কিভাবে মরতে চান
- ড. মাহবুব হাসান
- ২৩ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:৫৯
‘আপনি, আপনারা কোন পথে মৃত্যু চান আজই ঠিক করুন। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে (যদি কেউ স্বীকার করে যে তারাই মৃত্যুসহায়ক উপকরণের মৌলিক ও একমাত্র উৎপাদক ও এজেন্ট) নিবন্ধিত হোন মৃত্যুর পরোয়ানা চেয়ে। ঢাকাকে আমরা মৃত্যুর একটি অনন্য ফাঁদ হিসেবেও গণ্য করতে পারি।’
কথাগুলো লিখেছিলাম কয়েক মাস আগে। সংবাদপত্রে প্রকাশ পেয়েছে। বায়ুদূষণের প্রসঙ্গে ছিল ওই লেখা। আমরা কিভাবে মরতে চাই, সেই সিদ্ধান্ত আমাদের, একান্তই ব্যক্তিগত ইচ্ছাধীন। তবে, ব্যক্তির ওপর সমষ্টির চাপ ও উদ্যোগ আছে। তারা রাজনৈতিকভাবে চাপ দিতে পারেন যা সমষ্টিগত উদ্যোগ। এই যে এখন ক্ষমতাসীন সরকার ও তার রাজনৈতিক দল প্রায় প্রতিদিনই নানা উপলক্ষে মহানগর ঢাকার রাজপথ দখল করে মিছিল করছেন, মানুষের চলাচল অচল করে দিচ্ছেন, এ-নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এতে যে জ্যামের সৃষ্টি হচ্ছে, পথচারী ও যানবাহনের ওপর চাপ সৃষ্টির ফলে নাকাল হচ্ছে জনজীবন তা নিয়েও নেই ন্যূনতম ভাবনা। যদিও এ সব নিয়ে সরকারেরই দায় সবচেয়ে বেশি।
আবার বিএনপিও রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করে জনমনে চাপ সৃষ্টি করছে, বাড়ছে সংঘাতের আশঙ্কা এবং তাদের রাজনৈতিক সহযোগী বিভিন্ন দলও নানা কারণে মিটিং মিছিল করছেন। উড়াচ্ছেন ধূলি।
গাড়ি-ঘোড়ার মতোই, নির্মাণ প্রকল্পগুলো মহানগরকে মহাধূলি বালি আর দূষণের জন্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে সহায়তা করছে। এভাবেই আজ আমরা প্রথমস্থান অর্জন করেছি ধূলিবালির সাম্রাজ্য হিসেবে। এই গৌরবে আমরা তোপধ্বনি করতে পারি, এমনকি পাড়া-মহল্লায় জমায়েত করে বাসিন্দাদের বসবাসের জীবন ও তাদের কর্ণগুহা ঝালাপালা করতে পারি, কিন্তু সে পথে আমরা যাবো না।
এই অর্জনই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ।
বন্দুকের গুলি বা রাইফেলের বুলেট, এলএমজি বা এসএমজির ব্রাশফায়ারে একসঙ্গে কত মানুষ মেরে ফেলা সম্ভব? এর উত্তরে কেউ কড়ে আঙুল বা হাতের পাঁচ আঙুল গুনে বলবেন সংখ্যাটি। কেউ বলবেন শত শত লোক মেরে ফেলা সম্ভব। আবার যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তারা বলবেন অসংখ্য মানুষ হত্যা করা সম্ভব।
এ সবই সত্য। কম আর বেশি হলেও এর মধ্যে সত্য আছে। আর আমি বলব, মানুষ হত্যা করতে হলে রাইফেল, পিস্তল, বোমা, গ্রেনেড ইত্যাদি কিছুই লাগে না। কেবল বায়ুদূষণ করেই কোটি কোটি মানুষকে তিলে তিলে হত্যা করা যায় এবং তা করা যায় খুব সহজে। তাতে করে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে অস্ত্র আমদানি করার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু ধূলিবালি, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মনোক্সাইড, বায়ুতে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র ধূলিকণা, গাড়ি ও কলকারখানার কালো ধোঁয়া। এগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলেই কাজটা হয়ে যাবে। আর এইসব উপাদানের সঙ্গে কেবল যোগ করতে হবে উন্নয়নের কাটাকাটি, খোঁড়াখুঁড়ি, আর বেহুদা গৃহীত প্রকল্পের ওপর ওভারল্যাপিং প্রকল্প।
যানবাহনের যাত্রাকে নারকীয় করে তোলা গেলে আর কী লাগে? ঢাকা মহানগর থেকে উত্তরাঞ্চলের দিকে বেরুবার পথ ধরে এগুলেই সেটা টের পাওয়া যাবে। ঢাকা টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ সব গাড়িই বিমানবন্দর হয়ে উত্তরা পার করে বোর্ড বাজারের দিকে যায় অথবা কিছু বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার যায় আশুলিয়ার দিকে। ওই দুটি পথে যারা যাতায়াত করেন, তারা জানেন ধুলাবালি আর রাস্তার কী হাল। এই রাস্তাটি সংস্কার করা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। বিআরটি প্রকল্পটি ১০ বছর ধরে চলছে, কিন্তু তার জন্য কাটাকাটি পুরোটাই হয়েছে, নির্মাণকাজ ততটা হয়নি বা করেনি। এভাবে আমরা ধূলির সাম্রাজ্য গড়ে তুলে বায়ুবাহিত উইপনের সাহায্যে মৃত্যুর নিশানা স্থির করেছি। সরকার বাহাদুর ওইসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মহানায়কদের (ঠিকাদার) আশীর্বাদ দিয়ে চলেছেন।
ব্যস! এর চেয়ে বেশি কিছু আমাদের লাগে না।
একটা রিপোর্ট পড়া যাক, এই ঢাকা মহানগরের বায়ুর মান নিয়ে। ‘নভেম্বরজুড়ে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর ছিল ভারতের নয়াদিল্লি। শীত শুরু হতেই শহরটির বায়ুদূষণ দুর্যোগপূর্ণ হয়ে ওঠে। কর্তৃপক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং সরকারি অর্ধেক সংখ্যক কর্মীকে বাড়িতে বসে অফিস করার নির্দেশ দেয়। চলতি মাসে দিল্লিকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। জনবহুল শহরটির বাতাসের মান ভয়াবহ খারাপের দিকে। বাতাসে মিশে থাকা ‘বিষ’ নিয়ে পরিবেশবিদদের কপালে রীতিমতো ভাঁজ পড়লেও নির্বিকার সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে তারা নারাজ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজুয়ালের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহে বিশ্বের দূষিত শহরের মধ্যে পাঁচ দিনের বেশ কিছু সময়জুড়ে ঢাকা ছিল শীর্ষে। বাকি দু’দিন ছিল দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অবস্থানে। ১০ ও ১১ ডিসেম্বর সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত একিউআই স্কোর ছিল ১৯০-২২০ এর ঘরে। এ দু’দিন বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অবস্থানে ছিল ঢাকা। এরপর থেকে বায়ুর মান খারাপ হতে শুরু করে। ১২ ডিসেম্বর থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত দিনের কয়েক ঘণ্টাজুড়ে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে ছিল ঢাকা। ১২ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় একিউআই স্কোর ২০২; ১৩ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় ২৬৫; ১৪ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ১০মিনিটে ৩৮২ এবং ৫ ডিসেম্বর সকাল সোয়া ১০টায় রাজধানীর বায়ুর মান ছিল ৩৩৭। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনে সকাল ৯টা থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাত ৮টায় ঢাকা ছিল শীর্ষে। বায়ুর মান ছিল ২১০ থেকে ২৫৬-এর মধ্যে। (সমকাল/১৮/১২/২২)
আমরা রাজনীতিতে যেমন শীর্ষ দখলে রাখতে চাই, সেই পথ ধরে বায়ুর মানেও আমরা শীর্ষস্থানে থেকে বিশ্বকে দেখাতে চাই আমাদের সর্ব বিষয়ে উন্নতি। এ যেন পদ্মা সেতুর মতোই একটি উন্নতি, যা জাতির শিরস্ত্রাণে নতুন একটি পালক লাগল।
তবে পালকটি কখনো কখনো ওঠা-নামা করে। কখনো দুই বা তিনে নামে কখনো পাঁচ-এ। বায়ু বলে কথা। বিদেশী বায়ু এসেও আমাদের দূষণপ্রিয় ঢাকার বায়ুর মান আরো নিচে নামিয়ে দেয়। ফলে আমরা এই ক্ষেত্রে শিরস্ত্রাণের পালকে নতুন জেল্লা লাগাতে পারি।
তবে, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকেরা খুবই ইতিবাচক চেতনার মানুষ। তারা টুপির পালক নামাতে রাজি নন। এই মহানগরের বাসিন্দারাও তো বায়ুদূষণের জন্য সামান্য বা অসামান্য দায়ী হলেও, নিজেদের সেই কৃতিত্ব নস্যাৎ করতে চান না তারা। তাদের সংশ্লিষ্ট দফতর সচেতন করতে রাজি নয়, এ-নিয়ে তারা উদ্বিগ্নও নয়। কারণ এই বায়ুদূষণের শিরোপরি পালক ধরেই তাদের বীর্যময় উত্থান।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজুয়ালের ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স’ (একিউআই) যেসব তথ্যই আমাদের জানাক না কেন, আমরা তাদের সেই কাজের জন্য বাহবা দেবো না। কারণ বায়ুর কোয়ালিটি কি চোখে দেখা যায় যে মহানগরীর বাসিন্দারা সরকারকে দূষবে? অতএব আমরা বলব ওই প্রতিষ্ঠানটি, দিল্লির সাথে না পেরে আমাদের ঘাড়ে সওয়ার হতে চাইছে। না, এ নিয়ে আমরা কোনো তৎপরতাই দেখাব না। সেটা করতে গেলেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসবে এবং তিনি আমাদের হুদাহুদিই ভর্ৎসনা করবেন। তাই আমরা স্পিকটি নট। বায়ুর কোয়ালিটি নিয়ে আমাদের মাথা ঘামালে কি চলে? আমাদের হাজারো সমস্যার মধ্যে ভিজিবল বা যা চোখের সামনে বিদ্যমান সমস্যা তাই সমাধান করতে পারছে না সরকার, তার ওপর ইনভিজিবল বায়ুর মান নিয়ে উদ্বেগ করার সময় কি আমাদের হবে? কভি নেহি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা