‘রাজনীতিতে সম্প্রীতি থাকুক’
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:২৮, আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ২১:০২
ইংরেজি ভাষায় তিন শব্দের একটি মশহুর বাক্য রয়েছে, ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’। আমরা বাংলায় তার এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি, ধরে এই ওল্ডকে বয়োবৃদ্ধ চলচ্ছক্তিহীন কোনো ব্যক্তি নয়। বস্তুত সে প্রবীণ তবে বয়সের ভারে নুয়ে পড়েনি, তার বিবেক-বুদ্ধি বিচার সুবিবেচনা, বহু দিনের অভিজ্ঞতায় আরো তীক্ষèতর হয়েছে। সংবেদনশীলতাসহ বহু গুণে বেড়ে যায়। আর গোল্ড বলতে এটাই বোধগম্য হয়, তা নিছক কোনো জড় ধাতব পদার্থ নয়। সচল বহুদর্শী, মুদ্রার আরেকটি পিঠ দেখতে যিনি অভ্যস্ত, বিজ্ঞ অভিজ্ঞতা এসব গুণের আধার যে, কালের বহু ঘটনা অবলোকন করে নির্মোহ দৃষ্টির অধিকারী হয়েছেন। এমনকি সেসব ঘটনার গতি প্রবাহের ভেতরই শুধু তার অবস্থান নয়, ঘটনার গতি প্রবাহের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও তার স্মরণীয় ভূমিকা থাকে।
এ রকম সমৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা কোনো দেশেই কোনো কালেই অগণিত ছিল না, নেই। এমন স্মরণীয় ব্যক্তির সংখ্যা আমাদের দেশেও মাইক্রোস্কোপিক। সেই রকম গুটি কতক মানুষের মধ্যে যে কিছু ব্যক্তি রয়েছেন তাদের একজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও সে দলের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য জনাব তোফায়েল আহমেদ। স্বাধীনতার পূর্বাপর তার ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের কাহিনী সুদীর্ঘ। কিন্তু আজ আমাদের এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য সেটা বর্ণনা করা নয়। হালে তার কিছু কথা ও পর্যবেক্ষণই আমাদের এই নিবন্ধের প্রধান উপজীব্য বিষয়। আমাদের অনুমান কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন যদি ওপরের উল্লিখিত গুণ মানের কাউকে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন তাদের সাইড লাইনে ফেলে রাখে, তবে সেই ব্যক্তি বা সংগঠনই স্বয়ং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই প্রবীণের অভিজ্ঞতা অভিজ্ঞান থেকে তখন তারা কোনো ফায়দা তুলে নিতে পারে না। জনাব তোফায়েল এখন তার দলের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য। এটাকে আমরা তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো মনে করতে পারি। তবে ‘আউট সাইডার’ হিসেবে ভুল হতে পারে।
আজকে ৮ ডিসেম্বর জনাব তোফায়েলকে সামনে রেখে এই নিবন্ধ লেখার কারণ, গতকাল ৭ ডিসেম্বর দৈনিক সমকালে জনাব তোফায়েল আহমেদের একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সে পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক শাহেদ চৌধুরী। জনাব তোফায়েল সেই সাক্ষাৎকারে বর্তমান ঝড়ো হাওয়ায় ভীষণভাবে দুলতে থাকা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অবশ্যই একটি ভিন্ন ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে বলে বিশ্বাস করা যায় যা হয়তো সংশ্লিষ্ট অনেককেই নতুন করে সব কিছু পর্যালোচনার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পারে। সেই সাক্ষাৎকার থেকে চুম্বক কিছু বাক্য তুলে ধরা হলে পাঠকরা বোধ হয় বুঝবেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার কথাগুলো কত জরুরি ও সময়োপযোগী। প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল মার্জিত স্লোগান, চাই ‘সম্প্রীতি থাকুক রাজনীতিতে।’ সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের বহুল আলোচিত স্লোগান- ‘খেলা হবে’। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। রাজনীতিকরাও মিশ্রপ্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ‘খেলা হবে’ বলে স্লোগান দেয়ার পর থেকেই প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসে। তার ভাষায়, ‘খেলা হবে’ একটি রাজনৈতিক স্লোগান। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ সমকালকে জানিয়েছেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার কথা বলা যেতে পারে। অন্য কিছু নয়। ‘খেলা হবে’ রাজনৈতিক স্লোগান হতে পারে না।’ তোফায়েল আহমেদ এমপি বলেছেন, আক্রমণাত্মক নয়Ñমার্জিত স্লোগান চাই। রাজনীতিতে সম্প্রীতি থাকুক। আমাদের সেইভাবেই কথা বলা উচিত।’ এমন বক্তব্য অবশ্যই একটি নতুন বাতায়ন খুলবে।
জনাব তোফায়েলের প্রতিপক্ষদের মতামতের প্রতি সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধার আর একটি চমৎকার নিদর্শন দেখতে পেয়েছিলাম সম্ভবত ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদের এক বাজেট অধিবেশনে। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। জনাব তোফায়েল সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সিনিয়র কেবিনেট মিনিস্টার। বাজেট সেশনের এক অধিবেশনে বিএনপির কক্সবাজার থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মুহাম্মদ কামারুজ্জামান তখন এক অনবদ্য ভাষণ দিয়েছিলেন। এখানে জনাব জামানের সংক্ষিপ্ত একটি পরিচিতি তুলে ধরতে চাই। তিনি ছিলেন তদানীন্তন পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য তথা এমএনএ মৌলভী ফরিদ আহমদের পুত্র। জনাব ফরিদের নামের আগে মৌলভী জুড়ে দেয়ার একটি কারণ হচ্ছে, তিনি ‘নেযামে ইসলাম’ নামক রাজনৈতিক সংগঠনের টিকিটে কক্সবাজার নির্বাচনী এলাকা থেকে এমএনএ (মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে) নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার কোনো মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। শ্মশ্রুমণ্ডিত জনাব ফরিদ ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ছিলেন। ইসলাম সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান ও ব্যুৎপত্তি ও জীবনাচারে তিনি একজন উৎকৃষ্ট মুসলিম ছিলেন, সে এ জন্য এবং দলের কারণে তাকে মৌলভী বলা হতো। তিনি এমএনএ হিসেবে তদানীন্তন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের (আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ) স্বার্থ সংরক্ষণের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন এবং এ অঞ্চলের বৈষম্য নিয়ে পরিষদ কাঁপিয়ে তুলতেন তার বাগ্মিতায়। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশ্নে তিনি ইতিবাচক ছিলেন না। তার পুত্র জনাব কামারুজ্জামান ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদের বিএনপির টিকিটে এমপি হয়েছিলেন। উল্লিখিত সেই বাজেট অধিবেশনে তিনি অত্যন্ত পরিশীলিত, মার্জিত সুষমামণ্ডিত ভাষায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের খুব তীক্ষ্ণ ক্ষুরধারভাবে তীব্র সমালোচনা করছিলেন। সে সময় মন্ত্রী জনাব তোফায়েল আহমদ সংসদের প্রথম সারিতে নিজ আসনটিতে বসেছিলেন। জনাব জামানের চমৎকার ও মনোমুগ্ধকর ভাষণ শুনে জনাব তোফায়েল তার আসনটিকে বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে একেবারে পিছনের দিকে তাঁর আসন থেকে দাঁড়িয়ে সেই তরুণ এমপির অনবদ্য ভাষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন ও মৃদু মৃদু হাসছিলেন। এ সময় আওয়ামী লীগের অনেক এমপি জনাব জামানের বক্তৃতায় উত্তপ্ত হয়ে উঠছিলেন এবং তাকে কথা বলাতে বাধা দিতে চিৎকার করছিলেন। জনাব তোফায়েল তাদের শান্ত থাকার জন্য হাত তুলে ইশারা করছিলেন। অল্প সময় পরই স্পিকার মহোদয় জনাব জামানের বক্তব্য দেয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে বলে তাকে নিজ আসনে বসার রুলিং দিলেন। ঠিক তখনই মন্ত্রী জনাব তোফায়েল আহমেদ স্পিকারকে উদ্দেশ করে অনুরোধ জানালেন। তার নিজের বক্তৃতা করার নির্দিষ্ট সময় থেকে জনাব জামানকে আর ১০ মিনিট কথা বলার সুযোগ দেয়ার জন্য। সেই ১০ মিনিটে জনাব জামান তার কথা শেষ করে নিজ আসনে বসলেন। এ সময় বিএনপির সদস্যরা করতালি দিয়ে জনাব জামানকে বিপুলভাবে অভিনন্দন জানালেন। তখন মন্ত্রী জনাব তোফায়েল ভিন্ন দলের এমপি জামানের দিকে হাত নেড়ে ও করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানালেন। প্রতিপক্ষের প্রতি এমন আচরণ আমাদের দেশে একেবারেই বিরল ঘটনা। তবে এটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য-শৈলী। সেই দিন মন্ত্রী তোফায়েল আহমদ সেটা চর্চা করেছিলেন। যাই হোক, স্রষ্টা অবশ্যই প্রতিটি মানুষকে সীমাবদ্ধতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষ ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। তবে দিন শেষে যদি দেখা যায়, তার ভুল ত্রুটিগুলো ছাপিয়ে তিনি শুদ্ধাচারের অনুশীলনে উত্তীর্ণ, তবে তিনি অবশ্যই একজন সফল স্মরণীয় বরণীয় মহৎ প্রাণ-অধিকারী। জনাব তোফায়েল তেমনই একজন ব্যক্তি।
জনাব তোফায়েলের ছোট্ট সেই সাক্ষাৎকারের ভিতর অনেক কথাই কৃষ্টালাইজড হয়ে আছে। যে স্লোগান ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী উচ্চারণ করেছেন তাকে কোনোভাবেই শালীনতা ভব্যতার নিরীখে উত্তীর্ণ বলে ধরে নেয়া যায় না। সবচেয়ে অবাক হওয়ার কথা, তিনি যে খেলার কথা বলেছেন, সেটা শুধু অশালীন নয়, এতটা নির্দয় নির্মম হবে, তা কেউ পূর্বে কল্পনাও করতে পারেনি। রাজনীতিকে মনে করা হয় বিবেচনা, সমঝোতা, সহিষ্ণুতা, বুদ্ধিমত্তা, উত্তাপ উত্তেজনাবিহীন তর্ক-বিতর্কের এক উচ্চাঙ্গের যুদ্ধ। তার সবটুকু ঘিরে থাকে দেশ ও দশের কল্যাণ চিন্তা। সেখানে রক্ত ঝরানোর মতো পৈশাচিকতার বিষয় কেউ কস্মিনকালেও ভাবে না। কিন্তু এই জনপদে সেটাই এখন অহরহ ঘটছে। ক্ষমতা সব সময়ই রাজনীতিকদের হাতে একটা ‘আমানতের’ মতো বিষয়, তাকে সযতনে লালন করতে হয়, সংঘাত সংঘর্ষ সংহার করা নয়।
কিন্তু সেই সংঘাত, সংঘর্ষ ও সংহার হচ্ছে তাতে এটা প্রমাণিত হয় যে, তারা আমানতদার নয় যাদের দ্ব›দ্ব-সংঘাত থেকে জাতিকে রক্ষার সব দায়ভার। তারাই এমন মরণ খেলার আহ্বান জানায়। এর মূলত কারণ এখন আমানতদারির অর্থই হয়তো এখানে পাল্টে গেছে। জবাবদিহিতার অর্থ দাঁড়িয়েছে উন্মত্ততায়।
বাংলাদেশ এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সহনশীল এবং দেশ ও দশের কথা বিবেচনায় নিয়ে এবং প্রতিপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধা সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের মাধ্যমে যখন অগ্রসর হওয়ার কথা; তথাপি সেটার কোনো দেখা নেই। নিজেদের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থকে সর্ব উচ্চে স্থান দিয়ে পক্ষ শক্তি ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছে বলে প্রতীয়মান হয়। এতে হয়তো কিছু মানুষ স্বল্পসময় পর্যন্ত ভালোই থাকবে। কিন্তু আমজনতা কিভাবে দিন যাপন করবে সে ভাবনা পক্ষ শক্তির আছে বলে মনে হয় না। তাদের এ সময় সে বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তা ও সে আলোকে কর্মব্যস্ত হয়ে উঠার কথা, কিন্তু তার কোনো নিদর্শন নেই। কিন্তু কথা বলে সব ‘এ ফোঁড় ও ফোঁড়’ করা হচ্ছে অনবরত। প্রবাদ আছে ‘কথায় চিড়া ভিজে না’, তার জন্য পানির দরকার। সে পানিটুকু সিঞ্চন করার কোনো বালাই নেই।
অবশ্য এমন বিষয় তাদের থাকার কথাও নয়, কেননা তারা এ মাটির মানুষের আস্থা সমর্থনধন্য নন। ক্ষমতাকে কূটকৌশল করে নিয়েছে এবং ক্ষমতার ছড়ি ঘুরাচ্ছে। কিন্তু সত্যিকারভাবে যারা সঠিক পথ পদ্ধতি ও আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের স্টিয়ারিং হাতে পায়, তাদের পদে পদে পথের কাঁটা সরাতে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। সর্বক্ষণ উৎকণ্ঠায় কাটে কোথাও কোনো ব্যত্যয় যাতে না হয়।
জবাবদিহিতার লাগাম তাদের কণ্ঠে জড়িয়ে নেন। দেয়ালের লিখন পাঠ করতে মনোযোগী হন। পরচর্চা নয়, আত্মসমালোচনায় নিমগ্ন থাকেন। প্রতিপক্ষের দুই চোখ তাদের দর্পণ, সেখানে চোখ রেখে দেখতে হয় এখন দিনমান কতটা স্বস্তির স্বাচ্ছন্দ্যের। আর সর্বোচ্চ স্থান দিতে হয় এই জনপদের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে বসবাসকারী বিপুল জনগোষ্ঠীর কপালে বলি রেখার সৃষ্টি হচ্ছে কি না বা কারো ভ্রুকুঞ্চিত হচ্ছে না তো। প্রযুক্তির কল্যাণে আজকের বিশ্বের দেশগুলো সব যেন বিশাল এক গ্রামে পরিণত হয়েছে। তার প্রতিটি কোণে কী ঘটছে, সেখবর যেমন রাখতে হয়, তেমনি ওয়াকিবহাল থাকতে হয় তাদের নিয়ে বিশ্ব গ্রামের ও প্রান্তে কে, কি দেখছে, ভাবছে, বলছে।
ndigantababar@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা