এলাকার নাম সাগুয়ানঘুণ্টি
- ড. মাহবুব হাসান
- ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:২৩
এলাকার নাম সাগুয়ানঘুণ্টি। রাজশাহীর গোদাগাড়ির একটি গ্রাম। আর সেই গ্রামের ওপর দিয়ে এককালে রেল লাইন ছিল। সেখানেই গড়ে উঠেছে রেলবাজার। রেলের জমির ওপর দশাসই একতলা বিল্ডিং উঠেছে। এই বিল্ডিং ভেঙে এলজিইডি তাদের নেয়া রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পটি নিয়ে এগোতে পারছে না। কারণ ওই বিল্ডিংওয়ালা একজন খাঁটি স্থানীয় কমিশনার। সব থেকে মজার বিষয় হলো একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধির অবৈধ ক্ষমতার কাছে গোটা এলজিইডি একটি অচল প্রতিষ্ঠান হয়ে কাল কাটাচ্ছে। এসংক্রান্ত রিপোর্টটি পড়ে আসি আগে। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে এ দেশে ওই রকম ভূমিখোর স্থানীয় কমিশনারের সংখ্যা কত থাকতে পারে।
৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ আঞ্চলিক সড়কটির শুরু রাজশাহীর গোদাগাড়ীর রেলবাজারে। শেষ হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরায়। রেলবাজার থেকে যাত্রা শুরু করলে দেড় কিলোমিটার যেতে না যেতেই সড়কটি হঠাৎ শেষ হয়ে যাবে। পথ আগলে দাঁড়াবে একতলাবিশিষ্ট দশাসই একটা দালান। তার আশপাশে কিছু খুপরি ঘরবাড়ি। সেসব বাড়ির উঠোন মাড়িয়ে ভবনের অন্য প্রান্তে গেলে দেখা পাওয়া যাবে হারিয়ে যাওয়া পাকা সড়কটির।
গোদাগাড়ীর সাগুয়ানঘুণ্টি এলাকার চিত্র এটি। এক পৌর কাউন্সিলর ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে রেলের সরকারি জমি দখলে নিয়ে রাস্তার মাঝ-বরাবর ভবনটি নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে। তিনি ও তার ভাইয়েরা এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় সরকারি জায়গা থেকে ভবনটি সরছে না।
তিন মাস ধরে রাস্তাটিও পূর্ণতা পাচ্ছে না। ওই কাউন্সিলর ও তার ভাইদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ আছে। কাউন্সিলর নিজে মাদকের মামলায় গ্রেফতারও হয়েছিলেন বলে থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। (প্রথম আলো, ০৮ জানুয়ারি, ২০২৩)
এই রিপোর্ট যদি সত্য হয়, প্রকাশিত ছবি দেখে যদিও সত্য বলেই মনে করা যায়, তার পরও বলি, যদি সত্য না হয় এই রিপোর্ট, তাহলেও কিন্তু জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে সড়কের জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়া ওই চিহ্নিত জনপ্রতিনিধির সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব থাকে। সেটা তিনি ও তাঁর ভাই জানেন কি না বা বোঝেন কি না, সেটা এলজিইডির কর্তাব্যক্তিরা ভালো বলতে পারবেন। কেননা, তারাই তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সরকারি জমি উদ্ধারের কাজে।
সরকারি জমি, রেলওয়ের হোক বা স্থানীয় সরকারের জমিই হোক, খুবই ছোট একটি ঘটনা। এ রকম অসংখ্য সরকরি জমি দখল করে রেখেছে ওই শ্রেণীর দখলদার, যারা একই সঙ্গে জনপ্রতিনিধি এবং মাদকের কারবারিও। মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত লোককে নির্বাচনে ভোট দেবে সাধারণ মানুষ, আপনারা বিশ্বাস করলেও অন্তত আমি করি না। তাহলে কী করে তিনি জনপ্রতিনিধি হলেন? রহস্যটা কোথায় তার সন্ধান জাতীয় স্তরে এ রকম ঘটনার রেওয়াজ থেকেই পেতে পারেন আপনারা।
কথায় আছে বা লোকেরা বলে, ভূত তাড়ানোর জন্য যে সরিষা ব্যবহার করা হয়, সেই সরিষাতেই যদি ভূতের বসবাস হয়, তাহলে কি সেই সরিষা দিয়ে ভূত তাড়ানো যায়? নাকি যাবে? রিপোর্ট থেকে এটা পরিষ্কার যে ইউএনও, জেলা প্রশাসন, সংসদ সদস্য প্রত্যেকেই ওই চিহ্নিত বিপণিবিতানটি ভেঙে রাস্তা বানানো প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলছেন। কিন্তু এলজিইডি সেই কাজটি করছে না। কেন করছে না, সেটা আমরা বুঝি, সাধারণ মানুষের মতো পদস্থ সরকারি কর্তারাও বোঝেন। কিন্তু এলজিইডির কর্তাদের পকেটে টুপাইস ঢুকলে তারা কাজে ঢিলে দেবেনই, তার জন্য কি তাদের চাকরি যাবে? নাকি বদলি হয়ে অন্য কোথাও যাবেন?
বদলি হলে আরো ভালো তাদের জন্য। নতুন জায়গায় নতুন লোকেদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কোমর বেঁধে নামবেন অবৈধদের সরকারি ভূমি খাওয়ার সহযোগ দিতে। না, আমি এলজিইডির কর্তাদের দোষ দিচ্ছি না। কারণ সরকারি অফিসের সাংস্কৃতিক চরিত্রই হচ্ছে সেবাকে পণ্য করে তোলা। ধরুন, আপনি ঠিকাদার ওই প্রতিষ্ঠানের। বিট করে কাজ পেয়েছেন। কিন্তু কর্তাদের ৫% না দিলে সেই কাজের ওয়ার্ক অর্ডার কিছুতেই দেবে না। নানা টালবাহানা করে প্রাক্কলিত সময়ের অর্ধেক হজম করার পরও যখন মালপানি পান না, তখন কাজের ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হয়। তা, ওই কম সময়ে ঠিকাদার কাজ সম্পন্ন করতে পারেন না। তখন কর্তাদের টাকা কড়ি দিয়ে প্রকল্পের কাজের সময় বাড়িয়ে নেন, সেই সাথে বাড়ে ব্যয়ের বাড়তি বরাদ্দও। এ কারণেই সরকারের ব্যয় এত বেশি। ১০ টাকার কাজ ১০০০ টাকা ব্যয় করে তারা।
সরকারি মাল দরিয়ায় ঢালার এই রাজনৈতিক পদ্ধতির অবসান কবে হবে- কেউ তা বলতে পারে না। কারণ এটি একটি সিস্টেম। এই সিস্টেমলসের সিস্টেম যারা তৈরি করে গেছে, তারা মরে ভূত হয়ে গেছে। আর সেই ভূতরাই এলজিইডির মতো সব সরকারি অফিসে বিরাজমান। এখন সরকারি দফতরগুলোতে জনগণকে সেবা কিনে (ঘুষ) নিতে হয়। এই সংস্কৃতিই আমরা লালন করি, পালন করি এবং এ নিয়ে লজ্জা পাই না। ধরুন, পুলিশ, কাস্টমস, ভূমি, নিম্ন আদালত, সিটির অফিস- কোথায় নেই এই জবরদখল, ঘুষ-বাণিজ্য? সরকারের কোনো অফিস কর্তৃপক্ষ কি প্রমাণ করতে পারবেন যে ওই অফিসে ঘুষ বাণিজ্য নেই?
সরকারের যত বড় অফিস কর্তা, সেখানে তত বড় ঘুষবাণিজ্য। এ কারণে অনেক সেক্রেটারির সম্পদের পরিমাণ অনেক বলে শোনা যায়। তারা এমনকি বেতনভাতা পান বা পেতেন যে নিজের সাংসারিক খরচ বহনের পরও একাধিক বাড়ি ও গাড়ি করতে পারেন? নিচের স্তরের সরকারি কর্তাদের কথাও আসতে পারে। তারা বড় অফিসার হওয়ার পথেই মালকড়ি সৃজন করেন। তবে সব সরকারি কর্তারাই যে অবৈধভাবে বিত্ত অর্জন করেন, সেটা বলছি না। তবে অধিকাংশই ওই রকম অন্যায় ও অবৈধ কাজে জড়িত। আর ঘুষ খেলেই কেবল অসৎ হয় না, অবৈধদের সহযোগ দিলেও তা হয়। কিংবা অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে না দাঁড়ালেও একই অন্যায় ও অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারেন। আর আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ঠিকাদার ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের রাজনৈতিক ইতিহাসও কিন্তু ঘুষ দেয়া ও নেয়ার সাথে ওতপ্রোত।
আমাদের শাকসবজির বাজারে যে আগুনে দাম, তাতেও কিন্তু একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায়, বেশ কয়েকজন মন্ত্রীই বলেছেন, এই মূল্যবৃদ্ধি একদিন ক্রেতাদের সয়ে যাবে। হ্যাঁ, গচ্ছিত অর্থ বা সম্পদ বিক্রি করে অনেক পরিবারই সরকারের সয়ে যাওয়ার ফরমুলা অনুসরণ করছে। এদের একটি বড় অংশ যে রাস্তায় দাঁড়ানো ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) এর ট্রাকের লাইনে হতদরিদ্রদের সাথে দাঁড়িয়ে কম দামে পণ্য কিনে খাচ্ছে, সেটা সরকারের চোখে পড়ে না। তারা কোটি কোটি গরিব মানুষদের কম মূল্যে খাদ্যশস্য দিচ্ছেন, সেই খুশিতেই বাকবাকুম। একবারও ভেবে দেখেন না; কেন, কোন প্রক্রিয়ায় ওই বিপুল মানুষ হতদরিদ্র হয়ে পড়ল?
বাংলাদেশে অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে, তারাও ওই গরিবদের নিয়ে তেমন কাজ করেন না। করলেও সরকার সেগুলোর ফলাফলের গুরুত্ব দেন না। সরকার কেবল বলেন, এ বছর কত লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছে। ধানে বা খাদ্যশস্যে আমরা বাম্পার ফলন করেছি, ইত্যাদি। ফলন বেড়েছে সত্য, কিন্তু গরিব মানুষের হাঁড়িতে চাল নেই। তাহলে ওই ফসল কাদের গোলায় জমা হচ্ছে? কেন গরিব মানুষের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ওএমএস চালু করতে হয়। এই বাস্তবতা সরকারকে সম্যক বুঝতে হবে এবং গরিব মানুষের দুর্দশা কাটাতে তাকেই প্রধান উদ্যোগ নিতে হবে।
আমি কিন্তু গরিবদের বিপরীতে রাজনীতিকদের ভাণ্ডার ভরে ওঠার কথা বলিনি। বললে, রাজনীতিকরা গোস্যা হবেন। তবে, এটাও বাস্তবতা যে এখন সরকারি-বেসরকারি দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীই ব্যবসায়ী। আর তাদের কারণেই পণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি। আর সরকারের ব্যর্থতা হচ্ছে কাঁচাবাজারের মূল্যবৃদ্ধি সামাল দিতে না পারা।
না, এগুলো নিয়ে আমরা কিছু বলব না। আমাদের সয়ে যাবে, যাবেই। সরকার এটা জানেন। সরকার নিজেই এসব জানেন বলেই মাথা ঘামান না। কিন্তু পণ্যমূল্য বাড়ার লাগামটি টেনে ধরার দায়িত্ব তাদেরই। সেটা মনে রাখা জরুরি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা