২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রাষ্ট্র মেরামতে গণতন্ত্র মুক্তি পাক

- ছবি : সংগৃহীত

রাষ্ট্র মেরামতের স্লোগানটি ঢাকার রাজপথে প্রথম উচ্চারিত হয় স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মুখে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালের দিকে শিক্ষার্থীরা কয়েকবার রাজপথে নেমে আসে। ধর্ষণ ও সড়ক দুর্ঘটনার মহামারী, সন্ত্রাস ও পুলিশের বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ জানাতেই মূলত তারা রাজপথে নেমেছিল। কারণ ওই সব ঘটনায় স্কুলের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়েছিল। সহপাঠীদের মৃত্যু সে দিন তারা সহ্য করতে পারেনি। তবে সে দিন রাজপথে তাদের স্লোগান গোটা দেশকে ঝাঁকুনি দিয়েছিল। দেশে যে সুশাসন নেই, রাষ্ট্র যে ভেঙে পড়েছে সে কথা উচ্চারিত হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দেয়া স্লোগানে। রাজপথে সে দিন তারা ‘রাস্তা বন্ধ, রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে’ লেখা প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে ধরেছিল।

রাষ্ট্র মেরামতের কথা আবার দেশে এখন আলোচিত বিষয়। গত ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনের দোতলায় এক জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানে দেশের অন্যতম প্রধান ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি ‘রাষ্ট্র মেরামত’-এর ২৭ দফা রূপরেখা তুলে ধরেছে। লন্ডন থেকে অনলাইনে এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি সংক্ষিপ্তভাবে রূপরেখার বিষয়বস্তু উল্লেখ করার পর বিস্তারিতভাবে ২৭ দফা উপস্থাপন করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খোন্দকার মোশাররফ হেসেন। এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, কূটনৈতিক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।

বিভাগীয় শহরগুলোতে ১০টি গণসমাবেশ করার পর বিএনপি এই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। প্রথমে অনেকেরই ধারণা ছিল এটি সাদামাটা সেমিনারের মতো কোনো অনুষ্ঠান। পেশাজীবী নেতৃবৃন্দের সাথে সাংবাদিক হিসেবে আমারও অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা ঘোষণার পর মনে হলো রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি বিশাল এক কাজে হাত দিয়েছে যা অতীতে কিছুর সাথে তুলনীয় নয়। একজন নাগরিক হিসেবে দেশের প্রতিটি মানুষ যেভাবে নিজের দেশকে দেখতে চায়, সে ধরনের একটি দেশ উপহার দেয়ার মূলমন্ত্রই এই ২৭ দফা।

কী আছে রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফায় তা জেনে নেয়া যাক। বিএনপি সে দিন অনুষ্ঠানের শুরুতেই বলেছে একাত্তরে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জনগণ যে দেশ পেয়েছে, যে রাষ্ট্র পেয়েছে, সেই রাষ্ট্রের মালিকানা আজ জনগণের হতে নেই। কর্তৃত্ববাদী সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এগুলো আজ নির্বাসনে চলে গেছে। তাই এই রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান কর্তৃত্বপরায়ণ ফ্যাসিস্ট সরকারকে হঠানোর পর আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠিত হবে। সেই সরকারই রাষ্ট্র সংস্কারের কার্যক্রম গ্রহণ করবে।

সংবিধান সংস্কারের কথা উল্লেখ করে বিএনপি বলেছে ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে সংবিধানের সব বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সংশোধনী পরিবর্তন করে জনগণের প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে একটি ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করবে। প্রতিষ্ঠা করা হবে ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’। প্রবর্তন করা হবে নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যারা স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করবেন। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতার মধ্যে একটি ভারসাম্য আনা হবে। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে সুসমন্বয় করা হবে। দুই মেয়াদের অতিরিক্ত কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। উচ্চ কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন করা হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। নির্বাচন কমিশন আইনের সংস্কার করা, ইভিএমের পরিবর্তে পেপার-ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান, স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা হবে। জুডিশিয়াল কমিশন গঠন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন, মিডিয়া কমিশন গঠন, দুদকের স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও ন্যায়পাল নিয়োগ, মানবাধিকার নিশ্চিত, অর্থনৈতিক কমিশন গঠন, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর নিজ নিজ ধর্ম পালন, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া, প্রকৃত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে বিচার নিশ্চিত, যুক্তরাজ্যের ‘এনএইচএস’-এর আদলে স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন ইত্যাদি ২৭ দফার উল্লেখযোগ্য দফা। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ‘ভিশন-২০৩০’ এর আলোকে এ রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এগুলো সহজ কতগুলো দফা। কিন্তু এগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বিশাল সংস্কারের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বিএনপি। এরই মধ্যে এ নিয়ে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। প্রথমত, জাতীয় সরকারের বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি নিজেদের সরকার না করে কেন জাতীয় সরকার করবে? এর কারণ প্রথমেই বলে দিয়েছে বিএনপি। জাতীয় সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার করা সম্ভব। অনেকে বলেছেন বিএনপি কেন ‘রেইনবো নেশনে’র কথা বলেছে? এটি বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্বপ্ন। তিনি চান বাংলাদেশ এমন একটি অনুপম সুন্দর দেশ হোক, যে দেশটি হবে রঙধনুর মতো বহু বর্ণের ছটায় উদ্ভাসিত সুন্দর দেশ; অর্থাৎ দেশটা হবে সবার। সবার চাওয়া-পাওয়া প্রতিফলিত হবে দেশে। দেশে যে সরকার হবে, সেই সরকার নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর হবে না। সরকারটি হবে সবার। সেটাই ‘রেইনবো নেশন’। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিলে ‘রূপকল্প-২০৩০’ ঘোষণা করে খালেদা জিয়া রেইনবো নেশনের কথা বলেছিলেন। সেখানে তিনি সুনীতি, সুশাসন ও সুসরকার প্রতিষ্ঠার কথা জোরালোভাবে তুলে ধরেছিলেন।

রাষ্ট্র মেরামত রূপরেখায় আরো এক ধাপ এগিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুই মেয়াদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার ঘোষণা বিএনপির একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। এ ছাড়া সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধনও একটি বড় বিষয়। এ অনুচ্ছেদের কারণে কোনো সংসদ সদস্য ফ্লোর ক্রস করলে তার সদস্যপদ চলে যায়। ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনে এ বাধা দূর হলে সংসদের যেকোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সদস্যরা স্বাধীনভাবে তাদের সমর্থন জানাতে পারবেন। রাষ্ট্র মেরামতে বিএনপির ২৭ দফা আসলে দেশকে একটি আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রেই পরিণত করবে। রাষ্ট্র মেরামতে প্রকৃত গণতন্ত্র মুক্তি পাক এটিই জনগণ আশা করে।

যেভাবে রাষ্ট্রকাঠামো ধ্বংস করা হয়
কর্তৃত্ববাদী সরকারের ১৪ বছর ধরে চলা শাসনে দেশের রাষ্ট্রকাঠামো প্রায় ভেঙে পড়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই এই সরকার সিদ্ধান্ত নেয় তারা ক্ষমতার এই চেয়ার আর ছাড়বে না। ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখবে। সেটিই হয়েছে। এ সরকারের ক্ষমতার শুরুতেই বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তার হত্যা জাতিকে থমকে দেয়। এরপর প্রথমেই গণতন্ত্র এবং ভোটের অধিকার হরণ করা হয়েছে। এর বদলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসন। অস্ত্রবাজি, সন্ত্রাস, মাস্তানি ও পেশিশক্তিই এই শাসনের মূল অস্ত্র। এর মাধ্যমে জনমতকে স্তব্ধ করে দিয়ে পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনের নামে একটি প্রহসন সংঘটিত করে ক্ষমতা কব্জা করে রাখাই হয় কাজ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ব্যর্থ ও ভুয়া নির্বাচন তথা জঘন্য নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে এভাবেই ক্ষমতা দখল করে রাখার নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এভাবে ক্ষমতা দখলে রাখার ১৪ বছর চলছে। আগামীতেও যাতে একই কায়দায় ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা যায় সেই পাঁয়তারাই করছেন বর্তমান ক্ষমতাসীনরা।

চলমান দুঃশাসনে রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে পুতুলখেলার বস্তুতে। গণতন্ত্র মৃত। নির্বাচনী ব্যবস্থা তথা মানুষের ভোটের অধিকার ধ্বংস হয়ে গেছে। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদছে। দুর্নীতি মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত অতিক্রম করছে চরম শঙ্কা, উৎকণ্ঠা ও দীর্ঘশ্বাসে। অনিয়ম-দুর্নীতি, লুটপাট, খুন, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা চূর্ণ হয়ে গেছে। সরকার তার অপকর্ম দিয়ে বারবার বিড়ম্বনায় পড়লেও এ থেকে শিক্ষা নেয়নি, বরং আরো বেশি করে অপকর্ম করে চলেছে।

শেয়ারবাজার লুটপাট, হলমার্ক ও ডেসটিনির জালিয়াতি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি রেল ও পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, বিদ্যুতের রেন্টাল-কুইক রেন্টাল-রূপপুর দুর্নীতি, র‌্যাব-পুলিশ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের তাণ্ডব, সাগর-রুনি, বিশ্বজিৎ ও আবরারদের মতো নির্মম হত্যাকাণ্ড, নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবের ৭ খুন, পুলিশ ও র‌্যাব দিয়ে গণহত্যা, বিডিআর হত্যা, শাপলা চত্বরে আলেমদের গণহত্যা, দখল ও দলীয়করণ, সরকারি চাকরি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, ব্যবসা, চাকরি ও সুযোগ-সুবিধা কুক্ষিগতকরণ, ব্যাংক খাতে হরিলুট ও বিশৃঙ্খলা, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি ও পাচার, দ্রব্যমূল্য ও গ্যাস-বিদ্যুতের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, বিরোধী দল, গণমাধ্যম ও ভিন্নমতের প্রতি চরম অসহিষ্ণুতা ও কালো আইন করে দমন, হামলা-মামলাসহ রাজনৈতিক নিপীড়ন, মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতাদের অসংযত বক্তব্য, ইসলামবিদ্বেষ, প্রশাসন দলীয়করণ, ভিন্নমতের পেশাজীবীদের হয়রানি ও ভিন্নমতের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওএসডি, চাকরিচ্যুত ইত্যাদি অপশাসন দ্বারা সরকার আজ দেশ-বিদেশে ও জনগণের কাছে ঘৃণিত। পাশাপাশি কূটনৈতিক ব্যর্থতা, রোহিঙ্গা সমস্যা ডেকে আনা, ভারতকে ট্রানজিট প্রদানসহ জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া ও ভারত নির্ভরশীলতা, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা ও কিশোরী ফেলানীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখার মতো ঘটনায় মানুষ স্তম্ভিত হয়েছে। তেমনি এই সরকার ঐতিহ্যবাহী সুন্দরবন ধ্বংসের জন্য ভারতের স্বার্থে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করছে, যা জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা।

দেশের মানুষ উন্নয়ন চায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষ বুকে ধারণ করে। এগুলো তো কিছুর সাথে বিনিময়যোগ্য নয়। মানুষ তো একই সাথে গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার, ভোটের অধিকার, রাজনীতি ও সভা সমাবেশ করার অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও চায়। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকারটি সেই স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের মতো উন্নয়নের গল্প ফেঁদে মানুষের বাকি সব অধিকারকে গত ১৪ বছরে কিভাবে পদদলিত করেছে- এটি দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। উন্নয়নের আড়ালে কিভাবে তারা দুর্নীতি-লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করেছে, মেগা প্রকল্প নিয়ে মেগা দুর্নীতি করছে তা আজ ওপেন-সিক্রেট বিষয়।

প্রকৃতপক্ষে এক-এগারোর জরুরি সরকারটিকে যে উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশে আনা হয়েছিল, তার পর থেকেই তাদের সেই উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন চলছে। এক-এগারো মূলত ছিল একটি ষড়যন্ত্র। আওয়ামী লীগের সহযোগিতায় জেনারেল মইন-মাসুদ গংরা ছিল এই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এক-এগারোর জরুরি সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শেষের দিকে আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার তাণ্ডবের কথাও ভুলে যায়নি মানুষ। এক দিকে এই তাণ্ডব, বিভিন্ন বাহিনীর ভূমিকা আর অন্য দিকে বিদেশী শক্তি বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতের পরিকল্পনায় দেশের ক্ষমতা তুলে দেয়া হয় এক-এগারোর ওই বিশেষ জরুরি সরকারটির হাতে। সেই সরকারটি নীলনকশার অংশ হিসেবেই পরিকল্পনামাফিক ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ব্রুট মেজরিটি পাইয়ে দিয়ে ক্ষমতায় আনে। তার ধারাবাহিকতাই এখনো চলমান। শেখ হাসিনার ১৪ বছরের শাসনে তাই একে একে ভেঙে পড়েছে দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো। সবচেয়ে বড় আঘাত হানা হয়েছে আদালত ও নির্বাচন কমিশনের ওপর। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও বিরাজনীতিকীকরণ, ত্রাসের শাসন, ভাত ও ভোটের অধিকার হরণ চলছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। গণতন্ত্র হারিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রিপোর্ট প্রকাশ করে বলছে বাংলাদেশে চলছে কর্তৃত্ববাদী শাসন। ইকোনমিস্টের ইনটেলিজেন্স ইউনিটের রিপোর্টে ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের তালিকাতেও ঠাঁই পায়নি বাংলাদেশ। এ দেশ পরিণত হয়েছে মানবাধিকার হরণের দেশে। ধর্ষণের মহামারী চলছে এখানে। নৈতিক অবক্ষয় ও বিকৃত নৃশংসতা হয়ে উঠেছে সর্বগ্রাসী।

বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রপ্রিয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতান্ত্রিক স্বদেশের। এই গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে বারবার রক্ত দিয়ে সংগ্রামে জয়ী হতে হয়েছে। সেই গণতন্ত্রকে আবার হত্যা করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির ৩৫ লাখের বেশি নেতাকর্মীকে সরকার মামলায় জড়িয়েছে।

শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে দিয়ে, বিচারপতি খায়রুল হকের মতো লোকদের দিয়ে উদ্দেশ্যমূলক রায় দিয়ে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক প্রথা বাতিল করে দেয় ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য। আজ দেশে যে গণতন্ত্র নেই, নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে, রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তা উদ্ধার একমাত্র গণতন্ত্রের মুক্তির মাধ্যমে। আর সে জন্যই সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন। আর এ নির্বাচন হতে পারে একমাত্র নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এমন সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই কেবল দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে। গণতন্ত্র মুক্তি পেলেই ভেঙে পড়া রাষ্ট্র মেরামত করা সম্ভব হবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ই-মেইল : abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement