কূটনীতির ভয়ঙ্কর ফাঁদ
- গোলাম মাওলা রনি
- ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ২১:০৩
আমার শৈশব কেটেছে আবহমান বাংলার একটি শান্তিপ্রিয় উন্নত গ্রামে। তখন ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন গ্রামে যেভাবে দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ-মারামারি হতো অমনটি আমাদের গ্রামে কোনো দিন ঘটেনি। চুরি-ডাকাতি-যেনা-ব্যভিচার ইত্যাদি অপকর্মের ঘটনা আমরা জীবনে শুনিনি। এমনকি ছেলে-মেয়েরা প্রেম করে বিয়েশাদি করেছে অমন দৃশ্য আমাদের গ্রামে আশির দশক অবধি একটিও ঘটেনি। ফলে আমার শৈশবের ইতিবাচক চিন্তাচেতনা নিয়ে হাল আমলে যে কি বিপদ বিপত্তিতে পড়ি তার কিছু নমুনা বলে আজকের শিরোনাম নিয়ে আলোচনা শুরু করব।
আগেই বলেছি যে, আমাদের গ্রামে চুরি ডাকাতি হতো না। ফলে চোর ডাকাত সম্পর্কে ছেলেবেলায় আমরা অনেক গল্প শুনেছি দাদী-নানীদের মুখে। আমার খুব ইচ্ছে ছিল চোর দেখার কিন্তু ফরিদপুর থাকা অবস্থায় একজন চোরও দেখিনি। পরবর্তীতে যখন আমরা ফরিদপুর ছেড়ে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপাতে বসতি গড়লাম তখন সম্ভবত সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি এবং এক দিন হঠাৎ করে এক চোরকে দেখতে পাই। বেচারা অভাবের তাড়নায় বাজারের কোনো একটি দোকানে গভীর রাতে সিঁদ কেটে এক বস্তা চাল চুরি করেছিল। পরদিন পুরো এলাকায় হইচই পড়ে যায়। চকিদার-দফাদার-সাধারণ জনগণ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তন্ন তন্ন করে খুঁজে চোরকে পাকড়াও করে। গ্রাম্য শালিস বসে শত শত লোক চোর দেখার জন্য ভিড় জমায় যাদের মধ্যে আমিও ছিলাম।
চোর দেখার সাধ মিটলেও জীবনে ডাকাত দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি। ডাকাতদের বিশাল শরীর, বড় মোচ, বন্দুক-গুলি-রামদা সম্পর্কে এতসব ভয়ঙ্কর গল্প শুনেছি যা বলে শেষ করা যাবে না। ফলে ডাকাত নামের আতঙ্ক আমার এখনো কাটেনি। আমার প্রায়ই ভয় হয় এ কথা ভেবে যে, ডাকাতরা যদি আমার স্নায়বিক দুর্বলতা জানতে পারে এবং আমাকে একাকী পেয়ে কেবল নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে তবে তাদের আর কিছুই করতে হবে না। আমার হাঁটু কাঁপুনির মধ্যে বিনা বাধায় তারা আমার সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যেতে পারবে।
আমার মতো যারা সত্তরের দশকে কিশোর ছিলেন এবং বর্তমানে যারা মোটামুটি সফলতার একটি স্তরে পৌঁছেছেন, তাদের সবাই কম বেশি আমার মতো মন মানসিকতা সম্পন্ন বলেই মনে হয়। তা না হলে হাল আমলের প্রলয়ঙ্করী ডাকাতি এবং শত সহস্র ডাকাতের সদম্ভ পদচারণার মধ্যে কিভাবে সর্বস্ব হারিয়ে লজ্জা-ভয়-আতঙ্কে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী হয়ে স্ত্রীর আঁচলে আশ্রয় খুঁজছেন। অথবা চোরদের সম্পর্কে যদি তাদের সেই শৈশবের আগ্রহ আজও বহাল না থাকত তবে ভোটচোর-চালচোর-ডালচোর-রাস্তাচোর-পুলচোর ইত্যাদি হাজার হাজার বর্ণে বাহারি চোরদের নৃত্যগীত শোনার জন্য মানুষ কেন এত ভিড় করছে।
আজকের শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে উপরোক্ত লম্বা ভূমিকা টানার নেপথ্য কারণও আমার শৈশবকাল। আধুনিককালে যেটিকে কূটনীতি বা ডিপ্লোমেসি বলা হয় তা আমরা শৈশবকালে শুনিনি। আমরা কূটনামি-চোখলখোরী ইত্যাদি শুনেছি এবং এগুলো যে ভালো কর্ম নয় তা এখনো বিশ্বাস করি। পরবর্তীকালে পরিণত বয়সে যখন কূটনীতি নিয়ে অধ্যয়ন করেছি তখন অনেক ইতিবাচক বিষয়াদি জানার পরও মনে হয়েছে কূটনীতির সঙ্গে কূটনামি ও চোগলখোরীর একটি সম্পর্ক আছে। আমাদের কিশোর বেলায় ফা হিয়েন, মার্কো পোলো, ইবনে বতুতা প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত পর্যটক সম্পর্কে পড়েছি যারা মূলত তৎকালীন জমানার কূটনীতিবিদ বা ডিপ্লোম্যাট ছিলেন। তাদের মহামূল্য অভিজ্ঞতা ও ভ্রমণকাহিনী অধ্যয়ন করলে কূটনীতির মাহাত্ম্য যে মানবসভ্যতার কত বড় চাবিকাঠি তা সহজে অনুমান করা যায়।
আধুনিককালের কূটনীতিতে মধ্যযুগের কূটনীতির সেই মাহাত্ম্য নেই। এটা যেন হিন্দু পুরানে বর্ণিত দেবী-লক্ষ্মীর মতো হয়ে গেছে। অর্থাৎ পাপীর ঘরে যিনি অলক্ষ্মী হিসেবে চিহ্নিত তিনিই আবার ভালো মানুষের আবাসস্থলে লক্ষ্মী হিসেবে খ্যাতি পান। তদ্রুপ বর্তমান জমানার হাল হকিকত, শাসকদের নীতি-নৈতিকতা ও লোভ লালসার কারণে ফা-হিয়েন ইবনে বতুতা অথবা মার্কো পোলোর ঐতিহ্যবাহী কূটনীতির সঙ্গে আমাদের শৈশবে শোনা কূটনামি ও চোগলখোরীর রসায়ন এত বেশি প্রবল হয়ে পড়েছে যে, পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলের কূটনীতি পরমাণু যুদ্ধের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে পড়েছে। আমাদের পাক ভারতের কূটনীতি বিশেষত বাংলাদেশ-ভারত-আমেরিকা-রাশিয়া-চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ইতিহাসের জটিলতম এবং ভয়ঙ্কর সময় অতিবাহিত করছে। ফলে বলকান অঞ্চলের ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, সাব সাহারায় যুদ্ধরত পক্ষসমূহের ভয়ঙ্কর দুর্দশা কিংবা ইয়েমেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত ভ‚মিতে সর্বস্ব হারানো ইয়েমেনবাসীর চেয়েও বাংলাদেশী জনগণের দুরবস্থা কেন প্রকট তা বোঝার জন্য সাম্প্রতিক সময়ের ভয়ঙ্কর কিছু কূটনৈতিক তৎপরতার বিশ্লেষণ আবশ্যক।
আলোচনার শুরুতেই ডোনাল্ড লু’র বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে কিছু বলা আবশ্যক। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কর্তা লু’র বাংলাদেশে আগমন পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী উত্তেজনা, আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক এবং আতঙ্ক এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যা আমি আমার জীবনে কোনো দিন দেখিনি। আমাদের রাজনীতি, ক্ষমতার পটপরিবর্তন থেকে শুরু করে অনেক প্রলয়ঙ্করী ও নির্মম বিয়োগান্তক ঘটনার রেশ বড় জোর এক সপ্তাহ স্থায়ী ছিল। কিন্তু মিস্টার লুয়ের সফর নিয়ে গত তিন মাস ধরে যা হচ্ছে তা আগামী কত দিন ধরে অব্যাহত থাকবে- এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। সাদ্দাম জমানার শেষ দিকে তৎকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামস ফেল্ডের ইরাক সফরের চেয়েও ডোনাল্ড লুয়ের বাংলাদেশ সফর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলার পূর্বে ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক।
আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, মুজিববর্ষের সমাপনী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন। যতটুকু আন্দাজ করতে পারি তাতে মনে হয়েছে যে, মোদির সফরটি চীন ও আমেরিকা যুগপৎভাবে বিরোধিতা করেছিল। ফলে বহু পক্ষের মদদে রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে পড়ে মোদিবিরোধী আন্দোলনে যার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সায় কতটুকু ছিল তা আমরা না বুঝলেও দিল্লি হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে। ফলে অনেকটা অনাহূত অতিথি হিসেবে মোদি যখন বাংলাদেশে এলেন তখন কূটনীতির জটিল কূটনামির কারণে অসংখ্য হতাহত হন যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক জটিল করে তোলে।
ভারত কেন ২০১৪ সালের বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনে একক মদদ দিয়েছিল এবং কেন ২০১৮ সালের রাতের ভোটের পুতুল খেলার শেষ দৃশ্যে ভারতকে হটিয়ে চীন মঞ্চ দখল করে নিয়েছিল তা জানলে আপনারা খুব সহজে বুঝতে পারবেন যে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের চেয়েও ভয়ঙ্কর এক ফাঁদে আমাদের দেশের ১৭ কোটি মানুষ কিভাবে আটকা পড়ছে। কূটনীতির উপর্যুপরী ভয়ঙ্কর খেলার কবলে পড়ে আমরা যেভাবে গণতন্ত্র হারিয়েছি একইভাবে অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের পাশাপাশি সামাজিক সংহতি হারিয়ে একটি নিরাশ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছি। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের বিরাট অংশ ভাড়াটে হয়ে পড়েছে এবং অর্থনীতির চালিকাশক্তি চোর-ডাকাতদের হাতে চলে গেছে। আগেরকার জমানার মতো চোর-ডাকাতরা নিজেরা কষ্ট করে কুকর্মের ঝুঁকি নেয় না। তারা এখন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির বিনোদন বালকরূপে নির্বিচারে ও নির্বিবাদে লুটপাট করে এবং দেশের সর্বনাশ ঘটিয়ে স্বামীদের আশ্রয়ে পরদেশে আবাস গড়ে তোলে।
কূটনীতির হাল ফ্যাশনের ভয়ঙ্কর ফাঁদ এখন মূলত অর্থনীতিকে উপলক্ষ করে তৈরি করা হয় যা কিনা সত্তরের দশকে রাজনীতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো এবং আশির দশকে সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রকে টার্গেট করত। রাজনীতিতে যারা গলা ফাটান কিংবা বিদেশী প্রভুদের বদান্যতায় যারা বড় বড় পদে বসে দেশী স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে প্রভুদের স্বার্থরক্ষা করেন তারা যে কূটনীতির দাবার কতটা গুরুত্বহীন ক্রীড়নক তা ডোনাল্ড লু’র বাংলাদেশে সফর এবং সফরকালীন সময়ে তার গুরুত্বপূর্ণ একান্ত বৈঠকগুলো বিশ্লেষণ করলেই অনুমান করা সম্ভব।
বাংলার পুতুল নবাব মীর জাফরকে ইংরেজরা সিংহাসনে বসিয়েছিল মূলত জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ ধড়িবাজ অর্থপাচারকারী এবং ব্যবসায়ীরূপী ডাকাতদের পদলেহনের জন্য। লর্ড ক্লাইভ যেভাবে জগৎ শেঠের হুন্ডি ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলা থেকে অবাধে টাকা পাচার করতে পেরেছিলেন তা কয়েক হাজার মীর জাফরের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কাজেই আজ থেকে ২২০ বছর আগে বাংলার সিংহাসনকে কেন্দ্র করে পুতুল মার্কা শাসক এবং নেপথ্যের অর্থদানবদের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতির সব নির্যাস শোষণ করার জন্য যে ভয়ঙ্কর কূটনীতি ব্রিটিশরা চালু করেছিল তা বর্তমান জমানায় কোন হালতে রয়েছে তা অনুধাবন করা খুব কঠিন কিছু নয়।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা