ- দু’ধরনের অর্থের জোগানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আইএমএফের সাথে সরকারের আলোচনায় ব্যাংকিং খাতের সুশাসনের বিষয়গুলো গুরুত্ব পেলেও মুদ্রানীতিতে সুশাসনের জন্য করণীয় কিছুই উঠে আসেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর স্বীকার করেছেন, দেশ থেকে বড় অঙ্কের অর্থপাচার হয়েছে। সাধারণত দু’ভাবে সম্পদ পাচার হয়। এগুলো হচ্ছে- আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিং। হুন্ডির মাধ্যমেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয় দেশ থেকে। এতে এক দিকে দেশের টাকা বিদেশে চলে গেছে, অন্য দিকে কর ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ৪ ভাগের ১ ভাগ দামে এলসি খুলেছেন অনেক গ্রাহক। তবে বাকি ৩ ভাগ অর্থ নিশ্চয়ই হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধ করেছেন। বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে। ইতোমধ্যেই অনেকাংশে এই কাজগুলো নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং ভবিষ্যতে আরো কমবে বলে আশা ব্যক্ত করেন গভর্নর। তিনি আরো বলেন, ‘ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নন-পারফর্মিং লোন কমাতে এবং ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে কাজ করবে।’ মুদ্রানীতিতে দেশীয় ঋণ, অর্থ সরবরাহ, দেশীয় সম্পদ, বিদেশী সম্পদ কতটা বাড়বে বা কমবে তার একটি পরিকল্পনাও পেশ করা হয়েছে।
দেশের অর্থনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মুদ্রানীতি উপস্থাপন বক্তব্যে বলেছেন, ‘দেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে এর চেয়ে আর খারাপ হবে না।’ তার এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন যে, দেশের অর্থনীতি খারাপ যাচ্ছে। তিনি অবশ্য বলেছেন, ‘আমাদের অর্থনীতির যে সহনশীলতা, সেটি অত্যন্ত গভীর। যেকোনো একটি ধাক্কায় বাংলাদেশের অর্থনীতি পড়ে যাবে না। কোভিডের সময় আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি।’
নতুন মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তিনটি চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো-
১. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপ্তি; ২. যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সুদহার বাড়ানোর আগ্রাসী কার্যক্রম এবং ৩. চীনের কোভিড পরিস্থিতি। গভর্নর এ বিষয়ে বলেন, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, যত দ্রুত এ তিন চ্যালেঞ্জের সমাধান হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতিও তত দ্রুত বাউন্স করবে। বিদ্যমান এ তিন চ্যালেঞ্জের পরিস্থিতি যদি আরো খারাপ হয়, তাহলেও দেশের অর্থনীতির বর্তমান যে অবস্থা আছে, তার চেয়ে খারাপ হবে না বলেন গভর্নর; যদিও এ বিষয়টি মানতে নারাজ বিশেষজ্ঞ মহল।
দেশের ব্যাংক খাতে এ মুহূর্তে তারল্য সঙ্কট চলছে। বেশ কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক নিজেদের নির্ধারিত সিআরআর এবং এসএলআর সংরক্ষণেও ব্যর্থ হচ্ছে। এ অবস্থায় রেপোর সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে তারল্য পরিস্থিতিকে আরো বেশি চাপে ফেলা হলো কি না। এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘বাজারে অর্থপ্রবাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন করেছে। এসব তহবিলের সুদহার দেড় থেকে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ। এই তহবিল থেকে ব্যাংকগুলো কৃষি, সিএসএমই, রফতানিমুখী শিল্পসহ উৎপাদনমুখী বিভিন্ন শিল্পের জন্য গঠিত তহবিল থেকে অর্থ নিক। এর মাধ্যমে দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। সুদহার বাড়ানোর কারণে ব্যাংকগুলো রেপো থেকে ধার নেয়ায় নিরুৎসাহিত হবে। ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়ানো হলে দেশের রফতানি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে এখনই ঋণের সর্বোচ্চ সুদের ক্যাপ পুরোপুরি তুলে নেয়া হয়নি। তবে ধীরে ধীরে সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে।
এ ছাড়াও গভর্নর বলেন, ‘ব্যাংকগুলোয় সরকারি বিভিন্ন সংস্থার যেসব আমানত ছিল, সেগুলো কমে এসেছে। বিপিসি, পেট্রোবাংলা, বিপিডিবিসহ সরকারি বড় সংস্থাগুলোর আমদানি দায় পরিশোধের জন্য ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত রিজার্ভের প্রায় আট বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। গত অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। এর মাধ্যমে মুদ্রাবাজার থেকে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে এসেছে। এ কারণে ব্যাংক খাতে তারল্য চাপ তৈরি হয়েছে। চাপ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তারল্য সহায়তা দেয়া হয়েছে।’ গভর্নর অবশ্য স্বীকার করেছেন, ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে অনেক টাকা বের হয়ে গেছে, তবে তা দেশী-বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে সঙ্ঘবদ্ধ অপপ্রচারের কারণে হয়েছে, বলেছেন। বাস্তবে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের কারণে তারল্য ঘাটতি হওয়ার কথা তিনি সাবধানে চেপে গেছেন বলে অনেকই মনে করেন।
উল্লেখ্য, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে, যা দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যকে নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে। আমদানি দায়ের সাথে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান সরকারি-বেসরকারি বিদেশী ঋণ। একই সময় সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য আনতে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে আমদানির নতুন ঋণপত্র খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ব্যাপক কড়াকড়ি সত্ত্বেও প্রত্যাশা অনুযায়ী আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি বলে মেনে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে অর্থবছরশেষে আমদানি ব্যয় ৮০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে থামবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেটি হলে চলতি অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে অর্থবছর শেষে তা ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নামবে এবং রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ পর্যন্ত হবে বলে মুদ্রানীতিতে আভাস দেয়া হয়েছে। গত ছয় মাসে সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থবছর শেষে এ ঘাটতি ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে থামবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধারাবাহিকভাবে পতন হচ্ছে।
পরিশেষে বলতে হয়, দেশে ইসলামী ধারার কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও সুশাসন পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংক- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ঘিরেও নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ব্যাংকটি এত দিন অন্য ব্যাংকগুলোকে অর্থ ধার দিত। বর্তমানে নিজেই ধার করছে। এ পরিস্থিতির কারণ জানতে চাইলে গভর্নরের জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেনি কোনো মহল। গ্রাহক ও আমানতকারীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে তারল্য সহায়তা নিয়ে ব্যাংকটির পাশে বাড়ানোর কথা গভর্নর বলেছেন। তবে যে কারণে সমস্যা হলো তা খুঁজে বের করে সমাধান করার কথা বলেননি। অভিজ্ঞদের ধারণা, দেশের ব্যাংকিং খাতের এবং সার্বিক অর্থনীতিতে দুর্নীতিই অর্থনৈতিক মিস ম্যাচের অন্যতম কারণ; সাথে বৈশ্বিক সঙ্কটের প্রভাব তো রয়েছেই। তবে বৈশ্বিক প্রভাব আমাদের নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা