ডোনাল্ড লু’র সফর ও তারপর
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:০৮, আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:৪৮
গত কয়েক দিনে বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ বিদেশী নাগরিক সফর করে গেলেন। অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য গত ৯ জানুয়ারি মধ্যরাতের পর ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং। আফ্রিকার অনেক দেশ সফরে যাওয়ার পথে রাত ১টা ৫৮ মিনিটে তিনি ঢাকায় নামেন এবং রাত ২টা ৫০ মিনিটে ফের উড়ে যান। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ওই রাতে তার চীনা প্রতিপক্ষকে স্বাগত জানান। তারা দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। এমনটাই বলা হয়েছে ১০ তারিখ সকালের ব্রিফিংয়ে।
কিন গ্যাংয়ের সফরটি এমন সময় অনুষ্ঠিত হলো যখন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লবাশের বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। চার দিনের সফরে তিনি এসেছিলেন ৭ জানুয়ারি। লবাশের-এর বিদায়ের পর আসেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এর বাইরেও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফের কর্মকর্তা একই সময় ঢাকা সফর করেন। হাই প্রোফাইল এসব সফরের প্রতিটিই ছিল বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে চীন ও মার্কিন কর্মকর্তাদের সফর।
সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলো লু’র সফরের বিষয়টি। কারণ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, এখানকার গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা, মানবাধিকার, নির্বাচন প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বিভিন্ন সময়ের মন্তব্য ও কর্মকাণ্ড সরকার ভালোভাবে নেয়নি। বিশেষ করে পিটার হাস যখন একজন গুমের শিকার ব্যক্তির বাসভবনে যান তখন সেখানে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে, যেটি রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি মনে করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ঘটনার পর পরই পিটার আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করে এ বিষয়ে অবহিত করেন। সরকার অবশ্য বলেছে, রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কোনো কারণ ঘটেনি। সরকার নিরাপত্তা নিশ্চিতে সচেষ্ট আছে।
বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কিছুটা যে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয় তা স্পষ্ট। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়। আরো আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাও সরকারের জন্য চরম অস্বস্তি ও বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করে। সব মিলিয়ে লু’র সফর বাংলাদেশের জন্য নাজুক একটি বিষয় ছিল। এতটাই নাজুক যে, মাসের শুরুতে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও পদস্থ কর্মকর্তারা মিলিত হয়ে লু’র সফরের সময় কিভাবে কী করা হবে বা কি বলা হবে সেই কৌশল ঠিক করতে বসেন। বিবিসির খবর অনুযায়ী, সে বৈঠকে ডোনাল্ড লু’র সফর এবং ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হয়। একই সাথে এটাও ঠিক করা হয় যে, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বিষয়ে সবাই অভিন্ন সুরে কথা বলবেন। এছাড়া গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কথিত ‘অপপ্রচার’ রোধে একটি কমিটিও গঠন করা হয়।
সবাই একই সুরে কথা বলাটা প্রচার কৌশলের পুরোনো অনুষঙ্গ হলেও আধুনিক যোগাযোগ প্রক্রিয়ায়ও অনুসৃত। পরপর তিনজন মানুষ যদি একই কথা বলে, তাহলে পুরুৎ ঠাকুরের কাঁধের পাঁঠাও ঠিকই কুকুরে পরিণত হয়। এই গল্প বহুকাল আগের। সেখানে শতমুখে, শত চোঙ্গায় একই আওয়াজ ফোঁকা হলে ভিন্ন কোনো কণ্ঠস্বর এমনভাবে চাপা পড়ে যাবে যে, কেউ আর তা শুনতেই পাবে না; বিচার বিশ্লেষণ করা তো দূরের কথা।
যাই হোক, লু ঢাকায় এসে দুটি দিন বেশ ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। তিনি গত শনিবার রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে তার সরকারি বাসভবনে নৈশভোজে অংশ নেন। রোববার সকালে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা এবং দেশের শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন। আবার পররাষ্ট্র সচিবের মধ্যাহ্নভোজে অংশ নিয়ে তিনি শিক্ষক, গবেষক, সরকারি কর্মকর্তাসহ সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলেন। এরপর আলাদাভাবে বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে। এসব বৈঠকে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এবং অন্য কর্মকর্তারা ছিলেন। রোববার রাতে ডোনাল্ড লু মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই রাতেই ঢাকা ত্যাগ করেন তিনি। বোঝা যাচ্ছে, অল্প সময়ের মধ্যে শ্রমসাধ্য কাজ করেছেন লু। কোনো দলের সাথে আলাদা করে কথা বলেননি, তবে এরই মধ্যে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথেও তার কথা হয়েছে।
ডোনাল্ডের এই সফরে কী কী বিষয় আলোচিত হবার ছিল, আমরা আগেই জেনেছি। র্যাবের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া, জিএসপি সুবিধা, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে সহায়তা, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে (আইপিএস) সমর্থন ইত্যাদি।
কী ধারণা বা ইমপ্রেশন নিয়ে গেলেন তিনি? নিজে মুখে তেমন কিছু বলেননি। পত্র-পত্রিকার খবরে যেটুকু জানা যাচ্ছে তাতেও স্পষ্ট হয়নি কিছু। তবে বলে গেছেন, সবারই রাজনীতি করার অধিকার আছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান মুক্তভাবে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা এবং একক বা সম্মিলিতভাবে চিন্তাভাবনা, মতামত জনসমক্ষে তুলে ধরার স্বাধীনতার পক্ষে। বলেন, এ দেশে সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় তার দেশ যাতে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটবে।
লু’র বিভিন্ন বক্তব্যের জবাবে বাংলাদেশের মন্ত্রীরা যেসব কথা বলেছেন সেগুলো পুরোনো কথা। যেমন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চান। ‘মতপ্রকাশে কাউকে বাধা দেয়া হচ্ছে না। বিরোধী দলকে সভা সমাবেশ করার সুযোগ’ তারা করে দিয়েছেন। এক কথায়, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতিই মার্কিন মন্ত্রীকে শুনিয়েছেন তারা।
র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার প্রসঙ্গে লু বলেছেন, প্রক্রিয়াটি জটিল, সময় লাগবে। তবে র্যাবের যে উন্নতি হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যা যে একেবারেই কমে এসেছে এ কথা তিনি জেনেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট থেকে। বলেছেন, এতে প্রমাণিত, র্যাব মানবাধিকার রক্ষা করেও সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও আইন প্রয়োগের দায়িত্ব পালন করতে পারে।
জিএসপি পুনর্বহালের বিষয়ে জানান, মার্কিন কংগ্রেস যদি আবার এই সুবিধা চালুর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে প্রথম তালিকায় বাংলাদেশ থাকবে। অর্থাৎ কোনো দেশকেই এখন আর জিএসপি সুবিধা দেয় না যুক্তরাষ্ট্র। মি. লু বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) নিয়ে সরকারের সাথে চমৎকার আলোচনা হয়েছে।
সমস্যা হলো, মন্ত্রীদের কথা বাংলাদেশের মানুষ সবসময়ই নির্বিবাদে মেনে নেয়। কেন নেয় সবারই জানা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে একই পাল্লায় মাপতে যাওয়া বোধ হয় খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। র্যাবের আচরণে উন্নতির খবর মি. লু যেমন জেনেছেন মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট থেকে, তেমনি হাজারটা সূত্র তাদের আছে যেখান থেকে ঠিক তথ্যটি তারা সংগ্রহ করেন। রাষ্ট্রদূত তো আছেনই। সুতরাং আমরা অপেক্ষা করব দেশে ফিরে গিয়ে তিনি কী করছেন, সেটি দেখার।
আমাদের একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত বিবিসি রেডিওর সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দুটো জায়গা গুরুত্বপূর্ণ। একটি হোয়াইট হাউজের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল, আরেকটি পররাষ্ট্র দফতরের সহকারী মন্ত্রীর পর্যায় অর্থাৎ ডোনাল্ড লু। তার মতে, রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লবাশের বাংলাদেশ সফরে এসে সরাসরি দেখে, বুঝে-শুনে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। আর ডোনাল্ড লু ফিরে গিয়ে সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেবেন। অর্থাৎ মি. লু এখন লবাশেরের রিপোর্ট ও তার নিজের পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিষয়টিকে রাজনৈতিক কৌশলে রূপান্তর করবেন। সহজ ভাষায় বলা যায়, বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এখন কোন দিকে যাওয়া দরকার বা কী করণীয় সে বিষয়ে পরামর্শ তৈরিতে ভূমিকা পালন করবেন মি. লু। আশা করি, আমরা শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ দেখতে পাবো। আমাদের সরকারের আচরণে নতুন কোনো আলামত যোগ হয় কিনা সেটাও দেখার অপেক্ষা।
তবে ডোনাল্ড লু’র বিদায়ের পরপরই গত সোমবার ধনেজনে সমৃদ্ধ ঢাকার একটি মিডিয়া হাউজের একটি ‘বিশেষ লেখা’ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মিডিয়া হাউজটির বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে গোটা তিনেক দৈনিক পত্রিকা এবং একটি অনলাইন পোর্টালের সবগুলোতেই ওই ‘বিশেষ লেখা’ একযোগে প্রকাশ করা হয়। তাদের টেলিভিশন চ্যানেলে এটি গেছে কিনা আমাদের জানা নেই। ‘শহরের ভেতর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করুন’ শিরোনামের লেখাটি যে সম্পাদক মহোদয় লিখেছেন, তিনি নিজের পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম কলামে প্রধানমন্ত্রীর খবরের নিচে সিঙ্গেল কলাম ট্রিটমেন্টে দ্বিতীয় নিউজ আইটেম হিসাবে ছেপেছেন। আর হাউজের অন্য বাংলা দৈনিকেরও প্রথম কলামে প্রধানমন্ত্রীর খবরের নিচে সিঙ্গেল কলাম ট্রিটমেন্টে তৃতীয় নিউজ আইটেম হিসাবে ছাপা হয়েছে।
‘লেখাটি’ পড়ে বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি যে, এতে বাংলাদেশ সরকারের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন ঘটেছে। এটি পড়ার পর থেকে আমরা দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ অভিমুখ নিয়ে সত্যি শঙ্কায় আছি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা