২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রূপকথার মেসি বাংলাদেশে বেড়াতে আসুন

ট্রফিতে চুম্বন দিচ্ছেন লিওনেল মেসি। হাতে গোল্ডেন বল। - ছবি : সংগৃহীত

দোহার আইকনিক লুসাইল স্টেডিয়ামে ১৮ ডিসেম্বরের রাত ছিল একান্তই লিওনেল মেসির। আনন্দ বন্যা আর আলোর ঝলকানির মধ্যে বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে নিয়ে মেসি বললেন, ‘স্রষ্টাকে ধন্যবাদ। তিনি আমাকে সবই দিয়েছেন।’

লিওনেল মেসি, আপনাকে অভিনন্দন। কাতার বিশ্বকাপ জয় করে আপনি যে অনন্য রূপকথা সৃষ্টি করলেন, বিশ্ব ফুটবলে সেটা ‘মেসির রূপকথা’ হয়ে থাকবে। ডিয়েগো ম্যারাডোনা আজ বেঁচে নেই। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। কারণ ম্যারাডোনা নামের এক প্রায় অতিমানবের পায়ে বিশ্বকাপ জেতার ৩৬ বছর পর আবারও আর্জেন্টিনা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলো। আর এই বিস্ময়কর জয়ের রূপকার লিওনেল মেসি, তিনি ম্যারাডোনারই উত্তরসূরি, তাঁরই প্রিয় একজন।

লুসাইল স্টেডিয়ামে কাতার বিশ্বকাপ ২০২২-এর ফাইনাল খেলাটি ফুটবল ইতিহাসে সম্ভবত সর্বকালের সেরা ফাইনাল বলে বিবেচিত হবে। ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মতে খেলার মান, নাটকীয়তা এবং রুদ্ধশ্বাস সবকিছু মিলেই এটা ছিল এক অতুলনীয় ফাইনাল খেলা। ১২০ মিনিটের খেলায় ৩-৩ গোলে সমতার পর শুট আউটে খেলার ভাগ্য নির্ধারিত হয়।

এই ম্যাচে বড় প্রাপ্তি লিওনেল মেসির। বিশ্বকাপটাই বাকি ছিল ফুটবল জাদুকরের। কাতার বিশ্বকাপ মেসির এই অপ্রাপ্তিও ঘুচিয়ে দিলো। বিশ্বকাপ জেতা হয়নি এ আক্ষেপ তাঁকে আর বয়ে বেড়াতে হবে না। দেড় দশকের ক্যারিয়ারের শেষে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে গত ১৮ ডিসেম্বর বিশ্বকাপ জেতার মেসির স্বপ্নপূরণটা তাই খুব সুন্দর হয়েছে।

লুসাইন স্টেডিয়ামে এই বিশ্বকাপের সরাসরি সাক্ষী হয়েছে ৮৮ হাজারের বেশি দর্শক। তারা ছাড়াও টিভি সেটের সামনে বসে দেখেছে বিশ্বের কোটি কোটি দর্শক। তারা সবাই এই ফাইনালকে লিওনেল মেসির বলেই মনে রাখবে। মেসি জিতুক, ট্রফিটা তার হোক, এটা বেশির ভাগ ফুটবল দর্শকেরই চাওয়া ছিল। না, শুধু ফুটবল দর্শকই নয়, খেলোয়াড়, সংগঠকরাও চেয়েছেন। এমনকি ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশমও বলেছেন, বিশ্বকাপটি মেসির প্রাপ্য।’ সেটাই হয়েছে। মেসির এখন সব আছে। তাই লুসাইল স্টেডিয়ামে আনন্দ বন্যার মাঝে ট্রফিটা হাতে নিয়ে বিশ্বকাপকে হাসিমুখে বিদায় জানিয়েছেন মেসি। আর বলেছেন, ‘আমরা প্রচুর ভুগেছি। তবে শেষ পর্যন্ত ট্রফিটা হাতে এলো। এর চেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারতাম?’

এবার কাতার বিশ্বকাপে অনেক রেকর্ডও গড়েছেন মেসি। বিশ্বকাপ ইতিহাসে একমাত্র ফুটবলার মেসি গ্রুপ পর্বে, দ্বিতীয় রাউন্ডে, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমি ফাইনালে এবং ফাইনালে গোল করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

এবারের বিশ্বকাপে সেরা ফুটবলার হয়েছেন মেসি। সাতটি গোল করার পাশাপাশি তিনটি গোল করিয়েছেন। বিশ্বকাপে সর্বাধিক গোলের তালিকায় ফ্রান্সের কিলিয়ান এমবাপ্পে টেক্কা দিলেও সোনা বল পেয়েছেন মেসি। ২০১৪ সালে বিশ্বকাপেও সোনার বল জিতেছিলেন মেসি। সেবার চোখের পানিতে সেই পুরস্কার নিয়েছিলেন।

এবার নিলেন হাসতে হাসতে। পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলা ৬ বিশ্ব ফুটবলারের একজন হলেন মেসি। মেসি ছাড়া এই কৃতিত্ব রয়েছে মেক্সিকান অ্যান্তোনিও কারবাহাল, আন্দ্রেস গুয়াদ্রাদো ও রাফা মার্কুয়েজ এবং জার্মানির লোথার ম্যাথিউস এবং পর্তুগালের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন মেসি ২৬টি। এর আগে জার্মান কিংবদন্তি ম্যাথিউসের ২৫টি ম্যাচ খেলার রেকর্ড রয়েছে। অধিনায়ক হিসেবে ১৯টি ম্যাচ খেলে অনন্য এক চূড়া ছুঁয়েছেন মেসি। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি সময় মাঠে থাকা খেলোয়াড়ের রেকর্ডও মেসির। তিনি মাঠে ছিলেন ২,৩১৪ মিনিট। এর আগে ইতালির পাওলো মালদিনির রেকর্ড ছিল ২,২১৭ মিনিটের। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল এখন মেসির। এ বিশ্বকাপের ৭ গোলসহ মোট ১৩টি গোল করেছেন মেসি। ২০১৪ সালের ফাইনালের আগে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে ৯২টি ম্যাচে মেসির ৪২ গোল ছিল। আর ১৮ ডিসেম্বর কাতার বিশ্বকাপ ফাইনাল নিয়ে ১৭২টি ম্যাচে ৯৮ আন্তর্জাতিক গোল করেছেন তিনি। ২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হওয়ার পর এই ম্যাচ ও গোলের ফলে তিনি নিজ দেশের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতায় পরিণত হয়েছেন। এ ছাড়া তিনি সাতটি ব্যালন ডি’অর জিতেছেন।

বিশ্বকাপটা আমার চা-ই
আগেই উল্লেখ করেছি, লিওনেল মেসির ব্যক্তিগত অর্জনের আর কিছু বাকি নেই। ২০২১ সালে ব্রাজিলের বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে কোপা আমেরিকা শিরোপা জেতার পর মেসির কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল- পরের স্বপ্নটা কী? সেদিন মেসি শুধু হেসেছিলেন। হাসি দিয়ে তিনি বুঝিয়েছিলেন- ‘আমার চোখ কাতার বিশ্বকাপ-২০২২ এর দিকে। বিশ্বকাপটা আমার চাই-ই।’ অবশেষে স্বপ্নটা পূরণ করেই ছাড়লেন। ক্যারিয়ারের পঞ্চম বিশ্বকাপ মেসিরই হলো।

আর্জেন্টিনা ফরোয়ার্ড হুলিয়ান আলভারেজ-এর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হলো। তিনি বলেছিলেন-কাতার বিশ্বকাপটা বুঝে নেয়াই হবে মেসির কাজ। ঠিক তাই, মেসি কাতার বিশ্বকাপ বুঝে নিয়েছেন। আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কালোনি বলেছিলেন, মেসি শুধু আর্জেন্টিনার নয়, বিশ্বের সম্পদ। কোচ স্কালোনি সঠিকই বলেছিলেন। মেসি বিশ্বসম্পদ। এই বিশ্বকাপেও তার খেলার জাদু ফুটবল দর্শকদের মোহিত করেছে, অপার আনন্দ দিয়েছে। সেমি ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার সাথে খেলায় মেসির সেই জাদুর চমক ফুটবল দর্শকদের চোখে লেগে আছে। বল পায়ে মেসির সাপের মতো আঁকাবাঁকা দৌড়, মন মাতানো ড্রিবলিং, ছোট ছোট পাস, দৃষ্টিনন্দন গোল ও বুদ্ধিদীপ্ত অ্যাসিস্টের ঝলক দর্শকদের জন্য এক অপার আনন্দ। তাইতো মেসির খেলা দেখার জন্য দর্শকরা এত পাগল! এবারের বিশ্বকাপেও মেসি এসব জাদু দেখিয়েছেন।

মেসি যে, একজন সৃষ্টিশীল প্লেমেকার সে কথা ম্যারাডোনা বলে গেছেন। বলেছেন ফুটবলের রাজা পেলেও। পেলে বলেন, ‘আমি মেসিকে পছন্দ করি। কারণ সে অসাধারণ খেলোয়াড়।’ আর ম্যারাডোনা বলে যান, ‘আমি সেই খেলোয়াড়কে দেখেছি যে আর্জেন্টিনায় আমার জায়গা দখল করেছে। সে হলো মেসি।’ জার্মানির ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের মন্তব্য ছিল- ‘আমি যখন মেসিকে দেখি, তখন ম্যারাডোনার কথা মনে হয়।’ বার্সেলোনার কোচ গার্দিওলার মন্তব্য ছিল- ‘মেসিকে নিয়ে লিখো না, তাকে বর্ণনা করার চেষ্টা করো না। শুধু দেখে যাও।’ কোচ স্কলারির মন্তব্য ছিল- ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর জীবনে একমাত্র খারাপ জিনিস হলো মেসি। সে না থাকলে রোনালদোই হতো বিশ্বসেরা’ ফুটবলার। লুইস ফিগোর মন্তব্য ছিল- ‘আমার জন্য মেসির খেলা দেখা অপার আনন্দের।’ বিবিসি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষণে জারমেইন জেনাস মন্তব্য করেন- ‘লিওনেল মেসিকে দেখে মনে হয়েছে, তিনি মাঠের সবচেয়ে ঠাণ্ডা মাথার মানুষ।’ মেসি এমনই। ফুটবল বিশ্ব তাকে স্বল্পভাষী এবং বিনয়ী হিসেবেই চেনে।

আর্জেন্টাইন গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্টিনেজ খুব খুশি। ম্যাচের আগে তিনি বলেছিলেন, মেসির জন্য জীবন দিতে পারেন। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে পেনাল্টি শট আউটের নায়ক মার্টিনেজ আরো একবার নায়ক হয়ে উঠলেন। ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে শুট আউটে মেসিকে তিনি বিশ্বকাপ উপহার দিলেন।

ম্যারাডোনার পাশেই এখন উচ্চারিত হচ্ছে মেসির নাম। ১৯৮৬-এর বিশ্বকাপে পাঁচ গোল ও পাঁচটি ‘অ্যাসিস্ট’ করেছিলেন ম্যারাডোনা। মেসি এবার করলেন সাত গোল ও বানিয়েছেন আরো তিন গোল। ম্যারাডোনার মতোই তিনি বিশ্বকাপ জয়ের পাশাপাশি গোল্ডেন বলও জিতেছেন।

কাতারের ধন্যবাদ প্রাপ্য
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল আসরের জন্য কাতারের অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য। আরব বিশ্বে এবং মুসলমান দেশে এই প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন। এত সুন্দর আয়োজন বিশ্ব হয়তো দেখেনি। ফিফা সভাপতিই শুধু নন, ফুটবলের সঙ্গে জড়িতরা প্রায় সবাই একবাক্যে কাতারকে অভিনন্দন জানিয়েছে সুন্দর আয়োজনের জন্য। বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য কাতার ২২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছে। অসম্ভব সুন্দর আটটি স্টেডিয়াম তৈরি করেছে। খেলায় জৌলুশ এবং আনন্দ-বিনোদনের কমতি ছিল না। নিজ দেশের সংস্কৃতি এবং ইসলামী ঐতিহ্যের সঙ্গেও আপস করেনি কাতার। এ নিয়ে কারো কোনো অভিযোগও ছিল না। গত প্রায় এক মাস ধরে বিশ্বকাপের খেলাগুলো চমৎকারভাবে হয়েছে। উদ্বোধনী এবং সমাপনী অনুষ্ঠানে আলোর বন্যা বইয়ে দেয়া হয়েছে।

মেসির জন্য বাংলাদেশে প্রাণোল্লাস
বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশে সব সময়ই উন্মাদনা হয়। বাংলাদেশের দর্শকরা বিশ্বকাপের উত্তেজনায় সবসময় মাতোয়ারা হন। বিশেষ করে আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলকে নিয়েই হইচই তাদের বেশি। তবে এবার আর্জেন্টিনার জন্য মাতোয়ারা বেশিই ছিলেন। ম্যারাডোনা এবং মেসির জন্যই এই উচ্ছ্বাস। আর্জেন্টিনার খেলার দিন মনে হতো যেন বাংলাদেশই খেলছে। এই উন্মাদনা সবার দৃষ্টি কেড়েছে। আর্জেন্টিনা এজন্য বাংলাদেশে দূতাবাস খোলারও চিন্তা করছে। আর্জেন্টিনা ও মেসির জন্য বেশ কয়েকজন মারাও গেছেন। ১৮ ডিসেম্বর লুসাইল স্টেডিয়ামের ফাইনাল খেলা দেখেনি এমন বাংলাদেশী হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। বড় পর্দায়, বড় জায়গায় হাজার হাজার দর্শক খেলা দেখেছেন। খেলা দেখার বিশাল বিশাল সমাবেশ হয়েছে। ওই রাতে ঢাকা শহরটাই যেন আর্জেন্টাইন দর্শকের শহরে পরিণত হয়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে মেসি ঢাকায় এসেছিলেন। সেদিন নগরীর ফুটবল দর্শকরা আনন্দে ভাসছিলেন। মেসির অবিস্মরণীয় জয়ে বাংলাদেশ উৎফুল্ল। বাংলাদেশীরা চায় তাদের প্রিয় মেসি এখানে আসুন, বেড়িয়ে যান। তাই বাংলাদেশ বেড়াতে আসুন লিওনেল মেসি, আপনার ভালোবাসার মানুষগুলোকে দেখে যান।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement