২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিজয় দিবসের ভাবনা

বিজয় দিবসের ভাবনা - ছবি : সংগৃহীত

বিজয় দিবস। খুব কম জাতির ইতিহাসে এরকম একটি স্বর্ণালি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের দেখা পাওয়া যায় যেখানে এক দিকে আনন্দ-উচ্ছল উদ্বেলিত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নিল দ্যুতি, অপর দিকে দুঃখ বেদনা, স্বজন হারানোর দুঃসহ নীল অনুভ‚তি। এ জন্য বিজয় দিবসের আবহ এলেই পরিবর্তিত হয়ে যায় গোটা জাতির মানস। এক দিকে পাওয়ার আনন্দের উচ্ছলতা, অপর দিকে বিয়োগ-বেদনার অসহনীয় স্মৃতির ক্যানভাস ডানা মেলে জাতির মানসিকতায়। প্রাপ্তি ও হারানোর মহামিলনের দিন বিজয় দিবস। এই দিনের স্বপ্নে যারা শহীদ হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, যারা এখনো আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন তারা ইতিহাস তৈরি করতে গিয়ে নিজেরাই একেকটি ইতিহাস হয়ে গেছেন। আজকের দিনে তাদের জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।

বিজয়ের দিন এলেই কেমন একটা আনন্দের সুবাতাস, সাথে সাথে অসহনীয় দুঃখ বেদনার যন্ত্রণার নীলে জাতি নতুন করে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষতে বসে। যে স্বপ্নের চেতনায় দেশে আবালবৃদ্ধবনিতা, অনেকসময় প্রকৃত পক্ষেই খালি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একটি অসম যুদ্ধে, তাদের স্বপ্নের কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, কতটুকু মর্যাদায় তাদেরকে অভিষিক্ত করা হয়েছে, তাদের স্বপ্নের গাংচিলেরা কোথাও ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে কি না- সব কিছুর একটি নস্টালজিক ভাবনা পেয়ে বসে এ দিনটির পদধ্বনি শোনা গেলেই।

বিজয়ের প্রাক্কালে যে শিশুর জন্ম হয়েছিল আজ সে একান্ন বছরের পৌরুষে অভিষিক্ত। স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসের আবহে, দেশপ্রেমের চেতনায়, দেশ গড়ার প্রত্যয়ে নিবেদিত মনোভাব নিয়ে সে এতদূর এসেছে কি না, না হলে কেন হয়নি, এগুলো পর্যালোচনা করা এখন যৌক্তিক বিষয়। সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তার যে স্বপ্ন মুক্তিযুদ্ধকে শাণিত করেছিল, সামাজিক নিরাপত্তার বাতাবরণের আকাক্সক্ষা উচ্চকিত করেছিল গোটা জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায়, তারই বা কী অবস্থা? নতুন প্রজন্মের জন্য আগামী দিনগুলোতে কী ধরনের আর্থসামাজিক ভবিষ্যৎ তৈরি হয়েছে সব কিছুই নতুন করে ভাববার দাবি রাখে।

৫০ বছরে অনেক ক্ষেত্রেই অর্জিত ঈর্ষণীয় সফলতাগুলোকে কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। যোগাযোগ, কৃষি ও শিল্পে যে বিশাল অগ্রগতি এটি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। অস্বীকার করার উপায় নেই গড় আয়ু বৃদ্ধির কথা। খাদ্য উৎপাদনও ঈর্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। না খেয়ে মৃত্যুর খবর এখন আর শোনা যায় না। আন্তর্জাতিক আঙিনায় বাংলাদেশ বেশ শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থায় সদস্য পদে এখন বাংলাদেশ। শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। কমেছে প্রসবকালীন মাতৃ মৃত্যুহার। সুপেয় পানির সরবরাহ বেড়েছে। বেড়েছে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের চিত্র। রফতানি খাতেও প্রবহমান অগ্রগতির চিত্র।

বিপরীতে বিজয়ের হাসি ম্লান হয়ে যায় যখন দেখা যায়, গ্রাম-গ্রামান্তরের লেখাপড়া না জানা প্রবাসী শ্রমিক ভাইদের অমানবিক শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত অর্থ একশ্রেণীর শিক্ষিত ও সমাজের উঁচু তলার সুবিধাভোগীরা অবলীলায় বিদেশে পাচার করে বেগমপাড়া গড়েন। ব্যাপারটি দাঁড়াচ্ছে অশিক্ষিতরা পরিশ্রম করে দেশের জন্য যা অর্জন করেন, শিক্ষিত সুবিধাভোগীরা তা পাচার করে দেন। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে যেসব প্রবাসী ভাই মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠান, তাদের জানাই বিজয়ের শুভেচ্ছা। দেশ গড়ার ক্ষেত্রে, দেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তারাই অগ্রসৈনিক।

বিজয়ের আনন্দ বিষাদের কালিমায় ঢেকে যায়, বায়ুদূষণে আমরা পৃথিবীর প্রথম না হলেও দ্বিতীয় অবস্থানে আছি জানলে, যেকোনো দিন প্রথম হওয়ার তকমা আমাদের ললাটে ঝকমক করে ওঠার শঙ্কায়। আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠছে শ্বাসযন্ত্রের নানাবিধ জটিলতা নিয়ে। ভেজালের কারণে অকালেই কিডনি, যকৃৎ ও অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত জনজীবন। হারিয়ে ফেলছে জীবনীশক্তি, ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক ভিত্তি। ভেজাল ওষুধ, ভেজাল খাবার, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও বিষাক্ত পরিবেশ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিষিয়ে তুলছে। খারাপ লাগে যখন দেখি, শিক্ষিত যুবকরা হন্যে হয়ে বিভিন্ন ধরনের টাউটের পেছনে লাইন লাগাচ্ছে সামান্য অনুগ্রহের আশায়। বুক ভেঙে যায় যখন সংবাদ আসে তরতাজা যুবকরা সমুদ্রে অথবা বিজনে না ফেরার দেশে চলে গেছে।

রাস্তায়, বাজারে বা অন্য কোনোখানে পথশিশুরা যখন করুণ চাহনি নিয়ে হাত পাতে তখন কিছু করতে না পারার যন্ত্রণায় হৃদয় ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। বিজয় দিবসের আনন্দ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। যখন দেখি মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমেই তলানিতে হারিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত দ্বিধা সঙ্কোচ ও আত্মমর্যাদাকে বিসর্জন দিয়ে ওএমএসের চাল ডাল তেলের জন্য অসহনীয় প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে থাকেন। দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর এই প্রতীক্ষার সারি। বিজাতীয় সংস্কৃতির আলখেল্লা গোটা জাতিকে গ্রাস করেছে দেখেও নিজেকে নির্বাক দর্শক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। আমাদের নীতি, নৈতিকতা, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা দেখে মাথা ঠুকে মরতে ইচ্ছে করে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয় এটি দেখে যে, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পরিবর্তে পৈশাচিক উল্লাসে নির্মমভাবে হত্যা করছে নিজ সহপাঠীকে। চরিত্র, মেধা, মনুষ্যত্ব সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীরা হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমেই। এ যেন ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’

বিজয়োল্লাসের পরিবর্তে বিষাদের কালোমেঘ চিন্তার আকাশকে ঢেকে দেয়- যখন দেখা যায় নৈতিকতা, চারিত্রিক গুণাবলি, মনুষ্যত্ব, সততা এগুলোকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও অভিন্ন জাতিসত্তার বিকাশের পরিবর্তে বিভাজিত জাতিসত্তা দেখে শঙ্কিত হতে হয়। জাতির ভবিষ্যৎ পথচলার অনির্দিষ্ট গতিপথ ভেবে বিচলিত না হয়ে পারা যায় না বিজয় আনন্দের এই মাহেন্দ্রক্ষণেও।

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement