অন্য কিছু বলা কেবলই বাগাড়ম্বর
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:২৯, আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ২২:২৫
ব্যক্তি, সমাজ ও সংগঠন সম্পর্কে অকারণে কোনো নেতিবাচক ধারণাকে লালন এবং সে আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা; সেই সাথে কার্যক্রম গ্রহণের জন্য মনোস্থির করে এগিয়ে যাওয়া সব সময় যথার্থ না-ও হতে পারে। তবে কোনো ব্যক্তি সমাজ, সংগঠন পূর্বাপর যদি এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়া অব্যাহত রাখে যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ, কল্যাণ, প্রয়োজন ও প্রাপ্তির প্রতিক‚লে গিয়ে দাঁড়ায়, সে ক্ষেত্রে ধৈর্য অবলম্বন করে থাকা হয়তো মন্দের ভালো। কিন্তু সেই সমাজ সংগঠনের সব কিছু যদি এতটা প্রান্তিক হয়ে দাঁড়ায় যা নিজেদের ও বৃহত্তর জনগণের অস্তিত্বের ওপর হুমকি হয়ে ওঠে তখন অবশ্য বিবেচনা ভিন্ন হতে পারে এবং পৃথক বিবেচনায় নেয়ার অবকাশ আছে। অবশ্যই সবার জানা যে, এই জনপদের মানুষ কখনো স্বেচ্ছায় কোনো নেতিবাচক ধারণাকে লালন করেনি। এটা অতীতে একাধিকবার লক্ষ করা গেছে বরং পক্ষশক্তি প্রতিপক্ষদের ওপর তথা তাদের নেতাকর্মী, সমর্থক ও অনুরক্তদের ওপর চরম মনোভাবাপন্নতাকে আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুললে তথা তাদের প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠলে। সে ক্ষেত্রে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা থাকে না। তখন অবশ্য সব শ্রেণী ও স্তরের মানুষের সমর্থন সমবেদনা শুভাশিস প্রতিপক্ষের প্রতি অনল ধারায় বর্ষিত হতে থাকে।
গত বছরের মধ্য ভাগ থেকে দেশে বর্তমানে যারা পজিশনে আছেন তারা তাদের অপজিশনকে দলন মন্থন বহুগুণে বৃদ্ধি করে চলেছেন। পজিশন থাকা শক্তি এখন এতটা মারমুখী হয়ে উঠেছে, সেটি মানুষ উপলব্ধি করছে। আমাদের বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে সেই সব বিষয় নিয়ে বেশি কথা না বলে বরং সাম্প্রতিক কর্মসূচিকে নিয়ে কিছু বলাই এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছি। তা-ই আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হবে।
পক্ষ শক্তি তাদের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারসহ কিছুকাল আগে একটি স্লোগান নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল যে, তারা দেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর রূপ দেবে। এখন তারা আবার ভিন্ন একটি স্লোগান তুলেছে, সেটি হলো ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’; এই নতুন ধারণা এখন মাঠে থ্রো করা হয়েছে অর্থ হয়তো এটাই হবে যে, পূর্বে সেই স্লোগানের শুভ সমাপ্তি ঘটেছে। এখন নতুন ধারণার বিষয়ে খানিক পরে কথা হতে পারে। তবে তার আগে যে কথা বলে নিতে চাই; ডিজিটাল বাংলাদেশের সেই স্লোগান প্রকৃত অর্থেই দেশের তরুণ সমাজকে আন্দোলিত করেছিল; তারা নতুন এক স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে স্লোগান তরুণদের স্বপ্নচারী করেছিল; কিন্তু বাস্তবে তার কতটা সফল বাস্তবায়ন ঘটেছে? তরুণরাসহ বহু মানুষের সেই স্বপ্নকে কর্তৃপক্ষ কতটা স্বপ্নের ঘোর থেকে দিবালোকে আনতে পেরেছেন? একই সাথে এটাও জানার বিষয়, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে এই নতুন প্রযুক্তির সাথে কতটা সম্পৃক্ত করা গেছে এবং এ জন্য কী পরিকল্পনা ছিল? তা নিয়ে কেউ কোনো খবর জানে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া যাদের জ্ঞান গরিমার তেমন কমতি না থাকলেও তারা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর স্বরূপ ও প্রযুক্তিগত বিষয় সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত রয়েছেন কি না তারও কোনো পরিসংখ্যান কারো জানা শোনার সীমার মধ্যে থাকা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ রয়েছে। শিক্ষা থাকা সত্তে¡ও তাদের ডিজিটাল প্রযুক্তি অনুশীলন করতে পারার কোনো সুযোগ তৈরি করা হয়েছে, এমন কিছু জানা যায়নি। অন্তত এ দেশে এটা নতুন প্রযুক্তি তো বটেই, সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি না করে সাধারণের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকার অর্থ হচ্ছে, অন্ধের হাতি দেখানোর মতোই ব্যাপার। এই নতুন “কনসেপ্ট’কে ‘ফ্লোট’ করা ও সবার সক্ষমতা নিয়ে উচ্চ ধারণা পোষণ করাকে কেউ যদি গাড়ির আগে ঘোড়া জোড়ার” প্রবাদের সাথে তুলনা করে, তবে বলার কী থাকে।
গুটি কতক মানুষ ছাড়া অন্যদের সক্ষমতা নিয়ে, যে বিষয় নিয়ে সামান্য কিছু বলা হলো; সে সম্পর্কে হয়তো কোনো ভিন্ন মত পোষণ ও বিতর্ক করার অবকাশ নেই। এমতাবস্থায় এই প্রযুক্তির ব্যবহার করার জন্য সরাসরি নির্বাচনের মাঠে চলে যাওয়াকে সঠিক বলে অনেকেই মনে করছেন না। নির্বাচন হচ্ছে ‘গণতন্ত্রের প্রাণ’ স্বরূপ। এমন কথা বলা অত্যুক্তি বলে আখ্যায়িত করা ঠিক হবে না। গণতন্ত্রের চেতনা খোদ এখন ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। এমন পর্যায়ে ভোট দানের ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা সম্পর্কে ঘোরতর দ্বিমত, আপত্তি সবই ছিল ও আছে। তদুপরি এসব উপেক্ষা করে এই প্রযুক্তির ব্যবহার তথা ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণে জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা নিয়ে সচেতন মানুষ মনে করে, দেশের ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরো বেশি ভঙ্গুর করে তুলবে। আবার সাধারণ মানুষসহ বহু মানুষ সেটি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি। তাদের ভাষায় ইভিএমকে ‘জাদুবাক্স’ বলে অভিহিত করছে। তারা মনে করে, এর মাধ্যমে এধারে ভোট দিলে মুহূর্তের মধ্যে সেটা ওধারে গিয়ে যোগ হয়ে যাবে। তা ছাড়া এটা আগেই বলা হয়েছে, দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী এই প্রযুক্তি নিয়ে এতটুকু সক্ষমতাও অর্জন করতে পারেনি। সে জন্য তাদের পক্ষে কারো সহায়তা ভিন্ন ভোট দান ‘প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। ফলে তাদের ভোট দানের ক্ষেত্রে অন্যের সহায়তার ওপর শতভাগ নির্ভর করতে হবে। এতে শুধু ভোটের গোপনীয়তাই ক্ষুণ্ণ হবে না। যে সহায়তাকারী হবেন, তার এই প্রযুক্তি সম্পর্কে পারঙ্গম তার ওপরই ভোটদানকারীকে নির্ভর করতে হবে, কোন প্রতীকে তিনি ভোট দিতে চান। সেই সহায়তাকারী অবশ্যই তো মানুষ; তাদের একটা ‘লাইক-ডিজলাইক’ এর ব্যাপার থাকতেই পারে। সে সহায়তা কি যদি তার ‘লাইক’ এর মতো করে ব্যবস্থা নেয়, তবে সেটি হবে সকলই গরল ভেল’।
তার পরও কথা আছে, সম্প্রতি গাইবান্ধায় মাত্র একটি আসনে উপনির্বাচন হয়েছে। সেই নির্বাচন নিয়ে পত্র-পত্রিকা যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে ভোট দিতে গিয়ে বহু বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে ভোটারদের। কেননা ইভিএম যন্ত্র ঠিকমতো কাজ করছিল না, তাই ভোট শেষ করতে অতিরিক্ত সময় লেগেছে। এসব বিড়ম্বনার জন্য ইদানীং ভোট দানের ব্যাপারে মানুষ উৎসাহ প্রায় হারিয়ে ফেলছে। হয়তো সে জন্য গাইবান্ধার উপনির্বাচনে মাত্র ৩৫ শতাংশ ভোটার ভোটে অংশগ্রহণ করেছে। তার আগে রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোটের এই একই চিত্র লক্ষ করা গেছে। বস্তুত এখন গণতন্ত্র নানা বিপদের মধ্যে রয়েছে। তার ওপর এসব তথা কথিত প্রযুক্তির ব্যবহার দেশের ভঙ্গুর গণতন্ত্রকে আরো বেশি ভঙ্গুর করে তুলেছে।
এমন অভিজ্ঞতার পরও কেন যে ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের মন মজেছে তা বোধগম্য নয়। গাইবান্ধায় মাত্র একটি আসনে ভোট গ্রহণ নিয়ে সমস্যা তৈরির কথা বলা হয়েছে, সেটি বিবেচনায় নিয়ে ভাবতে হবে। দেশে দ্বাদশ সংসদের নির্বাচনে ৩০০ আসনে ভোট হবে। তার মধ্য থেকে যদি ৫০টি আসনেও ইভিএমের মারফত ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়, তবে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাই প্রশ্নের মুখে পড়বে। আর অন্য সব সমস্যার কথা না-ই বা বললাম। তা ছাড়া অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই ইভিএম নিয়ে নির্বাচন করার বিপক্ষে। এখন নির্বাচন কমিশন সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতকে গ্রহণ করছে না সংখ্যালঘিষ্ঠের মতো বিবেচনায় নিচ্ছে। কমিশনকে গণতান্ত্রিক চেতনারই প্রতীক হওয়ার কথা।
আগে যে প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হয়েছে, তথা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠন। সেটি তার পরিণতিতে পৌঁছার আগেই এখন এক নতুন ধারণা ফ্লোট করা হয়েছে, সেটি হলো ‘স্মার্ট বাংলাদেশ।’ অবশ্য একটি ধারণার সমাপ্তি টেনে অন্য কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হওয়া মন্দ কিছু নয়। কিন্তু আমরা আগেই বলেছি, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠনের কর্মসূচি মাঝপথও অতিক্রম করেনি। এ কথার প্রমাণ অবশ্য মিলবে; ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ধারণা পত্রেও আছে। তাই একটা কর্মসূচি শেষ না হতেই আর কিছু নিয়ে কাজ করার কথা বলা কিছুটা তাড়াহুড়া করা নয়।
যাক, ‘স্মার্ট বাংলাদেশের পরিপত্রে চারটি কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট সোসাইটি। এই দফা কি বিএনপির ২৭ দফা কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে ঘোষিত হলো কি না জানি না। তবে এই কর্মসূচির কিছুটা পূর্ববর্তী ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর ধারণাপত্রেও রয়েছে। এর দুটো অর্থ হতে পারে (এক) সে কর্মসূচিকে হাফডান করে রাখা হয়েছে, সে জন্য হয়তো। তবে এটাও হতে পারে বা নিছক কিছু দেয়া। যাক, এই স্মার্ট বাংলাদেশের প্রথম কার্যক্রমে উল্লেখ আছে, প্রতিটি নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করা হবে। কিন্তু কিভাবে হবে সে বিষয়ে বেশি কিছু বলা হয়নি। যে দেশের মানুষ ঠিকমতো তিন বেলা খেতে পায় না তাদের জন্য এসব বিলাস ছাড়া আর কি হতে পারে? স্মার্ট ইকোনমি অর্থাৎ অর্থনীতির সব কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। যখন দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ স্তরে নেমে গেছে, তাকে তো টেনে তোলাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার জন্য ডিজিটালই বা কি আর এনালগই কি। এ সমস্যা নিয়ে বিশদ আলোচনার দরকার নেই। এ জন্য নেই যে, প্রতিটি নাগরিক এখন সেটি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তৃতীয় পর্যায়ে বলা হয়েছে, স্মার্ট গভর্নমেন্ট। এখানে আসলে বলতে হলে হয়তো এতটুকু বলা যায়, সক্ষম যোগ্য দক্ষ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একটি প্রশাসন যারা দেশে সুশাসন কায়েম করবে। আমরা নিছক সমালোচনার জন্য পরনিন্দা করতে চাই না এবং এটা করা গর্হিত কাজ বটে। তবে এ ক্ষেত্রে এতটুকুই বলা যায় দেশে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যেত তাহলে বাংলাদেশে এখন পদে পদে সঙ্কট যে পায়ের ‘বেড়ি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হয়তো থাকত না। খোদ রাজধানীর যে বায়ু দূষণ সেটিই তো এখন মোকাবেলা করা যাচ্ছে না, অন্য আরো বহু কিছু নিয়ে যে সমস্যার, পাহাড় তৈরি হয়ে আছে সেগুলোর প্রতিবিধান করতে প্রশাসন ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকত কিন্তু সবই গাল গল্প মনে হয়।
যাক, সংবিধানের একটা অনুচ্ছেদের নির্দেশনার বিষয় উল্লেখ করে এই নিবন্ধের ইতি টানতে চাই। যেখানে (১৫(ক) অনুচ্ছেদ) বলা আছে, “অন্ন বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা। অনুচ্ছেদের (১৫নং) প্রথমেই উল্লেখ রয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে...। পক্ষে সরকারই এই দায়িত্ব পালন করবে, এটাই চেতনা।” এসব পূরণ করার পরই অন্যান্য বিশেষ বিশেষণ যুক্ত কর্মসূচি হাতে নেয়াই ছিল পালনীয় কর্তব্য। এই দায়িত্ব কেবল কোনো এক সরকারের নয়, বিগত সব সরকারেরই ছিল। এই দায়িত্ব পালন না করা নিয়ে ব্যর্থতায় সবাইকে তার শরিক হতে হবে। এখন ২৭ দফা বলি আর নতুন দুই ধারণার কথাই বলি এসব কেবল ছেলে ভুলানোর মতো কথা। মানুষের দুঃখ কষ্ট দূর করা কর্মসূচি হাতে না নিয়ে অন্য কিছু বলা কেবলই বাগাড়ম্বর।
ndigantababar@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা