২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

তাহলে কি ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা সফল নয়?

তাহলে কি ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা সফল নয়? - নয়া দিগন্ত

সাম্প্রতিককালের জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত ইসলামী ব্যাংকগুলো থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে স্বনামে-বেনামে ঋণ নেয়া এবং আমানত তসরুপের ঘটনায় দেশবাসী শঙ্কিত। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন জাগে, এই ঘটনা ইসলামী ব্যাংকে হয় কী করে? তাহলে কি ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা সফল নয়? এই সফল নাকি ব্যর্থ, সে কথা বলার পূর্বে আমরা দেখি ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা আসলে কী। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা মূলত আল্লাহ প্রদত্ত এবং রাসূল সা: প্রয়োগকৃত একটি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা পুরাপুরি ইসলামী শরিয়াহ পরিচালিত এবং এর সব কার্যক্রমে সুদ নিষিদ্ধ। অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামী অর্থনীতির একটি প্রায়োগিক ব্যবস্থা যা লাভক্ষতিভিত্তিক এবং ইসলামী বিধিবিধান দ্বারা পরিচালিত। এই ব্যবস্থা রাসূল সা: বাস্তবায়ন করেছিলেন তার মদিনায় প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে। এরপর ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার উৎস, ইতিহাস এবং বর্তমান বিশ্বে ইসলামী কার্যক্রমের প্রসার ও প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি আলোচনার মাধ্যমে দেখব, এই ব্যবস্থাটি সফল না ব্যর্থ।

ইসলামী অর্থব্যবস্থায় আল-কুরআনের নির্দেশনা
ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিষয়ে কুরআনে বিভিন্নভাবে নির্দেশনা রয়েছে। যেমন- ‘আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল, আর সুদকে করেছেন হারাম’ (সূরা বাকারা, আয়াত ২৭৫); আল্লাহ ‘আল-বাই বা ট্রেডের কথা উল্লেখ করে বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা পরস্পরের সম্মতিক্রমে ব্যবসা ব্যতীত অন্যায়ভাবে পরস্পরের ধন-সম্পত্তি গ্রাস করো না’ (সূরা নিসা, আয়াত ২৯)। কুরআনের চারটি সুরায় যথা, সুরা রুম, নিসা, আলে-ইমরান ও চতুর্থ পর্যায়ে সূরা বাকারায় চূড়ান্তভাবে সুদ হারাম করা হয়েছে। সর্বোপরি রাসূল সা: তার বিদায় হজের ভাষণে চূড়ান্তভাবে তা হারামের ঘোষণা দিয়েছেন।

শরিয়াহ মোতাবেক এবং সুদবিহীন ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও মানবকল্যাণ কিভাবে সাধন করা যায় সে বিষয়ে আল্লাহ কুরআনে বলেন; পরস্পরের মধ্যে ঋণের লেনদেন লিখে রাখো, সাক্ষী রাখো (সূরা বাকারা, আয়াত ২৮২); ঋণের বিপরীতে সম্পদ বন্ধক রাখা (সূরা বাকারা, আয়াত ২৪৩); ঋণগ্রহীতা অভাবী হলে সচ্ছলতা লাভ করা পর্যন্ত তাকে অবকাশ দেয়া এমনকি দান করে দেয়া (সূরা বাকারা, আয়াত ২৮০); ওজন ও পরিমাপ পূর্ণ করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে (সূরা আ’রাফ, আয়াত ৮৫)। জাকাত আদায়ের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণ সাধনের জন্য ইসলামী অর্থব্যবস্থাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছে কুরআনের মোট ১৯টি সূরার ২৯টি আয়াতে। সূরা হাশরে (আয়াত ৭) আল্লাহ সতর্ক করেছেন যেন সম্পদ কেবল সম্পদশালীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়।

খলিফাদের শাসন আমলে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রয়োগ
ইসলামের স্বর্ণযুগে (৬২২-৬৬১ খ্রিষ্টাব্দ) ইসলামী অর্থনীতির সূচনা হয় মদিনায়। ওমর রা:-এর যুগে বায়তুল মালে প্রাচুর্য দেখা দেয় এবং আধুনিক ইসলামী ব্যাংক ও ব্যাংকিং কার্যক্রমের অনেক কিছুই সেই বায়তুল মালের অনুসরণেই সম্পাদিত হয়। বায়তুল মালের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ সংরক্ষণ করা, মুদ্রা প্রচলন ও মুদ্রা প্রচলনের মঞ্জুরি প্রদান ও মুদ্রামান নিয়ন্ত্রণ করত কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আব্বাসীয় খিলাফতের (৭৫০-১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দ) যুগে ইসলামী অর্থব্যবস্থা অনুসরণ করে প্রভূত আর্থিক উন্নতি সাধিত হয়েছিল। ফলে দীর্ঘ এক হাজার ৩০০ বছর ইসলামী সাম্রাজ্যে সুদ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। উসমানীয় খেলাফতেও সুদবিহীন অর্থব্যবস্থা পরিচালিত হতো, যার পতন হয় ১৯২২ সালে। এরপর পুঁজিবাদীর সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা জেঁকে বসে এবং সুদবিহীন অর্থব্যবস্থা ছিলই না বললেই চলে।

বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মুসলমানদের মধ্যে সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়। একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে আদর্শ অর্থনীতির প্রবর্তন করে। মূলত ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আধুনিক সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রসার।

আধুনিক ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার প্রাসঙ্গিকতা ও কার্যক্রম
আধুনিক ইসলামী ব্যাংকে ব্যবসা হয় পণ্য বা সেবার কেনাবেচা, ব্যবসায়ে বিনিয়োগ, সম্পদের ভাড়া খাটানো এবং কমিশনের বিনিময়ে সেবা প্রদান, ইত্যাদির মাধ্যমে। এ ছাড়া, ইসলামী ব্যাংক মুদারাবা পদ্ধতিতে আমানত সংগ্রহ করে মুদারাবা, মুশারাকা, ইজারা, ইসতিসনা, বাই-সালাম, বাই-মুরাবাহাসহ বিভিন্নভাবে উৎপাদনমুখী ব্যবসায় বিনিয়োগ করে। এই ব্যবস্থায় চক্রবৃদ্ধি হারে মুনাফা আরোপের কোনো সুযোগ নেই। ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের বৈধ উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদে তাদের স্বত্বাধিকার স্বীকার করে।

ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রায়োগিক ভিত্তি মূলত অংশীদারিত্বভিত্তিক হওয়ায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও এ ব্যবস্থা টেকসই হয়। ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক মন্দায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সীমাহীন অর্থ সঙ্কটে পতিত হয়। ২০০৭-২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় বিশ্বব্যাপী অসংখ্য শেয়ারবাজার, ব্যাংক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান ধসে পড়ে অসহনীয় বেকারত্ব সৃষ্টি করে। ২০২০-২১ সালের করোনার সময়েও ব্যাংকের দূরবস্থা দেখা দেয়। মূলত সুদী ব্যবস্থা, দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ব্যাপক অভ্যন্তরীণ ঋণ গ্রহণ, অস্বচ্ছতা, জালিয়াতি এবং যথাযথ ব্যাংকিং তদারকির অভাবে এসব আর্থিক সঙ্কট।
উন্নত ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানের দিক থেকে ইসলামী ব্যাংকিং একটি শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা, বলেছেন লন্ডনভিত্তিক ইকোনমিস্ট পত্রিকা। তারা দাবি করেন, ‘পাশ্চাত্য আধুনিক যুগেও ইসলামের কাছ থেকে ইকুইটি বা অংশীদারিত্বের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিতে পারে’ (দি ইকোনমিস্ট, আগস্ট ১৯৯৪)।

মূলত ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অংশীদারিত্বের দায়বদ্ধতার কারণে ব্যাংক বিনিয়োগে, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায়, লভ্যাংশ অর্জন পর্যন্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে থাকে। অধিকন্তু অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসার কারণে অংশীদাররা যেকোনো সময় সেখান থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করতে পারে না। অন্য দিকে এই ব্যবস্থায় অনুমানকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় কারণ অনুমান অনেকটা জুয়া যা ইসলামে নিষিদ্ধ। ফলে এ ব্যবস্থার আলোকে পরিচালিত বিনিয়োগ বা ব্যবসা তুলনামূলকভাবে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের চেয়ে বেশি টেকসই ও ধাতস্থ।

বর্তমান বিশ্বে আধুনিক ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ধারাবাহিকতা
১৯৬২ সালে মালয়েশিয়ায় কিস্তিতে হজের অর্থ জমাগ্রহণের উদ্দেশ্যে ‘পিলগ্রিমস্ সেভিংস করপোরেশন’ নামে সুদমুক্ত একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ১৯৬৩ সালে মিসরের মিত্ব গামার ব্যাংক নামে আধুনিক বিশ্বের প্রথম সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ সালের ওআইসির সম্মেলনে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়। সে আলোকে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৫০টির মতো অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশসহ সারাবিশ্বের ৮০টি দেশে প্রায় ৫০০টি ইসলামিক ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে যা ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের একটি শিল্প এবং যার সম্ভাব্য আকার প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। বহু সুদভিত্তিক আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ইতোমধ্যে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে। পাশ্চাত্যের ব্যাংকিং জগতে ২০০৭-০৮ সালে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার পর এমন সঙ্কট সমাধানে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি অনুসরণ করছে। এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় পশ্চিমারা ইসলামী ‘সুকুক’ প্রক্রিয়ার মূল্যায়ন করে এবং এটাকে নিরাপদ অর্থলগ্নি ব্যবস্থা বলে গ্রহণ করে। বর্তমানে বিশ্বে সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ, অথচ ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের উপরে।

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার সফলতা
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। বর্তমানে দেশের ৬২টি ব্যাংকের ১০টি পূর্ণাঙ্গভাবে এবং ৩৪টি বিভিন্নভাবে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। রয়েছে এক হাজার ৭৫৫টি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের শাখা, যা দেশের মোট শাখার প্রায় ১০ শতাংশ। জনবল রয়েছে ৪৩ হাজার ২৮৮ জন। বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রায় সমস্ত ফ্যাক্টরের ২৫ শতাংশ এবং বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১৪ শতাংশ। সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যাংকিং র‌্যাংকিংয়ে ১১তম। আইবিবিএল বিশ্বের ১০০০ সেরা ব্যাংকের একটি। বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের ৩৫ শতাংশ গ্রাহক এবং ক্ষুদ্র ঋণের ৫০ শতাংশ নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ইসলামী অর্থায়নে উল্লেখযোগ্য অংশীদার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, মার্চ ২০২১ এর শেষে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে আমানত রয়েছে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা, যা দেশের মোট আমানতের ২৭.৫৪ শতাংশ। ওই একই সময় ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ ছিল তিন লাখ ২২ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা, যা দেশের মোট বিনিয়োগের প্রায় ২৮ ভাগ। প্রবাসী আয়ের ৩৩ শতাংশ আসে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে।
প্রতিষ্ঠা থেকে আইবিবিএল এর সফলতা

আইবিবিএল হলো বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের পথ প্রদর্শক। বিগত চার দশকে এই ব্যাংকটির সফলতা দেখে আরো ১০টি সুদমুক্ত ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করেছে। এমনকি এই ইসলামিক ব্যাংকগুলোর নীতিনির্ধারণ, প্রশিক্ষণ এবং পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন আইবিবিএলের দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যাংকাররা।

এককভাবে আইবিবিএলের বর্তমান আমানতের পরিমাণ এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট আমানতের ১০ ভাগেরও বেশি। ব্যাংকটির বিনিয়োগের পরিমাণ এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট ব্যাংকিং ঋণ বা বিনিয়োগের ৯ শতাংশ। এ ব্যাংকের বিনিয়োগে দেশে প্রায় ৮০ লাখের বেশি মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশের তৈরী পোশাক খাতের ভিত্তি তৈরি হয়েছে এই ব্যাংকের বিনিয়োগের মাধ্যমে। দেশের এক হাজারেরও বেশি গার্মেন্ট শিল্প এবং প্রায় ছয় হাজার শিল্প-কারখানা ও দুই হাজার কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান এ ব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে। দেশের মোট এসএমই বিনিয়োগের ১৭ শতাংশ এই ব্যাংকের যেখানে গড়ে উঠেছে তিন লাখ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই ব্যাংকটি চার লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার আমদানি ও দুই লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার রফতানি করে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে নেতৃত্ব দিয়েছে। এককভাবে ২০২১ সালে এই ব্যাংকের মাধ্যমে ৫১ হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স আহরিত হয়েছে, যা দেশের মোট রেমিট্যান্সের এক-তৃতীয়াংশ। কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প খাতে ২০২১ সালে দুই লাখ ৫০ হাজার গ্রাহককে বিনিয়োগ প্রদান করে এই ব্যাংক। এসএমই খাতে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগের পরিমাণ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট এসএমই বিনিয়োগের ১১ শতাংশ।

বর্তমানে দেশব্যাপী প্রায় পাঁচ শতাধিক শাখা ও উপশাখা এবং ২৭০০ এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট রয়েছে। এক কোটি ৬০ লাখ গ্রাহককে সেবা দিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকের প্রায় ২০ হাজার জনশক্তি। পল্লী উন্নয়ন কার্যক্রমে দেশের ২৮ হাজার ৯২১টি গ্রামের প্রায় ২৫ লাখ গ্রাহককে সেবা দিয়ে যাচ্ছে, যার ৯২ শতাংশ নারী। এই ব্যাংকটি দেশের বাইরেও শাখা ও প্রতিনিধি অফিস খুলতে যাচ্ছে।

প্রতি পাঁচ বছরে এ ব্যাংকের ব্যবসায়িক পরিধি দ্বিগুণ হয়। ইসলামী ব্যাংকের সাফল্যের ধারায় দেশের ইসলামিক ব্যাংকিং খাত বিকশিত হয়েছে। বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতের প্রায় ২৭ শতাংশ মার্কেট শেয়ার ইসলামিক ব্যাংকিং খাতের হাতে। এই ব্যাংক দেশের বাইরে শ্রীলঙ্কা ও নাইজেরিয়ায় ইসলামিক ব্যাংক স্থাপনে টেকনিক্যাল সহায়তা দিয়েছে।

যে কারণে দেশের ব্যাংকগুলো ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থায় ঝুঁকছে
বর্তমানে ইসলামী ধারার একটি ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৯০ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৫ টাকা ঋণ বিতরণ করতে পারে। এ ছাড়া প্রচলিত ধারার ব্যাংকের মতো ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাড়ে ৫ শতাংশ নগদ জমা রেশিও (সিআরআর) সংরক্ষণ করতে হয়। অথচ প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ১৩ শতাংশ সংবিধিবদ্ধ তারল্য রেশিও (এসএলআর) রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য তা সাড়ে ৫ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকগুলো যেকোনো সময় আমানতে মুনাফার হার পরিবর্তন করতে পারে। প্রচলিত ধারার ব্যাংক মেয়াদ পূর্তির আগে তা পারে না। প্রায় ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকে আমানত বেশি পাওয়া যায়। পাশাপাশি ‘কস্ট অব ফান্ডও’ কম। তাই সব মিলিয়ে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন অনেক উদ্যোক্তাই। অধিকন্তু এ দেশের সাধারণ মানুষের ধারণা, ইসলামী ব্যাংকগুলো ইসলামী আদর্শে পরিচালিত হয়, অন্য ব্যাংকগুলোর মতো এখানে দুর্নীতি হয় না।
টেকসই ব্যাংকিং-এ ইসলামী ব্যাংক অনন্য। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অ্যাসেট ব্যাকড বিনিয়োগ, যা প্রচলিত ব্যাংক ঋণের চেয়ে বেশি সুরক্ষিত। টাকার পরিবর্তে পণ্য আকারে বিনিয়োগ হয় বলে এখানে ফান্ড ডাইভার্শনের সুযোগ থাকে না। ইসলামী ব্যাংক ফটকাবাজি বা জুয়া পর্যায়ের কোনো বিনিয়োগ করে না। ডেরিভেটিভসের মাধ্যমে ঋণের বাবলও তৈরি করে না। ব্যাংকিং এ সমাজের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে এবং গ্রাহকের সততা ও পূর্ব রেকর্ড, উদ্যোগের প্রাসঙ্গিকতা, জামানতের যথার্থতা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করেই এই ব্যাংক বিনিয়োগ প্রকল্প বাছাই করে। তাই ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ ঝুঁকি সবসময়ই সর্বনিম্ন থাকে।

ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা কি বাংলাদেশে সফল?
সমসাময়িক সময়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত নামে-বেনামে নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ নেয়া এবং অর্থ তসরুপ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, বিশ্বব্যাপী সফল এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা কি বাংলাদেশে সফল নয়? উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অল্পসংখ্যক আল্লাহভীরু আমানতদার, বিশ্বস্ত, কঠোর পরিশ্রমী, সাহসী ও দূরদর্শী মানুষের ত্যাগের ফসল এ ব্যাংক। ব্যাংকটি তার চলার পথে গোটা মুসলিম বিশ্বকে এক প্লাটফর্মে শামিল করেছিল। আইডিবি, ইসলামী ব্যাংক, কুয়েত ফাইন্যান্স হাউজ ও আল-রাজি ইসলামী ব্যাংকসহ বিশ্বের অনেক নামিদামী ব্যক্তিত্ব ও সংস্থা এর উদ্যোক্তা সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত।

আর্থিক লাভ করা নয় বরং ধর্মপ্রাণ মানুষদের সুদমুক্ত ব্যাংক ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ছিল এই ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশের ৬৩টি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে একমাত্র আইবিবিএল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও পরিচ্ছন্ন ব্যাংক হিসেবে গ্লোবাল ফাইন্যান্স অ্যাওয়ার্ড জয় করেছে অনেকবার; বিশ্বের ১০০০ সেরা ব্যাংকের ব্যাংক হয়েছে। গতানুগতিক ব্যাংকিং ধারণার বাইরে এসে সাধারণ জনগণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা ও জীবনমান উন্নয়নে ব্যাংকটি প্রান্তিক দরিদ্রদের মধ্যে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে স্বাবলম্বী করছে; স্বল্প সময়ের মধ্যেই এই উদ্যোগটি আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পাশাপাশি এই দরিদ্র জাতির শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণের জন্য দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে এই ব্যাংক। সিএসআর এর মাধ্যমে দেশের দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যাংকটির রয়েছে বড়সড় অবদান। এককথায়, সেরাদের সেরা এই ব্যাংকটি নিয়েই দেশবাসী গর্বিত। অথচ লাখ-লাখ বিনিয়োগকারীর শেয়ার এবং আমানতের নিরাপত্তা নিয়ে গোটা দেশবাসী আজ শঙ্কিত। শুধুই আইবিবিএল নয়, এর পাশাপাশি আরো কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকের নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ গ্রহণ অর্থ তসরুপের খবর গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। সবমিলিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে মানুষ শঙ্কিত হয়ে উঠেছে।

উপরের আলোচনা থেকে পরিষ্কার যে, ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিশ্বে এক সফল বাস্তবতা। বাংলাদেশেও প্রতিষ্ঠা থেকে দেশের অর্থনীতি এবং সমাজনীতির সব ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থার রয়েছে ঈর্ষণীয় সফলতা। সেই সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে, ইসলামবিদ্বেষী শক্তির মদদে, দেশের ইসলামকে পছন্দ করে না এমন শক্তি এই ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছিল ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই। উল্লেখ্য, এই চক্রটি এখন কেবল আইবিবিএলকে নয় বরং দেশের পুরো ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্র বাড়িয়েছে; পুরো সেক্টরকেই ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে। এর মাধ্যমে ইসলামবিদ্বেষী শক্তির ইসলামী অর্থব্যবস্থাকে ব্যর্থ করার একটা নীলনকশাও থাকতে পারে। প্রমাণ করার অপচেষ্টা করতে পারে যে, ইসলামে আসলে অর্থব্যবস্থা বা ব্যাংকিং নাই।

পরিশেষে বলা যায়, ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা আল্লাহ প্রদত্ত এবং রাসূল সা: প্রবর্তিত ব্যবস্থা। রাসূল সা:-এর মদিনার রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও এই ব্যাংকিং ব্যবস্থার সফল প্রয়োগ ছিল। খলিফাদের শাসন আমলে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সফল বাস্তবায়ন ছিল। বর্তমান বিশ্বেও এখন পর্যন্ত এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা সফল। এমনকি বাংলাদেশেও ১৯৮৩ সালের যাত্রার শুরু থেকে এই ব্যাংকটি সফলতা অর্জন করেছে এবং এই সফলতা দেখে আরো ১০টি ব্যাংক পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত করছে। তবে, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান যে অভিযোগের কথা প্রচার মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে তার জন্য ইসলাম এবং ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা তো দায়ী নয়ই এমন কি ইসলামের প্রকৃত অনুসারীরাও কোনোভাবেই ব্যর্থ নয়। প্রচারমাধ্যম অনুযায়ী ব্যর্থতা যদি কিছু থেকে থাকে তা ইসলামবিদ্বেষী ও স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র ও লোভের বহিঃপ্রকাশ, যা দেশের অন্যান্য অনেক খাতেও হচ্ছে। ইতোমধ্যেই দেশের সচেতন মহল বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। অধিকন্তু ইসলামে যে, ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে এবং সেটা যে সফল ব্যাংকিং ব্যবস্থা তা জাতির কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে। এমনকি দেশবাসী ইতোমধ্যে বলতে শুরু করেছে যে, ইসলাম এবং ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা আল্লাহ ও রাসূল সা: প্রদত্ত, সুতরাং এর সফলতা এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব আল্লাহ এবং ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রকৃত ইসলামের অনুসারীদের হাতে সফল ও নিরাপদ।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ই-মেইল : [email protected]

 


আরো সংবাদ



premium cement