গরিবের ঘোড়ারোগ
- গোলাম মাওলা রনি
- ২৪ নভেম্বর ২০২২, ১৯:৪০
বাংলা ভাষার অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রবচন গরিবের ঘোড়ারোগটি যে আসলে কী তা হাল আমলে এসে টের পাচ্ছি। তবে প্রবাদটি পড়েছিলাম সেই ছোটবেলায় এবং শুনেছিলাম শিশুবেলায়। আমাদের গ্রামে সত্তরের দশকে যে অভাব অভিযোগ ছিল সেখানে গরিবের ঘোড়ারোগ দেখার সুযোগ হতো অহরহ। বেশির ভাগ গরিব পুরুষের রাগ এবং হাঁকডাক ছিল খুব বেশি। মহিলারা উঁচু গলায় কথা বলত এবং কথায় কথায় ঝগড়া বাধিয়ে দিত। ছেলেপুলেরা সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করত- মরুব্বিদের হাতে বেদম মার খেত এবং সমবয়সীরা মারামারি করে রক্তারক্তি বাধিয়ে ফেলত।
উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো ঘোড়ারোগ কি না তা বলতে পারব না। তবে গ্রামের অনেক ধুরন্ধর গরিব বাবরি চুল রাখত এবং নিজেদের কামেল পুরুষ বা অলৌকিক মানুষ হিসেবে প্রমাণের জন্য নানা রকম ভেলকিবাজি করত। কেউ কেউ দুই চারটে ম্যাজিক বা জাদুও জানত এবং সেগুলো দেখিয়ে লোকজনকে প্রতারিত করত। একশ্রেণীর আমোদপ্রিয় গরিব গাঁজা সেবন করত এবং পরিবার পরিজন ত্যাগ করে জঙ্গলের মধ্যে অথবা গ্রামের প্রান্তসীমায় কুঁড়েঘরে বাস করত। তারা কেউ কেউ ডুগডুগি অথবা একতারা বাজিয়ে সারা রাত নেশায় বুঁদ হয়ে যাচ্ছেতাই গাইত আর সারা দিন ঘুমাত। আমি এখন পর্যন্ত ওই সব লোক সম্পর্কে যখন চিন্তা করি তখন ভেবে কূলকিনারা পাই না যে- এদের খাওয়াদাওয়া ভরণ-পোষণ চলত কিভাবে। কারণ তাদের কোনো কাজ করতে দেখিনি এবং তারা প্রায় সবাই ছিলেন সহায়-সম্বলহীন প্রান্তিক দরিদ্র।
আমাদের গ্রামে একশ্রেণীর গরিব ছিল যারা কিছু দিন পরপর বিয়ে করে ভিন গ্রামে থেকে নতুন বউ নিয়ে আসত। তারপর নতুন বউ ও পুরাতন বউদের মধ্যে ঝগড়া ও চুলোচুলি এবং গ্রাম্য সালিশ দরবারের কারণে অনেক দিন পুরো গ্রাম মুখরিত থাকত। গরিব ঘরের মেয়েরা সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবারের সন্তানদের প্রেমে পড়লে প্রায়ই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটত। আর ধনীর ছেলেরা যদি কোনো গরিব ঘরের মেয়ের প্রেমে পড়ত তবে গরিব পরিবারটির ওপর নেমে আসত অত্যাচারের স্টিমরোলার। এত সব সাধারণ বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি গরিবদের মধ্যে অসাধারণ সব গুণাবলি দেখা যেত। অনেকে চমৎকার করে বাঁশি বাজাতে পারতেন। হাডুডু-ফুটবলে অনেকের দক্ষতা গ্রাম ছাড়িয়ে পুরো জেলায় মশহুর হয়ে যেত। কেউ কেউ যাত্রা-নাটক-থিয়েটারে খুব ভালো অভিনয় করত। আবার কেউ কেউ প্রকৃতিপ্রদত্ত সুর-কণ্ঠ ও সেটির সমন্বয় ঘটিয়ে গান-বাজনায় অনবদ্য মুনশিয়ানা দেখাত।
সাধারণ গরিব মানুষের মধ্যে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশের কারণে আমাদের গ্রামে নিয়মিত নাটক-থিয়েটার হতো। জারি-সারি-বিচার গানের আসর ছাড়াও যাত্রাপালা হতো নিয়মিত। নজরুলজয়ন্তী রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে নিরক্ষর শত শত ছেলে বুড়ো গভীর রাত জেগে কেন কবিতা শুনত তা আমার মাথায় এখনো ঢোকে না। শত অভাব অভিযোগের মধ্যেও গরিবের আনন্দ ছিল সীমাহীন। তারা কারণে অকারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাসত। কোনো বুড়োবুড়ির বায়ু ত্যাগের শব্দ যদি কেউ শুনতে পেত তবে আর রক্ষা ছিল না। উপস্থিত লোকজন অনেকক্ষণ ধরে সেই ঘটনার রসঘন বর্ণনা এবং অনবদ্য অভিনয় করে হেসে গড়াগড়ি দিত। ছেলে শিশুদের সুন্নতে খতনা নিয়ে উৎসব করত, এমনকি যে দিন ছেলে-মেয়েরা পবিত্র কুরআন পড়া আরম্ভ করত অর্থাৎ সিপারা শেষ করে কুরআন পাঠ আরম্ভ করত সে দিনও গরিবের ঘরে নিদারুণ আনন্দ হতো।
গ্রামের মধ্যে প্রায়ই ভূতের উপদ্রব দেখা দিত এবং জিন-পরীরা প্রায়ই গরিবের ছেলে-মেয়েদের ওপর আছর করত। ফলে ভিন গ্রাম থেকে নামকরা তান্ত্রিকদের ভাড়া করে আনা হতো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলে এক রাতে বিশাল খানাপিনার আয়োজন হতো এবং ঘটা করে জিন-ভূত তাড়িয়ে অথবা জিন-পরীর আছর মুক্ত করে গ্রামবাসীর মনে শান্তি ও নিরাপত্তার পরশ বুলিয়ে দেয়া হতো। গ্রামে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা হতো, বন্যাকেন্দ্রিক আনন্দ-উৎসব, খানা-পিনার আসর ছিল দেখার মতো। আশ্বিন মাসে মাছ ধরার উৎসব এবং কার্তিক অগ্রহায়ণে নবান্নের উৎসব পুরো গ্রাম মুখরিত করত আর পৌষ-মাসের পিঠে পায়েস খায়নি এমন গরিব সত্তর দশকের বাংলায় একজনও ছিল না।
গরিব পুরুষেরা কামলা খাটত কেউ বা রাখাল হিসেবে স্থায়ীভাবে গৃহস্থ বাড়িতে চাকরি করত। মুটেগিরি, ঘরামিগিরি অর্থাৎ ছনের ঘর নির্মাণ ও মেরামতকারীরা ছাড়াও ঘোড়ার গাড়ির চালকরা গরিব বলে বিবেচিত হতো। আমাদের এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রথম জমানায় অর্থাৎ ১৯৭৩ থেকে ’৭৫ অবধি কোনো পাকা সড়ক ছিল না। ফলে সাইকেল-ঘোড়ার গাড়ি এবং ঘোড়া ছিল সাধারণ বাহন। ধনী নারীরা পালকিতে যাতায়াত করতেন। আর রিকশা তখনো থানাপর্যায়ের সড়কগুলোতে দেখিনি। আমাদের গ্রামের হাকি যশোরে রিকশা চালাত। জিয়াউর রহমান যখন প্রেসিডেন্ট হলেন তখন হাকি তার রিকশাখানা মনের আনন্দে যশোর থেকে চালিয়ে সদরপুর থানার শ্যামপুর গ্রামে নিয়ে এলো। সেই হাকি যেভাবে গ্রামে রিকশা এনে সবাইকে চমকে দিলো তদ্রুপ ক’দিন পর ছোটো একটি ঘোড়ার বাচ্চা দশ গ্রাম দূরের পুবাইলের হাট থেকে কিনে এনে পুরো এলাকায় হইচই ফেলে দিলো।
গরিবের ঘোড়ারোগ- যদি আবহমান বাংলার উল্লিখিত ইতিহাস ঐতিহ্যের মধ্যে খোঁজ করি তবে আমাদের পুরো গ্রামের মধ্যে একমাত্র হাকির মধ্যেই ঘোড়া রোগটি দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু তার এই রোগটি ছিল নির্দোষ এবং বাংলা প্রবাদ প্রবচনের ঘোড়া রোগের সাথে হাকির ঘোড়া পোষার কাহিনীর কোনো অন্তঃমিল না থাকলেও আজকের শিরোনামে কেন সত্তর দশকের গ্রামবাংলার দরিদ্র মানুষের হাসি-কান্নার প্রসঙ্গ টেনে আনলাম তা ব্যাখ্যা করা আবশ্যক।
গরিবের ঘোড়ারোগ বলতে সাধারণত দুটো বিষয় বুঝানো হয়ে থাকে। প্রথমত, সাধ্যের অতিরিক্ত ব্যয় করা। এ ধরনের ব্যয় সাধারণত ধারকর্য করে করা হয় এবং ব্যয়ের উদ্দেশ্যও জরুরি কিংবা গুরুত্বপূর্ণ হয় না। যদি ক্ষুধা নিবারণের খাদ্য, শরীর ঢাকার পোশাক এবং রোগাক্রান্তের চিকিৎসার জন্য কেউ ধার করে তবে সেই ঋণকে গরিবের ঘোড়ারোগ বলা হয় না, বরং বিয়ে শাদি জিয়াফত, সুন্নাত খতনা গান-বাজনা, মদ-জুয়ার আসর ইত্যাদি কর্মের জন্য কেউ ধার দেনা করে তবে গরিবের ঘোড়ারোগ নামক প্রবাদটি সেই লোকের জন্য প্রযোজ্য হয়।
আলোচনার শুরুতে আমি আবহমান বাংলার দারিদ্র্যপীড়িত একটি গ্রামের অধিবাসীদের জীবনযাত্রা সত্তর দশকে কেমন ছিল তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। আপনি যদি আমার সমবয়সী অথবা আমার চেয়ে প্রবীণতর হন তবে উল্লেখিত বর্ণনার সাথে আপনার শৈশবের গ্রামীণ জীবনের হুবহু মিল পাবেন। একইভাবে আমি যখন স্থায়ীভাবে রাজধানীর বাসিন্দা হলাম তখনো এই শহরের দারিদ্র্য ছিল গ্রামের চেয়েও নির্মম ও নিষ্ঠুর। কিন্তু তা সত্ত্বেও গ্রাম বা শহরে আমি কোনো দরিদ্র মানুষের মধ্যে মারাত্মক কোনো অপব্যয়ের নজির দেখিনি। ফলে গরিবের ঘোড়া রোগ নিয়ে আমার মনে বিকল্প চিন্তার উদ্রেক হচ্ছে এবং সেটি কেন হচ্ছে তা বলার আগে সাম্প্রতিক সমাজের কিছু দৃশ্য বর্ণনা করা আবশ্যক।
আপনি যদি ইদানীংকালে গ্রামে যান তবে দেখবেন সত্তর দশকের হাঁকডাক হাহাকার কর্মব্যস্ততা এবং পর্নোকুটির নেই। বাড়ি-গাড়ি, অট্টালিকা, টিভি-ফ্রিজ, মোটরসাইকেল এখন গ্রামের সর্বত্র দৃশ্যমান। কিন্তু পুরো গ্রাম খুঁজে কোথাও উৎসব, নির্মল আনন্দ এবং মায়াময় সামাজিক বন্ধন দেখবেন না। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো বেশির ভাগ গ্রামবাসীর সঞ্চয় বলতে কিছু নেই। তাদের পুঁজি বা মূলধনও নেই। একশ্রেণীর গ্রামবাসী কেবল ভোগ করছে আরেক শ্রেণী শোষণ করছে। মানুষ ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে বাড়ি-খানা-খাদ্য আসবাবপত্র ইত্যাদি খাতে সর্বস্ব ব্যয় করে নিজেদের ধনী ও সুখী মানুষ প্রমাণের প্রতিযোগিতা করছে।
গ্রামবাংলার উল্লিখিত চালচিত্র এবং হাল আমলের শহুরে ফ্যাশনের সাথে সত্তর দশকের দারিদ্র্যের পীড়ন-হাসি-কান্না-আনন্দ-বেদনার কোনো মিল খুঁজে পাবেন না। আজকের সমাজে কোনটা যে কান্না সেটি যেমন বোঝা যাচ্ছে না তদ্রুপ আনন্দের নির্মল হাস্যরস এবং কূটনামির প্রতারণাপূর্ণ নিষ্ঠুর উল্লাসের পার্থক্যও করা যায় না। সত্য ও মিথ্যার বিভেদের রেখা দূর হয়ে সেখানে স্থান নিয়েছে মোনাফেকি, যা কিনা সত্য ও মিথ্যার গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে। ফলে গরিবের ঘোড়ারোগ নামক বালাইটি হাল আমলে পুরো দেশ জাতিকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যার কারণে আমরা সবাই প্রচণ্ড গতিতে উল্টো স্রোতের কারণে প্রাগৈতিহাসিক জমানার দিকে চলে যাচ্ছি।
আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। সাধারণ পাঠকদের জন্য আজকের নিবন্ধের শিরোনাম এবং আলোচিত বিষয়গুলোর সমন্বয় করে চলমান সময়ে আমরা কেন এবং কিভাবে ঘোড়ারোগের কবলে পড়েছি তা সংক্ষেপে বর্ণনা করে নিবন্ধের ইতি টানব। প্রথমত, আমাদের বর্তমানকালের যাবতীয় আর্থিক সঙ্কট, রাষ্ট্রীয় এবং জাতীয় দায়দেনা, অভাব অভিযোগ, সঙ্কট এবং ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের আলামতের নেপথ্যে রয়েছে গরিবের ঘোড়ারোগের প্রবাদটির প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া। অপব্যয় বলতে যা বুঝায় কিংবা অপরিকল্পিত ব্যয় এবং ফুটানির নিকৃষ্ট পরাকাষ্ঠার কবলে পড়ে দেশের পুরো আর্থিক খাতে রীতিমতো হাহাকার শুরু হয়ে গেছে।
চলমান সমস্যাগুলোর সাথে যদি গরিবের ঘোড়ারোগের অন্তঃমিল খোঁজেন তবে অবশ্যই অপনাকে রূপক অর্থের সাহায্য নিতে হবে। এখানে গরিব বলতে হাকি মিয়ার মতো আর্থিকভাবে গরিব মানুষকে না বুঝে বরং চিন্তা চেতনা, শিক্ষা-দীক্ষা, নীতিনৈতিকতা, সততা পরিশ্রম ধর্মবোধ মানবতা হৃদয়ের বিশালতা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাবকে দারিদ্র্য হিসেবে বিবেচনা করেন তবে দেখতে পাবেন এবং বুঝতে পারবেন যে আমরা কত বড় দারিদ্র্যের মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। আর এসব মূর্খের বিলাসিতার ঘোড়াগুলো খোঁজার জন্য যদি দিনে বা রাতে রাস্তায় বের হন, বাজারে যান, গণপরিবহনে চড়েন, চাকরির বাজারে ঢুঁ মারেন এবং কারো কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেন তবে ঘোড়ারোগে আক্রান্তদের নির্মমতা আপনার প্রকৃতির যেকোনো হিংস্র প্রাণীর চেয়েও নির্মম বলে মনে হবে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা