০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

আলিয়া মাদরাসা শিক্ষাক্রম নিয়ে কী হচ্ছে

আলিয়া মাদরাসা শিক্ষাক্রম নিয়ে কী হচ্ছে - প্রতীকী ছবি

নতুন বছর শুরু হতে আর বেশি দিন বাকি নেই। সরকার নিয়ন্ত্রিত আলিয়া পদ্ধতির মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২০২২ সালের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রণীত পাঠ্যবই যা দেশের ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইলটিং পদ্ধতিতে পাঠদান করা হচ্ছে এবং ২০২৩ সাল থেকে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে একই বই স্কুল ও মাদরাসায় বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হবে মর্মে এনসিটিবি ঘোষণা দিয়েছে, ইতোমধ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। এনসিটিবি কর্তৃক নতুন আঙ্গিকে পুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিশেষ করে উপসচিব, মাদরাসা অধিদফতরের মহাপরিচালক, মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান, এনসিটিবির চেয়ারম্যান, সদস্য শিক্ষাক্রমসহ বিষয় বিশেষজ্ঞদের সাথে, মাদরাসা শিক্ষকদের সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের নেতাদের সাথে পাঁচটি কর্মশালায় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা হয়। প্রতিনিধিরা মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা ও মান বজায় রেখে এবং এ দেশের মুসলমানদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি লক্ষ রেখে শিক্ষাক্রম ও পুস্তক প্রণয়নের জন্য জোর দাবি করে আসছেন এবং কর্তৃপক্ষও বারবার এ বিষয়ে মাদরাসার প্রতিনিধিদের আশ্বস্ত করে আসছে। কিন্তু ইতিবাচক কোনো ফল পাওয়া যায়নি। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণীর ৯টি বইয়ের মধ্যে কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরাম, আহলে বাইত, মুসলিম মনীষী, বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিকদের বাণী, উদ্বৃতি, নীতি-নৈতিকতা সৃষ্টিকারী কোনো বিষয় স্থান পায়নি। উপরন্তু আপত্তিজনক বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর রূপকল্প ৪১ এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যসূচি প্রণয়নের কাজ ধারাবাহিকভাবে করে যাচ্ছে। মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়নে মাদরাসা শিক্ষকরাও এনসিটিবির সাথে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। অথচ স্কুলে নবম ও দশম শ্রেণীর ইসলাম শিক্ষা বিষয়টি বোর্ড পরীক্ষা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণীর পাইলটিংয়ের জন্য প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আলোচিত বিভিন্ন বিষয়, শব্দ ও ছবির ব্যবহার এ দেশের মুসলমানদের তাহজিব-তামাদ্দুন, কৃষ্টি-কালচার বিশেষ করে মাদরাসা শিক্ষার উপযোগী নয় বলে দৈনিক নয়া দিগন্তের সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইসলামী শিক্ষা উন্নয়ন বাংলাদেশের কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি ড. এ কে এম মাহবুবুর রহমান অভিমত ব্যক্ত করেন। বইগুলো এমনভাবে রচিত যাতে সংশোধনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী, ১০টি বিষয় নিম্নরূপ- বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, গণিত, শিল্প সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও ধর্ম শিক্ষা। প্রথম পাবলিক পরীক্ষা এসএসসির সামষ্টিক মূল্যায়নে ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টিকে বাদ দেয়া হয়েছে (জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২০)।

মাদরাসার স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নসহ ১৩ দফা দাবি জানিয়ে সব জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন জমিয়াতুল মোদার্রেছীন নেতারা। স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, ৯১ শতাংশ মুসলমানের দেশে বিবর্তনবাদ, প্রাচীন সভ্যতার নামে মূর্তি, হিজাববিহীন মেয়েদের ছবি, গান-বাজনা, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার, খেলাধুলা, মোবাইল ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। বিজ্ঞানের নামে অশ্লীল ছবি, কুকুরের ছবি, সভ্যতার নামে উলঙ্গ ও অর্ধউলঙ্গ মূর্তির ছবি ব্যাপকভাবে স্থান পেয়েছে। দেড় হাজার বছরের মুসলিম ঐতিহ্য, নীতি-নৈতিকতা, কবি-সাহিত্যিকদের অবদানের কোনো বিষয় নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির আলোচনা খুবই কম। বইগুলোতে তিন শতাধিক মেয়ের ছবি পর্দাবিহীনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে ডারউইনের বিবর্তনবাদ (মানুষ বানর থেকে সৃষ্ট), পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনায় এমন সব বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে যা কুরআন-সুন্নাহ, মুসলমানদের আকিদা-বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের পরিপন্থী। প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস বর্ণনায় দেব-দেবীর নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবি, মৃত্যু ও পরকালের দেবতা ‘আনুবিষ’, সূর্য দেবতা ‘রা’, স্বর্গীয় মাতা ‘আইসিস’, কৃষি দেবতা ‘ওসাইরিস’, যুদ্ধ দেবতা ‘হোরাস’ ইত্যাদি দেবতার বর্ণনা দিয়ে পৌত্তলিকতা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৌদ্ধ মেয়েদের উলঙ্গ ছবি, হিন্দুদের মন্দিরের ছবি দেয়া হয়েছে। ‘বিজ্ঞান’ বইয়ে ১১ জন উলঙ্গ নারী-পুরুষের ছবি দিয়ে তাদের লজ্জাস্থানের পরিচয় দেয়া হয়েছে এবং ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন অঙ্গের বর্ণনা দিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নির্লজ্জ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে।

স্মারকলিপিতে বলা হয়, ‘ইংরেজি’ বইয়ে ১২টি কুকুর ও ১৪টি নেকড়ে বাঘের ছবি দেয়া হয়েছে, যা ইউরোপীয় কুকুর সংস্কৃতিরই অংশবিশেষ। সাহিত্য হিসেবে চরিত্র সৃষ্টি করার কোনো ব্যবস্থা তাতে নেই। ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ে কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন খুবই ন্যক্কারজনকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘জীবন ও জীবিকা’ বইয়ে পূজা, প্রণাম ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। গান শোনা, নাচ, বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার ইত্যাদি যন্ত্র ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদেরকে পাশ্চাত্য ও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেয়েদের ফুটবল খেলা, টিভি দেখা, অনলাইনে কার্টুন দেখার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি’ বইয়ে দুর্গাপূজা, অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির প্রবণতা লক্ষ করার মতো। ভ্রমণের জন্য দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরে যেতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। ‘বাংলা’ বইয়ে গানের প্রতি আসক্তি, কাল্পনিক বিষয়ের কবিতা, ভূতের ভয়, ঝগড়া শেখানো ও উদাহরণ হিসেবে গীতাঞ্জলির নাম উল্লেখ না করে কুরআন বা মুসলিম কোনো নাম ব্যবহার করা যেত। সাত ভাই চম্পা গল্পে হিংসা ও চারিত্রিক অধঃপতনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্রিকেট খেলা ও টেলিভিশনের সামনে বসার আগ্রহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ বইয়ের কভার পেজে ঢোল, তবলা ও মূর্তির ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে। সঙ্গীত, নৃত্য, মাটির পুতুল, সার্কাস ও মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতি উৎসাহ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ‘গণিত’ বইয়ে মেয়েদের ৭৭টি ছবি উপস্থাপিত হয়েছে যার একটিতেও হিজাব নেই। বাঁশি বাজানোর প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে। বেশির ভাগ অমুসলিম নাম ব্যবহার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। তাতে সব ধর্মের নাম থাকবে এটিই স্বাভাবিক। তবে ৯১ শতাংশ মুসলমানের দেশে মুসলিম নামের প্রাধান্য থাকাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এই ৯টি বইয়ে যেসব মানুষের নাম ব্যবহৃত হয়েছে একটি মুসলিম দেশে সত্যি তা আপত্তিকর। যেমন- অনিকা, মিনা, লিটল র‌্যাড, প্লাবন, রতন, মেধা, দীপক, স্কট, রূপা, নন্দিনী, এন্তি, মিসেল, মিতা, রন, শেলী, নিনা, জয়া, সুবর্ণা, রায়, মনিকা চাকমা, রিনা গোমেজ, রাতুল, রমা, রবিন, শিশির, ডেভিড, প্রিয়াঙ্কা, অরবিন্দু চাকমা, মন্দিরা, শিমু, মিলি, সুনীল, মিনু, চিনুক প্রভৃতি। বাংলা বইয়ের রচনা করেন প্রণয় ভূঁইয়া, সম্পাদনায় রয়েছেন স্বরোচিষ সরকার। স্মারকলিপিতে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

উপর্যুক্ত পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও ইসলামী শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত পীর-মাশায়েখ ও ওলামায়ে কেরাম প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশকৃত স্মারকলিপিতে নিম্নলিখিত দাবি উপস্থাপন করেন- ১. মাদরাসা শিক্ষার জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যবই, এনসিটিবি, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের বিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ আলেমদের সমন্বয়ে প্রণয়ন করার বিকল্প নেই। অবিলম্বে একটি সমন্বিত কমিটি গঠন করে এ কাজ শুরু করতে হবে। ২. এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠ্যবই প্রণয়নের আগপর্যন্ত বর্তমানে চলমান বই পাঠদান অব্যাহত রাখতে হবে। ৩. স্কুলের জন্য রচিত বইগুলো ইসলাম ও মুসলমানদের শিক্ষা সংস্কৃতির পক্ষে রচিত হয়নি। তাই বিশেষজ্ঞ আলেমদের সমন্বয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি এবং পাঠ্যবইগুলো সংশোধন করতে হবে এবং স্কুলের ধর্ম শিক্ষাকে বোর্ড পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ৪. সাধারণ শিক্ষায় ১০টি বিষয়ে এক হাজার নম্বরের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। মাদরাসা শিক্ষার জন্য মূল বিষয় ঠিক রেখে সমন্বয় সাধন করে এক হাজার নম্বর নির্ধারণ করতে হবে।

মাদরাসা শিক্ষক ও কর্মচারীদের বৃহত্তর সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন নেতৃবৃন্দ ও ইসলামিক স্কলাররা মনে করেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও বিশেষ করে মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন এবং যুগোপযোগীকরণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও মাদরাসা শিক্ষকদের কাছে প্রশংসনীয় হয়েছে। এ দেশের মুসলমানদের দীর্ঘকালের দাবি- ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি, ভৌত অবকাঠামো, জনবল কাঠামো, মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে স্বতন্ত্র অধিদফতর, ৫৬০টি মডেল মসজিদ প্রতিষ্ঠাসহ ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নে বহুমুখী পদক্ষেপের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নাম ইতিহাসে সোনালি হরফে লেখা থাকবে। প্রধানমন্ত্রী ১৭ নভেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ধর্মের শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করার আহ্বান জানান। এতে ধর্মের প্রতি তার অনুরাগ স্পষ্টত দৃষ্ট হয়; কিন্তু তার আশপাশের একটি সিন্ডিকেট ধর্মশিক্ষাকে সঙ্কুচিত করার বা ক্রমবিতাড়নের সুপরিকল্পিত অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে লিপ্ত। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। নইলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম অন্তঃসারশূন্য সর্বনাশের দিকে ধাবিত হবে।

শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, নবপ্রজন্মকে বিজ্ঞানমনষ্ক, যুক্তিবাদী ও আধুনিক করে গড়ে তোলা সময়ের দাবি। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়বস্তুর গুরুত্ব অস্বীকার করার জো নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন, মানবিক, সৎ, আদর্শ তথা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ধর্মশিক্ষা ও পরীক্ষার উৎস হলো শ্রেণীতে পাঠ্যবই। কিন্তু এই পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুতে চলছে ভয়াবহ নৈরাজ্য। ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য একটি গোষ্ঠী ঘাপটি মেরে বসে আছে। গত ৬ নভেম্বর এইচএসসি পরীক্ষার বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার ১১ নম্বর প্রশ্নে বলা হয়েছে, ‘নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘ দিন। অনেক সালিশ বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ-বণ্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আবদুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির এক অংশ বিক্রি করে। আবদুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এ ঘটনায় নেপালের মন ভেঙে যায়। কিছু দিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।’ এ যেন ভারতের আরএসএসের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের মোক্ষম চেষ্টা! আসামের মুসলমানদের তাড়ানোর অপচেষ্টাকে উৎসাহিত করা। পরীক্ষায় এমন বিতর্কিত প্রশ্নপত্র নিয়ে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সরকারের দায়িত্বশীলরা দাবি করছেন, ঘটনার সাথে জড়িতদের শনাক্ত করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু এ নিয়ে সারা দেশে তীব্র প্রতিবাদ চলছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এসএসসির প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়ার অভিযোগ তদন্ত করার কথা জানিয়েছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার। (দ্য ডেইলি স্টার, ১৮ নভেম্বর; ইনকিলাব, ১০ নভেম্বর-২০২২)।

ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা শাব্বীর আহমদ মোমতাজী বলেন, বর্তমান সরকারের সাফল্য ম্লান করতে এনসিটিবিতে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কিছু ব্যক্তি মাদরাসা, ইসলাম শিক্ষা ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কারিকুলাম তৈরি করেছে। তারা তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারকে বিতর্কিত করতে চায়। অবিলম্বে এদের চিহ্নিত করে অপসারণ করতে হবে এবং মাদরাসার জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম তৈরি করতে হবে যেটি হবে মাদরাসা, ইসলামবান্ধব ও এ দেশের আলেম-ওলামা এবং পীর-মাশায়েখদের সাথে আলোচনা করে, তাদের পরামর্শে। তিনি বলেন, আমরা একটি সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দিতে চাই যে শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষার সাথে সাধারণ, বিজ্ঞান শিক্ষার সমন্বয় করে একটি নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। আমরা খাঁটি ওয়ারিসাতুল আম্বিয়া তৈরি করতে পারব। (ইনকিলাব, ১৬ নভেম্বর-২০২২)

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘সরকার ধর্মহীন ও নাস্তিক্যবাদী জাতি গঠনে কাজ করছে। ইসলামবিদ্বেষীদের নীলনকশা বাস্তবায়নে ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দেয়ার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষায় ইসলামী শিক্ষা না নিয়ে কেবল সিলেবাসে রেখে শিক্ষামন্ত্রী জাতির সাথে ধোঁকাবাজি করছেন। আমাদের সন্তানদের নাস্তিক ও ধর্মহীন বানাতে দিতে পারি না। ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা আগের মতো বহাল রাখতে হবে। প্রথম শ্রেণী থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত ইসলামী ও দ্বীনিয়াত শিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘দেশে হিন্দুত্ববাদ ও নাস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত চলছে। ডারইউনের বিবর্তনবাদ সম্পূর্ণ নাস্তিক্যবাদী মতবাদ, এ শিক্ষা কোনোভাবেই মুসলমানের দেশে চলতে পারে না। মুসলমানদের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও সরকার নাস্তিক্যবাদী শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করলে এ দেশের ধর্মপ্রাণ জনতা জীবন ও রক্ত দিয়ে তা প্রতিহত করবে।’ (নয়া দিগন্ত, ১৯ নভেম্বর-২০২২)

সাধারণ শিক্ষার জন্য পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের আগে শিক্ষাক্রমকে সংশোধন করে দেশের বেশির ভাগ মানুষের ঈমান-আকিদা, কৃষ্টি-কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য বজায় রেখে শিক্ষাক্রমকে পরিমার্জন করা প্রয়োজন। পাঠ্যপুস্তকগুলোর ক্যাপশন, বিষয়বস্তু ও কন্টেন্টগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাদরাসা শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও নীতি-আদর্শের পরিপন্থী। তাড়াহুড়ো না করে জাতীয় শিক্ষানীতিতে বিঘোষিত মাদরাসা শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনে জরুরি ভিত্তিতে আলিয়া মাদরাসার জন্য পৃথক শিক্ষাক্রম প্রণয়নের আবশ্যকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement