ভ্রমণ, ইউরোপের ৪ দেশ
- জয়নুল আবেদীন
- ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:২৫
১ম পর্ব
২ ঋতুর দেশ ২ মেরু। উত্তর মেরুতে গ্রীষ্মকাল ১৮৭ দিন, শীতকাল ১৭৮ দিন। অর্থাৎ ৬ মাস রাত ৬ মাস দিন। সেখানে নেই ঘড়ির প্রচলনও। উত্তর মেরুর দক্ষিণে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল। Scandinavia is a subregion in northern Europe, with strong historical, cultural, and linguistic ties between its constituent peoples. ইউরোপের তিনটি দেশ নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্ক স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল। স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের পশ্চিম-দক্ষিণে ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডসহ ইউরোপ ৪ ঋতুর দেশ।
পতঙ্গ জগতে প্রজাপতির সৌন্দর্য নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই- ঘৃণা ও আতঙ্কের শেষ নেই শুঁয়োপোকার বিশ্রী চেহারা নিয়েও। অভিন্ন কীট হলেও শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি আমূল পরিবর্তন। এরকম ঋতু বদলের সাথে সাথে আমূল বদল হয় ইউরোপ-প্রকৃতিও। শীত শুরু ডিসেম্বরে। বসন্ত শুরু মার্চে। জুন থেকে শুরু গ্রীষ্মকাল। শীতের ইউরোপ আর গ্রীষ্মের ইউরোপ শুঁয়োপোকা আর প্রজাপতির মতোই আসমান জমিন তফাত। শীতের ইউরোপ ধরা পড়েছে আমার প্রথম ভ্রমণকাহিনী ‘বিলেতের পথে পথে’ গ্রন্থে। ২০০৩ সালের ১০ ডিসেম্বরের চিত্র, ‘স্থানীয় সময় বেলা ১টা বাইরে রোদ দেখা গেল। সবার বারণ সত্ত্বেও আমি বাইরে বের হওয়ার জন্য অস্থির হচ্ছি দেখে গিন্নি বলল, ‘সাবধান, এ পোশাকে বের হবেন না। আজ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, তাপমাত্রা চারের কাছাকাছি।’ আমার গায়ে ছিল গেঞ্জি, সোয়েটার, ফুলহাতা সার্ট ও কোট। বারণ উপেক্ষা করে...দরজা খুলে এক দৌড়ে একেবারে ফুটপাথে। উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ সূর্যালোকের মাঝে দাঁড়ানোর পর শরীরে রোদের উষ্ণতা পৌঁছার আগেই শীতের তীক্ষ্ণতা পৌঁছে যায়। মনে হলো, হাত, পা ও মুখের চামড়ার ভেতর অসংখ্য বিষাক্ত সুঁই ফুটছে। যেভাবে বের হয়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই আবার ঘরের দিকে দৌড় দিই।’ (বিলেতের পথে পথে পৃষ্ঠা ১৭)। ‘গাছগুলো বজ্রপাতে পোড়া গাছের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে। খ্রিষ্টানদের একমাত্র উৎসব বড় দিন। ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের উৎসবে আনন্দ করার জন্য আমরাও ছুটি পালন করি। খ্রিষ্টান দেশে খ্রিষ্টানদের বড়দিন দেখার শখ অনেক দিনের। ২০০৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের আনন্দে শেয়ার হওয়ার জন্য সকাল সকাল বের হই, কিছু দূর হাঁটার পর সামনে ডান দিকে একটি গির্জা। গির্জার দরজা বন্ধ, তালা ঝুলছে। মনে করেছিলাম, এত বড় খুশির দিনে গির্জায় লোকের ঠাঁই হবে না। রাস্তায় রাস্তায় রঙ-বেরঙের পরিচ্ছদ পরে লোকজন ঘোরাঘুরি করবে; হাসবে-নাচবেÑ শিশুদের কলকাকলীতে মুখরিত থাকবে লন্ডন শহর। ঘণ্টা খানেক রাস্তায় হাঁটছি। একজন লোকও চোখে পড়ল না। সুনসান বিরান নগরী।’ (বিলেতের পথে পথে পৃষ্ঠা ১১৪)।
এই হলো শীতের ইউরোপ। বারবার শীতের ইউরোপ দেখার পর ইউরোপ প্রকৃতি সম্পর্কে একটা ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছিল। ভ্রান্ত ধারণাটি অন্ধ হুজুরের পায়েস না খাওয়ার মতোই হাস্যকর।
- পায়েস খাবেন হুজুর? মা আজ পায়েস রান্না করছেন।
- (ছাত্রের এই প্রশ্নের উত্তরে অন্ধ হুজুর জানতে চেয়েছিলেন) পায়েস কেমন?
- সাদা।
- সাদা কেমন?
- বকের মতো ধপধপে।
- বক কেমন?
- বগা কাঁচির মতো ইয়া লম্বা।
- বগা কাঁচি কেমন?
ছাত্র দৌড়ে বারান্দার সিলিং থেকে পাট কাটার আড়াই ফুট লম্বা বগা কাঁচি এনে হুজুরের হাতে দেয়। হুজুর বকের গলার মতো ইয়া লম্বা ও বাঁকানো কাঁচি নাড়াচাড়া করে ভয়ার্ত কণ্ঠে,
- না রে পায়েস খাব না, গলা কেটে যাবে।
অন্ধ হুজুরের মতো ইউরোপ সম্পর্কে আমার ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে চায় মেয়েরা। ফোন করলেই বলি, ‘রাত দিন ইঁদুরের গর্তে বসে খানা-দানাসহ টিভি দেখা, আর এস্কিমোদের পরিচ্ছদ পরে খাবার কিনে আবার গর্তে ঢুকে পড়া মড়ার দেশে আর নয়।’ আমার এ রকম মন্তব্যে তারা বলত,
- আব্বা, ডিসেম্বরে ইউরোপের মানুষই ইউরোপ ছেড়ে উষ্ণ মণ্ডলের দেশে চলে যায়। আর আপনারা বোকার মতো উষ্ণ মণ্ডলের দেশ থেকে হিমমণ্ডলের দেশে আসেন ভ্রমণ করতে। যেখানে গ্রীষ্মমণ্ডলের শীতকালের সাথে হিমমণ্ডলের গ্রীষ্মকালের তুলনা চলে সেখানে গ্রীষ্মমণ্ডলের মানুষ শীতকালে হিমমণ্ডলের দেশে প্রবেশ করা উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে প্রবেশ করার শামিল।
- আমরা বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবী আবার বোকা হয় কি করে! যা করি বুঝে-শুনেই করি। বুঝে-শুনে করার কারণ দু’টি, প্রথমত; অনেক বিষয়ে আমরা অন্ধভাবেই ইউরোপকে অনুসরণ করি। শীতপ্রধান দেশে শীতের ছুটি ডিসেম্বরে, গ্রীষ্ম-প্রধান দেশেও শীতের ছুটি ডিসেম্বরেই। সাড়ে চার’শ বছর আগে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস মারা যাওয়ার পর শোক প্রকাশের জন্য আদালতের আইনজীবী ও বিচারপতিগণ কালো কোট ও গাউন পরা শুরু করেন। চার্লসের শোক পালন শুরু হয় ব্রিটিশ শাসিত পাক-ভারতেও। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কালো কোট ও গাউন পরার রেওয়াজ রয়ে গেছে। ‘আমরা বাঙালি’ কথাটি মুখেই বলি, অন্তরে স্বীকার করি না। নিজস্ব সংস্কৃতির সন্ধান না করে ধারক ও পোষক হয়ে পড়ছি প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের।
দ্বিতীয়ত, আমাদের মধ্যবিত্তের ভ্রমণের সাথে আর্থিক লাভ-ক্ষতি জড়িত। মার্চ এপ্রিল মাসে চেম্বার থাকে জমজমাট। তখন অনিবার্য কারণ ছাড়া বাইরে কাটাই না। সালমা চলে যাওয়ার পর আর কাজে মন বসে না। নানা কারণে বিরক্ত হয়ে অনেক ক্লায়েন্টকেই মামলা নিয়ে যেতে বলি। মামলা জয় করার নতুন অলিগলি বের হয়েছে- যা অতিক্রম করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এভাবে মনের বিরুদ্ধে কাজ কারতে থাকলে মামলা হ্রাসের সাথে সাথে অর্জিত সুনামও হ্রাস পেতে শুরু করবে। কাজের প্রতি অনীহার কারণেই, ইউরোপের বসন্ত দেখতে সম্মত হই।
ইউরোপ বলতে ইংল্যান্ডসহ সেনজেন ভুক্ত ২৬টি দেশ বোঝায়। ইংল্যান্ড সেনজেন জোটের বাইরে। সেনজেন ভুক্ত ইউরোপের জন্য নিতে হবে সেনজেন ভিসা। আমার জন্য লন্ডনের ভিসা সহজ হলেও সেনজেন ভিসা সহজ নয়। ছয় মাসের জন্য লন্ডনের মাল্টিপল ভিসা কনফার্ম করে সুইডেন অ্যাম্বেসিতে কাগজপত্র জমা দিই। কাগজপত্রের সাথে ছয় মাসের জীবন বীমা ও প্রবাসী কন্যাদের সুপারিশপত্র। সবকিছুর পরও সাথে বিমানের আপ-ডাউন টিকিট না থাকায় প্রথমবার ফিরিয়ে দেয়। পরেরবার ১৬ এপ্রিল থেকে ৪৫ দিনের জন্য ভিসা পাই। ঠিক করেছি, প্রথমে লন্ডন, তারপর ১৬ মে প্রবেশ করব সেনজেন দেশে।
‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার’, কবি হেলাল হাফিজের উক্তিটি শুধু যুদ্ধ নয়, প্রেম-ভালোবাসা, ধর্ম-কর্ম, মিছিল, ভ্রমণ ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রেই খাটে। যেমন- প্রথম সমস্যা; ভ্রমণ-বিনোদনে শরীর আনফিট। ২০১৯ সালের শীতে গিয়েছিলাম বান্দরবান। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের বৈরী আবহাওয়ার কারণে গ্রাউন্ড অলিম্পিয়ান দেখতে রওনা হয়েও থেমে গিয়েছিলাম। সঙ্গীরা আমাকে রেখেই হাজার ফুট উপরের খেলার মাঠ গ্রাউন্ড অলিম্পিয়ান দেখতে চলে গেলেন। মন খারাপ করে রয়ে গেলাম কোয়ান্টামের আবাসনেই। বান্দরবানে যে পাহাড় দেখতে গেলাম সে পাহাড়েই উঠতে পারলাম না।
দ্বিতীয় সমস্যা; চিরাচরিত আত্মভোলা স্বভাব। আত্মভোলা স্বভাবের কারণে মোবাইল, চশমা, ব্যাগ দূরের কথা, টাকা-পয়সা পাসপোর্টও নিরাপদ নয়। দূর দেশের প্রতিটি ভ্রমণেই সঙ্গে ছিল সালমা (স্ত্রী)। আত্মসচেতন সালমা। কখন কোন ওষুধ সেবন করতে হয় বিচক্ষণতাসহ আবশ্যকীয় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যজ্ঞের ধনের মতো আগলে রাখত।
তৃতীয় সমস্যা; বিধাতার বিস্ময়কর বিশ্বের বিস্ময়ের বিশালতা দেখার অনুভূতি প্রকাশের আনন্দ। অনুভূতি প্রকাশ না করতে পারা যন্ত্রণা। আমার কোনো ভ্রমণেই এই যন্ত্রণা ছিল না। ভ্রমণের অর্ধেক আনন্দই মাটি করে এই যন্ত্রণা। তাই ঠিক করেছি, বাইরে যাওয়ার আগে আমার বিগত দিনের সফর সঙ্গী সালমার সমাধি দেখাসহ বাড়ির মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করা।
আমার লেখার কাছের পাঠক তাহান (নাতি)। ভাষা সমস্যার কারণে ঘাটে ঘাটে দুর্গতির বিষয় জানে তাহানও। ইংলিশ স্কুলের শিক্ষার্থী তাহান। দাদা ভাইয়ের দুর্গতি দেখে ইংরেজি ভাষায় জোর দিয়েছে তাহান। দাদাভাইয়ের সাথে চলে যাবে ফুপিদের কাছে। তাই আমার সঙ্গ ছাড়ে না। সকালের হাঁটাসহ আমি যেখানে যাই সেখানেই সঙ্গে তাহান। দাদুভাইকে সাহায্য করার জন্য তৈরি হচ্ছে তাহানও। তাহানের ছোট নূরাত। অল্প অল্প কথা বলতে পারে। সব কথা বলতে না পারলেও বুঝতে পারে অনেক কিছুই। তার দিদি (সালমা) চলে যাওয়ার আগের দিনও বাড়িতে লোকজন ভরা ছিল। ভরা লোকজনের মাঝখান থেকে বের হয়ে গেল তার দিদিভাই, আর ফিরে আসেনি। দিদি ঘরে না ফেরার কারণটা জানার বয়স হয়নি, তাই মনে হলেই দিদির খালি বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাকে। দিদি চলে গেছে, যদি দাদাভাইও চলে যায়? খয়েরি রঙের নতুন লাগেজে মালামাল ভরতে দেখছে নূরাত। দাদাভাইকে কিছুতেই যেতে দেয়া যাবে না। নূরাতের বিশ্বাস, লাগেজটাই কাল। লাগেজটা আটকাতে পারলেই আটকে যাবে দাদাভাইয়ের চলে যাওয়াও। তাই কারো কাছে কিছু না বলে সর্বশক্তি ব্যয় করে লাগেজটা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।
লাগেজটা সরিয়ে নিয়েও আটকাতে পারেনি, সকাল ১০টার দিকে আমরা বের হয়ে পড়ি। ঢাকার ভেতর প্রবেশ না করে রূপগঞ্জের কাঞ্চন ৩০০ ফুট রোড দিয়ে বিমান বন্দর যাওয়া সহজ। চিটাগাং রোড, শীতলক্ষ্যা ব্রিজ পার হয়ে ৩০০ ফুট রোডের দিকে যাচ্ছি আমরা। ‘পূর্বাচল’ নামটা শুনেছি, দেখা হয়নি। ‘৩০০ ফুট’ নামটি প্রথম শুনলাম। বিশিষ্ট ব্যক্তি, স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের নামে রাস্তার নাম হওয়ার কথা শুনেছি, এরকম ‘৩০০ ফুট’ অঙ্কের নামে রাস্তার নামকরণ প্রথম শুনলাম। আমার পেছনের সিটে তওহিদ। কারণটা জানতে চাইলেই তওহিদ বলে,
- আব্বা, ৩০০ ফুট প্রস্থ রাস্তা। সম্ভবত বাংলাদেশে এটাই চওড়া রাস্তা। এই চওড়া রাস্তার অন্য নাম থাকতেও পারে। সবার কাছে ‘৩০০ ফুট রোড’ নাম-ই বহুল প্রচারিত। আমরা এখন ৩০০ রোডে। সামনেই কাঞ্চন ব্রিজ। ব্রিজ পার হলেই শহর পূর্বাচল। রাজউকের নতুন শহর প্রকল্প। ঢাকা মহানগরীর অদূরে রূপগঞ্জ ও কালীগঞ্জ এলাকার ৬,১৫০ একর জমি ৩০ সেক্টরে ভাগ করে ২৭ লাখ মানুষের বাসের উপযোগী হচ্ছে এই শহর। এই উদ্দেশ্যে এখানে ২৬ হাজার আবাসিক ভবনসহ ৬২ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করার কাজ চলছে। রাজধানী ঢাকা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে এই প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। ১৯৯৫ সালের জুলাই খেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৮ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে, সাত হাজার ৭৮২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। মূল লক্ষ্য, শহরের আশপাশে আবাসনের যুযোগ, শহরে জনসংখ্যার চাপ হ্রাস, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, নতুন জনপদের উন্নয়নসহ তীব্র আবাসিক সমস্যার সমস্যা হ্রাস।
- রূপগঞ্জের দেবই এলাকায় আমার এক বন্ধুর বাড়ি। আবদুস সামাদ আজাদ। একসাথে ওকালতি পড়া ও করা। বছর দুয়েক আগে মারা গেছেন। সামাদের সাথে এই এলাকায় এসেছিলাম। এসেছিলাম ৭০ দশকের শেষ দিকে। ছিলাম কয়েক দিন। টিলা, ডোবা, ফসলের জমি আর ফল-ফলাদির বাগানে ভর্তি ছিল এলাকা। ছিল প্রচুর কাঁঠাল আর কামরাঙা গাছ। মধুর মতো মিষ্টি গাছপাকা কাঁঠালের স্বাদ এখনো ভুলতে পারি না। সামাদের ঘরের সামনেই ছিল একটি মিষ্টি কামরাঙার গাছ। বড় বড় কামরাঙা গাছের তলায় পড়ে থাকত। গাছ-গাছালি আর ঝোপ-জঙ্গল ঘেরা ছিন্ন ছিন্ন বাড়িঘর। অধিকাংশ ঘরের ভিটি পাকা। গ্রিলের দরজা। চোর-ডাকাতের উপদ্রব বেশি বলেই এই নিরাপত্তা। পীর-দরবেশ আর বাউল-পাগলের এলাকা। সামাদ নিজেও এক পীরের মুরিদ। মাঝে মধ্যেই বাঁধাই করা সমাধি ও মাজার চোখে পড়ত। একদিন আমাকে দূরের এক মাজারে নিয়ে যায়। মাজারের উপরে প্রকাণ্ড এক তেঁতুল গাছ। মহীরুহের আকার ধারণ করা গাছটির সঠিক বয়েস কেউ বলতে পারে না। বছরের নির্ধারিত দিনে এখানে ওরস হয়। সাত দিন ব্যাপী ওরসের সময় এলাকা লোকে লোকারণ্য থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে গেরুয়া পরিচ্ছদে জটাধারী বাউল-দরবেশ আসতো। কোথায় সেই তেঁতুল গাছ আর জটাধারী বাউল-দরবেশ? কিছুই চোখে পড়ছে না। চোখে পড়ছে নির্মাণাধীন বহুতল ভবন, ফুটওভার ব্রিজ, কালভার্ট, হাইওয়ে প্রভৃতি স্থাপনা। এক হাউজিং প্রতিষ্ঠানের আইন উপদেষ্টা হিসেবে ২০০২ সালের দিকে মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম। ব্রিটিশ শাসিত ছিল ভারতবর্ষসহ মালয়েশিয়া। ৩,২৯,৮৪৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে এক সময় মানুষ ছিল না বললেই চলে। মালয়েশিয়ায় ১৮০০ সালে লোক সংখ্যা ছিল আড়াই থেকে তিন লাখ। ব্রিটিশ থেকে আমাদের ১০ বছর পর মুক্ত হয়। তিন দশকের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ায় জেলে-জোলার জনমানবহীন দেশটি। পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার যখন the tallest twin towers in the World তখন দেখতে গিয়েছিলাম। শৈশবে দাদিমার কাছে পরীর রাজ্যের গল্প শুনতাম। গল্প শেষে যতক্ষণ ঘুম না আসত ততক্ষণ পরী ও পরীর রাজ্য কল্পনা করতাম। কল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেই স্বপ্নদেবীর পাখায় ভর করে চলে যেতাম পরীর রাজ্যে। ভোর রাতে বাবার পুঁথিপাঠের শব্দে ঘুম ভাঙত পরীরাজ্য দেখা শেষ হওয়ার আগেই। পরীরাজ্য দেখার পিপাসা নিবৃত্ত হয়েছিল মালয়েশিয়ার সেপাং এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পরেই। জন-মানবহীন প্রশস্ত পথ ধরে চলছি তো চলছিই। কুয়ালালামপুরের কাছে যেতেই চোখ পড়ে Petronas Towers-এর প্রতি। কী দেখছি, স্বপ্ন না সত্য, বিশ্বের বিস্ময়, Petronas Twin Tower of Malaysia, or KLCC Twin Towers are 88-storey supertall, Top floor 1,230 ft, floor area 4,252,000 Twin Towers are the tallest twin towers in the World, and its status has remained unchallenged since1996. ২০০২ সালে যখন পেট্রোনাস টাওয়ার বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন তখন তা দেখাসহ শুনতে গিয়েছিলাম দেশটি রাতারাতি উন্নয়নের রোড-মডেল হওয়ার গল্প (বর্তমান মাথাপিছু আয় ১৮২৪ ডলার, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.২৫% ১০ মে ২০২২। ২০২১-২২ থেকে চলতি এক বছরে বেড়েছে ২৩৩ ডলার)। ২০০২ সালে মালয়েশিয়ার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখেছিলাম; সে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চোখে পড়ল বাংলাদেশের শহর পূর্বাচলে। শহরের আশপাশে আবাসনের সুযোগসহ শহরে জনসংখ্যার চাপ হ্রাসে উদ্যোগ উন্নত দেশ বহু আগেই নিয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশমাত্রই নানা উপায়ে প্রধান সিটি বা রাজধানী শহরকে জঞ্জাল ও যানজট মুক্ত রাখার জন্য নানা রকম কলাকৌশল অবলম্বন করেছে। যেমন, ইংল্যান্ডকে একটি মৌচাকের সাথে তুলনা করলে মধুভাণ্ডসহ মক্ষিরানীর স্থান বলা চলে লন্ডন সিটিকে। সিটিকে নিরাপদ, জঞ্জাল ও যানজটমুক্ত রাখার জন্য একাধিক জোনে ভাগ করাসহ লন্ডন শহরকে ঘিরে যে হাইওয়ে এই হাইওয়ের নাম, M25. The M25 or London Orbital Motorway is a major road encircling most of Greater London. The 117-mile motorway is one of the most important in the UK and one of the busiest . M25. দিয়ে চলছে তো চলছে। রোডের বাইরে যাওয়া ছাড়া পার্ক করার সুযোগ নেই। কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেলে রাখার নির্ধারিত স্থান আছে। নির্ধারিত স্থানে রেখে রয়েছে ফোন করার ব্যবস্থাও। স্র্রোতের মতোই এক দিক দিয়ে যাচ্ছে, আরেক দিক দিয়ে আসছে। এই স্রোত কখনো থামে না। এখানে ঘণ্টার ৭০ মাইল গতিতে গাড়ি চালানো যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি চালালেও অন্য গাড়ি রাস্তা ক্রস করার কারণে ট্রাফিক সিগন্যালের আবশ্যক হয় না। বাহির থেকে যেসব যান সিটিতে প্রবেশ করে সেসব যান শহরে প্রবেশের জন্য হাইওয়ের উপর কিংবা তলা দিয়ে রয়েছে অসংখ্য পথ। এই উদ্যোগের কারণেই হাজার বছর আগের লন্ডন শহর এক জনবিরল এলাকা। ২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর যখন লন্ডন সিটি দেখতে যাই তখন, ‘শতবর্ষের আগে পরিকল্পিত এসব রাস্তা পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধন করাও সম্ভব নয়। এ বিষয়টি বুঝতে পেরেই হয়তো লন্ডন শহরটিকে সাতটি জোনে ভাগ করে এক জোন থেকে অন্য জোনের ভেতর ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচলের ওপর ট্যাক্স ও জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই অতিরিক্ত ট্যাক্স জরিমানার ভয়ে অনেকেই তাদের প্রাইভেট কার ট্যাক্সেবল এলাকার বাইরে রেখেই বাস ও ট্রেনযোগে সিটি এলাকায় আসা-যাওয়া করে।...কয়েকটি বাস অদল-বদল করে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা সিটিতে পৌঁছে গেলাম। রাস্তাঘাট ফাঁকা। লোকজন চলাচল নেই বললেই চলে। কিছুক্ষণ পরপর যাত্রীবাহী দুয়েকটি দ্বিতল বাস চলাচল করে। যতট সিটির ভিতরে ঢুকছি, ততই জনবসতি কম দেখছি। রাস্তায় ট্যাক্সি চলাচলও খুব কম। ... বাস স্টপেজ ও আন্ডারগ্রাউন্ড রেল লাইনের আশপাশে ছাড়া সিটি এলাকা জনশূন্য বললেও চলে।...গরম হরতালের সময় ঢাকা শহরের মতিঝিল এলাকার অবস্থা যা হয়, লন্ডন সিটির অবস্থাও অবিকল তাই।’ (বিলেতের পথে পথে পৃষ্ঠা ৪৫-৪৬)
পূর্বাচল উপশহরের পূর্বাপর অবস্থা ভাবতে ভাবতেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ করি। যখন বন্দরে প্রবেশ করি তখন বেলা ৪ ঘটিকা। বিমান ছাড়বে রাত ১০টায়। টিকিটে উল্লিখিত তফসিলে বাংলাদেশ সময় ১০ এপ্রিল রাত ১০টায় রওনা হয়ে লন্ডন সময় ১১ এপ্রিল সকাল ৯-৫০ মিনিটে হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণের কথা। রমজান মাস, নিঃসঙ্গ অবস্থায় এই ৬ ঘণ্টা কী করে কাটবে, ভাবতে ভাবতে বিষণœ মনে বন্দরে প্রবেশ করি। (তারিখ ১০ এপ্রিল ২০২২ ইং)
লেখল : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail: [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা