যেন তেমন না হয় : কথা দিতে হবে
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ৩১ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:৫৬
কোনো সন্দেহ নেই, দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় বহু ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে, বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রে সেই ব্যত্যয়গুলো অত্যন্ত প্রকটতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। তার প্রতিবিধান করা এই মুহূর্তে খুব জরুরি। সেটি উপলব্ধি করে সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তার ভাষায় ‘রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এমন শিরোনাম নিয়ে রাষ্ট্রের ব্যত্যয় ঘোচানোর কর্মসূচি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহলে কৌতূহল-আগ্রহ সৃষ্টি হলেও ক্ষমতাসীন মহল থেকে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়ে চলেছে এবং সেই কর্মসূচি নিয়ে হাসি-তামাশায় মেতে আছে।
তারা কিছুতেই একে ভালো চোখে দেখছে না, হয়তো এ জন্য যে, তাদের আমলে সৃষ্ট ব্যত্যয়গুলোসহ রাষ্ট্রব্যবস্থায় আরো কিছু অনিয়ম-অব্যবস্থাকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেই ২৭ দফায়। স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে যদি তারা হেলা-তামাশা না করে তবে তাদের এসবের জন্য তো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। সেটি মৌন থাকলে, স্বাভাবিকভাবে নিলে, বিএনপির সেই অভিযোগগুলোকে তাদের স্বীকার করে নেয়া হবে, আনীত সব দোষ নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিতে হবে এবং সেটি বিরাট এক রাজনৈতিক পরাজয় শুধু নয়; বরং তাদের বোধ-বিবেচনা, সক্ষমতা, যোগ্যতা-দক্ষতাকে এক বিরাট প্রশ্নের মুখে ফেলবে। আর এই মুহূর্তে যা তাদের জন্য মারাত্মক, তথা তাদের ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে টানাপড়েন সৃষ্টি হবে। কর্মী-সমর্থকদের মনোবল ভেঙে পড়বে।
যাই হোক, একটি কথা সম্ভবত মাথায় রাখা প্রয়োজন- শুধু রাষ্ট্র মেরামত নয়, যারা রাষ্ট্র চালান অর্থাৎ সেই রাজনৈতিক নির্বাহীদের এর আওতায় আনতে হবে। রাষ্ট্র তো ‘ইনভিজিবল’ তথা অলক্ষ্যে থাকে। আর যারা রাষ্ট্র চালান বা চালাবেন তারা ভিজিবল তথা দৃশ্যমান। রাষ্ট্রকে মেরামত বা যথাযথ নিয়মের মধ্যে আনা বা সঠিক পথে পরিচালনা করা- যারা সেই সঠিক পথ অবলম্বন করবে সেই নির্বাহীদের যদি তাদেরও মেরামতির আওতায় নেয়া না হয় তবে তা মেরামত কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ অসমাপ্ত রাখারই শামিল বলে বিবেচিত হবে।
এ কথা মনে রাখা অত্যাবশ্যক, আমরা আজ রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবস্থাপনায় যে ব্যত্যয়, দুর্বলতা, অপরিণামদর্শিতা, অনিয়ম ও অবিরাম ভুলগুলোর কথা বলছি, রাষ্ট্রের পক্ষে সেগুলো প্রধানত রাজনৈতিক নির্বাহীরাই করছেন। বুদ্ধিমত্তার ঘাটতি, অদূরদর্শিতা, পরিণতি আন্দাজ করতে না পারার অক্ষমতা রাষ্ট্রকে আজ এক গভীর খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছে। সে জন্য আগামীতে যারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবেন তাদের এসব বিষয়ে অবশ্যই সঠিক ধারণা রাখতে হবে। যোগ্য, দক্ষ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, কর্তব্যনিষ্ঠতা, সমস্যার গভীরে পৌঁছার মতো স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের তৈরি করে বা বেছে নেয়ার বোধকে অবশ্যই রাষ্ট্র মেরামতের কর্মসূচিতে সন্নিবেশিত করতে হবে। ঘোষিত ২৭ দফা অবশ্যই এ মুহূর্তে সময়ের একটি বড় দাবি, কিন্তু এই দফা এখনই সিলগালা করে রাখার চিন্তা করা ঠিক হবে না, এর ভেতরে আরো কিছু সংযোজনের দরজাটা খোলা রাখতে হবে, কেননা সময় ও প্রয়োজন নিত্যদিন নানা রূপ নেয়, তাকে ধারণা করতে হলে অবশ্যই ২৭ দফার দরজা খোলা রাখতে হবে।
আরো একটি কথা এখানে স্মরণ রাখা জরুরি, কেননা দেশের এক ক্রান্তিকালে বিএনপির ২৭ দফা একটি অঙ্গীকারনামা, যা জাতির সম্মুখে তুলে ধরা হয়েছে এক যুগসন্ধিক্ষণে। অতীত থেকে একটি উদাহরণ তুলে এনে যে কথা বলতে চাই তার একটি উদাহরণ হচ্ছে- বর্তমান ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে একগুচ্ছ ওয়াদা বা অঙ্গীকারনামা, তারা জাতির সম্মুখে এনেছিল ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদের প্রাক্কালে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে। আজ এমন প্রশ্ন জাগে, সেই ইশতেহার নিয়ে দলটি সেদিন কতটা ‘সিনসিয়ার’ ছিল, সেটি বোধগম্য নয়। কেননা, এখন যদি সেই ইশতেহারের সুচ্যগ্র আলোচনা বা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়- সেই প্রতিশ্রুত পথ নিয়ে তারা কতটা নিষ্ঠাবান বা সিনসিয়ার ছিল? আজ অবধি তার কতটুকু বাস্তবতার মুখ দেখেছে? এমন জিজ্ঞাসার পেছনে আমাদের অভিপ্রায়টা এ রকম যে, আমাদের সব রাজনৈতিক দলই কথা দিয়ে কথা রাখে না কেন?
মানুষের জিজ্ঞাসা হতে পারে- এ প্রসঙ্গ কেন একটি ভিন্নবিষয়ক এক নিবন্ধের মধ্যে টেনে আনা হলো? আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের সেই অঙ্গীকারনামায় যেসব বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার বহু কিছু এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। এ নিয়ে জাতিকে সজাগ করা আর কেউ যাতে এমন সব ওয়াদা দিয়ে ‘রিপ ভ্যান উইংকেলে’র মতো ঘুমিয়ে না পড়ে, সে জন্য জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। সে যাক, আমরা প্রস্তুত সেই ইশতেহার নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ আলোচনার জন্য। হ্যাঁ, সেই ইশতেহারের বিষয় নিয়ে কিছু কাজ হয়েছে বটে তবে এমনো হয়েছে- এখান থেকে কিছু, ওখান থেকে কিছু করা হতে পারে; তবে কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ নয়।
শিক্ষার বিষয়ে গুরুত্বের কথা বলতে ইশতেহারে বলা হয়েছে- ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ বৃদ্ধি করা হবে।’ কিন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে, ‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সামান্য অর্থ গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় সেটিও এখন বহুলাংশে কমিয়ে দেয়া হয়েছে।’ আগে যে অর্থ বরাদ্দ দিত তা দিয়ে প্রকৃতপক্ষে কোনো গবেষণা কার্যক্রম চালানো একেবারেই অসম্ভব। অথচ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষাকার্যক্রমের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে- মৌলিক কোনো বিষয়ের ভেদ উদ্ঘাটনের জন্য গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা।
সবাই নিশ্চয়ই জানেন, কোভিডের একটি টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কো-পার্টনার হচ্ছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি। সেই টিকা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারের কর্মীরা। সেই প্রতিশ্রুতিপত্রে রয়েছে- তরুণ উদ্যোক্তা হওয়া ও আত্ম-কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে বিনা জামানতে ও সহজ শর্তে ঋণ দেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- আজ কোনো ব্যাংকের পক্ষে জরুরি পণ্য আমদানি করতে এলসি খোলার জন্য পুরো টাকা পেমেন্ট করার পরও ব্যাংক আমদানিকারকদের ডলার সরবরাহ করতে পারছে না। ব্যাংকে বড় কোনো ডিপোজিট হচ্ছে না; লোন দিতে পারছেন, লাভ-সুদ না দিলেও বিনিময়ে দেয়া হচ্ছে আবার চ্যারিটির অর্থ, এ তো কল্পনাই করা যায় না। আমাদের সংবিধানে আছে (১৬ অনুচ্ছেদে), নগর ও গ্রামের মধ্যে বিরাট বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করতে হবে। বিষয়টি আওয়ামী লীগের ইশতেহারেও সম্পৃক্ত হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি, বড় তথা মেগা প্রকল্প হচ্ছে, হবে। (অবশ্য এসব বৈদেশিক ঋণে হচ্ছে, আর এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে সাধারণ মানুষকেই। অর্থাৎ ঋণ করে ঘি খাওয়ার মতো) কিন্তু অপর দিকে, শহর ও গ্রামের মধ্যে কেবল বৈষম্য বাড়ছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষের বড় প্রকল্প সেসব কতটা কী সমৃদ্ধি দেবে?
এ দিকে খবর হচ্ছে- গ্রামের দরিদ্র এখন হতদরিদ্র হয়ে পড়ছে। ইশতেহারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আমরা আগেই বলে এসেছি, কোথাও কিছু অগ্রগতি হলেও সেটি ধরে রাখতে পারছে না বর্তমান সরকার। ২০২২ সালে বিদ্যুতের সে তেলেসমাতি খেলা মানুষ দেখেছে। ইশতেহারে বলা হয়েছে- বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ‘লুটপাট’ করেছে- কথার পিঠে কথা বলতে হলে বলা যায় ‘তখন যদি পুকুর চুরি হয়ে থাকে, আজ তো সমুদ্র চুরির কথা শোনা যায়।’ নৌপরিবহন বিষয়ে বলা হয়েছে- প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হবে। দেশের মানুষ এক কোদাল মাটি কাটাও দেখেনি। ইশতেহারে আরো বলা হয়েছে- ঢাকার চার পাশের নদী-খালগুলোর দূষণ ও দখলমুক্ত করে খননের মাধ্যমে নাব্য ফিরিয়ে এনে নদীতীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির মাধ্যমে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। কিন্তু এসব ফাঁকা বুলি।
দেশবাসীর কাছে ওয়াদা ছিল- ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশের পর্যায়ে উন্নীত হবে। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে- ইতোমধ্যে মধ্যবিত্ত সমাজ ভ্যানিস হয়ে গেছে। নিম্নবিত্ত হতদরিদ্রে পরিণত হয়েছে। ইশতেহারে আরো বলা আছে- রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি ও নতুন বাজার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হবে। পণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করা তো দূরের কথা, এখন সব পণ্য আগের পর্যায়ে উৎপাদিত হচ্ছে না। রেমিট্যান্স আসার ক্ষেত্রে ধস নেমেছে। শিল্প খাত নিয়ে অনেক গল্পের জাল বোনা হয়েছিল, এখন সে জাল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ইশতেহারে অনেক কথা বলা ও শোনাও হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, সেটি হলো- জলবায়ু ইস্যু। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। ইতঃপূর্বে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এক মিটার ভূভাগ সমুদ্রে বিলীন হবে। এ পরিস্থিতিতে বিপুল সংখ্যকমানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। কিন্তু সেই পরিপ্রেক্ষিতে কী প্রতিবিধান করা হবে তার কোনো স্বচ্ছ বক্তব্য সরকারের নেই।
আইনের শাসন ও মানবাধিক সংক্রান্ত বিষয়ে ‘নামকাওয়াস্তে’ যৎ কিছু সন্নিবেশিত আছে ইশতেহারে। এ নিয়ে বেশি কথা বলার দরকার নেই। দেশ-বিদেশে এই দুই ইস্যু নিয়ে ক্ষমতাসীনদের আচরণ, পদক্ষেপ, অবস্থান সম্পর্কে এখন তর্ক-বিতর্কের তুমুল ঝড় বইছে। এসব বিষয় এখন কোন অবস্থানে গিয়ে পৌঁছে সেটি সব মানুষই অবহিত। ইশতেহারে জবাবদিহিতার বিষয়ে যা বলা হয়েছে- সে সম্পর্কে শুধু এতটুকু বলা যায়, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় জবাবদিহিতার প্রধান জায়গাটি হচ্ছে সংসদ। অথচ সে সংসদ এখন এক জোটের, তাই সেখানে জবাবদিহিতার প্রশ্ন তোলা অবান্তর।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে চমৎকার কথা বলা আছে বটে; অথচ সরকার তৈরি করেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংবাদসেবীরা যাকে আখ্যায়িত করছে- সংবাদপত্রসহ সব মিডিয়ার কণ্ঠ রোধ করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে এই আইন। সবচেয়ে হাস্যকর যে কথাটি সেটি হলো- ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণ করা। এ ক্ষেত্রে একটি প্রবাদবাক্যই যথেষ্ট, যেমন- চালুনি বলে সুচ তোমার পেছনে তো একটি ছিদ্র আছে। দেশে হেন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে ভয়াবহ আকারে দুর্নীতি নেই। ঋণখেলাপি, টাকা পাচারকারী, ব্যাংকের অর্থ শুষে খাওয়াদের এক স্বেচ্ছাধীন রাজত্ব কায়েম হয়েছে। এখন তো সব কিছু লুটপাট করা ওপেন করে দেয়া হয়েছে।
উল্লিখিত ইশতেহারে আরো যা আছে সেগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত সূচ্যগ্র আলোচনা করলেও এমন আরো দু’টি কলাম তৈরি করতে হবে। সব কথার এক কথা- হয়তো এটি বলতে হয় বলেই তো বলা হয়েছে, ‘মিন’ করে বলা হয়নি। এই ইশতেহার নিয়ে এ জন্য কথা হলো, কেউ যেন আর ভবিষ্যতে ‘এমন করে বলতে হয়’ বলে ধাঁচের কোনো প্রতিশ্রুতি না দেয়, যেটি ক্ষমতাসীনরা দিয়েছিল। আমাদের বিনীত অনুরোধ, বিএনপি যেন তাদের প্রতিপক্ষের মতো তেমন কিছু না করে, এ কথা দিতে হবে। তবে সবারই এ বিশ্বাস জন্মেছে, প্রায় ১৪ বছর দলটি পথে পথে ঘুরেছে দেশকে ও দেশের মানুষকে নিয়ে তারা অনেক অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়েছে। বুঝতে পেরেছে, দেশের মানুষই কেবল তাদের প্রকৃত বন্ধু।
এখন বিএনপি ২৭ দফা নিয়েও সূচ্যগ্র আলোচনায় মিলিত হতে চাই। এই কলামে ইতঃপূর্বে একাধিকবার আমরা বলার চেষ্টা করেছি, আমাদের সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন, একে মান্য করা প্রত্যেকটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিশেষ করে পজিশন থেকে সংবিধান নিয়ে হেলাফেলা করা হয়েছে, ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে, কোনো কাজে একে কোনোভাবেই প্রাধান্য দেয়া হয়নি। বিএনপি সেই সংবিধানের ব্যাপারে ২৭ দফায় বলেছে- সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করবে। আমাদের সংবিধান ১৭ বার প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থে সংশোধন করা হয়েছে। ২৭ দফায় আছে- দলটি দেশে গণতন্ত্র ও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোটাধিকার পুনঃপ্রবর্তন করবে এবং স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্থায়ী সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার লক্ষ্যে একটি নির্বাচনকালীন দক্ষ দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করবে।
উল্লেখ্য, তা তারা আগেও করেছিল কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তা বাতিল হয়ে যায়। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগের ক্ষমতা-দায়িত্বের সমন্বয় করা হবে। বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশে প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদ উচ্চকক্ষবিশিষ্ট রেখেছে। কিন্তু বিষয়টি আমাদের দেশে নতুন। এটি সংযোজন হবে হয়তো। এমন বিজ্ঞজনদের রাষ্ট্রপরিচালনা ক্ষেত্রে সুযোগ দেয়া হলে অবশ্য তারা রাষ্ট্রব্যবস্থায় মূল্যবান অবদান রাখতে পারবেন। এ ছাড়া একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয় ২৭ দফায় সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ জন্য একটি ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন হবে, যেটি জাতীয় ঐক্যের জন্য কাজ করবে।
আরেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী বিষয়- বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেটি হলো- নির্বাচন কমিশনের সংস্কার। এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে বহু প্রশ্ন জনগণের ভেতর জমে আছে, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের প্রতি এখন জনগণের কিছুমাত্র আস্থা নেই। তাদের দলবিশেষের প্রতি প্রচ্ছন্ন অনুরাগ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। সংবিধান তাদের যতটুকু ক্ষমতা কর্তৃত্ব দিয়েছে তার অনুশীলন তারা করতে পারছে না। সে জন্যই ২৭ দফায় কমিশনকে সংস্কারের আওতায় আনাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিচার বিভাগ নিয়ে কথা বলা খুবই স্পর্শকাতর বিষয় বটে, তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞ আইনজীবীরা যে অনুযোগ করছেন- আইনের দৃষ্টিতে জামিনযোগ্য সাধারণ মানুষ ও রাজনীতিবিদদের জামিন নামঞ্জুর করা হচ্ছে। হয়তো এসবসহ আরো কিছু বিষয়ে বিচার বিভাগ ও প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয়গুলো রাষ্ট্র মেরামতের দলিলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেখানে সংযোজিত হয়েছে, বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। বর্তমান বিচারব্যবস্থা সংস্কারের নিমিত্ত একটি জুডিশিয়াল কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। কমিশন জুডিশিয়াল সার্ভিসে নিযুক্ত ব্যক্তিদের ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরসহ চাকরির শৃঙ্খলাবিধানে সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী বিচারপতি নিয়োগ করা হবে।
সংবাদপত্রের ও অন্যান্য মিডিয়ার স্বাধীনতার অন্তরায় বলে বিবেচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতিসহ সেই প্রতিশ্রুতিপত্রে আরো সংযোজিত আছে- গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী এবং অভিজ্ঞ ও গ্রহণযোগ্য গণমাধ্যমব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন করে সৎ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে তথ্য প্রযুক্তি আইনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার নিশ্চয়তা রয়েছে ২৭ দফা সংস্কার প্রস্তাবে। দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা আজকে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
দুর্নীতি নিয়ে সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়েছে- ‘গত দেড় দশকে সংগঠিত অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে একটি শ্বেতপত্র করা হবে। চিহ্নিত দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়াসহ পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ও দুর্নীতি দমন আইন সংস্কারের পাশাপাশি পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে দুদকের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানে যে ন্যায়পাল বিধান রয়েছে সেটি কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে।
সম্প্রতি গুম হয়ে যাওয়া মানুষের স্বজনদের দুঃখ বেদনার আহাজারি, তা প্রতিটি মানুষকে বিমর্ষ করে তুলেছে। বিএনপি সংস্কার প্রস্তাবে সেটি স্থান পেয়েছে। সেখানে বর্ণিত আছে- তারা ক্ষমতায় গেলে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং অমানবিক নিষ্ঠুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে। মানবাধিকার কমিশনে, গত দেড় দশকে সংগঠিত সব বিচারবহির্ভূত হত্যা, ক্রসফায়ারের নামে নির্বিচারের হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্মম শারীরিক নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর ও অমানবিক অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত সবাইর প্রচলিত আইনে সুবিচার নিশ্চিত করা হবে। বর্তমান সময়ে মানুষের জীবন অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
বিএনপি তার রাষ্ট্র মেরামতের ধারণাপত্রে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও গবেষক, অভিজ্ঞ ব্যাংকার, করপোরেট নেতা, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কমিশন করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। আরো অনেক বিষয়সহ ২৭ দফায় রয়েছে- শিক্ষিত বেকারদের বেকারভাতা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পুষ্টির ওপর গুরুত্ব প্রদান, মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ, নিম্ন ও মধ্য পর্যায়ে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া, কৃষিপণ্যে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি।
দেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এখন কোনো নীতির অনুসরণ ও দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হয় বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ যেন দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছে। এর পরিণতি অবশ্যই ভয়াবহ হতে পারে। বিশ্বে বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে যেতে পারে। বিএনপি পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে তাদের ২৭ দফায় বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। দেশের ভূখণ্ডে সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হবে না এবং কোনো সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। প্রতিরক্ষা প্রশ্নে বলা হয়েছে- দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, সময়োপযোগী ও সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা হবে।
পত্রিকার মাধ্যমেই ২৭ দফার বিষয়গুলো জানতে পেরেছি। কিন্তু একটি বিষয় আমাদের নজরে আসেনি সেটি হলো- জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যে ভয়াবহ বিপর্যয় আমাদের দ্বারপ্রান্তে সে সম্পর্কে কোনো কথা আমাদের নজরে আসেনি, আওয়ামী নির্বাচনী ইশতেহারে সেখানে বহু কথাই আছে। তবে সব কেবল কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ, বাস্তবে কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। এটিকে অবশ্যই সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বিএনপি একে সর্বোচ্চ বিবেচনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করবে আশা করি।
ndigantababar@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা