০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

বিজয়ের এই মাসে কী লিখব

- ছবি : সংগৃহীত

এই শিরোনাম আমাকে অনেকটাই বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে। লেখার জন্য এতসব বিষয় থাকতে কেন কি লিখব, বলছি? এর কি কোনো প্রশ্নহীন জবাব দেয়া সম্ভব? আমরা তো জানি, যেকোনো কথার উল্টো পিঠে যুক্তির তরবারি আছে। যে যুক্তি আমি দেবো, ঠিক উল্টোটাও তুলে আনা সম্ভব। আধুনিক তর্কময় সমাজ সংসারে সামাজিক ও রাজনৈতিক যুক্তি ও তর্কের অভাব নেই। তবে যার অভাব সর্বত্র, তা হলো সেসব যুক্তিকে গ্রাহ্য করা। অর্থাৎ নিজের যুক্তির বিপরীতে দেয়া অন্যের যুক্তি মেনে নেয়ার মানসিক ক্ষমতা থাকাটা জরুরি। সেই ক্ষমতা আমাদের দেশে নেই। আমরা সেইসব যুক্তিতে অটল, যা আমাদের স্বার্থের পক্ষে এবং আমাদের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম, তাই সুযুক্তি, তাই আমাদের জন্য সব থেকে ভালো।

এই একদেশদর্শী মনোভাবই আমাদের প্রধান শত্রু
আজ আমাদের ‘বিজয় দিবস’ যখন লিখছি, তখন এই কথা দিয়েই শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা হয়ে যাবে একদিন পর, তাই তা বাসি। তাই লিখছি আজ আমরা আছি বিজয় মাসের ছায়ায়। ১৯৭১ আমাদের চেতনায় যেভাবে বদ্ধমূল তারও চেয়ে অনেক বেশি ক্ষত আর রক্ত ঝরিয়ে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতা। কিন্তু সেই স্বাধীনতার যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সেটা আমরা অর্জন করতে পারিনি। আমরা সেই লক্ষচ্যুত হয়েছি। স্বাধীনতার মৌলশক্তি ছিল শোষণের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার দাবি। কারণ, পাকিস্তানি শাসকেরা আমাদের সম্পদ শুষে নিচ্ছিল। আমরা তার প্রতিবাদ করায় আমাদের চিন্তা ও ভাবনাকে হত্যা করে দমন করতে চেয়েছিল। একটি জাতিকে সর্বাংশে ধ্বংসের জন্যই পাকিস্তানি সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি ওই নৃশংস দমননীতি গ্রহণ করে।

পাকিস্তানি সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা বাংলাদেশের জাতীয় চিন্তার যারা সেরা সন্তান, যারা জাতির নেতৃত্ব দিয়ে শত শত বছরের সাংস্কৃতিক চেতনার জন্ম দিয়েছে, সেই সত্তাকেই হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা অনেকটাই সফল বলে ধরে নেয়া যায়। কারণ আমাদের সূর্যসন্তানদের আমরা ৯ মাসের যুদ্ধেই কেবল হারাইনি, একাত্তরের বিজয়ের প্রাকমুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা। যাতে দেশটা সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়াতে না পারে। ১৯৭২ সালে কি আমরা সেইরকম একটি আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে পড়িনি? যখন জাতিগঠনে আমাদের প্রয়োজন ছিল ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ও জাতিসত্তা বিনির্মাণ করে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করার, ঠিক সেই সময় চারদিক থেকে ছুটে আসে হায়েনার মতো রাজনৈতিক বিভাজনের বিষয়-আশয়। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভেতরেই গজিয়ে ওঠে সরকারবিরোধী চক্র, ছাত্রলীগ ভেঙে সৃষ্টি হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং এই জাসদের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বা আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি দেশের সামাজিক পরিস্থিতিকে হত্যার রাজনীতিতে পরিণত করে। তার আগে পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি শ্রেণী বিপ্লবের নামে দক্ষিণপন্থী আওয়ামীদের বিরুদ্ধে হত্যা ও ভয়ের একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে। সেই সূত্রেই জাসদ আওয়ামী নির্মূলে গণহত্যার পথে নামে। এভাবেই দেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে দেখা যায়। ফলে আমাদের স্বাধীনতার মৌলিক যে ধারাটি ছিল, সেই সামাজিক ন্যায় কায়েম, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের আকরণে সাম্যবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার বিকাশ করার মাধ্যমে গোটা জাতির সত্তা বিনির্মাণ। পাকিস্তানিরা যে উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়েছে ১৯৭১ সালে, গত ৫০ বছরে আমরা তা সাধন করেছি না বুঝে ও স্বার্থরক্ষার রাজনীতি করে।

তাই আজ আর এ-কথা ভুলতে পারি না যে, ১৯৭১ সালে আমরা যেভাবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলাম, আজকে সেই সার্বিক ঐক্য আমাদের মধ্যে নেই। নেই তার রাজনৈতিক কারণ, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বহুদলীয়, বহুমতের ও পথের যে শোভা, সেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ফলে যে বিবাদ ও বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছিল, যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস কায়েম করা হয়েছিল তারই আউটফল হয়ে দেখা দেয় হত্যার রাজনীতি। আজ সেই হত্যার রাজনীতির ঘৃণাই সর্বত্র উপ্ত হয়েছে, হচ্ছে।

গত ৫০ বছরে আমাদের অনেক সেক্টরে উন্নয়ন ও উন্নতি হয়েছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক সত্তা বিনির্মাণে আমরা পুরোপুরিই ব্যর্থ। রাষ্ট্র কাঠামোতে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আকরণ (স্ট্রাকচার) যাকে আমরা প্রশাসনধারা বলি, রাজনীতির ক্ষেত্রেও সেই ঔপনিবেশিক চিন্তা ও স্বার্থই প্রবহমান। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের সঙ্গে যেরকম আচরণ করত, সেই লিগেসিই স্বাধীন দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে চলছে। এই প্রশাসনই আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতীক গণতন্ত্রের প্রধান শত্রু। চলমান রাজনীতিই আমাদের কাক্সিক্ষত গণতন্ত্রের প্রধান অন্তরায়। এই দুই পক্ষই চায় না যে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রশাসনে গণতন্ত্র কায়েম হোক। কারণ তারা জনগণের সেবক না হয়ে ব্রিটিশদের অবশেষ পাকিস্তানি শাসকদের প্রজা হিসেবে জনগণকে দেখে। এই প্রশাসন যে দুর্নীতিমুক্ত হতে পারে না, তারও কারণ এটা। একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে মন-মানসিকতা বিষয়ে।

দেশে বেসরকারি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে পাঁচটি, উৎপাদন সক্ষমতা মাত্র ১১৬ মেগাওয়াট। পাইপলাইনে থাকা ১৮টি বেসরকারি কেন্দ্র মিলে এই খাতে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা হবে এক হাজার ১১৪ মেগাওয়াট। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জের ফাঁদ থেকে শিক্ষা না নিয়ে, সৌরবিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তিও হয়েছে ডলারে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভারতের তুলনায় ১০-২০ গুণ বেশি দামে সৌর বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি হয়েছে। এতে কুইক রেন্টালের মতো বোঝা হয়ে উঠছে সৌরবিদ্যুৎ (৮ নভেম্বর ২০২২, শেয়ারবিজ)।

২০২০ সেপ্টেম্বরে ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ভারত ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে ক্রমেই কমছে। ভারতে ২০১৯-২০ সালে দুই হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নিলামে রেকর্ড কম দামে লাইসেন্স দিয়েছে, প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ছে দুই টাকা ৭৩ পয়সা (২.৩৬ রুপি)। কাছাকাছি সময়ে দুবাইয়েও দুই গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নিলামে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় স্থির হয়েছে এক টাকা ৪২ পয়সা (১.৩৫ সেন্ট)।

বিপরীতে বাংলাদেশে সরকারি মালিকানাধীন দুটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদনে খরচ পড়ে ইউনিটপ্রতি ১৩-১৪ টাকা। নির্মাণাধীন ও পরিকল্পনাহীন সরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে ব্যয় হবে প্রতি ইউনিটে ১৩ থেকে ১৯ সেন্ট বা ১৪ থেকে ২০ টাকা। পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এলওআই (লেটার অব ইনট্যান্ট) ইস্যু করা বেসরকারি কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় ধরা হয়েছে ইউনিটপ্রতি ১১ থেকে ১৭ সেন্ট বা ১২ থেকে ১৭ টাকা। অর্থাৎ ভারতের ১০-১৫ গুণ বেশি দামে সৌরবিদ্যুৎ কিনে, দেশের সবুজ বিদ্যুৎ খাতকেও সম্ভাব্য লোকসানি খাতে রূপ দেওয়ার আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। (প্রথম আলো/১৬ ডিসেম্বর, ২২)

এরকম একটি নেতিবাচক বিশ্লেষণ কি ছাপা ঠিক হয়েছে? এটা সরকারি রাজনীতিক ও আমলাদের প্রশ্ন। বিশেষ করে বিজয়ের এই দিনে আর মাসে? যখন আমরা ৫১ বছরের বিজয়ে উদযাপন করছি, চারদিকে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করে, দেশকে ভাসিয়ে দিচ্ছি, তখন এই ধরনের দুর্নীতির মেগাপ্রজেক্ট সম্পর্কের বিশ্লেষণ ভালো দেখায় না। লুটপাট তো হচ্ছে, তা কম আর বেশি, সব সেক্টরেই তা আমাদের চোখকে চড়কগাছে তুলে দিলেও সরকারের মনের মধ্যে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া নেই। কারণ একটাই তারা উন্নয়নের জোয়ার তুলেছেন এবং তা যত বেশি খরচই হোক না কেন, নিজেদের উন্নতির শিখরে যাবেনই। সে বিশ্লেষণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছি সেটা অনন্যসাধারণ একটি প্রকল্প। এই প্রকল্প গ্রহণের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। কিন্তু যখন দেখা যাচ্ছে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি সরকারি সবুজবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যও ব্যয় বা দাম পরিশোধিত হবে বৈদেশিক মুদ্রায়, তখন চোখ ছানাবড়া হবারই কথা। এর মানে কী? আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কি ফুলেফেঁপে এতটাই বড় হয়েছে যে তা রাখার মতো জায়গা নেই?

টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ স্রেডা) ও ইউএনডিপির তত্ত্বাবধানে তৈরি ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-৪১’-এর মতে, জমির স্বল্পতা সত্ত্বেও সৌরবিদ্যুতায়নের মধ্যমানের কৌশলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ২০ হাজার মেগাওয়াট সবুজবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। অন্য দিকে নদী অববাহিকা উন্নয়নের ৫ শতাংশ ভূমি, শিল্পাঞ্চলের রুফটপসহ অপরাপর অব্যবহৃত ভূমি নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের সৌরমডেলে এই সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছানো সম্ভব।

জ্বালানি আমদানিনির্ভরতা থেকে বেরোতে হলে সরকারকে ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-৪১’কে আলোতে আনতে হবে এবং তা দুর্নীতিমুক্তভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। ( প্র/আ/১৬ ডিসেম্বর, ২২)

এই যে ‘দুর্নীতিমুক্তভাবে’ বাস্তবায়নের কথা লিখেছেন বুয়েটের এই অধ্যাপক, ওই শব্দটি তিনি তুলে এনেছেন কেন? কারণ কি এই যে দুর্নীতি এখন সর্বত্রই হচ্ছে। হাটে-ঘাটে-মাঠে, সড়কে-মহাসড়কে এবং সরকারি দফতরে তা বিরাজমান এবং এই যে চিত্রটি লেখক তুলে ধরেছেন ভারত ও বিশ্বের সবুজবিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় নিয়ে, সেখানে আমাদের ব্যয় কেন এত বেশি? কেবল বেশিই নয় ১০ থেকে ২০ শতাংশ বেশি। কারণ, যারা এই প্রকল্পের ব্যয় নির্বাহের ছকটি আঁকেন তারা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের লাভকে আকাশচুম্বী করতে চান। ক্ষমতা তাদের, যা আমরা কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জ দেবার ক্ষেত্রে করেছি, একইভাবে নবায়নযোগ্য সৌরবিদ্যুতের প্রকল্প বাস্তবায়নেও করছেন সরকার- এই দুর্নীতিই আমাদের মানসিকতার নমুনা। এরকম উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি আমাদের সম্পদ খেয়ে ফোকলা করে দিচ্ছে।

এই মনন ও মানসিকতার শেকড়শুদ্ধ উৎপাটনের জন্যই জরুরি ভিত্তিতে রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কার করার প্রয়োজন। এর ব্যতিক্রমে কভু এ দেশের গণমানুষের রাজনৈতিক অধিকার কায়েম হবে না।


আরো সংবাদ



premium cement