অর্থনীতির একটিই সঙ্কট, সুশাসনের অভাব
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:০৩
নানা কারণে বিশ্বজুড়েই অর্থনীতির অবস্থা বেশ খারাপ। মূল্যস্ফীতি অনেক দেশেই গুরুতর চাপ সৃষ্টি করেছে ভোক্তা সাধারণের ওপর। ব্রিটেনের মতো দেশে সরকারের টালমাটাল অবস্থা হয়েছে। আমেরিকা হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতির একই অবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশে অর্থনীতি দ্রুতই রুগ্ণ হয়ে পড়ছে। এতটাই যে, এটি এখন আর কেবল ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষেরই নয়, অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতদেরও কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলতে শুরু করেছে।
নিত্যপণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় দুবেলা খাবার জোটাতে পারছে না নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের একটি বড় অংশ। অনেকে মাছ-গোশত খাওয়া বাদ দিয়েছেন, অনেকে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ পরিবার পরিজনকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন ব্যয় সাশ্রয়ের আশায়। এসব খবর আমরা প্রতিদিনের সংবাদপত্রের রিপোর্টে বা আলোচনায় দেখছি, পড়ছি। আর আমাদের বুক প্রতি মুহূর্তে শঙ্কায় ঢিপঢিপ করছে, কপাল ঘেমে উঠছে।
বর্তমান সরকারের প্রায় ১৫ বছরের মেয়াদে অর্থনীতি এমন নাজুক অবস্থায় এসে দাঁড়াবে এমনটা কেউ কখনো ভাবেনি। কারণ এই সরকারের সময়েই রিজার্ভ অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের পরিমাণ রেকর্ড উচ্চতা স্পর্শ করে। বিশাল বিশাল মেগা উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। অনেকগুলো বাস্তবায়নও হয়। নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র ও বেশি উন্নয়নের ফর্মুলায় বিরোধীদের কোণঠাসা করে এক ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা হয় এবং এতে করে, কৃত্রিম হলেও, নিরবচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার একটা অনুক‚ল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এটি বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সাফল্যের তালিকায়ই সম্ভবত যুক্ত হবে। কিন্তু ১৫ বছর ধরে দেশ চালানোর যে ধারা সরকার দেখিয়েছে তাকে কেউই, আর যাই হোক, সুশাসন বলে অভিহিত করেন না। সুশাসনের অভাব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পিছুটান সৃষ্টি করে এটা সবারই জানা।
বর্তমান সঙ্কটসীমায় পৌঁছার কারণ হিসেবে সরকার পক্ষ বৈশ্বিক যুদ্ধাবস্থা এবং অর্থনৈতিক মন্দার দোহাই দিলেও সে বক্তব্যের সাথে একমত হননি দেশের বিশেষজ্ঞরা। সত্য কথা খোলাখুলি বলার পরিবেশের অভাব গত ১৫ বছর ধরেই রয়েছে। তাই আমাদের দলনিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞরাও সব সময় রয়েসয়ে, ঢেকেঢুকে, কখনো আভাসে-ইঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার পরও এই বিষয়টি তারা চেপে যাননি যে, আমাদের অর্থনীতির বর্তমান দুরবস্থার জন্য বৈশ্বিক সঙ্কট এককভাবে দায়ী নয়। বরং সমস্যা স্বীকার করে নিয়ে এর সুরাহা করার দিকে মনোযোগী হতে সরকারের অনিচ্ছা বা অনীহাই যে সঙ্কটের অন্যতম কারণ, সেটা তারা নানাভাবে জানিয়েছেন এবং গণমাধ্যমের সূত্রে সে খবর আমাদের জানা।
সুশাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এগুলো একটি সমাজ বা দেশের অগ্রগতির প্রাথমিক শর্ত। অগণতান্ত্রিক দেশ যে, উন্নয়নের দিকে এগুতে পারে না এমন নয়, তবে সে ক্ষেত্রেও নেতৃত্বের যোগ্যতা ও সদিচ্ছার বিষয়টি থেকেই যায়। অনেক স্বৈরাচারী দেশের নেতারা উন্নয়নের জন্য কঠোর শৃঙ্খলা নিশ্চিত করেছেন। দুর্নীতি রোধে নির্মম আচরণ করেছেন। ইরাকের সাদ্দাম হোসেন উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির দায়ে ঠিকদারকে জিপের পেছনে বেঁধে জিপ চালিয়ে দিয়েছেন এমন কাহিনী আমরা জানি। কিন্তু আমাদের দেশে সেটি এই মুহূর্তে অনুপস্থিত। আমরা নির্মমতা দেখিয়েছি সমালোচকদের প্রতি, ভিন্নমতাবলম্বী এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর। আর দুর্নীতির দুয়ার উন্মোচিত হয়ে গেছে সবার অলক্ষ্যে। যে যেভাবে পারছে লুটেপুটে নিয়েছে ব্যাংকের ঋণ, উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ, সরকারি দফতরের টেন্ডার এবং কী নয়! এখন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই। ব্যাংকগুলো থেকে প্রভাবশালীদের বিপুল পরিমাণ ঋণ দেয়া হয়েছে প্রায়ই নিয়মনীতি না মেনে। এমনকি এই প্রবণতা চলতি দুঃসময়েও বন্ধ হয়নি। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্যাংকের মালিকানা ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে এবং সেই ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এভাবে পুরো ব্যাংক ব্যবস্থা এখন অচলাবস্থার শিকার। দীর্ঘ দিনের অব্যবস্থা ও দুর্নীতিই ব্যাংক খাতের বেহাল দশার জন্য দায়ী বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
মেগা প্রকল্পে বিপুল ব্যয় এমনিতেই রিজার্ভের ওপর চাপ ফেলেছে। তার ওপর রিজার্ভ থেকে অর্থ সরিয়ে নিয়ে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ভিন্ন খাতে ব্যয় করা হয়েছে। রিজার্ভের ৭০০ কোটি ডলার গেছে রফতানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ গঠনে। রিজার্ভের অর্থে গঠন করা হয় লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ), গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)। উড়োজাহাজ কেনার টাকাও দেয়া হয় এখান থেকে। দেয়া হয় একটি বন্দরের নৌ-চ্যানেল খননের বরাদ্দ। এসব খাতে সব মিলিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে ৮০০ কোটি ডলার। আর রিজার্ভ চুরির ঘটনা তো আছেই। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, এই অর্থ রিজার্ভের হিসাব থেকে বাদ দিতে হবে। ফলে প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২৬ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। কেউ বলেন, ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখন ২৪ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
প্রতিদিনই রিজার্ভ কমেছে। এখন যে পরিমাণ রিজার্ভ আছে তা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব কিনা সেই হিসাব কষছেন সংশ্লিষ্টরা। বলা হচ্ছে, এই মুহূর্তে রিজার্ভের পরিমাণ ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে গেলে সেটি বিপজ্জনক। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর একটি দৈনিকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, রিজার্ভ দুই হাজার কোটি ডলারের (২০ বিলিয়ন) নিচে নেমে গেলে দেশ সঙ্কটে পড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, প্রতি মাসে এক থেকে তিন বিলিয়ন ডলার করে রিজার্ভ কমছে। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক মাসের মধ্যে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যেতে পারে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের অর্থ আসতে সময় লাগবে।
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, আমরা সঙ্কটের দিকে যাচ্ছি। তবে রিজার্ভ এখনো তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে না এমন পর্যায়ে নেমে যায়নি। সব মিলিয়ে বলাই যায়, আমরা দ্রুত সেই বিপজ্জনক খাদের দিকে এগুচ্ছি। এই অবস্থা কেবল ব্যাংক খাতে নয় বরং অর্থনীতির প্রতিটি খাতেই একই অবস্থা। তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য সব পণ্যে রফতানিতে ভাটার টান, জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতার ভ্রান্ত নীতি, প্রবাসী আয় এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে না পারা সঙ্কটের মাত্রা ক্রমাগত বাড়িয়েছে। জনশক্তি রফতানি সম্প্রতি কিছু বাড়লেও যত তরুণ বিদেশে যেতে প্রস্তুত জনশক্তি রফতানির বাজার সেভাবে বাড়ানো সম্ভব হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে।
রিজার্ভ সঙ্কটের কারণে বেশ কয়েক মাস হলো আমদানি সঙ্কুচিত করা হয়েছে। কিন্তু তার পরও সামাল দেয়া যাচ্ছে না। এখন সঙ্কটের মুখে ডলার ধার করতে হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের কাছ থেকে। এর বাইরেও বিশ্বব্যাংক, জাইকাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে ঋণ পাবার চেষ্টা চলছে। অনেকে আশার বাণী শোনাচ্ছেন যে, আইএমএফের ঋণ শিগগিরই পাওয়া যাবে। যাতে পাওয়া যায় সেজন্যে সরকার এরই মধ্যে সংস্থাটির দেয়া ৩০টি শর্ত মেনে নিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
এ মাসের মাঝামাঝি আইএমএফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্টোনেট মনসিও সায়েহ ঢাকায় আসছেন। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী এই ভদ্রলোকেরই সংস্থার পরবর্তী বোর্ড সভায় সভাপতিত্ব করার কথা। সেখানে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা এবং ঋণ দেয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরবেন। সুতরাং অ্যান্টোনেটের আসন্ন সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের সরকারের জন্য। এসেছে বিশ্বব্যাংকেরও উচ্চ পর্যায়ের একটি দলও। তবে শুধু এই সফর নয়, সরকারের জন্য আরো কতগুলি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি হলো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের একটি ভারসাম্য রক্ষা করার তাগিদ সব সময়ই ছিল। এখন সেটি চূড়ান্ত পর্যায়ে বলে মনে হয়।
বিশেষ করে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির পর পরিস্থিতি কিছুটা হলেও নাজুক হয়েছে। একের পর এক মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঢাকায় আসছেন। তাদের এজেন্ডা শুধুই মানবাধিকার, গণতন্ত্র, অবাধ নির্বাচন তা সম্ভবত নয়। সেই সাথে মার্কিন প্রভাববলয়ে থাকার প্রশ্নও যে আছে, সেটি কোনো গোপন বিষয় নয়। সরকার আবারও নতুন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করছে, এমন খবর এখনো টাটকা। এই সব বিষয় পরোক্ষে হলেও আইএমএফের ঋণ প্রাপ্তিতে ভূমিকা রাখবে। আর যে সরকার ১৫ বছরে নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে পারেনি সেটি রাতারাতি নিয়মানুগ পথ অনুসরণ করবে এমন আশা একটু বেশি হয়ে যায় নাকি? সুতরাং এই ঋণ পাওয়া খুব সহজ হচ্ছে, ব্যাপারটা বোধ হয় এমন নয়।
আইএমএফের ঋণ পাওয়া দেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেই বিবেচনায় যাচ্ছি না। কারণ আইএমএফের সাড়ে চারশ’ কোটি ডলার, আর বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে চলতি অর্থবছরে সম্ভাব্য প্রাপ্তি ২৫০ মিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা, এগুলো মরুভূমির বুকে কয়েক বালতি পানি ঢালার চেয়ে খুব বেশি কিছু হবে বলে মনে হয় না।
অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা যা কিছুই বলুন না কেন, দেশের একজন সাধারণ নাগরিক ও গ্যালারির দর্শক হিসাবে আমরা যেটিকে সমস্যার মূল কারণ বলে বিবেচনা করি সেটি খুবই সরল ও জটিলতাহীন। আমাদের বিবেচনায় সমস্যা মাত্র একটি। সেটি সুশাসনের অভাব।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা