২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা : সুশাসনের স্মারক

- ছবি : সংগৃহীত

যেকোনো ব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন একটি আবশ্যিক বিষয়। বাড়িঘর, দালানকোঠা ও প্রতিষ্ঠানে সময়ান্তরে মেরামত প্রয়োজন। এমনকি নিয়ম-কানুন, রীতি-রেওয়াজ ও আইন-কানুনে কালান্তরে পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র একটি প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এটি শ্রেষ্ঠতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। রাজা, রাজ্য, রাষ্ট্র ও রাজধানীর পরিবর্তন ইতিহাসের মতোই পুরনো। সময় এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাধ্যবাধকতায় রাষ্ট্র কাঠামোতে পরিবর্তন ঘটে। ঘরবাড়ি, দালান-কোঠার মতো প্রতিষ্ঠাকালে যদি রাষ্ট্রের ভিত্তি শক্ত-পোক্ত না হয় তাহলে অচিরেই তা ভেঙে পড়ে। আর যদি তা বিচক্ষণ নেতৃত্বে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবনাচার, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে তা পরিবর্তিত হতে শতাব্দী অতিক্রম করে।

ব্রিটিশ সংবিধান পৃথিবীর পুরোনো সংবিধানের একটি। শত শত বছর ধরে অনুসৃত এই সংবিধানটি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের অকৃত্রিম দলিল। এর অধিকাংশ বিধিবিধান অলিখিত। প্রথা, পদ্ধতি এবং জনগণের সতত আনুগত্য এর ভিত্তি। বলতে গেলে এত কালেও এর মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন যা হয়েছে তা সময় ও সম্মতির ভিত্তিতে বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতেই হয়েছে। আবার মার্কিন সংবিধান দীর্ঘ সময় ধরে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিবেচনার পর গৃহীত হয়েছে। সেখানে তাই সংশোধনীও বিরল। ওই দুটো সংবিধানের তুলনায় বাংলাদেশের সংবিধান গ্রহণযোগ্য ও টেকসই হয়নি। যদিও এর মৌলিক অধিকার অংশটির প্রশংসা করেন অনেকেই। মৌলিক অধিকার লিখিত হলেও বিগত ৫০ বছরেও জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়নি। বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সময় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার অনুকূলে এবং প্রতিকূলে সংবিধান পরিবর্তন করেছে। যারা সংবিধানের প্রণেতা তারাই ক্ষমতার প্রয়োজনে বারবার সংবিধানে ছুরি চালিয়েছে। ৫০ বছরে ১৭ বার পরিবর্তন অবশ্যই স্থিতিশীলতার প্রমাণ বহন করে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গতি নির্দেশ করে না। শাসক দলগুলো তাদের ক্ষমতার প্রয়োজনে অধিকাংশ সংশোধনী প্রণয়ন করে। দ্বিতীয় সংশোধনীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতার প্রয়োজনে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান সংযোজন করে। এরই ধারাবাহিকতায় বিনা বিচারে আটক রাখার বিশেষ আইনও ঘোষিত হয়। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে তারা একদল ও একরাষ্ট্রের বিধান ‘বাকশাল’ প্রবর্তন করে। এই ক্ষমতালিপ্সু শক্তিই ২০১৫ সালে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রণীত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। উদ্দেশ্য, অলিখিত বাকশাল প্রবর্তন। পঞ্চাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তারা সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র কায়েম করে। দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছরের শাসনে শাসনব্যবস্থায় এমন সব পরিবর্তন, দলীয়করণ ও দুর্নীতি পরিদৃষ্ট হয় যে লিখিতভাবে ও বাস্তবে গণতন্ত্রের অবসান ঘটে। নির্বাচন ব্যবস্থাকে নির্বাসিত করে তারা নিকৃষ্ট কর্তৃত্ববাদ কায়েম করে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থা একটি তামাশায় পরিণত হয়। নির্বাহী বিভাগ নিকৃষ্ট দলীয় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। বিচার বিভাগ আজ্ঞাবহতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো নিকৃষ্টভাবে দলীয়করণ করা হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত কমিশন দলীয়করণের বদনাম কুড়ায়। রাজনৈতিক দলগুলো বিধিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের পরিবর্তে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় জনগণের অধিকার সংরক্ষণ ও গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারে সংবিধান সংস্কার তথা রাষ্ট্র মেরামতের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে। প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি জনমতের প্রতিধ্বনি করে অবশেষে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা ঘোষণা করে।


বিগত দেড় দশকের রাজনৈতিক সংগ্রামে বিরোধী দলগুলো শাসক দলের ওইসব অসাংবিধানিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি শাসনব্যবস্থায় জনপ্রিয় বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ১৯৯১ সালে দেশে প্রথমবারের মতো একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ধারণা করা হচ্ছিল যে প্রাথমিক শাসকদল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসবে। কিন্তু জনগণ অতীতে তাদের অন্যায়-অত্যাচার ও বাকশালী চরিত্রের কারণে ভোট দেয়নি। এই নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি। জামায়াতের সহযোগিতায় তারা সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের ভুলবোঝাবুঝির কারণে প্রতারণা কৌশলে ২১ বছর পর তারা ক্ষমতায় আসীন হয়। এভাবে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় ফিরে আসে। আওয়ামী লীগ বুঝতে পারে যে, দেশের মানুষের ভোটে তাদের ক্ষমতায় আসা কোনো দিনই কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। তাই শুরু হয় ষড়যন্ত্র। ১/১১’র নাটকীয় ঘটনাবলির মাধ্যমে একটি প্যাকেজ ডিলের আওতায় ২০০৮ সালের শেষ দিনের নির্বাচনে দূরদেশী এবং প্রতিবেশীর সহযোগিতায় তারা ক্ষমতায় আসে। যেহেতু তাদের দৃঢ় উপলব্ধি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তারা আর ক্ষমতায় আসবে না সে জন্য ২০১১ সালে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করে। ২০১৪ এবং ২০১৮-এর গল্প সবার জানা কথা। শাসন কাঠামো ও নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তন করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছে। অর্থনৈতিক ভাবে দেশকে দেউলিয়াত্বের প্রান্ত সীমায় পৌঁছে দিয়েছে। সামাজিক মূল্যবোধে এতটাই ধস নেমেছে যে, সন্তান পিতাকে হত্যা করছে, মা তার সন্তানকে বিক্রি করছে এবং নারীর ইজ্জত নষ্ট হচ্ছে যত্রতত্র। তাই রাষ্ট্র মেরামতের বিষয়টি শুধু সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই কাঠামোর বিস্তৃতি সাংবিধানিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক। সঙ্গতভাবেই মানুষ শাসকদলের বিপরীতে বিরোধী দল বিশেষত বিএনপি থেকে তা প্রত্যাশা করে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির পক্ষে গণজোয়ার এই প্রত্যাশার সাক্ষ্য দেয়।

জনগণের এই প্রত্যাশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিএনপি গত সোমবার ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা ঘোষণা করে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কর্তৃক ভাষণে রূপরেখা ঘোষিত হয়। এর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে তারেক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ সম্প্রতি চরম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটে পর্যুদস্ত। চাল, ডাল তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, জ্বালানি, গ্যাস, পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন ও বিদ্যুতের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পরিবহন ব্যয় অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একদিকে নজিরবিহীন মূল্যস্ফীতি অন্যদিকে অনির্বাচিত সরকারের দুঃসহ দুঃশাসন মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।’ ২৭ দফার এই ঘোষিত রূপরেখায় বিরোধী দল ও সিভিল সোসাইটির উত্থিত দাবিগুলোর সমন্বয় ঘটেছে। উল্লেখ্য যে, বিরোধী গণতন্ত্র মঞ্চ ও জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল অভিন্ন ভাষায় না হলেও মোটামুটি ১০ দফার একই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

ঘোষিত রূপরেখার দফাগুলো নিম্নরূপ :
১. সংবিধান সংস্কার কমিশন। ২. জাতীয় পুনর্মিলন কমিশন (National Reconciliation Commission) ৩. নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন। ৪. রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনয়ন। ৫. পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। ৬. জাতীয় সংসদে উচ্চ কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন। ৭. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ৮. প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২ সংশোধন। ৯. সকল রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান পুনঃগঠন। ১০. জুডিশিয়াল কমিশন গঠন। ১১. প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন। ১২. মিডিয়া কমিশন গঠন। ১৩. দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ। ন্যায়পাল নিয়োগ। ১৪. সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। মানবাধিকার বাস্তবায়ন। ১৫. অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন। ১৬. ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। ১৭. শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতকরণ। ১৮. বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল। ১৯. বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া। (ক) বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাস্ত করা হবে না। (খ) সন্ত্রাসী তৎপরতা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ। (গ) সন্ত্রাসবাদের তকমা লাগিয়ে ভিন্নমতের বিরোধী শক্তি এবং রাজনৈতিক বিরোধী দল দমনের অপতৎপরতা বন্ধ। ২০. প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিতকরণ। ২১. স্থানীয় সরকারের অধিকতর ক্ষমতায়ন ও বিকেন্দ্রীকরণ। ২২. মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন এবং তাদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান। ২৩. আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন। শিক্ষিত বেকারদের বেকারভাতা প্রদান। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি বিবেচনা। ২৪. জাতীয় সংসদে নারী মনোনয়নে প্রাধান্য। ২৫. চাহিদাভিত্তিক ও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা। ২৬. সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা প্রবর্তন। ২৭. কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ।

ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখার বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি প্রতিটি দফার পটভূমি ও যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। এতে দফাগুলো আরো স্পষ্ট হয়। যেমন প্রথম দফায় সংবিধান সংশোধনে গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তি (Social Contract)’র বলা হয়েছে। সপ্তম ধারায় সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রশ্নে সীমারেখা নির্দেশ করা হয়েছে। অষ্টম দফার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ‘ইভিএম নয়, সকল কেন্দ্রে পেপার ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান নিশ্চিত করা হইবে।’ দশম দফায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তথা বর্তমান বিচারব্যবস্থা সংস্কারের যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। পঞ্চদশ দফায় অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠনের বাধ্যবাধকতা স্পষ্ট হয়েছে। একবিংশ দফায় চমৎকারভাবে স্থানীয় সরকার বিষয়ে বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গির যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়েছে। ২৩তম দফায় চাকরিতে বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাবটি বাস্তবানুগ মনে হয়েছে। অবশেষে রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা অধিকতর সমৃদ্ধ করতে সকলের গঠনমূলক পরামর্শ চাওয়া হয়েছে। সূচনা বক্তব্যে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘‘বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়া এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়িয়া তুলিয়াছিল সেই রাষ্ট্রের মালিকানা আজ তাহাদের হাতে নাই। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামোকে ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া ফেলিয়াছে। এই রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনঃগঠন করিতে হইবে। দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরাইয়া দেওয়ার লক্ষ্যেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয় লাভের পর বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার হঠানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐক্যমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হইবে। উক্ত জাতীয় সরকার ও রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করিবে।’’

ঘোষিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা গোটা জাতির প্রত্যাশার প্রতিচ্ছবি। জনগণের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক নিস্পৃহতায় ভোগে। তারা বলে, দু’টি দল মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বাংলাদেশে যে লুটেরা সংস্কৃতির প্রবর্তন ক্ষমতাসীনরা করেছে তার পরিবর্তন বড়ই কঠিন। এ পর্যন্ত বিএনপির তরফ থেকে প্রকাশ্য প্রতিশ্রুতি ছিল না। অনেকগুলো সংবেদনশীল বিষয়ে যেমন নেতৃত্বের মেয়াদকাল ও দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, অনেক সংস্কারকামী নাগরিককে তুষ্ট করবে। তবে শিক্ষাব্যবস্থা বা ছাত্ররাজনীতির মতো বিষয়ে বক্তব্য না থাকায় অনেকে ক্ষুণ্ণ হয়েছেন। ইতঃপূর্বে কূটনীতিকদের সাথে বক্তব্যে ইসলামিক স্কলারদের উপরে সরকারি নির্যাতনের উল্লেখ ছিল। এবারে একটি শব্দও নেই; এতে বিএনপির সমর্থক বিশাল আলেম-ওলামা গোষ্ঠী হতাশ হবে। তবে বাম ধারার লোকেরা ওই উচ্চারিত বাক্যের সমালোচনা করেছে। শুধু ভোটের রাজনীতি নয়, বিএনপির আদর্শিক স্বার্থেও ইসলামী মূল্যবোধের মধ্যম ধারাকে ধারণ করতে হবে। আশার কথা এই যে, ঘোষিত রূপরেখায় অবশেষে বলা হয়েছে পরবর্তীতে যথাসময়ে অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক সংস্কার প্রস্তাব ও উন্নয়ন কর্মসূচি প্রকাশ করা হবে। জনমত যাচাই-বাছাইয়ের পর রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা আরো বাস্তবানুগ ও জীবনঘনিষ্ঠ হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement