কী দেখেছি, কী দেখছি
- গোলাম মাওলা রনি
- ২৩ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০৫, আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:৩৪
বিএনপি রাষ্ট্র মেরামতের জন্য ২৭টি দফা পেশ করেছে। রাষ্ট্র মেরামতের উপবাচ্যটি বিএনপির জন্য নতুন হলেও দেশবাসীর জন্য বেশ পুরনো। আমাদের দেশের প্রতিভাবান কিশোর-কিশোরীরা প্রথম রাষ্ট্র মেরামত নামক শব্দটি ব্যবহার করেছিল বেশ কয়েক বছর আগে। একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে একটি ঐতিহাসিক বিদ্রোহ হয়েছিল যা শিশুবিদ্রোহ নামে সমধিক পরিচিত।
মাধ্যমিক স্তরে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা যেভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল তাতে মনে হয়েছিল শিশু-কিশোরদের হাতেই হয়তো সরকারের পতন হবে এবং সরকারের মধ্যেও সেই ভয় ঢুকে গিয়েছিল। ফলে তারা অনেকটা ঔপনিবেশিক কায়দায় শিশুবিদ্রোহ দমন করে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল।
শিশুবিদ্রোহ যা কি না অনেকের ভাষায় কিশোরবিদ্রোহ হিসেবে অভিহিত তা নিয়ে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের ১০ তারিখ নয়া দিগন্তে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম, যা এখনও ভাইরাল হিসেবে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ভাসছে। সেই নিবন্ধে বিস্তারিতভাবে বলেছিলাম কিভাবে রাষ্ট্র মেরামতের জন্য স্কুলপড়ু য়া ছেলেমেয়েরা অভিনব পদ্ধতিতে আমাদের দেশ-কাল-সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল- রাষ্ট্রের কোথায় কিভাবে মেরামত দরকার। তো বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা বনাম শিশু-কিশোরদের রাষ্ট্র মেরামতের মূলমন্ত্র নিয়ে একটি রসঘন আলোচনা হতে পারে। তবে আমি আজকের নিবন্ধে ওদিকে না গিয়ে বরং ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
আমি রাজধানী শহরে আমার কর্মজীবন শুরু করেছিলাম আশির দশকের মাঝামাঝি, তাও আবার সাংবাদিক হিসেবে। আজ থেকে ৩৮ বছর আগে আমার সেই তারুণ্যের স্বর্ণালি সময়ে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ছিলেন বাংলার ইতিহাসের একমাত্র স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্বৈরাচারী শাসক যিনি বুদ্ধিজীবী মহল কর্তৃক বিশ্ব বেহায়ারূপে নিন্দিত ও চিত্রিত হয়েছিলেন। শাসকের একাধিক স্ত্রী, বহুসংখ্যক প্রেমিকা, অগণিত প্রমোদবালা এবং ফরমায়েশি আমলা-কামলা-পাইক-পেয়াদা-কতোয়াল-জল্লাদসহ আমির-ওমরাহ, উজির-নাজিরের অভাব ছিল না। শাসকের শখ পূরণে নিত্যনতুন আইন ছড়া-গান-কবিতা-নাটক রচিত হতো- অভিনয়ের পাশাপাশি মানব চরিত্রের মন্দ দিকগুলোর চর্চা ও পরিচর্যায় সমাজে পচনের দুর্গন্ধে সব কিছু বিষাদময়তার দিকে ধাবিত হচ্ছিল।
উল্লেখিত অবস্থার মধ্যেও সমাজের মধ্যে নিদারুণ এক প্রাণ ছিল। ভক্তি-শ্রদ্ধা, মানবতাবোধসহ ন্যায়নীতির অনেক বালাই ছিল। ফলে প্রতিটি শ্রেণী-পেশার আলাদা বৈশিষ্ট্য এবং মান-সম্মান-ইজ্জত ছিল। আজকের দিনে যেমন সব শ্রেণী-পেশার রূপ-রস-গন্ধ চাটুকার-দালাল-দুর্নীতিবাজ-ধান্ধাবাজদের মতো হয়ে গেছে ঠিক তেমনটি সেই জমানায় ছিল না। শিক্ষকদের জ্ঞানগরিমা অধ্যাপকদের উঁচুমার্গের পাণ্ডিত্য-সাংবাদিকদের সৎসাহস ও অনুসন্ধিৎসু মন, আমলাদের দক্ষতা, কামলাদের শ্রম, ক্ষমতাধরদের উদারতা, অভিজাতদের ঔদার্যতা মহত্ত্ব, গরিবদের বিনয় ধৈর্য সহ্য এবং চোর বাটপাড়দের ভীরুতা দৃশ্যমান ছিল। সমাজে ভদ্রজন ইতরজনের পার্থক্য এবং কুলবধূ ও পথবধূদের মর্যাদা অনুভব করার মতো শক্তি সমাজ সংসারে ছিল। উকিল মোক্তার কোর্ট কাচারি জজ ব্যারিস্টার নিয়ে লোকজন ঠাট্টা মশকরা করত না এবং ধর্মীয় নেতা, কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের একটি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ছিল।
উপরোক্ত সমাজব্যবস্থায় একটি জাতীয় দৈনিকে কর্মরত সাংবাদিকের মর্যাদা আজকের দিনের তাঁবেদার ও পোষ্য সাংবাদিক নামধারীরা কল্পনাও করতে পারবেন না। একটি ছোট্ট উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। সময়টা ১৯৮৮ সালের শেষ দিকের। আমি তখন একটি জাতীয় দৈনিকের সহসম্পাদক। একদিন আমাদের পত্রিকায় তৎকালীন বিডিআর অর্থাৎ আজকের বিজিবি নিয়ে বড়সড় একটি প্রতিবেদন ছাপা হলো। বিডিআরের ডিজি প্রতিবাদ পাঠালেন। কিন্তু তা ছাপা হলো না। তিনি নিজে কয়েকবার ফোন করে বার্তা সম্পাদকের সাথে কথা বলতে অর্থাৎ অনুরোধ জানাতে চাইলেন। রিসিপশন থেকে বলা হলো, বার্তা সম্পাদক রাতে আসেন এবং এসব বিষয় নিয়ে তিনি সাধারণত কথা বলেন না। বিডিআরের ডিজি বারবার অনুরোধ করে পরবর্তী দায়িত্ববান ব্যক্তির সাথে কথা বলতে চাইলেন।
রিসিপশন থেকে বার্তা বিভাগের শিফট ইন চার্জের সাথে ফোনের কানেকশন লাগিয়ে দেয়া হলো।
আমাদের শিফট ইনচার্জ খুবই কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি শুধু হ্যালো বলে ফোনের রিসিভার আমাকে দিলেন। আমি ডিজি সাহেবের সাথে কথা বললাম এবং বিষয়টি বার্তা সম্পাদককে জানাব বলে আশ্বস্ত করলাম। কিন্তু নাছোরবান্দার মতো ডিজি উপর্যুপরি অনুরোধ এবং একপর্যায়ে একটু হুমকি দেয়ার চেষ্টা করলেন। আমি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম এবং বড় বড় ভর্ৎসনাসমেত পাল্টা হুমকি দিয়ে ফোনটি রেখে দিলাম। সে দিনের সেই ঘটনা নিয়ে আর কোনো পুনরাবৃত্তি হয়নি বা কোনো সংস্থার লোক এসে আমাকে তুলে নিয়ে যায়নি। বিডিআর অফিস থেকে পুনরায় ফোন আসেনি এবং আমাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আমলে নিয়ে উল্টো বিডিআরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল।
২০২২ সালে আমি যখন ১৯৮৮ সালের সেই স্মৃতি স্মরণ করি তখন এক ধরনের নস্টালজিয়া আমায় পেয়ে বসে এবং বর্তমান জমানার একজন ওসি-ডিসির দাপট এবং বড় বড় পত্রিকার মালিক সম্পাদকের কাঁপুনির যে দৃশ্য হররোজ দেখি তাতে মনে হয় সেই স্বৈরাচারের আমল- হালফ্যাশনের জমানার চেয়ে স্বর্গরাজ্য ছিল। সেই সময়ে জেলা শহরে ডিসির বাংলো, জজের বাসভবন ও জেলা প্রকৌশলীর বাসভবন ছিল মানমর্যাদা আভিজাত্য ও কৌলিন্যের প্রতিভূ! মানুষ ওসব ভবনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শ্রদ্ধা আগ্রহ ও কৌতূহল নিয়ে তাকাতেন এবং নিজেদের আওলাদ আওতাদ নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। জজ ব্যারিস্টার উকিল মোক্তার ইত্যাদি পদ-পদবি ছিল সম্মান মর্যাদার জীবন্ত দলিল।
১৯৮২-৮৮ সালে ঢাকার বড় ব্যবসায়ীরা কেউ চোর ছিলেন না। ব্যাংক লুট, মন্ত্রী-এমপিদের পদলেহন, প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে একখানা ফটো তুলে তা দিয়ে পরে লুটপাট করার প্রবৃত্তিসম্পন্ন কোনো ধান্দাবাজকে ব্যবসায়ী বলা হতো না। রাজনীতিতে মদ্যপানের জন্য নির্ধারিত পানশালা ছিল এবং বিবৃত যৌনাচারের জন্য গণিকালয় ছিল। তখনকার মতো মদ-জুয়া এবং গণিকালয় কোনো পাঁচতারা হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে জায়গা করে নেবে তা আশির দশকে কল্পনা করা অসম্ভব ছিল।
রাজনীতি নাটক সিনেমাতে ভালো মানুষ এবং শিক্ষিতজনদের দাপট ছিল। নেতা ও অভিনেতা সবাই মিলে বাস্তব জীবন ও কল্পনার জীবনে সুকুমারবৃত্তির চর্চা করতেন পাল্লা দিয়ে। বড় বড় নেতার গাড়ি-বাড়ি ছিল না। মন্ত্রী-এমপিদের বিরাট অংশ গরিব ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সচিবালয়ের বড় আমলা এবং ক্যান্টনমেন্টের কর্নেল ব্রিগেডিয়াররা নিজ নিজ পদ-পদবি ও পোশাক-আশাকের মর্যাদা বজায় রাখতেন। সব আদালতের বিচারক, সমাজের মুরুব্বি, পাড়া-মহল্লার সর্দার কিংবা দশ গ্রামের মাতুব্বররা বটবৃক্ষের মতো সমাজকে ধারণ করতেন ভালো বাসতেন। ন্যায়বিচার করতেন এবং মজলুমদের পক্ষে দাঁড়াতেন। সেই আমলের চোরেরা ধর্মের কাহিনী শুনতেন। ডাকাতরা নিয়ম মেনে ডাকাতি করতেন। এমনকি গুণ্ডা বদমাস লুচ্চা টাউট বাটপাড়দেরও নিয়মনীতি ছিল। দালাল-ফড়িয়াদের সুনাম ছিল। মহাজনদের সম্মান ছিল। গ্রামের গৃহস্থবাড়ির ঐতিহ্য ছিল এবং মেহনতি মানুষ তথা কৃষক, ঘোড়াচালক, গরুর গাড়ির চালক, নাপিত, ধোপা, ইত্যাদি সব শ্রেণী-পেশার মানুষের আলাদা গুরুত্ব ছিল।
আবহমান বাংলার উল্লেখিত শ্রেণী-চরিত্র হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে যখন স্বৈরাচারের কবলে পড়ল তখন প্রতিদিনটি দেশকাল সমাজ বিবর্তিত হয়ে ক্রমে মন্দের দিকে ধাবিত হতে থাকল। ১৯৮৬ সালের দৃশ্যের সাথে ১৯৮৮ সালের দৃশ্যের যেমন মিল ছিল না তদ্রুপ ১৯৮৯ সালের সার্বিক আস্থা ১৯৯০ সালে এসে রীতিমতো ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে পড়ে। স্বৈরাচারী শাসকের সব অভ্যাস, চিন্তা-চেতনা, কর্ম এবং চরিত্র সংক্রমিত হতে হতে সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে যা ২০২২ সালে এসে রীতিমতো মহামারী আকার ধারণ করেছে।
১৯৮৬ সালে যারা চোর হওয়ার স্বপ্ন দেখত তারা এখন রীতিমতো বিশ্বচোরে পরিণত হয়েছে। যারা সেই আমলে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে ছোটখাটো ডাকাতি করত, ঘুষ-দুর্নীতির মোহে ক্ষমতার পদলেহন করতে চাইত তারা হালআমলে এসে রীতিমতো পাইরেট অব ক্যারেবিয়ানের কুখ্যাতি হাসিল করে ফেলেছে। ভোট চুরি, ব্যালট ছিনতাই এবং অপশাসনের মোহ যাদের মধ্যে লুকায়িত ছিল তারা সব অপকর্মজাত দুঃশাসনে গর্ভবতী হয়ে এত বেশি কুকর্ম প্রসব করেছে যার ফলে বিশ্ব দুর্নীতির সূতিকাগার হিসেবে অনেকের গর্ভাশয় অথবা জননেন্দ্রিয় রীতিমতো পিরামিড অথবা চীনের মহাপ্রাচীরের মতো ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেলেছে।
উল্লেখিত অবস্থায় স্বৈরাচার জমানার প্রথম দিককার সুকুমারবৃত্তি কবরে চলে গেছে। ভালো মানুষের জন্মের হার মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং সৎ ব্যবসায়ী দক্ষ আমলা সম্মানীত বুদ্ধিজীবীরা নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে ক্রমেই জাদুঘরের প্রাণীতে পরিণত হতে চলেছেন। স্বৈরাচারের বড় বড় দোসর সব মরেছে আর তাদের প্রেতাত্মা ও আওলাদ আওতাদ এবং তাঁবেদাররা রঙ ও ভোট পাল্টে নয়া জমানার নয়া দামান হয়ে সমাজে বলাৎকার করছে এবং সতীত্ব নষ্ট করার সেঞ্চুরি করে চলছে। দিনের কর্ম কমে গেছে, রাতের কর্ম বেড়ে গেছে। অন্ধকারের শক্তি বেড়ে গেছে এবং আলো ক্রমেই নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় মহাকাশের ব্ল্যাক হোলের মতো একটি ভয়ানক মরণ ফাঁদের কবলে পড়ে আমরা সবাই মিলে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার জন্য প্রবল গতিতে ছুটে চলেছি অজানা ধ্বংসের অধিক্ষেত্রের দিকে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা