২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সব সঙ্কটে কৃষিই বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু

- ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কর্মসংস্থানেরও ৬০ শতাংশ ছিল কৃষির; বর্তমানে কমার পর এখনো ৪০ শতাংশের বেশি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের জিডিপিতে যে অগ্রগতি হয়েছিল, কৃষি খাত তার অন্যতম। বিগত দুই দশকে সেবা ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ফলে কৃষির অবদান শতাংশ হারে কমলেও খাদ্য উৎপাদনে ধারাবাহিক অগ্রগতি ও কর্মসংস্থানে অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখায় অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা অপরিবর্তিত রয়েছে।

১৯৭১ সালে দেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের জন্যও খাদ্যঘাটতি ছিল ২৫-৩০ লাখ টন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর জনসংখ্যা ১৮ কোটি হলেও খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতার কাছাকাছি। কৃষি শুধু খাদ্যই জোগায় না, অনেকের আয়ের উৎসও। উল্লেখ্য, কৃষি বলতে কেবল দানাদার ফসল, সবজি এবং ফলই নয়; বরং পাট, তুলা, আখ, ফুল ও রেশমগুটিসহ বাগান, বন, মৎস্য, পশুসম্পদ, এমনকি মাটির ব্যবস্থাপনাও এই খাতের আওতাভুক্ত। কৃষির এই উন্নয়নের জন্য কৃষক যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণও গুরুত্বপূর্ণ; সরকারেরও সহযোগিতা রয়েছে কৃষির উন্নয়নে।

ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় অবস্থিত। এ দেশের আবহাওয়া যেমন কৃষিবান্ধব, জমিনও তেমন উর্বর। এই দেশটির মানুষের ক্ষুধা মুক্তির জন্য স্বাধীনতার পরই সবুজ বিপ্লবের আহ্বান করা হয়েছিল; যার স্লোগান ছিল- কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। এ দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও গ্রামীণ উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়; যার উদ্দেশ্য মূলত খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও আয় নিশ্চিত করা। প্রথম বার্ষিক পরিকল্পনার বরাদ্দকৃত ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ১০০ কোটি টাকা কৃষি খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়।

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১ শতাংশ হারে চাষের জমি কমছে। তদুপরি, কৃষির অগ্রগতির ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি) ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, দেশের দারিদ্র্য নিরসনে কৃষি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইফপ্রির বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। এফএও-এর বার্ষিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি প্রতিবেদন ২০১৯ অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে দেশের প্রধান শস্য উৎপাদন চার থেকে পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

কৃষির উন্নয়ন যেভাবে হলো
কৃষির উন্নয়নে কৃষকের অবদান সবচেয়ে বেশি। তবে, আধুনিক বীজ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য গবেষক এবং এই প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গবেষণা বলতে যতটুকু আছে তার বেশির ভাগই কৃষি-বিষয়ক গবেষণা। দেশে প্রায় প্রতিটি প্রধান ফসল, যেমন- ধান, গম, ভুট্টা, পাট, সবজি, কন্দাল ফসল, মসলা, ফল, চা, ইক্ষু, তুলা, বন, ইত্যাদির জন্য রয়েছে আলাদা গবেষণা প্রতিষ্ঠান; অধিকন্তু অন্যান্য সব ফসলের গবেষণার জন্য রয়েছে কৃষি গবেষণা নামে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়াও রয়েছে নিউক্লিয়ার অ্যাগ্রিকালচার গবেষণা, কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন সংস্থা, মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন, মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও পশুসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। এই গবেষণার ফল কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের রয়েছে দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক।

কৃষির উন্নয়নে সরকারেরও ভূমিকা রয়েছে অনেক। স্বাধীনতার পরপরই কৃষিবিদের চাকরি প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেয়ায় মেধাবীরা এই সেক্টরে অবদান রাখার সুযোগ পেয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশে অনেক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। অনেক মেধাবী কৃষিবিদ বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের কৃষি সেক্টরে ভূমিকা রাখছেন। এ ছাড়াও সরকার কৃষকের আধুনিক সার, ওষুধ, পানি, বীজ সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয়। ইদানীং প্রতি অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি রাখা হয়, যা জ্বালানি ও সারের জন্য বেশির ভাগ ব্যবহার করা হয়। কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ বিতরণের জন্য বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ২০৫০ সাল পর্যন্ত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা কীভাবে ধরে রাখা যায়, সেটি নিয়ে কাজ চলছে। নতুন জাত উদ্ভাবনের সময় কমানোর জন্য চেষ্টা চলছে। তবে সরকারকে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য ও মাঠপর্যায়ে কৃষকের সরাসরি ভর্তুকির সুফল পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। রক্ষা করতে হবে কৃষিজমি।

কৃষিতে গবেষণার অবদান
ধান : দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই স্থানভিত্তিক জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা করছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। তবে ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোর প্রতিটিই বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। বিজ্ঞানীরা পরিবেশ উপযোগী যেমন- খরা, বন্যা, লবণ, জোয়ার এবং শীতসহনশীল জাত ও লাগসই ধান উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য কাজ করছে। ব্রি ১৯৭০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০৬ জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ব্রি ধান-২৮ ও ব্রি ধান-২৯ দেশে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জাত উদ্ভাবন করার মাধ্যমে প্রায় ৫৭ হাজার হেক্টর জমি ধান চাষের আওতায় এসেছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির বেশির ভাগ ক্যালরি, প্রোটিন, মিনারেল ও জিঙ্কসমৃদ্ধ পুষ্টির উপাদান সরবরাহ করার লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। ব্রি প্রিমিয়াম কোয়ালিটিসম্পন্ন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়।

গত পাঁচ দশকে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। যে জমিতে আগে হেক্টরপ্রতি দুই থেকে তিন টন ফলন হতো, এখন সেখানে ফলন হচ্ছে ছয় থেকে আট টন। ১৯৭১ সালের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার অন্ন জোগানো যেখানে সম্ভব হচ্ছিল না সেখানে বর্তমানে ১৮ কোটি জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে। হাইব্রিড ধানের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে। এ ছাড়াও অগ্রিম ও স্বল্পমেয়াদের ধানের জাত উদ্ভাবন করে উত্তরবঙ্গের মঙ্গা দূর করতে সক্ষম হয়েছে। হাওর এলাকার প্লাবন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যও অগ্রিম ও স্বল্পমেয়াদের ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।

ভুট্টা ও গম : বাংলাদেশে ভুট্টা ও গম যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রধান দানাদার ফসল। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টন ও গমের ৭০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন ছিল যথাক্রমে- প্রায় ৫৪ লাখ টন ও ১২ লাখ টন। গত এক দশকে বাংলাদেশে ভুট্টার উৎপাদন ছয়গুণেরও বেশি বেড়েছে। অথচ গমের ক্ষেত্রে প্রয়োজনের মাত্র এক-ষষ্ঠাংশ ও ভুট্টার ক্ষেত্রে প্রয়োজনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ উৎপাদন হচ্ছে। জীবিকা কৃষি ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈরী প্রকৃতির প্রভাবে ক্রমহ্রাসমান চাষযোগ্য জমি হ্রাস ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিপরীতে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দশম।

সবজি : সবজির উচ্চ ফলনশীল জাত ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সবজির উৎপাদন প্রায় ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিবিড় সবজি চাষে দেশ প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টন সবজি উৎপাদন করেছে যা বিশ্বে তৃতীয়। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিশ্বের ১১৮টি দেশে রফতানি করে ১৬৪ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। দেশে তেলজাতীয় ফসল ১২ লাখ টন ও ডাল ৯ লাখ টন উৎপন্ন হয়। এ ছাড়াও তেলবীজ সাড়ে ১০ লাখ, পেঁয়াজ ২৩ লাখ, রসুন ছয় লাখ, ধনিয়া সাত হাজার, আদা আড়াই লাখ ও হলুদ দেড় লাখ টন উৎপাদন হয়। মসলাজাতীয় পণ্যে উৎপাদন ছিল ৩৫ লাখ টন।

এক কথায়, কৃষি খাতের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য আধুনিক ও বিরূপতা সহনশীল জাতের উদ্ভাবন, পানিসাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তি আবিষ্কার, ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ এলাকার সম্প্রসারণ, সমন্বিত পতঙ্গ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুসরণ, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, ট্রান্সজেনিক শস্য উৎপাদন ইত্যাদি ও বিশেষ ভূমিকা রাখছে। নিউক্লিয়ার ও জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে লবণাক্ত সহনশীল ও স্বল্প ব্যাপ্তির শস্য জাত এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে; যা উপকূলীয় এলাকায় ধান চাষাবাদের পরিধি প্রসারিত করেছে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় এক বা দু’ফসলি জমি চার ফসলি জমিতে রূপান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের ফসলের নিবিড়তা ২১৬ শতাংশ, যা ২০০৬ সালে ছিল মাত্র ১৬০ শতাংশ। ফলে চাষকৃত জমির পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে।

ফল : দুই দশক আগেও আম ও কাঁঠাল ছিল দেশের প্রধান ফল। বর্তমানে দেশ ১৫৭ হাজার হেক্টর জমিতে ৭২ জাতের ফল চাষাবাদ করে প্রায় ৫০ লাখ টন ফল উৎপাদন করছে। কৃষকরা খেজুর, বরই, মাল্টা, ড্রাগন ফল, অ্যাভোকাডো, স্ট্রবেরি, বাউকুল, আপেলকুল, ডুমুরসহ বিভিন্ন ফল, এমনকি আপেলও চাষ করছে। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ১৫ বছর ধরে দেশে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৭৯১ টন আম রফতানি হয়েছে।

মৎস্য : দেশে মৎস্যবান্ধব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের ফলে মাছ উৎপাদন বিগত আট বছরে প্রায় ২৭ শতাংশ বেড়েছে। এই খাতে দেশের জিডিপিতে অবদান সাড়ে ৩ শতাংশ এবং মোট কৃষি জিডিপিতে তা সাড়ে ২৬ শতাংশ। ‘খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন-২০২০’ অনুসারে, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে বাংলাদেশ তৃতীয় ও মাছচাষে পঞ্চম। বর্তমানে দেশ তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ ও এশিয়ায় তৃতীয়। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, মাছ ও মাছজাতীয় পণ্য বাংলাদেশের অন্যতম রফতানি পণ্য। বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে এ দেশের মাছ ও মাছজাতীয় পণ্য রফতানি হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশ হিমায়িত ও তাজা মাছ রফতানি করে ৪৭৭ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। মাছ ও মাছজাতীয় পণ্যের রফতানির পরিমাণ মোট রফতানি আয়ের ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

প্রাণিসম্পদ : প্রাণিসম্পদ যেমন- মুরগি, গরু ও ছাগল চাষেও বাংলাদেশে বিপ্লব হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং কৃষি জিডিপিতে তা ১০ দশমিক ৬৯ শতাংশ। যদিও পশুপালন উপখাতে জিডিপির ভাগ কম, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষের প্রয়োজন মেটাতে এর বিশাল অবদান রয়েছে। কয়েক বছর ধরে প্রাণিজ আমিষ যেমন- দুধ, গোশত ও ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ : কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প দ্রæত উন্নতি লাভ করছে। কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে বাংলাদেশ বিদেশে রফতানি করছে। বর্তমানে দেশের প্রক্রিয়াজাত শিল্পে উৎপাদিত শস্যজাতীয় খাদ্য, হিমায়িত সবজি, ফল, আলুজাতীয় খাদ্য, ভেষজ খাদ্য, চিনিজাতীয় খাদ্য, মধু, মাছ ও অপ্রচলিত মাছজাতীয় খাদ্য, পোলট্রি ও দুধজাতীয় খাদ্য রফতানি করে। কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনে পাঁচ শতাধিক ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তা জড়িত। তার মধ্যে প্রায় ১০০টি কোম্পানি রফতানির সাথে সম্পৃক্ত। ইতোমধ্যে দেশ এক বিলিয়ন ডলার কৃষিপণ্য রফতানির মাইলফলক অতিক্রম করেছে।

কৃষি খাতের কৌশল : উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা; ফলন ব্যবধান সর্বনিম্নদ করা; পণ্যের দাম স্থিতিশীল করা; কৃষকদের মুনাফা ও নিরাপত্তার উন্নতি বিধান; জলবায়ুসহিষ্ণু উৎপাদনে শস্যপণ্য বহুমুখীকরণ; কৃষি পণ্যের সরবরাহ শক্তিশালী করা; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ বৃদ্ধি করা; ক্ষুদ্র কৃষকদের ঋণ সুবিধাদি সহজীকরণ; উচ্চমানের গবেষণা ও বিতরণ সেবার মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণ; প্রাকৃতিক সম্পদের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে দেশ। এখন দেশের লক্ষ্য হবে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন ও বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের মাধ্যমে কৃষি খাতকে বৃহৎ খামারভিত্তিক বাণিজ্যিক খাতে পরিণত করে ক্রমান্বয়ে ক্ষুদ্রায়তন কৃষি থেকে বেরিয়ে আসা।

কৃষি খাতের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
কৃষি খাতের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো- প্রতি বছর দেশের প্রায় ১ শতাংশ হারে আবাদযোগ্য জমি কমে যাওয়া। ইতোমধ্যে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও হাউজিং প্রকল্পের জন্য প্রচুর ভালো মানের উর্বর তিনফসলি জমি হারিয়েছে দেশ। দেশে আইন করে শিল্পায়নের ও হাউজিংয়ের জন্য চাষযোগ্য উর্বর জমি ব্যবহার বন্ধ করে আবাদি জমি রক্ষা করতে হবে। যত্রতত্র নয়; বরং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তুলতে হবে।

বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে তার সুফল সমানভাবে পৌঁছাচ্ছে না। সমাজের বহু মানুষের প্রকৃত আয় বাড়েনি। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত আয়কে কমিয়ে দিচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চরম আকার ধারণ করছে। সমাজের আয়বৈষম্য এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ যা দূরীকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃষি খাতে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা ও প্রাপ্য মর্যাদা না থাকা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি আবাদ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গ্রামের অনেক মানুষ উৎপাদনবিমুখ হচ্ছে। ফলে দেশের প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে।

কৃষিতে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা এখন কমে ৪০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ফলে কৃষি মজুরের সঙ্কট যেমন বেড়েছে, তেমনি মজুরিও অনেক বেড়েছে। ফলে চাষাবাদ অলাভজনক হয়ে পড়েছে। তাই কৃষিকে পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই। কৃষি চাষাবাদ, কর্তন, প্রসেস করার যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কৃষককে কৃষি ভর্তুকির আওতায় সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি কৃষিঋণের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। এক সময় কৃষিপ্রযুক্তি প্রসারের একমাত্র বাহন ছিল কৃষি সম্প্রসারণকর্মী। এখন তাতে যোগ হয়েছে ই-কৃষি। কৃষি সমস্যা সমাধানের জন্য মুঠোফোন অ্যাপস ব্যবহার করে বাড়ি থেকে কৃষি সম্প্রসারণকর্মীদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পাচ্ছে কৃষক। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ই-কৃষির ধারণা মোটেও রাখে না, তাই তারা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যার কারণে কৃষি সম্প্রসারণকর্মীদের মাঠে গিয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে হয়। এ জন্য এ কর্মীদের দক্ষ করে তুলতে প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে।


উপসংহারে বলতে হয়, বর্তমানে কৃষি খাতে উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে দেশের অবস্থান সবার উপরে। প্রতি বছর দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে ২০ লাখেরও বেশি; অথচ কৃষিজমি কমছে আট লাখ হেক্টর। তারপরও জনপ্রতি উৎপাদন কমছে না; বরং তা বাড়ছে। উল্লেখ্য, দেশের খাদ্যশস্যের চাহিদার প্রায় ৯৫ শতাংশই স্থানীয় পর্যায়ে উৎপন্ন হয়। বর্তমান সঙ্কটে খাদ্য উৎপাদনে বিশেষ সার্বিক প্রচেষ্টায় এই ৫ শতাংশ খাদ্য ঘাটতিও মেটানো সম্ভব হতে পারে। এ জন্য দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ঠিক রাখা, সার ও পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, পণ্যের সঠিক মূল্যসহ সরবরাহ নিশ্চিত করা, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও গবেষণায় আরো নজর দেয়াসহ একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক কৌশল হাতে নিতে হবে।

সর্বোপরি বলতে হয়, বিগত ২০০৮-০৯-এর বৈশ্বিক মন্দার সময়ও কৃষি খাত রিয়েল ইকোনমিতে অর্থায়নের কৌশল অবলম্বন করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছিল। প্রায় দুই বছর ধরে মহামারীর ছোবলে শিল্প ও সেবা খাত তছনছ হয়ে প্রবৃদ্ধি তলায় নেমে গেলেও কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বেড়েছে। বর্তমান মহাসঙ্কটের সময়ে কৃষিই বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে। এতে প্রতীয়মান হয়, সব সঙ্কটে কৃষিই বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ই-মেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement