২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রাসূল সা:-এর অর্থনৈতিক সংস্কার বনাম বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট

-

রাসূল সা: ছিলেন বিশ্বনবী যদিও তাঁর আগমন হয়েছিল মক্কায়। সে সময় আরবে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’, অর্থাৎ অজ্ঞানতা বিরাজ করছিল। এই অজ্ঞানতা অর্থ লেখাপড়া, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে ছিল তা নয়; বরং এই অজ্ঞানতা হলো ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে অজ্ঞানতা। ওই সময় শক্তিমানের মুখের কথাই ছিল আইন। অবাধে চলত অন্যায়, অত্যাচার, অনাচার, ব্যভিচার, চুরি, ডাকাতি, হত্যা ও রক্তপাত। ছিল না সুবিন্যস্ত কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা, অবিসংবাদিত কোনো নেতৃত্ব। জৈবিক চাহিদা পূরণ বা বৈষয়িক ভোগ-বিলাস ছাড়াও মানবজীবনের যে, মহিমান্বিত কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকতে পারে সে কথা যেন তারা কল্পনাও করত না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রে বিভক্ত ছিল সমাজ। গোত্রগুলোর মধ্যে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও জাতীয় চেতনা ছিল না। মারামারি ও যুদ্ধবিগ্রহ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। কোনো কোনো যুদ্ধ চলত শতাব্দীকাল অবধি।

রাসূল সা:-এর আগমনের আগে আরবের অবস্থা
তাঁর আগমনের আগে আরবের অধিবাসীদের ধর্ম বলতে কিছুই ছিল না। তারা ছিল স্বাধীন। তাদের আমানতদারী, সাহস, অতিথিপরায়ণতা, সত্যবাদিতা, স্মৃতিশক্তি ছিল কিংবদন্তিতুল্য। বছরে চার মাস তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। তারা ইহুদি বা খ্রিষ্টান ছিল না; ছিল ইবরাহিম আ:-এর একান্ত অনুসারী, একনিষ্ঠ একত্ববাদী। মক্কা ছিল পুরো আরবের কেন্দ্রবিন্দু এবং সম্মান ও মর্যাদায় শীর্ষস্থানীয়। সে কারণে খ্রিষ্টান রাজারা মক্কায় দখল কায়েম করার জন্য বারবার চেষ্টা করত। তখন সেখানকার অবস্থা ছিল নিম্নরূপ-

শিরক ও বিদয়াতের প্রচলন : মক্কার লোকেরা ছিল ইসমাইল আ:-এর বংশধর এবং জন্মগতভাবেই তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাসী। তারা কাবাগৃহকে আল্লাহর গৃহ বলে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কোনো নবী না আসায় শয়তানের প্ররোচনায় তাদের অনেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যায় এবং মূর্তিপূজার শিরকের সূচনা হয়। তবে মূর্তিপূজাকে তারা শিরক নয়; বরং বিদয়াতে হাসানাহ; অর্থাৎ ভালো কিছুর সংযোজন মনে করতেন। শিরক ও বিদয়াতসমূহ চালুর পরও তাদের অহঙ্কার ছিল, তারা ইবরাহিম আ:-এর দ্বীনে হানিফার খাঁটি অনুসারী। তারা কাবাগৃহের সংরক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক।

আরবের সামাজিক অবস্থা : তৎকালীন আরবের অভিজাত শ্রেণীর লোকদের অবস্থা খুবই উন্নত ছিল। পুরুষপ্রধান সমাজব্যবস্থা থাকলেও নারীদের মর্যাদা ছিল। অপরপক্ষে সাধারণ ও দরিদ্র শ্রেণীর আরবদের মধ্যে ছিল এর বিপরীত চিত্র। তাদের সামাজিক ব্যবস্থা গোত্রভিত্তিক হওয়ার কারণে বংশীয় ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক অবস্থা পরিচালিত হতো ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে।

অর্থনৈতিক অবস্থা : ব্যবসায় ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। নিখাদ পুঁজিবাদী অর্থনীতি চালু ছিল। ফলে সমাজে একদল উচ্চবিত্ত থাকলেও বেশির ভাগ লোক মানবেতর জীবন যাপন করত। উচ্চবিত্তদের মধ্যে মদ-জুয়ার ব্যাপক প্রচলন ছিল। বিত্তহীনরা দাস-দাসীরূপে বিক্রি হতো। উদার মরুচারী আরবদের নৈতিকতার ক্ষেত্রে দ্বিমুখী ধারা পরিলক্ষিত হতো। একদিকে তাদের মধ্যে মদ্যপান, ব্যভিচার, হানাহানি লেগে থাকত- অন্যদিকে, সাহস, ব্যক্তিত্ববোধ, সরলতা, দানশীলতা, আমানতদারি, মেহমানদারির সমাবেশ দেখা যেত।

রাসূল সা:-এর আগমনের পরে মক্কায় কার্যক্রম : রাসূল সা: ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মলাভ করেন এবং মাত্র ৪০ বছর বয়সে নবুয়তপ্রাপ্ত হন। প্রথমেই মাতৃভূমি মক্কার মানুষকে এক আল্লাহর পথে আহ্বান করেন। মক্কাবাসী তাঁর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে তাঁর ওপর নির্মম অত্যাচার শুরু করে। পরে আল্লাহর আদেশে মদিনায় হিজরত করেন। মাত্র ২০ বছরে তার দূরদর্শিতা দিয়ে তিনি সভ্যতা-বিবর্জিত পৌত্তলিক আরব জাতিকে এক সুসভ্য জাতিতে পরিণত করেছেন। অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী নতুন কর্মসূচির সূচনা করেন। তার কর্মনীতি অনুসরণ করে স্পেন থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত মুসলিম বিশ্বে শোষণমুক্ত ও কল্যাণধর্মী নতুন এক অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল।

রাসূল সা:-এর মক্কায় অর্থনৈতিক কাজের অভিজ্ঞতা : তখন আরব দেশে পোশাক শিল্প, চর্মকার ও রাখালের পেশা ইত্যাদি যৎসামান্য কিছু কর্ম ছাড়া তেমন কোনো শিল্পের প্রসার ছিল না। ব্যবসায়ই ছিল তাদের আয়-উপার্জনের প্রধান অবলম্বন। তিনি শিশুকাল কাটিয়েছিলেন পবিত্র নগরী মক্কায়। কোরাইশরা তখন ধনাঢ্যতা ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক ছিল। খাঁটি বাণিজ্যিক পরিবেশেই বেড়ে উঠেন মহানবী সা:। ১২ বছর বয়সে রাসূল সা:-তাঁর চাচা আবু তালিবের সাথে সিরিয়ার পথে বাণিজ্যিক কাফেলায় অংশগ্রহণ করেন। যৌবনে উপনীত হওয়ার পর মেষ চরানো ও পরে ব্যবসায়ের মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর অর্থনৈতিক জীবন।

লাভ-লোকসানের ব্যবসায়ের অভিজ্ঞতা : খাদিজা রা: ছিলেন একজন ধনবতী ও সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। তিনি মহানবী সা:-এর সততা ও উত্তম চরিত্র, বুদ্ধিমত্তা, দৈহিক শক্তি এবং বিচক্ষণতার কথা জানতে পেরে তাঁকে পুঁজি দিয়ে মুদারাবার (অংশীদারিত্বের) ভিত্তিতে ব্যবসায় শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যে তার ব্যবসায়িক সফলতা দেখে বিস্মিত হন খাদিজা রা:। ফলে তিনি রাসূল সা:-এর সাথে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামী হিসেবে তিনি খাদিজার ব্যবসায় তত্ত্বাবধান করতেন এবং নিজেও সেই পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় করছিলেন। ১৪ বছর বয়সে তিনি চাচা জুবায়ের রা:-সহ কয়েকজন যুবককে নিয়ে ‘হিলফুল ফুজল’ নামে একটি সমাজসেবামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নিজস্ব ও খাদিজা রা: থেকে প্রাপ্ত পুঁজি দিয়ে নতুন ধর্মের প্রচার করতে লাগলেন। নওমুসলিম সাহাবিদের মধ্যে যারা সামর্থ্যহীন তাদের খরচাদি রাসূল সা: নিজেই বহন করেছিলেন।

মদিনায় অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম
ইহুদি-নাছারারা কেনআন (ফিলিস্তিন) থেকে উৎখাত হওয়ার পরে মদিনায় এসে বসবাস শুরু করেছিল। কারণ তারা বায়তুল মুক্কাদ্দাস হারিয়েছিল, অতএব বায়তুল্লাহর নিকটবর্তী থাকলে নিয়মিত হজ-ওমরাহর মাধ্যমে পরকালীন পাথেয় হাসিল করবে। কিন্তু, মদিনার মানুষ তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও শ্রেণিবৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট। সুদের কবলে জড়িয়ে যাওয়া মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছিল। নারীরা সম্পদ থেকে বঞ্চিত হতো। এতিমরা অধিকার থেকে বিতাড়িত। সর্বনাশা জুয়ার খপ্পরে পড়ে মানুষ হয় সহায় সম্বলহীন। ব্যবসায়িক অসাধুতার কারণে জনসাধারণ জিম্মি। হারাম উপার্জনের তোড়জোড়ের কাছে মেহনতি শ্রমজীবী মানুষ হচ্ছে অবহেলিত। রাসূল সা: তাদের মুক্তির দিশা দেন। অর্থনীতির ভিত্তি শক্ত করার কাজে হাত দেন। কারণ, একটি রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব-সমৃদ্ধি নির্ভর করে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার ওপর।

ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা : হিজরত ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করা ও সেখানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্থনৈতিক কাঠামো রচনা করা। অর্থনৈতিকভাবে নিগৃহীত মুহাজিররা নিজেদের ধন-সম্পদ মাতৃভূমি মক্কায় রেখে এসেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা: মদিনায় প্রবেশের পর আনসাররা তাদের জমিজমা ও ধনসম্পদ থেকে উদ্বৃত্ত সব কিছু তাঁর কাছে সমর্পণ করতে শুরু করলেন। রাসূল সা:কেও মুহাজিরদের ব্যয়ভার নির্বাহে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল। তিনি কার্যত শ্রমের যে আদর্শ পেশ করেছিলেন তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুহাজিররাও আনসারদের ওপর বোঝা সৃষ্টি না করে কাজে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। এভাবেই গড়ে উঠছিল একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক বন্ধন।

বাজার প্রতিষ্ঠা : রাসূল সা: মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করে তাঁর অসীম প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। উল্লেখ্য, মুহাজিররা কৃষিকাজ জানতেন না। ব্যবসায়ই ছিল তাদের প্রধান অর্থনৈতিক অবলম্বন। তাই রাসূল সা: মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথেই বাজার প্রতিষ্ঠা করা শুরু করেছিলেন। ভ্রাতৃত্ববন্ধন ছিল নতুন ইসলামী অর্থনৈতিক বিপ্লবের ভিত্তিপ্রস্তরস্বরূপ।

রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পদের উৎস
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। অর্থনীতি তারই একটি অংশ। মানুষ কীভাবে অর্থ উপার্জন, ব্যয় ও ভোগ করবে সে সম্পর্কে ইসলামে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হিসাবে রাসূল সা: কুরআনের আলোকে অর্থনীতি সংস্কার করেন। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পদে যাতে জনসাধারণের অধিকার ও ভোগ করার সুযোগ থাকে তার জন্য ছয় প্রকারের রাজস্বের প্রবর্তন করেন। এখানে তার বর্ণনা দেয়া হলো-

জাকাত : জাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। জাকাত দানের মুখ্য উদ্দেশ্য গরিবদের অবস্থার পরিবর্তন করা, আর্থিকভাবে সচ্ছলতা লাভ করার ব্যবস্থা করা, অভাব থেকে মুক্তি দেয়া। জাকাত আদায়ে সমাজের কাঠামো তৈরি হয় এবং অর্থনীতিতে গতিবেগ সঞ্চারিত হয়।

উশর : উশর কৃষিজাত পণ্য ফল ও ফসলের জাকাত। এটি আদায় করা ফরজ। এর ব্যয়ের খাত জাকাতের মতোই।

খারাজ : এর অর্থ ভূমিকর যা অমুসলমানদের থেকে আদায় করা হয়। মহানবী সা: খারাজ আদায় করে অর্থনৈতিক সমতা বিধান করেন।

জিজিয়া : জিজিয়া অর্থ, বিনিময়। অমুসলমানদের কাছ থেকে জাকাতরূপে বছরে একবার অর্থ নেয়া, নিরাপত্তা কর তৎকালীন আরবের নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত সদস্যদের জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হতো।

আল-ফে : রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি থেকে আদায়কৃত অর্থ। এই অর্থ গরিব জনগণ ও রাষ্ট্রের মঙ্গলের কাজে ব্যয় করা হতো।

গণিমত : এটি হলো, অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে রণক্ষেত্রে বিজয়ী হওয়ার পর বিপক্ষের পরিত্যক্ত সম্পদ মুসলিমদের হস্তগত হলে তাকে গণিমত বলে। গণিমতের মালের ক্ষেত্রে বিধান হচ্ছেÑ প্রাপ্ত সম্পদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুল মালে জমা। এ ছাড়া, রাসূল সা: মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা করেন যেন মৌলিক মানবিক প্রয়োজনীয় চাহিদা থেকে কোনো নাগরিক বঞ্চিত না হয়।

সম্পদের মান নিয়ন্ত্রণ
অর্থনীতির ভিত্তি তৈরির সাথে সাথে রাসূল সা: সম্পদের মানের প্রতি নজর দিতেন; এখানে কিছুটা দেয়া হলোÑ
হালাল-হারাম : ইসলামী বিধান মতে, ব্যবহারিক জীবনে কিছু কাজকে হালাল ও কিছু হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। উৎপাদন, ভোগ ও বণ্টনের ক্ষেত্রেও এ বিধান প্রযোজ্য। ব্যক্তি পছন্দমতো উৎপাদন, উপার্জন, ভোগ ও বণ্টন করবে। রিজিক অন্বেষণ করবে, কিন্তু হারাম পন্থায় তিল পরিমাণ উপার্জন করা যাবে না।

সুদ নিষিদ্ধ : মদিনার অর্থনৈতিক সমস্ত কার্যক্রম ছিল সুদভিত্তিক। অথচ ‘আল্লাহ সুদ নির্মূল করেন ও দান-সাদকাকে প্রতিপালন ও ক্রমবৃদ্ধি করেন’ (সূরা আল বাকারা, আয়াত-২৭৬)। ‘তোমরা এই যে সুদ দাও মানুষের ধনসম্পদ বৃদ্ধির আশায়, জেনে রাখো, আল্লাহর কাছে তা কখনো বৃদ্ধি লাভ করে না। তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জাকাত বাবদ যে দান করে থাকো একমাত্র তার মধ্যেই ক্রমবৃদ্ধি হয়ে থাকে’ (সূরা আর রুম, আয়াত-৩৯)। রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা সুদ খায়, সুদ দেয়, সুদের হিসাব লিখে এবং সুদের সাক্ষ্য দেয় তারা সবাই সমান পাপী’ (তিরমিজি, হাদিস-১২০৬)। এভাবে কুরআনের চারটি সূরায় সাতটি আয়াত রয়েছে সুদ নিষিদ্ধের, রয়েছে অসংখ্য হাদিস। সমস্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বর্তমান বিশ্বের সমস্ত অর্থনৈতিক অব্যবস্থা ও অনাচারের মূলে এই সুদ।

অসাধুতা দূরীকরণ : মহানবী সা: সর্বপ্রকার অবৈধ উপার্জন যেমন- সুদ, ঘুষ, মদ, কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, মজুদদারি প্রভৃতি অবৈধ ও অন্যায় পথে অর্থ উপার্জন সম্পূর্ণ হারাম করেছেন। আল্লøাহ বলেছেন, ‘তোমরা উত্তম ও পবিত্র বস্তু খাও, যা আমি তোমাদের জীবিকারূপে দান করেছি’ (সূরা আল বাকারা, আয়াত-১৭৭)। তিনি মজুদদারি, মিথ্যা হলফ, অনিশ্চয়তামূলক ও ফটকামূলক সব আদান-প্রদান নিষিদ্ধ করেন। রাসূল সা: বলেন, ‘কেবল পাপী ব্যক্তিই মজুদদারি করে’ (সহিহ মুসলিম-১৬০৫)।

শ্রমের মর্যাদা : হিজরতের পরপরই মহানবী সা: সাহাবিদের শ্রমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেছেন। মদিনায় প্রবেশ করে তিনি নিজে মসজিদ নির্মাণে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম শ্রমনীতির প্রবর্তন করে শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার মজুরি পরিশোধ করো।’ শ্রমিকের বেতন-ভাতা, কষ্ট ও ঘামের মূল্য দিতে উৎসাহিত করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে তাদের সম্মান, বেঁচে থাকা ও মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটান। শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষণ করে ভঙ্গুর অর্থনীতিকে মহানবী সা: উচ্চ স্থানে নিয়ে গেছেন।

দাসপ্রথা : রাসূল সা:-এর আগমনের আগে দাসই ছিল শ্রমের ভিত্তি। সুতরাং হঠাৎ করে দাসপ্রথা বন্ধ করলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে যেত। এতে একদিকে যেমন দাসদের মনিবরা ক্ষতিগ্রস্ত হতো, অন্য দিকে উৎপাদন, ব্যবসায়-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে জনমানবের ক্ষতি হতো। অধিকন্তু, আত্মীয়স্বজন ঘরবাড়িবিহীন দাসরা মনিব হারিয়ে বিপদে পড়ে যেত। তাই দাসপ্রথা বন্ধ না করে তিনি দাসদের পরিবারের সদস্য করে নিয়েছেন। বিভিন্ন কারণে কেউ স্বেচ্ছায় দাসমুক্ত করলে বিনিময়ে সওয়াবের সুযোগ দিয়েছেন।

সম্পদের ন্যায্য বণ্টন : সম্পদ বণ্টনের বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘যেন সম্পদ কেবল ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়।’ আল্লাহর এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিত হচ্ছে, মদিনায় ইহুদি বনি নজির গোত্রের সাথে দ্বন্দ্বের পর তারা মদিনা ত্যাগ করে চলে যায় এবং তাদের পরিত্যক্ত মালসম্পদ ইসলামী রাষ্ট্রের অধিকারভুক্ত হয়। এই ফাই সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এটি হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার জন্য, রাসূলের জন্য, নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজনের জন্য, ইয়াতিম ও মিসকিনের জন্য এবং সম্বলহীন পথিকদের জন্য; যেন সম্পদ তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়’ (সূরা হাশর, আয়াত-৭)।

উত্তরাধিকার নীতি প্রণয়ন : রাসূল সা:-এর আবির্ভাবের আগে পৃথিবীতে ভূমির উত্তরাধিকারের আইন ছিল না। পুরুষানুক্রমে পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান অথবা শুধু ছেলেরা সম্পদের অধিকারী হতো, কিন্তু নারীরা পেত না সম্পদের কিছুই। অতঃপর তিনি নারীর অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লাহ বলেন, ‘মাতা-পিতা ও আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং মাতা-পিতা ও আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদের অংশ আছে; অল্প হোক কিংবা বেশি, এ অংশ নির্ধারিত’ (সূরা নিসা, আয়াত-৭)।

রাষ্ট্রের ন্যায়সঙ্গত হস্তক্ষেপের বিধান : সমাজের জুলুম, অত্যাচার, দুর্নীতি, অর্থনীতিতে শোষণ, শাসন, সুদ, ঘুষ, মুনাফাখোরি, মজুদদারি বন্ধ করতে রাসূল সা: ন্যায়সঙ্গত হস্তক্ষেপের বিধান আরোপ করেন। এতে রাষ্ট্র ও তার অর্থনীতির ব্যাপক পরিবর্তন হয়। সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসে। সমাজে কায়েম করেন সামাজিক নীতি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা। মহানবী সা: তাঁর বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রু তোমাদের পরস্পরের কাছে পুতঃপবিত্র।’ রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার কারণে কারো মৃত্যু হলে তা হত্যা হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

জীবন যাপনে মধ্যপন্থী হওয়া : রাসূল সা: পানাহার ও পোশাক-পরিচ্ছদের বেলায় অতিমাত্রায় বিলাসিতা ও শৌখিনতা পছন্দ করতেন না। আল্লাহ বলেন, ‘হে আদম সন্তান, প্রত্যেক নামাজের সময় তোমরা সুন্দর পোশাক গ্রহণ করো। আর পানাহার করো; কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না’ (সূরা আরাফ, আয়াত-৩১)। তবে, অপচয় ত্যাগ অর্থ হলো মধ্যপন্থা অবলম্বন করা, কৃপণতা নয়। আল্লাহ কৃপণদের পছন্দ করেন না। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি একেবারে ব্যয়কুণ্ঠ হয়ো না, আর একেবারে মুক্তহস্তও হয়ো না, তাহলে তুমি তিরস্কৃত, নিঃস্ব হয়ে বসে থাকে ’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-২৯)।

খাদ্য সঞ্চয় : খাদ্য সঞ্চয়ের ব্যপারে রাসূল সা:-এর নীতি ছিল আলোকোজ্জ্বল। যেসব দ্রব্য নির্দিষ্ট কয়েকটি মৌসুমে সঞ্চয় করে পরবর্তীতে ভোগ করার রীতি রয়েছে তা তাঁর অর্থনীতির আলোকে বৈধ। দ্রব্যমূল্য বাড়ার আশঙ্কা না থাকলে মনীষীরা সঞ্চয়কে বৈধ বলেছেন। রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা জগৎবাসীর প্রতি সদয় হও, তাহলে আসমানের মালিক তোমাদের প্রতি সদয় হবেন’ (তিরমিজি)।

স্বনির্ভর জীবন যাপন : আল্লাহর ইবাদত করা যেমন ফরজ, ইসলামে জীবিকা উপার্জনও তেমন ফরজ। আল্লাহ বলেন, ‘এরপর যখন নামাজ আদায় শেষ হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে, আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করবে এবং বেশি বেশি জিকির করবে, এতে তোমরা সফল হবে’ (সূরা জুমুআ, আয়াত-১০)।

উপসংহারে বলা যায়, বর্তমান জমানার অর্থনীতির সাথে রাসূল সা:-এর অর্থনৈতিক কার্যক্রমের পার্থক্য হলো- তাঁর অর্থনৈতিক কার্যক্রম ছিল- ক. সেবামূলক; খ. মধ্যস্বত্বভোগ সীমাবদ্ধ করা ও সুদকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা; গ. ব্যক্তি মালিকানার সাথে সামাজিক দায়িত্ববোধের সমন্বয়; ঘ. সাম্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। রাসূল সা: পুঁজিবাদসর্বস্ব ও মানবতাবিরোধী অর্থনীতির পরিবর্তে অত্যন্ত কল্যাণমুখী এবং মধ্যপন্থী অর্থনৈতিক জীবনের মহান আদর্শ তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। কুরআনের আলোকে মানুষের সব অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। মদিনার অর্থনীতির চাকাকে সচল, সবল ও সুষ্ঠু সমৃদ্ধ রাখার জন্য রাসূল সা:-এর প্রদত্ত কর্মসূচি অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলমন্ত্র। তাঁর দেয়া কর্মসূচি পালন করতে পারলে বর্তমানেও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব।

সবশেষে বলতে হয়, প্রকৃত অর্থে, রাসূল সা:-এর তেমন কোনো অর্থনৈতিক সংস্কারই বর্তমান জমানার প্রচলিত অর্থনীতিতে অনুসরণ করা হচ্ছে না; বরং বর্তমান বিশ্বের তথা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায়ই তাঁর আগমনপূর্ব জাহেলিয়াতের জমানার মতোই। বড়জোর বর্তমান ব্যবস্থাকে ‘আধুনিক আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বলা যেতে পারে। আগেই বলেছি, জাহেলিয়াতের সময় মানুষ জ্ঞানহীন ছিল না, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে ছিল না; বরং তাদের ছিল না ন্যায়-অন্যায়, হালাল-হারাম ও সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে জ্ঞান। ফলে জাহেলিয়াতের সময়ের চেয়ে বর্তমান জমানার অর্থনৈতিক টেকনিক, মেকানিজম ও কার্যক্রম ভিন্ন হলেও লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং আদর্শ একই রকম। ফলে, জাহেলিয়াতের যুগের মতাই মারামারি, যুদ্ধবিগ্রহ, লুটতরাজ, সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, অসততা, হালাল-হারাম চলছে হরদম; পরিণতি অর্থনৈতিক সঙ্কট, দুর্ভিক্ষ, মহামারী। এমন অবস্থা থেকে রাসূল সা: যেমন তখনকার মানবজাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়েছিলেন তেমনি তাঁর অর্থনৈতিক সংস্কার বর্তমান দুনিয়ার অর্থনৈতিক মুক্তির রোল মডেল হতে পারে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ই-মেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
এখন মানবিক সমাজ বিনির্মাণের খুব প্রয়োজন : অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ফল আমদানি কি আদৌ অত্যাবশ্যক ‘শিক্ষার্থীরা অন্তর্বর্তী সরকারের অনুকম্পায় দল গঠন করছে না’ সোনাইমুড়ী উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক খলিল গ্রেফতার এনডিএম ও গণধিকার পরিষদের সাথে বিএনপির লিয়াজোঁ বৈঠক বিনা শর্তে দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাসে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর সড়ক ছাড়ল শ্রমিকরা রেমিট্যান্স বাড়ায় দেশের রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে শরণার্থীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে দক্ষিণ সুদান সরকারকে বিরোধ নিষ্পত্তির নোটিশ এস আলম গ্রুপের, নইলে আন্তর্জাতিক সালিশির হুমকি একনেকে ১ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকার ১০ প্রকল্প অনুমোদন সালাহর চমকে উড়ল লিভারপুল

সকল