শয়তানের জয়-পরাজয়
- ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
- ০৪ ডিসেম্বর ২০২২, ২১:২০
মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি (খলিফাতুন) হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। (সূরা আনআম, আয়াত-১৬৫; সূরা ফাতির, আয়াত-৯৩, সূরা হিজর, আয়াত : ৩২-৪৪) আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনের দ্বিতীয় সূরা আল বাকারার ৩০ থেকে ৩৭ নম্বর আয়াতে মানুষ সৃষ্টির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন এবং পৃথিবীতে তাদের শয়তানের শত্রুতা মোকাবেলা করে কিছুকালের জন্য জীবনযাপন করার নির্দেশনা দেন।
৩০, স্মরণ করো! যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, ‘আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে যাচ্ছি’ তখন তারা বলল, আপনি কি এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যারা সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও খুনখারাবি করবে? আমরা তো সর্বদাই আপনার প্রশংসা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণায় নিমগ্ন। আল্লাহ জবাবে বললেন, ‘আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।’
৩১. আর তিনি আদমকে সব কিছুর নাম শিক্ষা দিলেন (অর্থাৎ সব বিষয়ের জ্ঞান দান করলেন)। এরপর এক এক করে সব কিছু ফেরেশতাদের সামনে হাজির করে বললেন, ‘তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’
৩২. তারা বলল, আপনি মহাপবিত্র। আপনি আমাদের যা শিখিয়েছেন, তার বাইরে আমরা কিছুই জানি না। আপনি প্রজ্ঞাময়, মহাজ্ঞানী।
৩৩. তিনি বললেন, ‘হে আদম! তাদের এগুলোর নাম বলে দাও।’ তখন আদম সব কিছুর নাম বলে দিলো। এরপর আল্লাহ ফেরেশতাদের বললেন, ‘আমি কি তোমাদের বলিনি, মহাবিশ্বের সব কিছুর অন্তর্নিহিত বাস্তবতা শুধু আমিই জানি এবং তোমরা যা প্রকাশ করো বা গোপন রাখো তাও আমার জানা?’
৩৪. এরপর আমি ফেরেশতাদের বললাম, ‘আদমকে সেজদা করো। তখন ইবলিস ছাড়া সবাই সেজদা করল। ইবলিস অহঙ্কারবশত আমার আদেশ অম্যান্য করল। ফলে সে সত্য অস্বীকারকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলো।’
৩৫. আমি বললাম, ‘হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস করো। সব কিছু ইচ্ছামতো খাও। শুধু ওই গাছের কাছে যেও না। যদি যাও, তবে তোমরা জালেমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’
৩৬. কিন্তু শয়তান তাদের উভয়কেই প্রলুব্ধ করল। পরিণামে জান্নাত থেকে তারা বহিষ্কৃত হলো। আমি বললাম, ‘(ইবলিস ও) তোমরা একে অন্যের শত্রুরূপে দুনিয়ায় যাও। কিছুকালের জন্য তোমরা সেখানেই জীবনযাপন করবে।’
৩৭. ‘এরপর আদম তার প্রতিপালকের কাছ থেকে কিছু (দিকনির্দেশনামূলক) বাণী পেল। (গভীর অনুশোচনায়) সে তওবা করল। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। যদিও আমি বলেছিলাম, তোমরা সবাই এখান থেকে দুনিয়ায় যাও। তার পরও তোমাদের মঙ্গলের জন্য আমি অবশ্যই (যুগে যুগে) সত্যপথের দিকনির্দেশনা প্রেরণ করব। তখন যারা এই দিকনির্দেশনা অর্থাৎ নৈতিক বিধিবিধান অনুসরণ করবে, তাদের কোনো ভয় বা দুঃখ থাকবে না। আর যারা এই সত্যপথের নৈতিক বিধিবিধানকে প্রত্যাখ্যান করবে, তারাই জাহান্নামের আগুনে পুড়বে। সেখানেই থাকবে চিরকাল।’
১৫ নম্বর সূরা হিজরের ৩৯ থেকে ৪৪ আয়াতে আরো স্পষ্ট করা হয়-
৩৯. এরপর ইবলিস বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি যেহেতু আমার সমস্ত অর্জন (ফেরেশতাদের নেতা হিসেবে প্রাপ্ত সম্মান) ধূলিসাৎ করে দিয়েছ, আমিও পৃথিবীতে (সব ধরনের পাপাচারকে) মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তাদের পথভ্রষ্ট করব (স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে তাদের মর্যাদাকে ধূলিসাৎ করে দেবো)।’
৪০. ‘আমার কবল থেকে শুধু তারাই রক্ষা পাবে, যারা তোমার সত্যিকারের বান্দা।’
৪১. আল্লাহ বললেন, ‘আমার কাছে পৌঁছানোর এটিই সরল পথ।’
৪২. ‘আমার সত্যিকারের বান্দাদের ওপর তোমার কোনো প্রভাবই কার্যকরী হবে না।’
৪৩. ‘তোমার প্রভাব তাদের ওপরই থাকবে, যারা পথভ্রষ্ট হয়ে (স্বেচ্ছায়) তোমাকে অনুসরণ করবে...’
মানুষকে জ্ঞান বা শিক্ষাদানের মাধ্যমে ফেরেশতাদের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করা এবং ফেরেশতাদের মানুষ আদমকে সিজদা করার নির্দেশ দানের তাৎপর্য মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে। ইবলিস আদমকে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাকে বহিষ্কার করা এবং পৃথিবীতে মানুষের প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত করে প্রেরণ করার মধ্যেও সবার জন্য রয়েছে উপলব্ধির যৌক্তিকতা। কেননা, শয়তানের প্ররোচনায় আদম আ: ও বিবি হাওয়া আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার প্রথম যে অন্যায় করেছিলেন তার পরিণতিতে মানুষকে বেহেশত থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। মানুষকে বেহেশতচ্যুতি করা হচ্ছে শয়তানের প্রথম ও বড় বিজয়। এরপর আল্লাহ বলেছেন, ‘পৃথিবীতে তোমরা (শয়তান ও মানুষ) পরস্পরের শত্রু হিসেবে অবস্থান করবে।’ শয়তান আল্লাহর কাছ থেকে মানুষকে প্রতারিত করার ক্ষমতা অর্জন করে এবং আল্লাহ বলেছেন, ‘তিনি যুগে যুগে সত্যপথের দিক-নির্দেশনা প্রেরণ করবেন। যারা সে মত অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় বা দুঃখ থাকবে না। আর যারা শয়তানের প্ররোচনায় সত্যপথের নৈতিক বিধিবিধানকে প্রত্যাখ্যান করবে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বা জাহান্নামের আগুনে পুড়বে। অর্থাৎ শয়তান যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছিল তাতে সে জয়লাভ করতে থাকলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত তো হবে এবং সবার ওপর আল্লাহ যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন শয়তানের প্রতি তাও বাস্তবায়িত হবে। এ ব্যাপারে সব সময় তাই সবার সচেতন থাকা উচিত। দৈনন্দিন জীবনে যখনই অন্যায়-অনিয়ম বা আল্লাহর হুকুমের অমান্য বা বিরুদ্ধাচার করা হবে তখনই শয়তানের হবে বিজয়। সুতরাং শয়তান যেন বারবার জিতে না যায় সেদিকে সজাগ ও সক্রিয় থাকা প্রকারান্তরে আল্লার রহমত পাওয়ার বা সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম উপায়।
শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক, সুফি সাধক খানবাহাদুর আহছানউল্লাহ রহ. তার ‘আমার জীবনধারা’ গ্রন্থের পরিশিষ্টে ‘কিছু কূট প্রশ্নের সমাধান’ শীর্ষক অধ্যায়ে ‘শয়তান বলিতে কি বুঝি’ পরিচ্ছেদে যা লিখেছেন তার উদ্ধৃতি এখানে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক প্রতীয়মান হয়-
‘মানুষ সৃষ্টির সেরা, রবি-শশী, জিন ফেরেশতা মানুষের খেদমত করে। মানব-সৃষ্টির আগে জিন ছিল, ফেরেশতাও ছিল, তবুও করুণাময় খোদা মানুষকে তাহার খলিফা বানাইতে ইচ্ছা করিলেন সৃষ্টির আদর্শ স্বরূপ। তিনি স্বীয় আত্মা ফুঁকে দিলেন আদমের ভিতর, আর আদমকে সাধারণ মাটি দিয়া তৈরি করিলেন। তার খাদ্যের সহিত লোভ-মোহ প্রভৃতি প্রবৃত্তিরও সৃষ্টি করিলেন। ফেরেশতার না আছে আহার, না আছে খাদ্যের বাসনা, না আছে নফছ। মানুষের সবই আছে; সে মাটি হইতে উৎপন্ন, যে মাটি সকলেরই পদদলিত। শক্তিশালী খোদার ইচ্ছা হইল, এই মাটির মানুষকে আগুনের ফেরেশতা হইতে উন্নততর করিবেন। তাই তিনি দয়া পরবশ হইয়া স্বীয় ছেফাতের কিয়দংশ ফুঁকিলেন মাটির আদমের মধ্যে। ফেরেশতারা নতশির হইল, আদমকে সেজদা দ্বারা ভক্তি জ্ঞাপন করিল। কিন্তু শয়তান সেজদা করিল না এবং সে যে করিবে না, খোদা তাহাও নিশ্চয়ই জ্ঞাত ছিলেন।
খোদা আদমের মধ্যে প্রবৃত্তির সৃষ্টি করিয়াছিলেন এই উদ্দেশ্যে যে, আদম জাত অহরহ প্রবৃত্তির সম্মুখীন হইয়াও, শয়তানের ধোকা খাইয়াও ফেরেশতার ঊর্ধ্বতন স্থান অধিকার করিবে। আর জ্ঞানময় খোদা আদমকে ঐ জ্ঞান দিলেন, যে জ্ঞান দ্বারা আদম সৃষ্টির মধ্যে খোদার যেসব রহস্য প্রচ্ছন্ন আছে, তাহা উদঘাটন করিতে পারে ও খোদার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করিতে পারে।
আমি রিপুকে শত্রু মনে করি না; মানুষের মধ্যে রিপু না থাকিলে, কুপ্রবৃত্তি না থাকিলে তাহার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হইত না। যিনি যত পরিমাণে কুপ্রবৃত্তিকে দমন করিতে পারেন, নফসকে বশীভূত করিতে পারেন, তিনি ততই খোদার নৈকট্য লাভ করিতে পারেন। এই রিপু না থাকিলে মানুষের মাহাত্ম্য আমরা কিরূপে উপলব্ধি করিতাম? বলিতে গেলে, শয়তান খোদার নৈকট্য লাভের সহায়-স্বরূপ। খোদা শয়তানকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন, আমাদেরই মঙ্গল হেতু। মঙ্গলময় খোদা সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে নষ্ট করিতে শয়তানকে সৃষ্টি করেন নাই। অন্ধকার না হইলে আলোকের বাহার কোথায়? কদাকার না হইলে সুন্দরের প্রশংসা কোথায়? বদি না হইলে নেকির বাহাদুরি কোথায়? দোজখ না হইলে বেহেশতের শান্তি কে বুঝিত? খোদার অসীম শক্তি, অফুরন্ত দয়া; তাই মাটির মানুষের মধ্যে শয়তানকে ভরিয়া দিয়া তাহাকে উচ্চতম স্থান দান করিয়াছেন। ধন্য তাঁহার মহিমা ধন্য তাঁহার সৃষ্টি কৌশল।’
সমাজে অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির যে চেষ্টা তা সে নিরিখেই দেখার অবশ্যই অবকাশ রয়েছে। অশরীরী অপশক্তিকে রুখে দেয়ার নাম করে প্রকারান্তরে শারীরিক অপশক্তির উদ্ভব ঘটে এবং সে অগ্রযাত্রায় আপ্লুত বোধ করা হয়। কল্পিত অপশক্তির অর্থায়নে বাধা দেয়ার নিয়তে আসল অপশক্তির দ্বারা লাখ কোটি টাকা লোপাটের মহা উৎসব চলে। ঠাকুর ঘরে কে? সমস্বরে সুচতুরতায় উত্তর আসে- ‘আমি কলা খাই না’। শয়তানের জয়-পরাজয় এখানেই।
লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা