২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রাজনীতির অবৈধ খেলা

রাজনীতির অবৈধ খেলা - ছবি : নয়া দিগন্ত

রাজনীতির মতো মহৎ বিষয়কে তিনি হাস্যকরভাবে খেলার সাথে তুলনা করছেন। তার সর্বশেষ বয়ান হচ্ছে- ‘১০ ডিসেম্বরের খেলায় আমরা জিতে গেছি। খেলা হবে, নির্বাচনী ফাইনাল খেলা হবে। নির্বাচন হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। দুর্নীতিবাজ তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে খেলা হবে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল আবারো সরকার গঠন করবে।’

এর আগে তিনি বলেছিলেন, ১০ ডিসেম্বরের খেলায় অর্ধেক বিজয় হয়েছে তাদের। এখন অবশ্য পুরো বিজয়ের দাবি করছেন। রাজনীতি যদি খেলা হয়, তাহলে তারও কিছু নিয়ম-কানুন আছে। যে খেলার কথা তিনি বলছেন তার নিয়ন্ত্রক তারাই। খেলার নিয়ম-কানুন তারাই প্রণয়ন করেন। তারাই কোচ, তারাই রেফারি, তারাই ম্যানেজার। দেশ-বিদেশের খেলায় অনেক টিম থাকে। প্রতিদ্ব›িদ্বতা হয়। নিয়ম-কানুন মেনে প্রতিযোগিতা হয়; কিন্তু এ খেলা সেই খেলা নয়। খেলার মধ্যে যারা অন্যায়, অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি আমদানি করে, অনুশীলন করে ও স্বঘোষিত ফলাফলে জয়লাভ করে- এরা সেরকম লোক। তারা আইন-কানুন, রীতি-নীতি ও ভদ্রতা-সভ্যতার ধার ধারেন না। অনিয়মই তাদের কাছে নিয়ম। দুর্নীতিই তাদের নীতি। যারা এর ধারক-বাহক তাদের আনাগোনা সর্বত্র। গ্রাম থেকে শহর, রাজধানী থেকে রাজধানী, আন্তর্জাতিক পরিসরেও তাদের উপস্থিতি।

গ্রামের হাডুডু খেলায় এরাই কাঁটা পুঁতে রাখে প্রতিপক্ষকে রক্তাক্ত করার জন্য। শহরে এরাই শরীরী শক্তি দিয়ে খেলা পণ্ড করে। আন্তর্জাতিক খেলাগুলোতে ঘুষ, দুর্নীতি ও বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটে। খেলার স্টারদের লাখ ডলার নেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। ডলারের বিনিময়ে জয়-পরাজয় নির্ধারণের প্রমাণ তৈরি হয়। সর্বত্রই এসব চক্রান্ত, কারসাজি ও ষড়যন্ত্র প্রতিফলিত হয়। তিনি তার স্বরে যে খেলার কথ বলছেন- এটি সেই খেলা। তার শেষ বয়ানকে যদি ব্যাখ্যা করা হয় তাহলে প্রথমত তার একক বিজয়ের ঘোষণা। কিভাবে জিতলেন, কে রেফারি ছিলেন বা কার্যক্রমই বা কি ছিল, তা যদি দেখি তাহলে নিষ্ঠুরতা, প্রতারণা ও প্রভুত্বের নমুনা ছাড়া আর কিছুই জুটবে না। তিনি বললেন, খেলায় জিতে গেছেন। জিতে যাওয়ার চিত্রটি কি? এই উদাহরণটি অনেকবার দেয়া হয়েছে। তাদের প্রতিদ্ব›দ্বী দল বা টিমকে খেলার আগেই মারধর করে নিহত অথবা আহত করা হয়েছে। হাত-পা বেঁধে তাদের রাখা হয়েছে মাঠের আশপাশে। গোলকিপারকে দেয়া হয়েছে জেলে। মাঠ তখন একেবারে ফাঁকা। অথচ তাদের ভাষায়- তুমুল খেলা হচ্ছে। গোল দিচ্ছেন তারা। অনেক গোল করেছেন তারা। দর্শকহীন মাঠে ডিজিটাল দর্শকরা বারবার করতালি দিচ্ছে। এই হচ্ছে তাদের খেলার চিত্র। এতে তারা শতভাগই জিতেছেন। লোকেরা বলে, ‘পাগলের সুখ মনে মনে’!

তার সর্বশেষ বয়ানের দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে- ফাইনাল হবে নির্বাচনে। প্রশ্ন হচ্ছে- কোন নির্বাচনে? গ্রামের লোকেরা প্রশ্ন তোলে, আপনারা জিতবেন নির্বাচন হলে তো! তারা বিরোধী রাজনৈতিকদের বলে- ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়। ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন তথাকথিত নির্বাচনে তারা জিতে গেল! তারা বিশ্বস¤প্রদায়কে কথা দিয়েছিল- এটি নিয়মরক্ষার নির্বাচন। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে। জনগণ প্রতারিত হয়েছে। টোনা-টুনির মতো ক্ষমতার উঁচু ডালে বসে তারা জনগণকে বলল, টুন! টুন! টুন! ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি বললেন, আমায় বিশ্বাস করুন। তিনি দিনের নির্বাচন রাতে করে বিশ্বাস ভঙ্গ করলেন। এবার ২০২৪ সালে নির্বাচনে তাকে কি বিশ্বাস করা যায়?

লোকেরা এখন বলাবলি করে- নাপিতের যেমন ১৬ চোঙা বুদ্ধি আছে তারও এরকম হরেক রকমের বুদ্ধি আছে। একে আসলে বুদ্ধি বলা যায় কি? ধূর্তামি কাকে বলে? তার সাথে বুদ্ধির প্রতিযোগিতায় বিরোধীরা পারবে না। ক্ষমতাপাগল তিনি। ক্ষমতায় থাকার জন্য যা যা করা দরকার সব কিছুই তিনি করবেন। সত্যকে মিথ্যা, আর মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করতে তিনি পারঙ্গম। তার কাছে আছে মেকিয়াভ্যালির ব্যাকরণ। এটি তার নীতি আদর্শ। সেই নীতিতে বলা আছে- শাসককে হতে হবে সিংহের মতো সাহসী ও শেয়ালের মতো ধূর্ত।

তার তৃতীয় বাক্যটি হচ্ছে- নির্বাচন হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। বিগত ৫০ বছরের মধ্যে যে সরকারটি সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত তারা যখন এ কথা বলে তখন গ্রাম-বাংলার প্রবাদ ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ মনে করতে ইচ্ছে করে। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয়, চোর যেমন নিজেকে বাঁচাতে তার স্বরে চোর চোর বলে চিৎকার করে, তাদের উচ্চারণ তেমনই এখন। মনে করিয়ে দিই মরহুম প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা বলেছিলেন, ওদের দেখলেই চোর বলুন। সেদিন এক রাজনৈতিক নেতা বললেন, তার কাছে সবচেয়ে জঘন্য মনে হয়েছে ভোট চোরদের ভোটচুরির বিরুদ্ধে স্ববিরোধী বক্তব্য দেয়া। যিনি গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করলেন তিনি কিভাবে বলেন, নিজেই গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা। সত্যিই যদি খেলার সাধ থাকে, তবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী খেলায় আসুন। তখন জমবে খেলা হাটতলা, বটতলা, মাঠে-ঘাটে, বাটে! তার ঘোষণা হচ্ছে- তারাই জিতবেন। তার মানে হলো- নির্বাচনের আগেই বিজয়ের ঘোষণা দেয়া। বিগত দেড় দশকে আমরা দেখেছি গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত এই ঘোষণার অসংখ্যবার উচ্চারণ। কথাটি শাশ্বত বাক্যের মতো বলা হয়েছে ‘ভোট যেখানেই দিন জিতবে তো নৌকা’।

এ অবস্থায় দেশের জনগণ সম্ভবত বিপরীত প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। বিগত সপ্তাহগুলোতে বিএনপির সপক্ষে যে গণজাগরণ দেখা গেছে তা তাৎপর্যপূর্ণ। এটি রাজনৈতিক দল হিসেবে যতটা না বিএনপির প্রতি সমর্থন তার চেয়েও সরকারবিরোধী নিদর্শন এটি। বিগত ১৫ বছরের যে রাজনৈতিক খেলা শাসকদল দেখিয়েছে তাতে মানুষ অতিষ্ঠ। তারা আর অপেক্ষা করতে চায় না। দীর্ঘ বছরগুলোতে জমে থাকা রাজনৈতিক ভীতিকে অগ্রাহ্য করতে চায় জনগণ। জনগণের রাজনৈতিক নিস্পৃহতা নিয়ে গবেষণা আছে। বিএনপির নীরব সমর্থক জনতা সরব হবে না। অন্যায়-অত্যাচার তাদের পাঁজর ভেঙে দিয়েছে- এ রকম আক্ষেপ ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, বাঁধ ভাঙা জোয়ার আসছে। সেই ষাটের দশকের মতো চিড়া-মুড়ি নিয়ে তারা মাঠে আসছে। অনেকদূর পথ অতিক্রম করছে তারা। সুতরাং আরো পথ অতিক্রম করার জন্য তারা প্রস্তুত রয়েছে। বিশেষত ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগের জনসভা তার প্রমাণ দিচ্ছে।

যে রাজনৈতিক খেলা সরকারি দল শুরু করেছে অন্যায়-অত্যাচার ও নিপীড়নের মাধ্যমে, বিরোধী দল নিয়মতান্ত্রিকভাবেই তার মোকাবেলা করছে। সরকারি দল নিষ্কলুষ জনসভাকে ভয় করছে। রাজধানীতে সমাবেশ হলে তারা আরো বেশি ভীত হয়ে পড়ে। কারণে-অকারণে জনসভাকে ভণ্ডুল করতে চায়। একদিকে তারা নমনীয়তার কথা বলে ভেতরে ভেতরে তারা নাশকতার অভিযোগ তুলে জনসভাকে বানচাল করতে চায়। এ ক্ষেত্রে তারা এক রকম ন্যাংটা হয়ে মাঠে নামে।

৭ ডিসেম্বর পুলিশ যেভাবে বেপরোয়াভাবে গুলি চালায় ও নেতাদের গ্রেফতার করে তা বর্তমান সময়ে নির্মমতার একটি নজির হয়ে থাকবে। বিএনপি অফিস অভ্যন্তরে গুলি চালিয়ে তারা একজনকে হত্যা করে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে গ্রেফতার করে তারা মহাসমাবেশকে ব্যর্থ করতে চায়। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীকে অবাক করে দিয়ে জনগণ স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে সমাবেশ সফল করে। বানোয়াট অভিযোগে তাদের জামিন না দিয়ে সরকার প্রমাণ করেছে- তারা শক্তির মাধ্যমেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। তারা যে আরো আগ্রাসী হয়ে উঠবে আমিরে জামায়াতের গ্রেফতার তারই প্রমাণ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করে, ১০ ডিসেম্বর যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার পর এই আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্যই তাকে গ্রেফতার করে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে।

উপর্যুক্ত আলোচনা প্রমাণ করে, শাসক দল যে রাজনৈতিক খেলা শুরু করেছে তা স্বাভাবিক নয়। খেলার নিয়ম-কানুনের পরিবর্তে অন্যায়-অনাচার, নিপীড়ন-নির্যাতনই হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক সম্বল। রাজনৈতিক সঙ্ঘাত ও সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যখন সরকারকে সংলাপে বসার আহ্বান জানাচ্ছেন তখন তারা নিপীড়নের পথে হাঁটছে। দেশ যে প্রান্তিক অবস্থায় খাদের কিনারায় রয়েছে- একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই তার উত্তরণ ঘটতে পারে। সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা-বিশ্বাসের সবটুকু যখন তলানিতে ঠেকেছে তখন কেবল একটি তত্ত¡াবধায়ক ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন হতে পারে। প্রয়োজনে ২০২৪-এর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনটি এগিয়ে এনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানের প্রয়াস নিতে পারে সরকার। ‘খেলারামদের’ রাজনৈতিক খেলাকে এভাবে অবাধ, অবাস্তব ও অযৌক্তিকভাবে অগ্রসর হতে দেয়া যায় না।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement