অগাস্টিন-এরিজেনার ঈশ্বরতত্ত্ব বনাম দুই তরবারি
- মুসা আল হাফিজ
- ০২ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:০০
প্রথম দিকের খ্রিষ্টান দার্শনিক জাস্টিন মার্টিয়ার (আ. ১০০-১৬৫ খ্রি.) খ্রিষ্টধর্মকে দেখেন গ্রিক দর্শনের সমকণ্ঠী হিসেবে। এ দর্শনের উচ্চ ও উত্তম আওয়াজগুলো খ্রিষ্টধর্মের কণ্ঠেও বেজে উঠেছে। জাস্টিন ছিলেন নব্যপ্লেটোবাদী। ক্যাথলিক, অ্যাংলিকান অর্থোডক্স কিংবা ওরিয়েন্টাল অর্থোডক্স চার্চও তাকে সাধু হিসেবে উচ্চসম্মান দিয়ে থাকে। খ্রিষ্টধর্মের জন্য প্রাণ দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন এর প্রতি আপন আস্থা ও অঙ্গীকার। খ্রিষ্টীয় খোদাতত্ত্বে নব্যপ্লেটোবাদের প্রভাবগুলোকে তিনি দেখেছিলেন মুগ্ধতার নজরে। কিন্তু প্লেটোর দর্শন ও খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের মিলের প্রশ্নে ভিন্ন অবস্থান ছিল টারটুলিয়ান (আ. ১৬০-২২৫) এর।
তিনি দেখান, এথেন্সের কাছ থেকে জেরুসালেমের নেয়ার কিছুই নেই। এথেন্স বলতে নির্দেশ করেন গ্রিক দর্শনকে, দার্শনিকদের কেন্দ্রকে। জেরুসালেম বলতে বোঝান ধর্মকে, ধর্মকেন্দ্রকে। তিনি খ্রিষ্টান হন ধর্মের জন্য খ্রিষ্টানদের প্রাণদানের ঘটনাগুলোর প্রভাবে।
রোমানরা খ্রিষ্টানদের হত্যা করত যেকোনো ছুতায়। তাদেরকে তারা দেখত রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে। টারটুলিয়ান এর প্রতিবাদ করেন। দেখান খ্রিষ্টানরাই রোমান রাষ্ট্রের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নাগরিক। রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে তখনই দুর্বল হয়, যখন খ্রিষ্টানদের হত্যা করা হয়। খ্রিষ্টানদের প্রতি ইহুদি ও রোমান পৌত্তলিকদের ঘৃণা, আক্রোশ ও অযৌক্তিক ব্যবহারের প্রতিবাদ করেন তিনি। টারটুরিয়ান লিখেন : ‘(বিরোধীরা) মনে করে- চারদিকে সংগঠিত প্রতিটি দুর্দশা ও মানুষের প্রতিটি অমঙ্গলের কারণ হলো খ্রিষ্টানরা। ... নীলনদ যদি ক্ষেতে উপচে না পড়ে, যদি আবহাওয়ার পরিবর্তন না হয়, যদি ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, মহামারী হয়- তা হলে এই চিৎকার শোনা যায়- ‘খ্রিষ্টানদের সিংহের কাছে ফেলে দাও’।
খ্রিষ্টজগতের প্রতি তার প্রধান অবদান হলো তিন সত্তার একত্বের তত্ত্ব, যার ওপর ভর করে পরের লেখকরা ট্রিনিটি বা ত্রিত্ববাদের মতবাদ গড়ে তুলেছিলেন। খ্রিষ্টধর্ম স্পষ্টত বিশ্বাস করে ঈশ্বরের একত্বে। তিনি মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন উপাদানশূন্য অবস্থা থেকে। টারটুরিয়ান সেখানে ত্রিত্ববাদের বিশ্বাসকে ভাষা দান করেন। দর্শনের বিরোধিতা করেও দর্শনের আশ্রয় নিয়েই তিনি ঐশ্বরিক ঐক্যের মধ্যে বহুত্বের প্রস্তাবনা করেন। হেঁয়ালি তার মধ্যে ছিল তীব্রভাবে। এর নজির শুধু তার তত্ত্বে নয়, বিখ্যাত বচনগুলোতেও দেখা যায়।
তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে তখনই ঈশ্বর মহান, যখন তিনি ক্ষুদ্র।’ ‘যেভাবেই হোক, ঈশ্বরের পুত্র মারা গেছেন, এটি বিশ্বাস করতেই হবে। কারণ এটি অযৌক্তিক।’ ‘যিশুকে কবর দেয়া হয়েছিল এবং তিনি আবার জীবিত হয়েছিলেন; এই ঘটনা সত্য। কারণ এটি অসম্ভব।’ টারটুরিয়ান গির্জার কাছে অবনত খ্রিষ্টান আশা করতেন। গির্জার শিক্ষার বাইরে যা আছে, তাকে দিয়াবল বা শয়তানি ব্যাপার হিসেবে তিনি দেখান। তার বিখ্যাত উক্তি- ‘ঈশ্বরের গির্জা থেকে দিয়াবলের দিকে যাওয়া কতই না জঘন্য- যেন আকাশ থেকে শূকরের খোঁয়াড়ে।’
সেন্ট অগাস্টিন (৩৫৪-৪৩০) টারটুরিয়ানের উত্তরাধিকার নিয়ে সামনে আসেন। তিনি খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক। টারটুরিয়ানের ত্রিত্বকে তিনি করেন আরো প্রতিষ্ঠিত, আরো সম্প্রসারিত। অগাস্টিন ঈশ্বরের স্বরূপ বয়ান করেন সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপী হিসেবে। নৈতিকভাবে উত্তমতম হিসেবে। যিনি মহাবিশ্বের স্র্রষ্টা, মহাবিশ্বের ধারক। ঈশ্বর অনন্য এবং সরল। তিনি সব কিছু থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন। ফলে তাকে তৈরি করতে হয়নি। পৃথিবীকে তিনি তৈরি করেছেন প্রেমের অভিনয় হিসেবে। দুনিয়া তার সৃষ্টি হিসেবে তার মনের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। সময় ও স্থানের শুরু আছে এবং তা শুরু হয়েছিল সৃষ্টির শুরুতে। সৃষ্টির সব কিছুই ভালো। কোনো মন্দের জন্য ঈশ্বর দায়ী নন। তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে যা ভালো, তা প্রকাশ করা। বিশেষত সেই সব ভালো, যা ঈশ্বরের মধ্যে রয়েছে। ঈশ্বর একজন নিখুঁত সত্তা। তিনি বাস করেন ‘সর্বোচ্চ অর্থে’। আমরা যখন ঈশ্বরের কথা চিন্তা করি, তখন ‘এমন কিছু কল্পনা করার চেষ্টা করি, যার থেকে উৎকৃষ্ট বা মহৎ আর কিছুই নেই।’
এরিস্টটলের ঈশ্বরের সাথে অগাস্টিনের ঈশ্বরের মিল এখানে। কিন্তু এরিস্টটলের উপসংহার হলো- সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তাকে কেবল নিজের সম্পর্কেই সচেতন হতে হবে। তিনি কেবল নিজেকেই জানেন, নিজেকে নিয়েই মগ্ন থাকেন। অন্য কোনো কিছু নিয়ে তার সচেতনতা নেই। অগাস্টিন এর বিপরীত। তার উপসংহার হলো- ঈশ্বর পৃথিবীকে ভালোবাসেন। প্রত্যেক প্রাণীর প্রতি তার ভালোবাসা সর্বোচ্চ। বিশ্বের সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি হলেন তিন সহচিরন্তন সমসত্তা তথা পিতা, পুত্র (যিশুখ্রিষ্ট) ও পবিত্র আত্মা। তিনি এক, কিন্তু এই তিন দৈব ব্যক্তিতে বিদ্যমান তার একত্ব। সেন্ট জেরোমের মতে, অগাস্টিন মূলত প্রাচীন বিশ্বাসকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। যৌবনে তিনি ছিলেন প্যাগান বা প্রকৃতিবাদী। ৩৩ বছর বয়সে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং অচিরেই হন প্রধান এক ধর্মযাজক। বিশ্বাস ব্যতীত জ্ঞানকে তিনি অসম্ভব মনে করতেন। ইতিহাসকে দেখতেন অদৃষ্টবাদের প্রকাশ হিসেবে। এখানে যা ঘটছে, সবই নিয়তির অবধারিত বাধ্যবাধকতা, সবই ঈশ্বরের কাজ। অগাস্টিনের ঈশ্বর ভাবনা প্রসারিত হয় ঈশ্বরের শহর অবধি। যেখানে রাজত্ব করছেন তিনি। এ রাজ্যের ভিত্তি হলো স্বর্গীয় শান্তি ও মুক্তির আকাক্সক্ষা। এর বিপরীতে আছে শয়তানের রাজ্য। যা সূচিত হয় অভিশপ্ত দেবতার অবাধ্যতা থেকে। আদিপিতার আদিপাপের ফল পার্থিব-শয়তানি রাষ্ট্র। তার প্রকাশিত রূপ হলো ধর্মহীন রোম সাম্রাজ্য। আত্মিক শক্তি ও আধ্যাত্মিক মহিমায় এর পতন ঘটবে।
যাদের মন খারাপ, তারা প্রবেশ করবে ঈশ্বরের রাজ্যে, যাদের আত্মা নিকৃষ্ট তারা শয়তানের শহরে থাকবে। হিব্রু জাতির আধিপত্য নিশ্চিত হলে ঈশ্বরের রাজ্য প্রদর্শিত হবে। স্বর্গীয় সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রেমই হলো এ রাজ্যের বৈশিষ্ট্য। সেখানে ক্ষমতার নেশা ও কামনার অগ্নিশিখার কোনো অস্তিত্ব নেই। এই প্রেমের দ্বারা সব কিছু ঈশ্বরের রাজত্বে একাকার হয়ে যাবে। পৃথিবীকে ঈশ্বরের রাজ্যে পরিণত করবে বলে বিশ্বের সব কিছুই এক নিরবচ্ছিন্ন গতিতে ধাবিত হচ্ছে। সেন্ট অগাস্টিনের ঈশ্বর তাই দুনিয়া নিয়ে আছেন। শয়তানের মন্দের সাথে লড়াই করছে তার রাজ্য। কিন্তু রাষ্ট্রকে গির্জার অধীনে এনে খ্রিষ্টধর্মের প্রাধান্য স্থাপনের দাবিই অগাস্টিনের মূল সুর।
মূলত প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র থেকে আদর্শ কথাটির জায়গায় ধর্ম কথাটি বসিয়ে দেন তিনি। গির্জাকে তিনি দেন পবিত্রতা। পার্থিব বা জাগতিক বিষয়ের শাসক হিসেবে রাজার কর্তৃত্ব স্বীকার করেন তিনি। আর অপার্থিব বা বিধাতার রাষ্ট্রের শাসক বানান পোপ ও গির্জাকে। এই হলো তার দুই তরবারি তত্ত্ব। এক তরবারি রাজা, আরেক তরবারি পোপ, পাদ্রি। এক তরবারি জাগতিক বা পার্থিব রাষ্ট্র, আরেক তরবারি দৈব বা বিধাতার রাষ্ট্র। যেহেতু মানুষের সত্তায় আছে ভালো ও মন্দ, ফলে রাষ্ট্রকে হতে হয়েছে দুই প্রকার। পার্থিব রাষ্ট্র বস্তু ও দৈহিক গুণাবলির প্রতীক। সে প্রতিষ্ঠিত হয় অহঙ্কার ও স্বার্থপরতার ওপর। আর বিধাতার রাষ্ট্র মানুষের আত্মার প্রতিনিধিত্ব করে। এই রাষ্ট্রের সদস্যরা বিনয় ও নম্রতার প্রতীক। তারা দৈবপ্রেমে অভিষিক্ত। সদস্যদের অভিন্ন ঈশ্বরপ্রেমই এই রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি।
অগাস্টিনের চিন্তার দুই তরবারি ইউরোপে রাজত্ব করল বহু শতক। উভয় তরবারিই মানুষকে কাটছিল। মধ্যযুগে ‘শয়তানি’ রাষ্ট্র যেমন মানুষের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল, ঈশ্বরের নামে তৈরি পবিত্র রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান গির্জাও মানুষের অগ্রগতির পথরোধ করছিল। কিন্তু ঈশ্বরের নামে অগাস্টিন গির্জার হাতে জীবনকে তুলে দিয়েছিলেন আগেই!
জন স্কোটাস এরিজেনা (৮১০-৮৭৭ খ্রি.) ছিলেন নব্যপ্লেটোনিক চিন্তাধারায় সমর্পিত দার্শনিক। তার মতে- সব কিছুর উৎপত্তি ঈশ্বর থেকে, তিনিই সব কিছুর স্থিতিশীলতার কারণ, সমাপ্তিরও কারণ। সব কিছু তার থেকে জন্মে, তার মধ্যেই থাকে এবং তার কাছেই ফিরে যায়। জগৎকে তিনি বানিয়েছেন শূন্য থেকে। তিনি স্রষ্টা, নিজে সৃষ্ট নন। তিনি এক সৃজনীশক্তি। মনের নিজস্ব ভাব, পরিকল্পনা বা চিরন্তন আদর্শ থেকে জগৎ গড়েছেন তিনি। এরিজেনা একে বলেছেন লগোস। চিরন্তন এই লগোস হচ্ছে তার সত্তার প্রকাশ। এ হচ্ছে সেই প্রজ্ঞা, যা ঐশ্বরিক। জগতের সব শৃঙ্খলা ও নিয়মের মূলে আছে তার ক্রিয়া। ঈশ্বর সব কিছুতেই বিরাজমান। যেহেতু তিনি সব কিছুর অস্তিত্বের ভিত্তি। ঈশ্বর ও তার সৃষ্টি এক ও অভিন্ন। তিনি তার সৃষ্টিতে আছেন, সমগ্র সৃষ্টি তার মধ্যে আছে। জগতের বিভিন্নতা ও সৃষ্টির বহুত্ব মানুষের বোধের বিভ্রম। আসলে সব কিছুই অবিভক্ত। অচ্ছিন্ন, অচ্ছেদ্য। সব কিছুই এক। সমন্বিত। আপাত সব ভিন্নতা ও বিরোধের আড়ালে জগৎময় রয়েছে গভীর ঐক্য। ঈশ্বর আছেন লোকে, অলোকে। সব জীব ঈশ্বরের সত্তার অংশ। সবার মধ্যে থেকেও তিনি একক, পরিপূর্ণ। জগতের ভেতরে ঐশ্বরিক সত্তা আংশিকভাবে প্রতিফলিত, জগতের বাইরেও তিনি প্রতিফলিত।
ঈশ্বরের আত্মপ্রকাশের আছে চার স্তর। প্রথম স্তর সৃজনে প্রকাশ পায়। এই স্তরে তিনি সৃজিত নন, কিন্তু সৃজনময়। সব সৃষ্টির তিনি শুরু ও কেন্দ্র, ভিত্তি ও সূত্র। সীমায়িত অভিজ্ঞতা তাকে প্রকাশ করতে পারে না। কারণ তিনি অসীম। এরিস্টটল ঈশ্বরকে আত্মসচেতন হিসেবে দেখান। কিন্তু এরিজেনার ঈশ্বর আত্মসচেতনও নন। কারণ তিনি চেতনার এত ঊর্ধ্বে, যার ফলে তার আত্মজ্ঞান বলতে কিছু নেই। কেননা, চেতনা একটি সীমার মধ্যে অর্থদান করে। জ্ঞানও সীমায়িত। চেতনা ও জ্ঞানের রয়েছে নানা শ্রেণী ও শর্তাবলি। ফলে ঈশ্বর চেতনায় নেই, জ্ঞানেও নেই। দ্বিতীয় স্তরে ঈশ্বর সৃষ্ট ও স্রষ্টা। এখানেও তিনি সম্পূর্ণরূপে জগতের অতীত। কিন্তু তিনি ধারণ করছেন অস্তিত্বের অসীম সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনা প্রত্যহ বাস্তবে রূপায়িত হচ্ছে। নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে, নতুন বাস্তবায়নে তা প্রকাশিত হচ্ছে। এর ফলে জন্ম নেয় তৃতীয় স্তর। এখানে জগৎ লাভ করে বুদ্ধিসম্মত আকার। আর ঈশ্বর প্রথমবার হন নিজের প্রতি সচেতন। তিনি প্রথমবার নিজেকে জানেন এই স্তরে এসে।
এই স্তরে ঈশ্বর আর স্রষ্টা থাকেন না, সৃষ্ট হয়ে যান। মানে প্রকৃতি ও দেশ-কালের মধ্যে হারিয়ে যান। ফলে সমগ্র জগৎকে সৃষ্টি করে ঈশ্বর নিজেও সৃষ্ট হয়ে যান। দুনিয়া সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকেও সৃষ্টি করেন। সব কিছু ঈশ্বর থেকে, মানুষও। সব কিছু ঐশ্বরিক সত্তায় মিশে যাবে, মানুষও। এই মিশে যাওয়াতেই পরিত্রাণ। কিন্তু সব কিছু ঈশ্বরে ফিরে যায় কেবলই যিশুর সাহায্যে। সব কিছু ঈশ্বরে মিলিত হওয়ার জন্য যিশুর সাহায্যের কোনো বিকল্প নেই। কারণ যিশুই দেশ-কালে ঈশ্বরের প্রকাশিত রূপ। ঈশ্বরের দিকে না তাকিয়ে মানুষ নিজের দিকে তাকায়। ফলে জন্ম নেয় পাপ। তার ঘটে পতন। এই পাপ ও পতন মানুষের স্বাধীনতার ফল। সে স্বাধীনতা পেয়েছিল বলেই ঈশ্বরকে উপেক্ষা করতে পেরেছিল। এতে সে স্বর্গচ্যুত হয়। এই পতন থেকে তার মুক্তি ঘটবে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এ মৃত্যু জীবদ্দশায় লাভ করার জন্য দেহের বিরুদ্ধে বহু কঠোরতা করেছে খ্রিষ্টীয় বৈরাগ্য। আয়ারল্যান্ডে জন্ম হলেও এরিজেনা বিকশিত হন অক্সফোর্ড ও প্যারিসে।
ফরাসি রাজা চার্লস তাকে রাজকীয় বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। মুসলিম জ্ঞানের প্রভাব তখন ফ্রান্সের বিদ্যাজগতে বিস্তৃত হচ্ছে। এরিজেনা গ্রিক ও ল্যাটিনের পাশাপাশি আরবি শিখলেন। ইবনে সিনা ও ফারাবির অধিবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র এবং প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্বের অনুরাগী ছিলেন তিনি। তাদের মতোই তিনি অ্যারিস্টটলের বিপরীতে বিশ্বাস ও ইচ্ছাশক্তিকে জোর দিয়েছিলেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও ঈশ্বরের গুণাবলির প্রমাণে প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্বে এরিজেনা যে অবদান রাখেন, তাকে ইবনে সিনার অসীম সত্তার বিশ্লেষণের সাথে এরিস্টটলীয়-খ্রিষ্টীয় খোদাতত্ত্বকে জোড়া দেয়ার চেষ্টা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়।
তিনি জোরালোভাবে সমর্থন করতেন ইবনে সিনার common nature বা সাধারণ প্রকৃতি তত্ত্বে। স্বাধীনতাকে তিনি মানুষের স্বর্গচ্যুতির জন্য দায়ী বানালেও ইউরোপের মধ্যযুগে তিনিই স্বাধীনতাকে প্রথমবার আমন্ত্রণ করলেন জীবনে। মানুষের বুদ্ধি ও ইচ্ছার স্বাধীনতাকে সমর্থন করেন ঠিক ইবনে সিনার প্রতিধ্বনি করে। দেখান মানুষ তার বুদ্ধির শক্তি বা প্রাকৃতিক সামর্থ্যরে দ্বারা সত্যের জ্ঞানার্জন করতে সক্ষম।
পূর্ববর্তী খ্রিষ্টান দার্শনিকদের মতো তিনি প্রশ্নহীনভাবে পাদ্রিদের মর্জিকে মেনে নিতে তৈরি ছিলেন না। আবার নাস্তিকতা ও সংশয়বাদের সমালোচনা করেছেন তীব্রভাবে। চার্চের অনুশাসনে আস্থাশীল হওয়া সত্ত্বেও চার্চের হাতে লাঞ্ছিত হলেন এরিজেনা। মধ্যযুগের অন্ধকার তার জীবন বিপন্ন করল। তিনি ছিলেন স্কলাস্টিক দার্শনিক গোষ্ঠীর প্রথম দিকের সন্তু। তাদের চিন্তা ও প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা খোদাতত্ত্ব নতুন আবর্তনের সম্মুখীন হলো, যা খ্রিষ্টীয় ঈশ্বরতত্ত্বে নিয়ে আসবে নবযুগ। এই নবযুগ বহু চিন্তাবিদের মেধাবিনিয়োগে সমৃদ্ধ। এর প্রভাবে যাজকতন্ত্রের তরবারির নিচ থেকে ধীরে ধীরে মাথা তুলতে থাকে মানুষ। কারণ যুগ যুগ ধরে ঈশ্বরের নাম করে যাজকতন্ত্র মানুষের প্রতিটি দুর্দশা ও অমঙ্গলের জন্য দায়ী করে আসছিল বিজ্ঞানচেতনা ও মানুষের প্রগতির প্রয়াসকে। ওই যে টারটুরিয়ান বলেছিলেন ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, মহামারী হলে রোমান পৌত্তলিকরা বলত- ‘খ্রিষ্টানদের সিংহের কাছে ফেলে দাও’। এবার উল্টো পরিস্থিতি দেখা গেল। প্রতিটি দুর্ভিক্ষ, মহামারী বা অঘটনের জন্য স্বেচ্ছাচারী যাজকতন্ত্র বলতে লাগল- বিরোধীদের আগুনের মধ্যে ফেলে দাও!
রেনেসাঁ-রিফরমেশনের মধ্য দিয়ে গির্জার কর্তৃত্ব খর্ব করা হলো। কিন্তু অগাস্টিনের সেই দুই তরবারি থেকে যায় পশ্চিমের মস্তিষ্কে। ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ঈশ্বর ও দুনিয়াকে আলাদা করে আধুনিকতা। এরিস্টটলীয় ঈশ্বর আরো প্রবল হতে থাকেন। জগৎ নিয়ে যার কোনো অভিপ্রায় নেই, কাজ নেই, অবগতি নেই। তাকে পাঠানো হয় ধ্যানে, উপাসনালয়ে। আর দুনিয়ার বাস্তব জীবনকে ঈশ্বররহিত প্রথম তরবারির তলায় সঁপে দেয়া হয়। যার ফলাফল ভালো হয়নি মোটেও! এরিজেনা যুক্তির সমর্থন করলেও ঐশ্বরিক তরবারি বা পার্থিব রাষ্ট্র আর জাগতিক তরবারি বা যাজকীয় রাষ্ট্রের ভিন্নতাকে চ্যালেঞ্জ করেননি। তার ঈশ্বরও জগৎব্যবস্থার ঘটনাচক্র থেকে বিচ্ছিন্ন এক ভাব মাত্র! অশুভের সাথে ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে এসব অশুভ, অন্যায়, অবিচার, হত্যা, লুণ্ঠন, দুঃশাসন, মিথ্যা ইত্যাদির উচ্ছেদে বা মোকাবেলায় ঈশ্বরের কোনো অবগতি নেই, সক্রিয়তা নেই!
খ্রিষ্টীয় ঈশ্বরতত্ত্বের গোড়ার দিকের এসব দার্শনিক ঈশ্বরভাবনার যে জমি তৈরি করেন, এর মধ্যে নিহিত ছিল আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ!
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা