২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

শুধুই কি হুমকি-ধমকি নাকি পারমাণবিক যুদ্ধ?

শুধুই কি হুমকি-ধমকি নাকি পারমাণবিক যুদ্ধ? - ছবি : সংগৃহীত

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গতি প্রকৃতি প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের এই প্রিয় ধরাকে নরকে পরিণত করে ফেলবে কি না তা-ই এখন চিন্তাশীলরা আতঙ্কের কারণ হিসেবে দেখছেন। সাধারণ বিবেকবানদের প্রশ্ন সত্যিই কি আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ লেগে যাবে? বিবদমান দেশগুলোর নেতৃবর্গ কি এতটাই অবিবেচক ও বেপরোয়া? এই যুদ্ধ বাধলে তারা নিজেরাও যে ধ্বংস হয়ে যাবেন, এটি কি বিবেচনায় রাখছেন না? অবশ্য এবারই প্রথম নয়। এর আগেও পৃথিবী একবার পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছে। সেটা পারমাণবিক যুদ্ধ না হলেও আমেরিকা একতরফাভাবে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল। তাতে বোমা বিস্ফোরণের সাথে সাথেই এক লাখ ২০ হাজার নিরস্ত্র নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছিল। সেই বোমা বিস্ফোরণের পরবর্তীতে তেজস্ক্রিয়তায় আরো ৬২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সেটা ছিল একতরফা পারমাণবিক আক্রমণ। আর এখন হুমকি হচ্ছে পারমাণবিক যুদ্ধের, অর্থাৎ বিবদমান দুই পক্ষই পরস্পরের ওপর, পরস্পরের ভ‚খণ্ডে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করবে। তার মানে হলো, শত্রু-মিত্রসহ যুদ্ধে জড়িতদের বাইরের মানবতাও এই ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হবে। তারপরও কেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ ধরনের হুমকি ও পাল্টা হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন পারমাণবিক আক্রমণের? এসব হুমকি ও পাল্টা হুমকি কি শুধুই বাগ্যুদ্ধ, নাকি পারমাণবিক যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ছে?

প্রায় ছয় দশক আগে আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে এমন একটি পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকির মুখে পড়েছিল এই ধরাধাম। এটিকে ইতিহাসে ‘কিউবার মিসাইল ক্রাইসিস’ নামে লেখা হয়েছে। তৎকালীন শীতল যুদ্ধের দুই প্রতিদ্ব›দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া সারা বিশ্বে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দ্ব›েদ্বর একেবারে তুঙ্গে। মার্কিনিরা সাম্রাজ্যবাদ ও রুশরা সম্প্রসারণবাদ নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে করতে বিশ্বকে ক্লান্ত করে ফেলেছিল। তারা দেশে দেশে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান, প্রক্সিযুদ্ধ, সামরিক স্থাপনা স্থাপন, অস্ত্র মজুদ, বিপ্লবী বা পাল্টা বিপ্লবী গোষ্ঠী দাঁড় করানো ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সারা বিশ্বকে টালমাটাল করে তুলেছিল। ল্যাটিন আমেরিকায় এমনই একটি দেশ কিউবার তৎকালীন বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো (১৯২৬-২০১৬) সোভিয়েত সহায়তায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটান। এরপর সোভিয়েতরা দ্রুত তাদের অস্ত্রসম্ভার কিউবায় স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকির মুখে রেখে বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য নিজেদের দিকে রাখার পরিকল্পনা করে। তারা পারমাণবিক অস্ত্র বহনকারী ক্ষেপণাস্ত্র কিউবাতে স্থাপনের কাজ শুরু করে। ১৯৬২ সালের ১৪ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা বিমান কিউবার ওপর দিয়ে রেকি মিশন চালিয়ে রুশ মিসাইল কিউবায় স্থানান্তরের তথ্য সংগ্রহ করে ফেলে। প্রতিক্রিয়ায় ২২ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি (১৯১৭-৬৩) জাতির উদ্দেশে ভাষণে এ তথ্য জানান এবং কিউবার চার দিকে নৌ অবরোধ আরোপ করেন। এতে কিউবায় নিয়ে আসা রাশিয়ান অস্ত্রবহনকারী জাহাজগুলো আটকে দেয়া হয়। ফলে দুই পারমাণবিক অস্ত্রধারী পরাশক্তির মধ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র বেশি আতঙ্কিত হয়ে ওঠে এ জন্য যে, কিউবার মিসাইল নিক্ষেপক সাইট থেকে মাত্র ৯০ কিলোমিটার দূরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া হয়ে ওঠে রাশিয়ান এই ক্ষেপণাস্ত্রাগার স্থাপনকে বন্ধ করে দিতে। সোভিয়েত রাশিয়াও যেকোনো মূল্যে কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। সারা বিশ্ব মহা-আতঙ্কিত হয়ে পড়ে; যেকোনো সময় পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। এমন চরম ধ্বংসাত্মক মুহূর্তে ২৬ ও ২৭ অক্টোবর জন এফ কেনেডি এবং সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ (১৮৯৪-১৯৭১) অত্যন্ত দায়িত্বশীল আচরণ করলেন। তারা টেলিফোনে কথা বলে সম্ভাবনাময় প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধের অবসান ঘটান। ক্রুশ্চেভ কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নিয়ে যান এবং কেনেডি কিউবাতে কমিউনিস্ট বিপ্লবকে মেনে নেন ও কিউবা আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেনেডি এর আগে রাশিয়ার কাছাকাছি, তুরষ্কে যে ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেছিলেন ক্রুশ্চেভের সেগুলোও সরিয়ে নেয়ার দাবি গোপনে মেনে নেন। ১৯৬২ সালের ২৮ অক্টোবর সেই ঘোষণায় তখনকার বিশ্ব একটি ব্যাপক ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে নিস্তার পেয়েছিল।

তবে ২০২২ সালের ‘নিউক্লিয়ার ওয়ার’ সম্ভাবনা সম্পর্কে এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধটাও মূলত বিশ্বে কর্তৃত্বপরায়ণতার যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে ইউরোপিয়ানদের সহায়তায় তার একক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে। সে জন্য তারা ন্যাটো জোটকে ঠেলতে ঠেলতে রাশিয়ার দেয়াল পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। অর্থাৎ ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্য করে নিলে সীমান্তবর্তী রাশিয়া ইউরোপের রুগ্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হবে। এতে রাশিয়া মনে করছে, তার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এ জন্যই ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান বন্ধ করতেই পুতিন রাশিয়া আক্রমণ করে বসেন। আক্রমণে ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদেরকে চরম নিরাপত্তাহীন মনে করে তারা আমেরিকার নেতৃত্বে রাশিয়া ঠেকানোর জন্য ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়ায়। ইউরোপীয়রা জানে, যুদ্ধ আপাতত ইউক্রেনের ভ‚মিতেই হবে। আর ইউক্রেন আমেরিকা থেকে হাজার মাইল দূরে হওয়ায় এর তাপ কোনোভাবেই মার্কিনিদের গায়ে লাগবে না। ফলে আমেরিকা ও ইউরোপ ইউক্রেনকে প্রচুর অস্ত্র-রসদ দিয়ে সাহায্য করে যুদ্ধের ব্যাপকতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে রাশিয়ার দ্রুত যুদ্ধে জয়ের স্বপ্ন ভেঙে যায়। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে উৎসাহব্যঞ্জক সফলতা পেলেও বর্তমানে পশ্চিমাদের নিরবচ্ছিন্ন অস্ত্র-রসদ ও প্রশিক্ষণের সহযোগিতায় ইউক্রেন সশস্ত্রবাহিনী রুশদেরকে বলিষ্ঠভাবে মোকাবেলা করছে। সম্প্রতি দখল করা ইউক্রেনের খেরসন অঞ্চল থেকে প্রচণ্ড মার খেয়ে আট মাস পর রাশিয়ান ৩০ হাজার সৈন্য পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়েছে। এটা পুতিনের জন্য মারাত্মক অবমাননাকর। পুতিনের যুদ্ধের কৌশল একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধের শুরুতেই ইউক্রেনের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছিল। কিন্তু ইলন মাস্ক তার স্টারলিংক কোম্পানির ২০ হাজার টার্মিনালের দ্বারা বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবস্থার মাধ্যমে ইউক্রেন বাহিনীর সিগন্যাল যোগাযোগ পূর্ণাঙ্গভাবে চালু রাখায় ইউক্রেন সশস্ত্রবাহিনী সুসমন্বিতভাবে রুশ বাহিনীর ওপর একটির পর একটি আক্রমণ রচনা করে সফলতা অর্জন করছে (প্রথম আলো : ২২/১০/২০২২)। সেই সাথে আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে আসা ক্ষেপণাস্ত্র, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, আর্টিলারি পিস ও গোলাবারুদ ব্যবহার করে ইউক্রেনের সৈন্যরা সব ময়দানেই রুশ বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করছে।

গত ৯ মাসের যুদ্ধে সারা বিশ্ব বিপর্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি রাশিয়া নিজেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এ অবস্থায় দ্রুত যুদ্ধ শেষ করার অভিলাষে পুতিন ইউক্রেনে টেকনিক্যাল পরমাণু বোমা নিক্ষেপের পাঁয়তারা করছেন। রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘ডার্টি বোমা’ ব্যবহারের অভিযোগ তুলে পাল্টা টেকনিক্যাল পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু ইউক্রেনসহ পুরো পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার এ অভিযোগ অস্বীকার করে তার প্রমাণ চাচ্ছে। কিন্তু কোনো ধরনের প্রমাণ না দিয়েই রাশিয়া পারমাণবিক যুদ্ধের মহড়া সম্পন্ন করেছে সম্প্রতি। সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধ নিয়ে প্রস্তুতির আলোচনাও করছে। তাদের ভাষায়, ‘পারমাণবিক যুদ্ধে কেউ জয়লাভ করতে পারে না এবং রাশিয়া পারমাণবিক যুদ্ধে জড়াবে না তবে তারা আত্মরক্ষামূলক পারমাণবিক যুদ্ধ করতে প্রস্তুত রয়েছে।’

এরই মধ্যে জো বাইডেন রাশিয়ার হুমকিতে কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পুতিনের পারমাণবিক হামলা পৃথিবীর সর্বশেষ ‘সত্য মিথ্যার রণক্ষেত্র’ (অৎসধমবফফড়হ) সৃষ্টি করবে। রাশিয়ার এ ধরনের পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকিকে দু’ভাবে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এক দিকে আমেরিকা তাদের গোয়েন্দা তথ্যের বিশ্লেষণমতে বলছে, রাশিয়া হুমকি দিলেও পারমাণবিক যুদ্ধের বিষয়ে তারা এখনো ততটা সিরিয়াস নয়। অন্য দিকে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন পারমাণবিক যুদ্ধের মহড়াও সম্পন্ন করেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র ভ‚মধ্যসাগরে প্রবেশ করিয়েছে পারমাণবিক মিসাইলবাহী সাবমেরিন ‘ইউএসএস রোড আইল্যান্ড’। ‘পারমাণবিক প্রলয়ের ঘোড়সওয়ার’ নামে খ্যাত এই সাবমেরিন ২৪টি ট্রাইডেন্ট টু আন্তঃমহাদেশীয় পারমাণবিক মিসাইল বহন করছে। এসব মিসাইল ১২ হাজার থেকে ১৮ হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। আর এসব সাবমেরিনই শত্রুপক্ষের নজরদারি এড়িয়ে মাসের পর মাস সমুদ্রের তলদেশে ভ্রমণ করতে পারে। অন্য দিকে স্পেনের রোতা বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করেছে মার্কিন বাহিনীর বিশেষ বিমান ‘মার্কিন ডুমসডে’। এই বিমানে রয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর কৌশলগত কমান্ড সেন্টার, যাতে পারমাণবিক যুদ্ধ অথবা বিপর্যয়কর তেজস্ক্রিয় বিচ্ছুরণের মুহূর্তে আকাশ থেকে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর কৌশলগত ইউনিটগুলো পরিচালনা করা যায়। এসব বিমান একটানা দুই সপ্তাহ পর্যন্ত আকাশে অবস্থান করতে পারে এবং এই বিমানের কাঠামো পারমাণবিক বিস্ফোরণের ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ওয়েভের সামনে অটল থাকতে ও আরোহীদের সুরক্ষা দিতে সক্ষম (নয়া দিগন্ত : ০৮/১১/২০২২)।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এসব পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী জাহাজ ও বিমানের আনাগোনা হয়তোবা রাশিয়াকে ভয় দেখাবে বা পারমাণবিক অভিলাষ থেকে নিবৃত করবে। কিন্তু পুতিনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, হিংস্রতা, একনায়কত্ব, প্রতিশোধ জিঘাংসা, চলমান যুদ্ধে রাশিয়ার অপমান ও ক্ষয়-ক্ষতি, পশ্চিমাদের অব্যাহত অস্ত্র সরবরাহের কারণে জয়ের অনিশ্চয়তা ইত্যাদি অনেক ধরনের উপাদান রয়েছে সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধ হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপারে।

যদি কোনো কারণে পারমাণবিক যুদ্ধ বেধেই যায় তবে তা হবে ‘কিয়ামতের শামিল’। রাশিয়ার কাছে দুই হাজারেরও বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। আর আমেরিকা ও ইউরোপের মিলে মোট হবে আরো কয়েক হাজার পারমাণবিক অস্ত্র। যুদ্ধ হলে নিশ্চয়ই তারা পরস্পরের ওপর এসব বোমা নিক্ষেপ করবে। আমেরিকার নিউ জার্সির রুটজারস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা মনে করেন, যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথেই লাখ লাখ লোকের প্রাণ যাবে। এর তেজস্ক্রিয়তা ও ঠাণ্ডার জন্য আরো লাখ লাখ বনি আদম বিস্ফোরণস্থল থেকে দূরে থাকা সত্তে¡ও মৃত্যুবরণ করবে। সূর্যের আলো নিঃসরিত গ্যাসের আড়ালে পড়ে যাওয়ায় পরবর্তী দুই বছরে পৃথিবীর তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষ দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারাবে (ডেইলি স্টার : ০৫/১১/২০২২)। পারমাণবিক যুদ্ধ না বাধলেও এই যুদ্ধের হুঙ্কার-ঝঙ্কারে আরো একটি বিপদের সম্মুখীন হতে পারে বিশ্ব। এই ডামাডোলের আড়ালে, বহনযোগ্য ও স্থানান্তরযোগ্য টেকনিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্রের একটি অংশ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে চলে যেতে পারে। এই অস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে পড়লেই এগুলো ‘উইপন অব মাস ডেসট্রাকশন’ (ডগউ) বা ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রে পরিণত হয়ে উঠবে; যা পুরো মানবসভ্যতাকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপের সম্ভাবনা খুবই কম। রাশিয়ার কাছে যথেষ্ট কনভেনশনাল অস্ত্র আছে। সেগুলো ব্যবহার শেষ না করা পর্যন্ত বা পুরোপুরি ধ্বংসের হুমকির আগ পর্যন্ত রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করবে না। তা ছাড়া পুতিন ইউক্রেনকে পশ্চিমের সহযোগিতা বন্ধ করা বা যুদ্ধের একটি কিনারা করার জন্য সতর্কীকরণ হিসেবে একটি মাত্র ট্যাকটিকাল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। জানা যায়, রাশিয়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ রয়েছে। টেকনিক্যাল অস্ত্রগুলো ছোট আকারের হলেও ধ্বংসলীলার বিস্তৃতি হতে পারে প্রায় কয়েক শ’ কিলোমিটার, যা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকার ফেলা বোমার চেয়েও অনেক শক্তিশালী। ভয় দেখানোর এই যুদ্ধের উদ্দেশ্যে শুরু থেকেই পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ‘যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত’ অবস্থায় রেখেছেন। তবে পুতিনের খেরসনসহ আরো অঞ্চলগুলো থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের আসল উদ্দেশ্য এখনো স্পষ্ট নয়। এগুলো শীতের গভীরে প্রবেশের পর প্রচণ্ড প্রতি আক্রমণের প্রস্তুতির জন্য, নাকি সম্ভাব্য টেকনিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার থেকে নিজের সৈন্য বাঁচানোর জন্য তা বুঝতে শীত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

এত ভয়ের মাঝেও আশার বিষয় হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার নেতারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা জারি রেখেছেন। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনি ও গুতেরেস সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধের উদ্বেগের কথা বিশ্ববাসীকে বারবার জানাচ্ছেন। এ দিকে রাশিয়াও শীতের অপেক্ষায় আছে যেন পুরো ইউরোপকে গ্যাসের সরবরাহের কষ্টে ফেলে একটা দরকষাকষির জায়গায় নিয়ে আসা যায়। তবে বাইডেনকে বিশ্ববাসীর কথা ভেবে এই যুদ্ধের অবসানে অগ্রণী হতে হবে। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ পুতিন শুরু করলেও যুদ্ধের চাবিটি মূলত রয়েছে বাইডেনের হাতে। যুদ্ধক্ষেত্রের অনেক দূরে অবস্থান করায় এর সরাসরি তাপ আমেরিকানদের গায়ে না লাগলেও ইউরোপ ও এশিয়ায় মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোও এর খেসারত দিচ্ছে। পুতিনকে শিক্ষা নিতে হবে নিজ দেশের অতীত ইতিহাস থেকে। আরেক সীমান্তবর্তী দেশ আফগানিস্তান দখল করতে গিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছিল, তাদের সমাজতান্ত্রিক মতবাদের কবর হয়ে গিয়েছিল। কাজেই ক্ষয়ক্ষতি যতটুকুই হয়েছে সব ভুলে গিয়ে অহমিকা ছেড়ে দিয়ে মানবিক হন, মানবতার কথা ভাবুন। কারণ জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচটি সদস্য দেশগুলো এ ব্যাপারে একমত যে, ‘পারমাণবিক যুদ্ধে কারো জয় হয় না’। তবে পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপের হুমকি বা পাল্টা হুমকিতেই রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করার অন্তর্নিহিত শক্তি।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement