২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ডায়বেটিস : বাস্তবতা ও করণীয়

ডায়বেটিস : বাস্তবতা ও করণীয় - ছবি : সংগৃহীত

মানুষের জীবনাচারে পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ন, আয়ু বৃদ্ধি, তামাক ও মাদকের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং লাগামহীন জীবন যাপনের ফলে বদলে যাচ্ছে রোগচিত্র। কলেরা, বসন্ত, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়ার পরিবর্তে এখন ব্যাপ্তি ঘটেছে অসংক্রামক রোগের। এখন ডায়বেটিস, উচ্চরক্তচাপ, বিভিন্ন ধরনের প্রদাহজনিত অসুস্থতার কথাই বেশি শোনা যাচ্ছে। এসব অসুস্থতা সারা জীবন আক্রান্ত ব্যক্তিকে ভোগায়। এসব রোগের কারণে সৃষ্ট জটিলতা চিকিৎসাব্যয় বাড়িয়ে দেয়। ডায়বেটিস এ ধরনের একটি বহুমাত্রিক রোগ। এর সঠিক চিকিৎসা না হলে সৃষ্ট জটিলতা রোগীকে পঙ্গু করে; ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয় ডায়বেটিসের জটিলতাজনিত হৃদরোগের কারণে। এ ছাড়াও অনিয়ন্ত্রিত বা ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসার কারণে রেটিনোপ্যাথিজনিত জটিলতায় অসময়ে অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে। মস্তিষ্কের স্ট্রোক ডায়বেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে অন্যের গলগ্রহ হয়ে জীবন কাটাতে হয়। পায়ের রক্তনালী শুকিয়ে গ্যাংগ্রিন- এর সাথে অনেকেই পরিচিত। এসব ক্ষেত্রে জীবন বাঁচাতে রোগীর পা কেটে ফেলতে হয়। জীবন বেঁচে যায়; কিন্তু পঙ্গুত্ব আজীবন সাথী হয়ে থাকে। এ ছাড়াও প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, কিডনি বৈকল্য আরেকটি কঠিন জটিলতা। এসব জটিলতার কারণে বেড়ে যায় পারিবারিক দুর্ভোগ ও চিকিৎসাব্যয় যা মেটাতে প্রায়ই নিঃস্ব হতে হয় রোগীকে, রোগীর পরিবারকে। বাংলাদেশের ডায়বেটিস রোগীদের বার্ষিক চিকিৎসা ব্যয়ভার ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা রোগের জটিলতার সাথে সাথে বাড়তেই থাকে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের ১০ শতাংশ ব্যয় হয় ডায়বেটিস চিকিৎসায়। ডায়বেটিসজনিত জটিলতার চিকিৎসাব্যয় এর সাথে যোগ করলে এটি কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। এ ছাড়াও ভবিষ্যতে ডায়বেটিস জনগোষ্ঠীর পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে সাথে চিকিৎসাব্যয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা তো আছেই।

এক সময় মনে করা হতো- ডায়বেটিস শুধুমাত্র শহুরে লোকদেরই হয়। ভাবা হতো- ডায়বেটিস বয়স্কদের রোগ। দুটো ধারণাই মারাত্মকভাবে ভুল। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ভেতর ডায়বেটিসের উপস্থিতি (৩৫-৭০ বছর বয়স্ক) ৯.৫ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রতি ১০ জনের ভেতর একজন ডায়বেটিসে ভুগছেন যা এ দেশের ভবিষ্যত জাতীয় স্বাস্থ্য কাঠামোতে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ভেতর মহিলাদের সংখ্যানুপাতিক হার বেশি। অন্য দিকে, অল্প বয়সীদের ভেতরেও এ রোগের সংখ্যানুপাতিক হার ফেলে দেয়ার মতো নয়; যদিও ডায়বেটিস যেকোনো বয়সেই হতে পারে।

বাংলাদেশ, বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম ডায়বেটিস রোগীর দেশ। এক কোটি ৩০ লাখ ডায়বেটিস রোগী ও ৩৬ লাখ ঝুঁকিসম্পন্ন এক বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে এই দেশে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে- প্রায় ১২.১ শতাংশ পুরুষ ও ১৬.৫ শতাংশ মহিলা ডায়বেটিসে ভুগলেও এদের ৬২ শতাংশ জানেই না তাদের ডায়বেটিস রয়েছে। মাত্র ৪৫.১ শতাংশ নিয়ে থাকে নিয়মিত চিকিৎসা যার ফলে দিন দিন বাড়ছে ডায়বেটিস ও এর জটিলতাসম্পন্ন রোগীর সংখ্যা। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত। ডায়বেটিসের কারণে নষ্ট হচ্ছে অসংখ্য শ্রমঘণ্টা, বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।

পারিবারিক সূত্রতা ছাড়াও ডায়বেটিসের জন্য দায়ী স্থূলতা, উচ্চরক্তচাপ, গর্ভাবস্থা, দৈহিক শ্রমের স্বল্পতা, অপরিমিত জীবনাচার, বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সেবন, সর্বোপরি চর্বিযুক্ত খাবার, বাজারের তৈরি খাবার, মাদক ও তামাক গ্রহণ। এগুলো এড়িয়ে চললে ও জীবনে মিতাচারী হলে প্রায় ৮০ শতাংশ জটিলতা এড়ানো যায়। এড়ানো যায় ডায়বেটিস রোগকেও। শরীরের এক কেজি ওজন কমানোতে কমে ৮০ শতাংশ ডায়বেটিস ঝুঁকি। নিয়মিত দৈহিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম, রঙিন শাক-সবজি, লাল আটা, চাল, লাল চিনি ডায়বেটিস ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। পক্ষান্তরে চর্বিযুক্ত অতিরিক্ত ক্যালরিসম্পন্ন খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয় ডায়বেটিস উসকে দেয়।

ইদানীং আমাদের জীবনাচারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, বিশেষ করে নাগরিক জীবনে স্কুলের শিশু থেকে শুরু করে অবসরভোগী বয়স্ক জনগোষ্ঠীসহ। এটি হচ্ছে, দৈহিক শ্রমের কোনো সুযোগ নেই। শিশুরা স্কুলে যায় গাড়িতে, বেড়াতে যায় গাড়িতে। সারা দিন তাকে ব্যস্ত থাকতে হয় স্কুল আর কোচিং নিয়ে। বয়স্কদের চলাফেরার জায়গাগুলো বেদখল, অনিরাপদ। খাবারে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সুষম খাবারের জায়গা নিয়েছে ক্যালরিযুক্ত খাবার। যারা বিভিন্ন অফিসে কাজ করেন তারাও বলতে গেলে সারা দিনই চেয়ার-টেবিলে বসেই কাজ করেন। পরিণতিতে দৈহিক ওজন বৃদ্ধি ও স্থূলতা জাঁকিয়ে বসেছে- যা ডায়বেটিস ও উচ্চরক্তচাপকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। সুস্থতা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। এটি জাতির স্বাস্থ্যের প্রতি বিরাট হুমকি। এ ব্যাপারে প্রয়োজন ব্যাপক সচেতনতা। বছরে একবার ডায়বেটিস দিবসে আলোচনা, প্রদর্শনী করে এটি সম্ভব নয়। এর মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টার সাথে সাথে প্রয়োজন সর্বস্তরের জনগণের ব্যাপক সম্পৃক্ততা। প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন প্রচার-প্রচারণা; চিকিৎসক, রোগী, স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজকর্মী ও গণমাধ্যমের নিবিড় সমন্বয়। প্রয়োজন জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির সাথে সমন্বিত কার্যক্রম। মনে রাখা দরকার, একমাত্র সচেতনতাই ডায়বেটিসকে ঠেকিয়ে দিতে পারে ৮০ শতাংশ।

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ

Email: shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement