২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
দেখা-অদেখা

সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্যের যত কাহিনী

সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্যের যত কাহিনী - ছবি : নয়া দিগন্ত

আমাদের এটি বড় সৌভাগ্যের বিষয় যে, এই ব-দ্বীপের অগণিত সাধারণ মানুষ, সৈনিক কৃষক শ্রমিক ছাত্র-জনতা তথা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সমাজের সদস্যরা জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করে রক্তস্নাত পথ অতিক্রম করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন। তাই এটি স্বাধীন, কারো দান বা করুণা অথবা অন্য কিছু নয়। তবে দীর্ঘদিন পরে আজও উল্লিখিত দুই বৃত্তের মানুষের কাছে ধরা দেয়নি, অর্জিত স্বাধীনতার স্বাদ গন্ধ। স্বাধীনতার কোন স্বাদ অনুভ‚তি তারা বোঝেন না। কিন্তু কোনো একটি শ্রেণী পদ-পদবি গদি আটা কুরসিতে বসে অর্থবিত্ত সবই পেয়েছেন। আর না পাওয়ার দলের বৃহত্তর সংখ্যক মানুষ কিন্তু নীতিনিষ্ঠ, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। শত কষ্টের মধ্যে থেকেও তারা নীরবে সব সয়ে সর্বংসহা হয়ে আছেন, এক চরম বৈরী স্বদেশভ‚মিতে। তারপরও তারা কখন অনিয়ম অন্যায়, অন্যায্যের কোনো পঙ্কিল পথে পা বাড়াননি। কোনো লোভ-লালসা তাদের স্পর্শ করতে পারেনি।

আর এই ভ‚খণ্ডের দুর্ভাগ্যের অন্যতম কারণ- অর্ধশতাব্দী ধরে যারা রাষ্ট্রের ক্ষমতার চর্চা করছেন ও বেশির ভাগ সময়ই যাদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার ছিল এবং রয়েছে, তারা দেশ ও দশের স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বার্থ পূরণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছেন। এমন শাসনে সমাজে এক মারাত্মক বৈষম্যের অলঙ্ঘনীয় দেয়াল নির্মিত হয়ে গেছে। সে দেয়াল ভাঙা তো দূরের কথা, সেটি সময়ের সাথে সাথে আরো দৃঢ়তর হয়ে উঠছে। অথচ এ দেশে নীতি ও লক্ষ্যের সাথে যা সাংঘর্ষিক। সংবিধানে যেখানে বলা আছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে- সেখানে বাস্তবে কিন্তু সবই তার বিপরীত। অথচ এমন ব্যত্যয় নিয়েই আমরা চলছি। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এ জন্য এতটুকু অনুতাপ নেই। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কোনো হিসাব মেলাতে পারছেন না।

আরো বেদনার বিষয় হচ্ছে- দেশের মানুষকে শুধু বঞ্চনা ও বৈষ্যমের মধ্যে ফেলে রেখে তাদের হতাশা ম্রিয়মাণ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাই নয়; দেশের সর্বোচ্চ ও অলক্ষণীয় আইন গ্রন্থ সংবিধান স্বীকৃত বহু মৌলিক অধিকারের চর্চার সুযোগ এখন আর এই দেশে নেই। এসব অধিকারের অন্যতম হচ্ছে নাগরিকদের ভোটাধিকার। সেটিও বহু আগেই বেহাত হয়ে গেছে। গত দু’টি সংসদ নির্বাচন ও বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ভোটের রূপ স্বরূপ এবং ভোটকেন্দ্রে ক্ষমতাসীনদের দুরন্ত বিপ্লবী সব কর্মী-সমর্থকদের প্রলয়কাণ্ড ও প্রশাসনের যত তোষণনীতি নির্বাচনকে অর্থহীন করে তুলেছে। গণমানুষের এই ভোটাধিকারকে ‘ক্যারিকেচারে’ পরিণত করার ফলটা যদি বিবেচনায় নেয়া যায় তবে যে সত্যটা বেরিয়ে আসবে, সেটি হচ্ছে দেশ ও জাতির নেতৃত্বে এসেছে এমন অক্ষম, অবিশ্বস্ত একশ্রেণীর মানুষ, যারা কেবল ক্ষমতার ঘ্রাণ পেতেই উৎসুক। যাদের বিচার বিবেচনায় শুধু রয়েছে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী। সামষ্টিকতার ধারে কাছে তারা নেই। এমন সব ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের যোগফল হচ্ছে, দেশে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’র মতো অবস্থার সৃষ্টি। ফলে সাধারণের জীবন-জীবিকা অচল হয়ে পড়েছে। এই অচলাবস্থা সবার মন-মানসিকতায় গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। মুহূর্তে মুহূর্তে এমন সব তথ্য মানুষের কানে ঢুকছে, যা তাদের অন্তরে চরম ভীতি ও উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দলিত মথিত করে তুলছে।

যার তুলনা অতীতের কোনো সময়ের সাথে করা যাবে না। পাখির ডানার নিচে যেমন অন্ধকার তেমনি আজকে এখানে সেই ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে। পাখি তো সুদূর আকাশের নীলিমায় অপার স্বাধীনতা ও আনন্দ নিয়ে উড়ে বেড়ায় এবং গোধূলিতে যথেষ্ট আহার নিয়ে কুলায় ফিরে আসে। নিজের ও পোষ্যদের জন্য। তাতে পক্ষীকুল পরম আনন্দ তৃপ্তি অনুভব করে। দুর্ভাগ্য এ জনপদের মানুষের পদে পদে, পলে পলে দারিদ্র্য ক্ষুধা ও অপ্রাপ্তির যত শৃঙ্খল তাদের পদযুগলে। নিজের ও পোষ্যদের এক বেলা আহারের ব্যবস্থা করতে পারছে না। দিনমান ঘাম ঝরানো পরিশ্রম করে যে পরিমাণ অর্থকড়ি হাতে আসে তা দিয়ে এখন আকাশছোঁয়া পণ্যমূল্যের ধারেকাছে তাদের যাওয়া সম্ভব হয় না। অনাহারে-অর্ধাহারে মানুষের জীবনের পাচালী রচিত হচ্ছে।

এমন দুর্বিষহ দিনকে বদলে দেয়ার একটি মাত্র পথ পদ্ধতি তারা জানে। সেটি হচ্ছে শান্তি স্বচ্ছতার অনুশীলন করে নিজেদের আস্থার মানুষটির হাতে বদ্ধ দুয়ারের চাবিটি তাদের তুলে দেয়া। কিন্তু আগেই বলে এসেছি, সেই পথ বহুদিন কণ্টকাকীর্ণ করে রাখা হয়েছে, সে জন্য দুর্গম সেই পথ। এমন পালাবদল নিয়ে আজ চলছে ছলা-কলা নানান খেলার যত কৌশল। অথচ এসব কানো হাস্যরস ক্রিয়া কৌতুক বিষয় নয়। অথচ তা নিয়েই কৌতুক করা হচ্ছে। মানুষের অবিচ্ছদ্য অধিকারকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। স্বচ্ছভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা পালাবদলকে অসম্ভব করে তোলার অদম্য চেষ্টা প্রতিনিয়ই হচ্ছে।

এসব অশুভ প্রয়াস চালিয়ে আবারো একটি পুতুল নাচের আসর জমানোর সর্বাত্মক আয়োজন করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন। যারা সাবেকি ব্যবস্থা বহাল রাখতে চান, যারা ভাবেন, আমরাই আমাদের একমাত্র বিকল্প, অন্য কেউ হতে পারবে না। সে জন্য এই পালাবদলকে এমন এক পুতুল নাচের আসরে পর্যবসিত করা হবে। যার পেছন থেকে সুতার টানে সব কিছু সাঙ্গ করার মনোবাসনা। যাতে সব কিছু পেছন থেকে সুতার টানে হেলবে দুলবে। এমন চিন্তায় বিভোর থেকে মাঠে ময়দানে এখন হুঙ্কার দেয়া হচ্ছে। সব কিছুকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়া এমন ধমকি দেয়া হয়। কিন্তু স্র্রষ্টা প্রকৃতির অমোঘ একটা নিয়ম করে রেখেছেন। প্রত্যুষের আলোকোজ্জ্বল এক প্রভাত আসবে আর গোধূলিতে সূর্য প্রভা হারিয়ে ডুবে যায়। কারো পক্ষে এই নিয়মের ব্যত্যয় করার শক্তি ক্ষমতা থাকে না। জোয়ারের পর যেমন ভাটা আসে, যৌবনের পর আসে বার্ধক্য। তাই সবাইকে মনে রাখতে হবে- এর বাইরে বা ঊর্ধ্বে কেউ উঠতে পারবে না। আত্মসমর্পণ করতে হবে।

অনেকেই হয়তো অনেক কিছুই ভাবছেন। কিন্তু যা কিছুই ভাবুক, হেঁয়ালি করার সময় সুযোগ এখন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে; বাতাসে থেকে এমন বার্তাই ভেসে বেড়াচ্ছে। ঈশান কোণে মেঘ জমেছে, তার গতিবেগ এতটাই হতে পারে সামনের খড়কুটো সব উড়িয়ে নেবে। জনতার সাগরে যে উত্তাল ঊর্মি এখন দীপ্যমান, সেটি ক্রমান্বয়ে ফনা তুলে এগিয়ে আসার পর্যায়ে। কেউ যদি ভাবেন আবারো পুরনো খেলায় মাতবেন, তবে বুঝতে হবে তারা আজো মাতৃক্রোড়েই আছেন। রাতের খেলায় উৎরে যাওয়া হয়েছিল ভেবে খুব সন্তুষ্ট হওয়া গেলেও এখন তার জের দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দোল খাচ্ছে, সেটি ইতোমধ্যে সবাই আঁচ করতে পেরেছে। সব ধরনের খেল তামাশা ভাবনার ইতি টানতে সময় সুযোগ হারালে ক্ষতি হবে। ময়দান খালি করে যেসব আনন্দের গীতিনাট্য মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। সম্মুখে সে সুযোগ আর মিলবে না।

মনে রাখতে হবে, অতীতে যা হয়েছে তার একটি প্রতিউত্তর পাওয়ার ভয় থেকে কেউ সেটি রুখতে চাইবেই। এ জন্য উৎরে যাওয়ার সব পথই খোঁজা হবে। যেমন ভোট ব্যবস্থার আয়োজকরা বহু দেশ থেকে ফেলে দেয়া একটি জাদুর বাক্সের সন্ধান করে দিয়েছেন। সেই বাক্স ‘ভেল্কিবাজি’ করে রঙ রূপ, হিসাব কিতাব সব মুহূর্তে পাল্টে দেয়া যায়। সেই ভেল্কিবাজির বাক্সকে শেষ ভরসা হিসেবে আঁকড়ে ধরার শতভাগ চেষ্টাটাই হচ্ছে। এই ভোট ব্যবস্থার আয়োজকরা কিন্তু প্রথম থেকেই একদিকে ঝুঁকে হাঁটছেন। আর হাঁটবেন নাই বা কেন, যে আঁতুড়ঘরে তাদের জন্ম- সেই ঘরের মালিক মোক্তারদের ভোলা যায় কেমন করে। এতটা অকৃতজ্ঞ হওয়াটা কি ঠিক! ভোট ব্যবস্থাপকদের নিয়ে আরো কিছু কথা বলা যায়। যেমন তারা বহুবার বহু কথা বলেছে, যার পূর্বাপর গরমিলে ভরা। তারা বিভিন্ন সময় নানা কথা দিয়ে মালাগাঁথার চেষ্টা করেছে। সেই কথামালার প্রথম বাক্যটি যে অর্থ হয়; কিন্তু একই মালার শেষ অংশটি আবার ভিন্ন অর্থের সন্ধান দেয়। এমন দ্বিচারিতা প্রতিশব্দ কী, সেটি পাঠক আপনারা সবাই জানেন।

সবাই জানে, পানির কোনো রঙ ও আকার নেই। তাতে যে রঙ মেশানো হবে সে সেই রঙ ধারণ করবে। আবার তাকে যে পাত্রে রাখা হবে সে সেই আকারই নেবে। আজকের ভোট ব্যবস্থাপনার প্রতিষ্ঠানটির স্বরূপ যেন এমনই। তাই তাদের ওপর কারো আস্থা নেই। আস্থা অর্জনের পথটিতে চলার কোনো ইচ্ছা প্রয়াস তাদের ছিল না। এখানে খুব সহজ কাজগুলোর অন্যতম হচ্ছে পথচলার পথনির্দেশিকা, বিধিব্যবস্থা ভেঙে ফেলা। এখানে ভোট ব্যবস্থাপকদের যে পথ ও দিকনির্দেশিকা রয়েছে সেটি খুব সুস্পষ্ট। সেখানে তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও সে লক্ষ্য পানে পৌঁছানোর সব পথ পদ্ধতি ও ক্ষমতা পারঙ্গমতার বিশদ বর্ণনা পথনির্দেশিকায় আছে। কিন্তু তার অনুশীলন তাদেরই করতে হবে- এমনটাই নিয়ম হবে। সেখানে কোনো অক্ষমতার অজুহাত দেখানোর কথা না থাকলেও সব ওলট-পালট করা হচ্ছে। অথচ স্পর্শকাতর, নীতিনিষ্ঠ জাতির জন্য বিরাট দায়িত্ব পালনকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের অটল অবিচল থাকার পরিবর্তে নতজানু হয়ে থাকা সেই প্রতিষ্ঠানের শুধু ভাবমর্যাদাই ক্ষুন্ন হয় না, জাতির অপরিচিত ক্ষতিই তারা করে ফেলেন।

আজ রাজনৈতিক অঙ্গনে পক্ষশক্তি তাদের কর্মকাণ্ডের যে নজির রেখে চলেছেন তার চুলচেরা হিসাব মূল্যায়ন অবশ্যই কোনো হাশরে হবে। কিন্তু সেসব বিষয় বর্তমান সময়ের জন্য খুবই নাজুক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে চলেছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিশেষ করে কোনোভাবে যদি কোনো ম্যাসাকার হয়ে যায় তবে সাধারণকে তার চরম মূল্য দিতে হবে। এমন অবস্থার কথা ভেবে সমাজসচেতন মানুষ কুলকিনারা পাচ্ছেন না।

ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement