ড. মানে হাম্মাদ আল-জুহানির দর্শন ও জীবনচর্চা
- ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
- ১৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯:৫৪
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী পণ্ডিত, দাওয়াহকর্মী, ওয়ার্ল্ড অ্যাসেম্বলি অব মুসলিম ইয়ুথের মহাসচিব, সৌদি সরকারের পরামর্শক পরিষদের সদস্য ড. মানে ইবন হাম্মাদ আল-জুহানির দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন ২০ বছর হয়ে গেল। সড়ক দুর্ঘটনায় তার মর্মান্তিক মৃত্যু মুসলিম বিশ্বে বিশেষত যুবকদের মধ্যে এখনো বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করছে। প্রতি মুহূর্তে তার অনুপস্থিতি অনুভূত হচ্ছে।
১৯৪২ সালে সৌদি আরবের তায়েফে জন্মগ্রহণ করেন। এ মনীষী তায়েফে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে ১৯৪২ সালে রিয়াদের কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। সে সময় মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশন ও ইসলামিক সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকার (আইএসএনএ) চেয়ারম্যান ছিলেন। পরবর্তী সময়ে রিয়াদের কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৭৫-১৯৯২) ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবনের সূচনা করেন।
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে ড. মানে আল-জুহানির দক্ষতা ছাত্রাবস্থায় তাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ও অনেক ইউরোপীয় দেশে ইসলাম ধর্মপ্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে বেশ সহায়তা প্রদান করে। যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নকালীন তিনি ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন। বিশেষত কানাডা ও আমেরিকার মুসলিম ছাত্র সমিতিকে তিনি সংগঠিত করেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ছাত্রদের ভর্তির ব্যাপারে তার প্রয়াস ছিল অগ্রণী ও আন্তরিক। আরব মুসলিম যুব পরিষদের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। তিনি ওয়ার্ল্ড অ্যাসেম্বলি অব মুসলিম ইয়ুথের (ডাব্লিউএএমওয়াই) সহকারী মহাসচিব ও পরবর্তীতে এক দশক ধরে মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। আমৃত্যু তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। আরবের বাইরে ওয়ামির তৎপরতাকে সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ড. জুহানি ছিলেন অগ্রণী। প্রারম্ভিক অবস্থায় ওয়ামি হেড কোয়ার্টারে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২০ জন। ড. জুহানির সময়ে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫০-এ উন্নীত হয়। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বিশ্বের প্রায় গুরুত্বপূর্ণ দেশে ওয়ামির অফিস খোলা হয়। এর আগে ওয়ামির আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্ব পরিচালিত হতো প্রতিটি মহাদেশে একটি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে।
জীবনীশক্তি নিঃশেষকারী কিছু ব্যাধি যেমন- ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত হলেও তিনি কখনো এসব স্বাস্থ্যগত জটিলতাকে দাওয়াতি কাজে বাধা সৃষ্টি করতে দেননি। ওয়ামি হেড কোয়ার্টারে তিনি দৈনিক ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করতেন। তিনি দু’-দুবার সৌদি পরামর্শক সভার সদস্য মনোনীত হন। ওয়ামির মহাসচিব হিসেবে তার কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের মধ্যে রয়েছে বেশ ক’টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন। তার আমলে ওয়ামির বার্ষিক বাজেট ছয় মিলিয়ন ডলার থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দিনব্যাপী ‘বিশ্বায়ন ও মুসলিম যুবক’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজনে ব্যতিব্যস্ত সময় কাটান। তার মৃত্যুর দু’মাস পর ২০০৩ সালের ২২-২৫ অক্টোবর সৌদি আরবে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ড. জুহানি ওয়ামির তত্ত্বাবধানে রিয়াদে একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ইসলামী যুবকদের সম্মেলন, শিক্ষাশিবির ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি নবতর উদ্দীপনা নিয়ে অংশ নেন। মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এ মনীষী সারা বিশ্বের ৫০০ ইসলামী সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ওয়ামির সাথে সম্পৃক্ত করে সহায়তা দেন। ড. জুহানিকে তার সাধারণ কর্মকাণ্ডের বাইরে অমুসলিমদের ইসলামের দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে দেখা গেছে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে একটি কমিটি গঠন করে বেশ কিছু পুস্তিকা প্রকাশের ব্যবস্থা নেন। ক’বছর আগে যুক্তরাজ্যে ইসলামী দাওয়াতি কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ইসলামী তথ্যের আন্তর্জাতিক পরিষদ- ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর ইসলামিক ইনফরমেশন (আইটিসিএইচ) নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন ওই সংস্থার ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। কুয়েত আন্তর্জাতিক ইসলামী সেবা সংস্থা, মিসরের আন্তর্জাতিক ইসলামী ও দাওয়াহ সংস্থা এবং চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি ছিলেন নির্বাহী পরিষদের সদস্য।
ইসলামী আকিদা ও বিশ্বাসের ওপর ড. জুহানি ১০টি গ্রন্থ, ১২টি বুকলেট ও ১২টি সুচিন্তিত গবেষণা নিবন্ধ রচনা করেন। তার লিখিত গ্রন্থাবলির মধ্যে- The Truth About Jesus, Islamic Renaissance, A Future Look and Encyclopedia of Muslim Minorities অন্যতম। শায়খ সালিহ উসাইমিনের আরবি ভাষায় লিখিত গ্রন্থ ও ড. ফাতিহ ইয়াকানের আরবিতে লিখিত গ্রন্থের ইংরেজি তরজমা করে নিম্নোক্ত শিরোনামে প্রকাশ করেন- The Muslim Belief I Problems faced by Dawah Workers.
তার প্রতিটি গবেষণা মূলত ইংরেজি ভাষায় রচিত হতো। পরবর্তীতে বিশ্বের ৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়ে পাঠকদের হাতে পৌঁছত। এসব গ্রন্থ, নিবন্ধ ও প্রচারপত্র বিভিন্ন দেশে অমুসলমানদের ইসলামের পথে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এ ছাড়া তিনি সৌদি টেলিভিশনে Islam and Perspective শিরোনামে দু’বছর ধারাবাহিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। Islamic Belief and Teaching শীর্ষক আরবি ও ইংরেজি ভাষায় গালফ টিভিতে প্রচারিত তার প্রোগ্রাম আরব বিশ্বে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। The propaganda of Sheikh Mohammed Ibn Abd Al Wahab, the essential nature of Sufism, The creed of Ahle Sunnah wal Jamaah পাঠকনন্দিত।
ড. মানে হাম্মাদ আল-জুহানির একাডেমিক সক্ষমতার কথা উল্লেখ না করেও এ কথা বলা যায়, তার দক্ষতা, অটল ভক্তি, উদ্যম, বুদ্ধি তার জোড়া প্রকল্পকে চালিত করেছে। প্রকল্পদ্বয় হলো- ওয়ামি ও দাওয়াহ। ইসলাম ও মুসলমানের স্বার্থ ছিল তার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। সৌদি আরবের শূরা কাউন্সিলের ইসলামিক বিষয়ক উপ-কমিটির প্রধান হিসেবে তিনি ফিলিস্তিন, কাশ্মির ও চেচনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনসহ ইসলামিক বিষয় এবং মুসলিম বিষয়গুলোতে গভীর আগ্রহ রাখতেন।
২০০৩ সালের ৪ আগস্ট সৌদি যুবরাজ আবদুল্লাহ ইবন আবদুল আজিজের সাথে, ‘বিশ্বায়ন ও মুসলিম যুবসমাজ’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করার উদ্দেশে রিয়াদ থেকে জেদ্দাগামী বিমান ধরতে রিয়াদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অনতিদূরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি প্রাণ হারান। ড. জুহানির ইন্তেকালে গোটা দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার যুব দাওয়াহকর্মী এতিম হয়ে গেল। অনাড়ম্বরপূর্ণ জীবন, উচ্চচিন্তা, সারল্য, হাসিমাখা চেহারা, পরকে সাহায্য করার অদম্য ইচ্ছা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথ দেখাবে। তার বিদায় সত্যিকার অর্থে বিশ্বব্যাপী ইসলামী আন্দোলনের ময়দানে বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসের উচ্চাসনে অভিষিক্ত করুন, আমিন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা