২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মানবিক অনুভূতি হোক শীতের উষ্ণতা

- ছবি : সংগৃহীত

শীতের তীব্রতা যেন দিন দিন বাড়ছেই। অন্যান্য বছরে দেশের নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় শীতের তীব্রতা লক্ষ করা গেলেও এবার তার ব্যতিক্রম। গোটা দেশেই এবার শীতের দাপট। হাড়কাঁপানো শীতে জনজীবন স্থবির। গোদের ওপর বিষফোঁড়া শৈত্যপ্রবাহ। সাথে রয়েছে কুয়াশার চাদর। শীত এবং কুয়াশায় বিপর্যস্ত জীবন। বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা। শুধু মানুষ নয়, পশু পাখিরাও এবারের শীতে রেহাই পায়নি। তারাও শীতের দাপটে অসহায়।

এবারের শীতে সূর্য যেন মুখ লুকিয়েছে কুয়াশার ঘোমটায়। সূর্যের আলোর দেখা পাওয়া, মেলা ভার। যেটুকু পাওয়া যায় তার কোনো উত্তাপ নেই। ফলে গায়ে রোদ লাগিয়ে শীত তাড়ানোর চিরাচরিত চিত্রটিও এবার হারিয়ে গেছে। এর ওপর রয়েছে শৈত্যপ্রবাহ নামে হাড় কনকনে অসহনীয় ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা। বাইরে বেরোনো দায়। বেরোলেই হাত পা জমে যাওয়ার জোগাড়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল এবং নদী চরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভোগান্তির শেষ নেই এই শীতে।

তীব্র শীতে কাঁপছে সারা দেশ। শীত কারো জন্য আনন্দের, মজার। শীত এলেই ধুম পড়ে শীত ফ্যাশনের; শীতের পিঠা আর নতুন নতুন সুস্বাদু খাবারের। আগুনের পাশে গোল হয়ে বসে আগুনের উষ্ণতায় শরীর তাতিয়ে নেয়ার প্রভাতি আয়োজন কারো জন্য বিলাস, আবার কারো জন্য শীত থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, হররোজ রোজা, তাদের কাছে শীত মানেই আতঙ্ক। শীত মানেই হিম শীতল বাতাসের নিদারুণ কশাঘাত। বিশেষ করে যাদের শীত বলয়ে বাস তাদের কাছে শীত মানেই মূর্তিমান বিভীষিকা। এক টুকরো গরম কাপড় তাদের কাছে সোনালি সুখের স্বপ্ন। শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই তাদের।

আমাদের চোখের সামনে আশপাশে ফুটপাথে, বাস ও রেলস্টেশনে বাজার ঘাটের দোকানের চালার নিচে রিকশার সিটের ওপর রাতের বেলা কুণ্ডলী পাকিয়ে অনেককেই শুয়ে থাকতে দেখা যায়। ছেঁড়া ময়লা শীতবস্ত্রের টুকরো গায়ে জড়িয়ে কোনো মতে শীতের আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টার মানুষগুলো আমাদের সামনেই। আমরা যখন নতুন নতুন দামি কম্বল বা লেপের তলায় শুয়ে ঘরে হিটার জ্বালিয়ে সুখ নিদ্রায় রাত কাটাই, তখন তাদের রাত কাটে নির্ঘুম, শীতে জবুথবু হয়ে। গ্রাম গ্রামান্তরের খেটে খাওয়া ভূমি শ্রমিকদের কথা একবার ভেবে দেখুন। ৭-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বলতে গেলে উদোম গায়ে কুয়াশা ভোরে যারা হিমশীতল জমিতে কাজ করে তারাও তো আমাদের মতোই মানুষ। আমাদের মতোই শীতানুভূতি তাদেরও রয়েছে। শীতবস্ত্রের প্রত্যাশা, শীত নিবারণের প্রয়োজন তাদেরও রয়েছে। কিন্তু সাধ্যে কুলোয় না। আমরা কি পারি না তাদের পাশে দাঁড়াতে? অসহায় শীতার্ত মানুষদের প্রতি সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। অসহায় শীতার্ত মানুষদের প্রতি সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়াই মানবিকতা। সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করার একটু সেতুবন্ধ।

তীব্র শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকা মানুষগুলোর গায়ে একটি শীতের কাপড় জড়িয়ে দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটানোর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? আমাদের সামান্য সহযোগিতা এসব মানুষের জীবনে এনে দিতে পারে একটুখানি সুখনিদ্রা, এতে কোন সন্দেহ নেই। পরিবর্তে তাদের হৃদয় উজাড় করা দোয়া যেন স্বর্গীয় আবহ তৈরি করে। এর মাধ্যমে সমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক, মমত্ব ও ভালোবাসার যে আবহ তৈরি হতে পারে তার কোনো তুলনা হয় না। একজন, দু’জন বা ততোধিক শীতার্ত অসহায় মানুষকে সাহায্য করতে সংসারের বাজেটের বিরাট ঘাটতি কখনোই হয় না। এ জন্য বিত্তশালী হওয়া আবশ্যকীয় নয়; মনোভাবটাই মুখ্য। আমাদের ব্যবহৃত অতিরিক্ত শীতবস্ত্রগুলো আমাদের পরিচিত অসহায় আপনজন, প্রতিবেশীদের মাঝে বিতরণের মাধ্যমে এটা করা যায়। এভাবে প্রত্যেকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেষ্টার মাধ্যমে সমাজের মেলবন্ধন তৈরি হতে পারে। হতে পারে পারস্পরিক দুঃখ বেদনা আনন্দ আর হাসি-কান্নার সহযাত্রী। এটাই ইসলামের শিক্ষা। ইসলামী সমাজব্যবস্থার ভিতই হচ্ছে পারস্পরিক দুঃখ বেদনা হাসি কান্নাকে সবাই মিলে ভাগ করে নেয়া মদিনার আনসাররা যে জন্য অমর হয়ে আছেন ইতিহাসে।

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এ ধরনের অনেক চেষ্টার কথা শোনা যায়, দেখা যায়। এর কিছু কিছু চটকদার প্রচার ব্যবহৃত হয়। অথচ ইসলামী সমাজব্যবস্থায় কাউকে কিছু দান করার ব্যাপারটা গোপনীয় রাখার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়াও ঢাকঢোল পিটিয়ে কাউকে সাহায্য বা দান করলে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রটি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে নিঃসন্দেহে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হচ্ছে নিজ পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনদের সাহায্য করা। এতে সাহায্য নেয়ার উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে সাহায্য পৌঁছানো যায় এবং উপকার গ্রহণকারী কোনো রকম হীনম্মন্যতায় ভোগেন না।

মোট কথা, শীতার্তদের সহায়তার জন্য নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী পরিচিত আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা দরকার সবার। এভাবে আমরা সমবেত প্রচেষ্টায় শীতার্ত জনগোষ্ঠীর কিছুটা হলেও শীত নিবারণে সাহায্য করতে পারি। পারি তাদের মুখে হাসি ফোটাতে। এভাবে একদিকে যেমন শীতার্ত মানুষগুলোর ভেতর সৃষ্টি হবে স্বস্তির আবহ; তেমনি গড়ে উঠবে ‘সুখ দুঃখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই’ এর আদলে মানবিক অনুভূতিসম্পন্ন সমাজ। পারস্পরিক কল্যাণবোধে উজ্জীবিত জীবন।

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement