০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

চলে গেলেন মুফতি রফি উসমানি

মুফতি রফি উসমানি - ছবি : সংগৃহীত

পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন বিশ্ববরেণ্য আলেম, পাকিস্তানের গ্র্যান্ড মুফতি ও করাচি দারুল উলুমের প্রধান পরিচালক মাওলানা মুফতি রফি উসমানি (রহ.)। জীবদ্দশায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তন্মধ্যে কেন্দ্রীয় ওলামা কাউন্সিলের সদস্য, পাকিস্তান ইসলামী নযরিয়াতি কাউন্সিলের সদস্য, সিন্ধু প্রদেশের জাকাত কাউন্সিলের সদস্য, শরিয়াহ আদালত বেঞ্চ ও উচ্চ আদালতের উপদেষ্টা এবং শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া পাকিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট। এ ছাড়া তিনি এনইডি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন।

তিনি ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দে জন্মগ্রহণ করেন। বিশ্বখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা মুফতি শফি (রহ.) ছিলেন তার বাবা এবং শায়খুল ইসলাম মুফতি তকি উসমানির বড় ভাই। দেশ বিভাগের পর তারা পারিবারিকভাবে করাচিতে থিতু হন। ১৯৬০ খ্রি. দারুল উলুম করাচি থেকে দাওরায়ে হাদিস কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন। একই বছর দারুল উলুম করাচিতেই উচ্চতর ফিকহ ও ফতোয়া বিভাগে গবেষণা করেন। ১৩৭৮ হিজরিতে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে ফাজিল ডিগ্রি লাভ করেন।

তিনি সমসাময়িককালের অনেক কীর্তিমান ব্যক্তিদের শিষ্যত্ব, সান্নিধ্য ও ইজাজত লাভে ধন্য হন। মুফতি আজম মুহাম্মদ শফি, মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি, মাওলানা আকবর আলী সাহারানপুরি, মাওলানা সাহবান মাহমুদ, মাওলানা সালিমুল্লাহ খান, শায়খ হাসান আলমাশশাত (মক্কা মুকাররমা), আল্লামা ইদরিস কান্ধলভি, শাইখুল হাদিস আল্লামা যাকারিয়া কান্ধলভি, আল্লামা কারি তাইয়েব, আল্লামা যফর আহমদ উসমানি প্রমুখ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু হয় দারুল উলুম করাচিতে। সহিহ মুসলিমসহ দারসে নিজামির গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাদি তিনি পাঠদান করেন। ১৯৮৬ সালে দারুল উলুমের প্রধান পরিচালক নিযুক্ত হন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বিশ্বের নানা প্রান্তের হাজারো আলেমের শিক্ষক তিনি। এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশে দেশে ছড়িয়ে আছেন তার অগুনতি ছাত্র, ভক্ত ও অনুগামী। তিনি শুধু পাকিস্তানেরই নন; বরং গোটা বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ একজন গবেষক আলেম ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে ফকিহ, মুফাসসির ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখক।

তার রচিত বইয়ের সংখ্যা অন্তত ৩০টি। এগুলো হলো।
১. ফাতাওয়া দারুল উলুম করাচি,
২. ফিকহি রাসায়েল,
৩. দারসে মুসলিম,
৪. হায়াতে মুফতিয়ে আযম,
৫. নাওয়াদিরুল ফিকহ,
৬. মেরে মুরশিদ হযরত আরেফি,
৭. ইসলাহি তাকরিরেঁ,
৮. ফিকাহ মে ইজমা কা মাকাম,
৯. রফিকে হজ,
১০. হজ কে বাদ জিন্দেগি কেইসে গুযারেঁ,
১১. হাজিওঁ কু চান্দ নসিহতেঁ,
১২. ইলমুছ ছিগাহ উর্দু,
১৩. আলামাতে কিয়ামত,
১৪. আম্বিয়া আ: কে সার জমি মে,
১৫. কিতাবাতে হাদিস,
১৬. আওরাত কি সারবরাহি,
১৭. দো কওমি নাযরিয়া,
১৮. ইয়ে তেরে পুর আছরার বন্দে,
১৯. ইউরোপ কে তিন মাআশি নিযাম,
২০. ইসলাম মে গোলামি কা তাছাওয়র,
২১. ইখতিলাফ রহমত, ফিরকাবন্দী হারাম,
২২. মাসলাকে দেওবন্দ,
২৩. ফিতনায়ে ইনকারে হাদিস,
২৪, ইত্তেবায়ে সুন্নাত কি আহাম্মিয়ত,
২৫. মুস্তাহাব্বাত,
২৬. কাম চুরি, আল্লাহ কা এক আযাব,
২৭. তাওবা কি হাকিকত,
২৮. মাহে রামাযান,
২৯. জান্নাত কা আসান রাস্তা,
৩০ তারিখকে দারিচৌঁ ছে।

মুফতি রফি উসমানির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বৈশ্বিক। ফিলিস্তিনি, কাশ্মিরি, চেচেন, রোহিঙ্গা ও উঁইঘুর মুসলমানদের মুক্তির পক্ষে তিনি জোরদার বয়ান করে জনমত সংগঠিত করেন। আফগানিস্তানে বৈদেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল সব সময় সোচ্চার। ১৯৮০ সালে তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা সরব ছিলেন। তিনি সারা জীবন পারস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মুসলমানদের কালিমা তৈয়েবার পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস চালান। তিনি মনে করতেন, ইখতিলাফের মাত্রা যত কমিয়ে আনা যায় তত মঙ্গল। সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের আমলে সেনা অভিযানের মুখে জামিয়া হাফছাকে নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেন। তার প্রচেষ্টায় জাতীয় ইস্যুতে বিভিন্ন ঘরানার ও চিন্তাধারার আলেম ওলামাদের নিয়ে বৈঠক করে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন। তিনি দেওবন্দী ঘরানার প্রতিনিধিত্বশীল নেতা হয়েও বেরলভি, জামায়াতে ইসলামী, আহলে হাদিস, শিয়া জাফরি ও মাজারের মুতাওয়াল্লিদের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক বহাল রেখে চলতেন। তার ঔদার্য ও ওহাদাতে উম্মতের চেতনা তাকে জনপ্রিয় করে তোলে।

পাকিস্তানের সরকার, সরকারি দল, বিরোধীদল, প্রশাসনের লোকজন মুফতি রফি উসমানিকে সম্মান ও সমীহের চোখে দেখতেন। তার ইন্তেকালে শোক প্রকাশ করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। তিনি বলেন, ‘মুফতি রফি উসমানি ফিকহ, হাদিস ও তাফসির ক্ষেত্রে মূল্যবান কীর্তি রেখে গেছেন। তার ধর্মীয় ও একাডেমিক সেবা এবং ধর্মীয় জ্ঞানের প্রচারের জন্য যুগ যুগ মানুষ তাকে স্মরণ করবে।’
প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘মাওলানা রফি উসমানি সারা জীবন ইসলামী শিক্ষার প্রসারে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার ধর্মীয় ও সমাজসেবার অবদান চিরকাল মানুষ স্মরণ করবে। মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের জন্য তিনি যে মেহনত করে গেছেন তা জাতি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে’।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রধান মাওলানা ফজলুর রহমান বলেছেন, ফিকহ, হাদিস ও তাফসিরের ক্ষেত্রে মুফতি রফি উসমানির মূল্যবান সেবা প্রদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমি মনে করি, তিনি পৃথিবীর সামনে ইসলামের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছেন।

সিন্ধুর গভর্নর কামরান তেসোরিও এক শোকবার্তায় বলেন, ‘এটি শুধু পাকিস্তান নয়, ইসলামিক বিশ্বের জন্য একটি বড় ক্ষতি। ধর্মীয় শিক্ষার প্রচারে মুফতি সাহেবের অবদান অতুলনীয়।’

পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী মিয়া পারভেজ ও সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী মুরাদ আলী শাহ তার অবদান তুলে ধরে শোক প্রকাশ করেন।

মাওলানা মুফতি রফি উসমানির সাথে আমার একটি ছোট্ট স্মৃতি আছে। আজ থেকে ২০ বছর আগে তিনি বাংলাদেশ সফর করেন এবং চট্টগ্রাম পটিয়া জামিয়া ইসলামিয়ার আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। মাদরাসার প্রধান পরিচালক মাওলানা হারুন ইসলামাবাদীর অনুরোধে রফি উসমানি সাহেবের উর্দু বক্তৃতা তাৎক্ষণিক অনুবাদ করেছিলাম। উসমানি সাহেব পরে আমাকে বলেন, ‘আমি যদিও বাংলা বুঝি না তবে আপনার দেহভঙ্গি ও বক্তব্যের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হলো অনুবাদ যথার্থ হয়েছে। অনুমিত হলো, আমার কথা দিয়ে আপনি নিজেই বক্তব্য রাখছেন’।

তার সালাতে জানাজায় সিন্ধু প্রদেশের গভর্নর কামরান তেসোরি, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের আমির মাওলানা ফজলুর রহমান, করাচি জামায়াতে ইসলামীর আমির হাফেজ নাঈমুর রহমানসহ দেশের শীর্ষ আলেম ও একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

মুফতি রফি উসমানি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১৮ নভেম্বর রোজ জুমাবার তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ইন্তেকালের সময় তার বয়স ছিল ছিয়াশি বছর। আমরা তার মাগফিরাত কামনা করি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক।
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement