০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

বিদ্যুতের শপথ করে বলতে পারি...

- ছবি : নয়া দিগন্ত

এই শিরোনামের পর বিদ্যুৎ নিয়ে কি লিখব, যুক্তিগুলো কোথা থেকে আনব তা-ই ভাবছিলাম। আমি তো বিদ্যুতের বিশেষজ্ঞ নই, তাই যুক্তির পরিমাণও কম আর তথ্য-উপাত্তও কম। তবে পত্রিকায় খুঁজলে পাব অনেক তথ্য, যা দিয়ে এই লেখা তাজা করে উপস্থাপন করা যাবে। প্রশ্ন করা যায়, তথ্য দিয়ে লেখা তাজা করা যায় কি না? সেটি অবশ্যই যথার্থ যে, তথ্য অনেক গ্যাপ বা শূন্যস্থান পূরণ করে দিতে পারে।

বিদ্যুতের ভোক্তারা তো সাধারণ মানুষ আর অসাধারণ গ্রাহক হচ্ছে শিল্পপতি, বাণিজ্যপতি ও যারা বিদ্যুতের বাল্ক (পরিমাণে বেশি ভোগ করেন বলে তারা বাল্কগ্রাহক বা ভোক্তা) কেনেন। এই বড় গ্রাহকরা জানেন বছরে বা কয় বছরে কয়বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে নিয়ন্ত্রক কমিশন বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন)। তবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আসে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে। আর ওই বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন ফ্যাক্টরি থেকে পাওয়া পণ্য পাঁচটি বিতরণী কোম্পানির মাধ্যমে গোটা দেশে সরবরাহ করে সেই পণ্য। এক্কেবারে মাঠপর্যায়ের ভোক্তারা বিদ্যুতের দাম প্রতি মাসেই পরিশোধ করে থাকেন এই ভয়ে যে, কখন না জানি বকেয়া রাখার অপরাধে লাইন স্থগিত বা কেটে দেয়; কিন্তু বাল্ক ক্রেতারা তা কেয়ার করেন না। যদি এমন সিদ্ধান্ত হয় যে, যাদের কাছে কোটি কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়ে গেছে তাদের সরবরাহ লাইন কেটে দেয়া হোক। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সাথে সাথে বিদ্যুৎবেগে সেই তথ্য বিদ্যুৎ বিলখেকোদের কাছে পৌঁছে যায় এবং সেই সব বিশাল আকারের শিল্পপতিরা তদবির করেন উচ্চ পর্যায়ে, প্রয়োজনে সুউচ্চ পর্যায়ে যাতে সিদ্ধান্তটি বাতিল করা হয়। শিল্পপতি, বাণিজ্যপতি ও সরকারের মালিকানাধীন বিদ্যুৎখেকো প্রতিষ্ঠাগুলোর নির্বাহীরা নানারকম তদবির শুরু করেন, যুক্তির পাহাড় খাড়া করেন। ফলে তদবিরে মেওয়া ফলে যায়।

শিল্প খাতের ভোক্তারা এই রকম যুক্তি দেন যে, বিদ্যুৎ না থাকলে দেশের শিল্প সেক্টর ডুবে যাবে। কথাটি ঠিক। কিন্তু এটিও তো ঠিক যে, তাদের বকেয়া পরিশোধ না করলে সরকারকে প্রতি বছর পিডিবিকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। একটু খোঁজ নিন সংশ্লিষ্টরা, সরকার প্রতি বছর কত হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে পিডিবিকে। পিডিবিকে দেয়া ভর্তুকির টাকাটা কোথা থেকে আসছে? সেটি সরকারি তহবিলের। আর সরকারি তহবিল তো জনগণের টাকা। তার মানে কি এটি নয় যে, জনগণের টাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, জনগণের টাকায় ভর্তুকি গোনা, আবার জনগণের টাকায় বিইআরসি, পিডিবি ও পাঁচটি সরবরাহ কোম্পানিসহ এর সাথে লাগোয়া বা জড়িত যত খাত উপখাত আছে, প্রত্যেকের জন্য সরকার অর্থাৎ জনগণের টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। এই চেন অব সাবসিডি (ভর্তুকি) কি সরকারের নীতি ও আদর্শের প্রতিফলন? সরকারের যে প্রশাসনিক কাঠামো (স্ট্রাকচার) যা, ব্রিটিশ আমলের ঔপনিবেশিক ধারার, সেই ধারায় তো এই শ্রেণীর বাল্ক ভোক্তাদের বাঁচিয়ে ক্ষুদ্র ভোক্তাদের ঘাড়ের ওপর ভূতের মতো চেপে বসার কায়দা-কৌশল নিয়ম-নীতির স্ট্রাকচার নির্মাণ করে শোষণের বেড়ি চাপানোই ছিল আসল উদ্দেশ্য। আর সেটিই স্বাধীনতার ৫১ বছরেও বহাল আছে বা রাখা হয়েছে। সরকার কেন জনগণের টাকা অদক্ষ, অসৎ, অমার্জিত চোরা মানসিক লোকবলের খাই মেটাতে উদগ্রীব? আসুন দেখা যাক, তাদের কৃতকর্মের ধারা কেমন। নিচের উদ্ধৃতি থেকে তার রূপটি দেখা যাক।

‘পাইকারি পর্যায়ে বাড়ানোর দুই দিনের মাথায় খুচরা পর্যায়ে ভোক্তাদের জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। গড়ে ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে তারা।

এর আগে গত সোমবার পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এখনই খুচরা দামে প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছিল বিইআরসি। এরপর পিডিবি সবার আগে খুচরা দাম বাড়ানোর আবেদন জমা দিলো। বাকি পাঁচ বিতরণ সংস্থার মধ্যে দু’টি বৃহস্পতিবার সকালে জমা দিয়েছে বলে বিইআরসি সূত্র নিশ্চিত করেছে। বাকি তিনটিও বৃহস্পতিবার বিকেলের মধ্যে জমা দিতে পারে বলে জানা গেছে। (প্রথম আলো/২৪ নভেম্বর-২০২২)

লোকবুলি হচ্ছে, সব রসুনের এক গুয়া। অর্থাৎ তাদের রস সংগ্রহের গোড়াটি একটি জায়গায়ই নিহিত বা পোতা। তার নাম বিইআরসি।

কমিশন নিজেই দাম বাড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তার প্রধান শাখা পিডিবি দাম বাড়াবেই এতে কোনো ভুল নেই। তারা প্রচলিত পথেই চলে ও চলেছে; কিন্তু এই সংস্থাগুলো কোনোভাবেই বলে না যে, সরকারি ও বেসরকারি খাতে ওই সব সংস্থার বকেয়া পাওনা তোলার কোনো নির্দেশনা নেই। নীতিটি কাকের চক্ষু বুজে কোকিলের বাসায় ডিম পাড়ার মতো ঘটনা। সরকারকে আরো ভর্তুকির সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়ে যাতে সিস্টেম লসের মাধ্যমে চোরদের লালন-পালন করা যায়, সেই প্রয়াসই প্রধান। সরকারকে ডোবানো মানে তো জনগণকে ডোবানো। কেনো না, সব দায় তো শেষাবধি জনগণের স্কন্ধে জমবে। এই যে এখন সরকার আইএমএফের কাছে ৪৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে যাচ্ছে, ওই ঋণ পরিশোধ তো জনগণের ঘাড়েই তুলে দিচ্ছে সরকার। মানে জনগণের নামেই, তাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির সোপান রচনা ও দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণ নিশ্চিত করতেই ওই ঋণ- এরকমটিই বলা হচ্ছে। তো, বিদ্যুৎ খাতের মূল্য বৃদ্ধি না করেও কিন্তু বিদ্যমান লস কমানো যায়। সেটি কিভাবে?

শিল্প সেক্টরে পিডিবির লাইনম্যানরা যে চোরাই মিটারবিহীন লাইন সংযুক্ত করে, সেটি যদি বন্ধ করা যায়, তাহলে সাশ্রয় হবে। এখন বলা হবে, কোনো রকম চোরাই লাইন লাইনম্যানরা দেয় না। কথাটি প্রচলিত সত্য ও তার সত্যতা আছে। আমরা সেটি বুঝতে পারি আমাদের বাড়ির মিটার চেক করতে আসা লোকেরা যখন টাকার বিনিময়ে মিটারে চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে কম বিল করেন, তখন বোঝা যায়- এই একই কাজ তারা করেন শিল্প সেক্টরেও এবং ওই চোরাই কাজের টাকা মিটার রিডার থেকে পিডিবির মহানদের তহবিলে- মানে পকেটে যায়। বেশি কষ্ট করে এই সত্য জানতে হবে না। যারা মিটার রিড করে বিল তৈরির কাজ করেন, তাদের ব্যক্তিগত সম্পদের হিসাব নিলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে যাবে। একই ঘটনা ঘটে পানি বা ওয়াসার মিটার রিডারদের ক্ষেত্রেও। তারাও বিনিময়ের কাজে পারদর্শী। ওয়াসার এমডি আমেরিকায় বসে অফিস করার অফিসিয়াল অধিকার পান কোন জাদুবলে, সেটিও ভোক্তা জনগণ জানে।
এসব চোরাই কাজ আদিকাল থেকেই চলে আসছে। আর তার দায়-দায়িত্ব নিয়ে সংস্থার প্রধানরা জনগণের টাকা লুটে নিচ্ছেন। পিডিবির হাই-অফিসিয়ালদের সম্পদের পরিমাণ যাচাই করা হোক। তাতেই পেয়ে যাবেন গত ১৪ বছরে তার বা তাদের সম্পদ কতটা বেড়েছে।

কিন্তু আমি জানি, এই পথে যাবেন না সরকারের দায়িত্বশীলরা। কারণ তারাও তো ওই বিদ্যুৎ চুরির ভাগিদার। সিস্টেম লসের নামে উৎপাদনের কত শতাংশ, বিতরণ লাইনের সিস্টেম লস কত পারসেন্ট এসব লস কতটা তার প্রকৃত হার পাওয়া গেলে। সেটি পাবে না কেউ, কারণ ওই সেক্টরে কর্মরত লোকেরা আসল সত্য নিশ্চিতভাবে বলবে না। কারণ তারাও তো ওই সিস্টেম লসের লভ্যাংশের ভোক্তা বা পাওনাদার। তাদের পকেটেও তো ওই অবৈধ টাকা ঢোকে। এটিই সিস্টেম। এই সিস্টেম ভেঙে না দেয়া পর্যন্ত এর বিনাশ নেই।

কেনো এর বিনাশ নেই, তার মূল কারণ বিদ্যুৎ সেক্টরের নিয়ম ও স্ট্রাকচারাল ডিজাইন। এই ডিজাইন ভেঙে দেয়ার একটি পদ্ধতি বা সিস্টেম সরকার কায়েম করার চেষ্টা করছে। তার নাম কার্ডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বেচাকেনা। ভোক্তা পর্যায় থেকে শুরু করে পিডিবি পর্যন্ত, আবার পিডিবি থেকে উৎপাদক পর্যন্ত কার্ডের মাধ্যমে বিদ্যুতের পরিমাণ ও মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা করলে আমার ধারণা, সিস্টেম লসের চুরি যৎসামান্যই থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। এই সিস্টেমে বিভিন্ন স্তরে বিল বকেয়া থাকতে পারবে না। ধরা যাক, পাঁচটি বিতরণ কোম্পানি কার্ডের মাধ্যমে তার প্রয়োজনীয় পরিমাণ বিদ্যুৎ কিনে নেবে পিডিবির কাছ থেকে। টাকা থাকলে সে কিনতে পারবে, না থাকলে সে পারবে না। একেবারে গ্রাম স্তরের গ্রাহক থেকে নগরের শিল্প স্তরের মালিকরা কার্ডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কিনবেন। তাতে করে বকেয়া যেমন হবে না, তেমনি বিল খেলাপি হবে না তারা। সরকারি অফিস-আদালতেও একই সিস্টেম চালু করলে আমরা লসের গর্তে পড়ব না।

উৎপাদন পর্যায়ে ধরুন, উৎপাদন হবে ৪৪০ মেগাওয়াট। কিন্তু যারা সেখানে ওই দায়িত্ব পালন করেন, তারা শত চেষ্টা করেও ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেন না। সেখানে তো কিছু সীমাবদ্ধতা আছেই; কিন্তু রাজনৈতিক মুখে আমরা বলতেই থাকব যে (৪৪০ মেগাওয়াট ধরে) আমাদের ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন আছে। আসলে কিন্তু সব মিলিয়ে উৎপাদন ১২-১৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি নয়। এখন বলবে, জ্বালানির জন্য তারা সর্বোচ্চ উৎপাদন করতে পারছে না। কিন্তু যখন জ্বালানি সঙ্কট ছিল না, তখন কেন হয়নি। তখন কি সঙ্কট ছিল? চুরির বিষয়টি গোড়া থেকেই প্রাক্কলিত হয়। যাতে এটিকে বলা যায় সিস্টেমের লস। অর্থাৎ সিস্টেমটাই লসের, এখানে পরিপূর্ণ উৎপাদন করা যায় না। ওই যে মানসিকভাবে বিদ্যুৎ চুরির সূচনা হয়, সেই সূত্র ধরেই মিটার রিডার পর্যন্ত তা পরিবাহিত হয়।
আমরা শপথ করে বলতে চাই, হাজার হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ চুরি বন্ধ করলেই আর দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। কিন্তু কেউ কি নিজের/নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরে জাতির কল্যাণ করবেন?


আরো সংবাদ



premium cement