০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

তারি দু’চারিটি অশ্রুজল

-

পূর্ব প্রকাশের পর
ফেনী জেলা আইনজীবী সমিতির শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রধান বিচারপতি মো: রুহুল আমিন বলেছিলেন, ‘বিচারপ্রার্থীদের ৯০ ভাগ বঞ্চিত মানুষ। বাকি ৫ ভাগ বিপক্ষকে ঘায়েল করতে বিচারপ্রার্থী হয়। বাকিরা আসে বিভিন্ন কারণে। এদের উদ্দেশ্য থাকে অপর পক্ষকে সায়েস্তা করা।’ একই সভায় টি-এইচ খান বলেন, ‘বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাপাসহ সব সরকারের আমলেই বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছ পথ অনুসরণ করা হয়েছে।’ (দৈনিক মানব জমিন ০১/৫/২০০৭)।

অস্বচ্ছ বিচারক
‘নারায়ণগঞ্জে বিচারকের বিরুদ্ধে জেলা বারের তদন্ত কমিটি, শিরোনামে দৈনিক মানবজমিনের খবর (১০ নভেম্বর ২০১০)। প্রকাশ, ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ২২(গ) ধারায় ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(বি) ধারায় গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে মামলা নং ৩০(১০)২০১০। উক্ত মামলায় নি¤œ আদালতে আসামিদের জামিন নামঞ্জুর হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ২৭ অক্টোবর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জামিনের জন্য সিআরমিস করেন। দায়রা জজ আদালত শুনানির জন্য ১৪ নভেম্বর তারিখ নির্ধারণ করা হয়। উচ্চ আদালত অর্থাৎ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে শুনানি নিষ্পত্তির আগেই অপর একজন আইনজীবী নিম্ন আদালতেই আসামির জামিন মঞ্জুর করিয়ে ফেলেন। এ কারণে, প্রথম দরখাস্তকারী আইনজীবী পরবর্তী দরখাস্তকারী আইনজীবীসহ নিম্ন আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে অনৈতিক আচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে নারায়ণগঞ্জ বার সমিতিতে আভিযোগ করেন।’

মানবজমিনের খবরের মতো, ‘বিচারকের কক্ষে ঢুকে ঘুষ দেয়ার চেষ্টা, বিচারকের নামে ঘুষ নিলেন আদালতের কর্মচারী, বিচারকের ঘুষ দুর্নীতির জন্য আইনজীবীদের আদালত বর্জন, ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ : বিচারক প্রত্যাহারে আইনজীবীদের আলটিমেটাম’ এরকম খবর প্রায়ই চোখে পড়ে। বিচারকদের অনিয়মের প্রতিকার সম্পর্কে মরহুম মিজানুর রহমান খান প্রথম আলো পত্রিকায় ৫ নভেম্বর ২০১৬ একটি রেখচিত্র প্রকাশ করেছিলেন, ১১ জন জেলা জজ ও ১৭ জন যুগ্ম ও অতিরিক্ত জেলা জজ এবং ১৮ জন সহকারী জজ ও জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ, মোট ৪৬ জন অভিযুক্তের তদন্ত ঝুলে আছে ১৫ জনের দুই বছর থেকে পাঁচ বছর, ১৮ জনের ছয় মাস থেকে দুই বছর ও ১৩ জনের ছয় মাসের কম। মিজানুর রহমান খানের ‘আদালতে দুর্ণীতির চালচিত্র’ নামক কলামে ঝুলে থাকার জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে বিচার বিভাগে ‘দ্বৈতশাসন’কে দায়ী করেছেন। তার মতে, ‘দ্বৈতশাসন’-এর টানাপড়েনে দুর্নীতি ও অসদাচরণের মতো অভিযোগ নিষ্পত্তি ও শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়ার আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, দুর্ণীতিবাজ বিচারকদের চাকরিচ্যুত বা বরখাস্ত করা নিঃসন্দেহে লঘুদণ্ড। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘নিম্ন আদালতে দুর্নীতির ব্যাপারে দুদকের হস্তক্ষেপ চোখে পড়ে না।

একাবিংশ শতাব্দীর শুরুতে নিযুক্ত অযোগ্য বিচারকদের লোভ, লালসা ও প্রলোভনের দ্বারা খুব সহজেই বিচ্যুত করা যায়। যোগ্যতাহীন বিচারকদের বিচ্যুতির জন্য রয়েছে একশ্রেণির আইনজীবীও। তারা আইন ব্যবসায়ের চেয়ে লাইন ব্যবসায়ে অধিক পারদর্শী। বিপথে নেয়ার জন্য আইনজীবীদের চেয়েও বেশি পারদর্শী টাউট ও একশ্রেণীর মুহুরি। গুরুদণ্ডের মামলার জামিন শুনতেন চিফ সিএমএম নিজে, অধস্তন সিএমএম শুনতেন লঘুদণ্ডের জামিন। গুরুদণ্ডের মামলা লঘুদণ্ডের আদালতে নিয়ে সিদ্ধিসাধনের বিষয়টি ঢাকা সিএমএম আদালত থেকেই দেখা শুরু করেছি। প্রায় ৪ দশক যাবৎ দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, রাজধানী সিএমএম কোর্ট থেকেই যেন বিচারক বিচ্যুতির উৎপত্তি।

ফৌজদারি মামলায় জামিন কেলেঙ্কারির চেয়ে দেওয়ানি মামলার রায় কেলেঙ্কারি ভয়ঙ্কর। জামিন কেলেঙ্কারি সাময়িক হর্ষ-বিষাদের কারণ, আর রায় কেলেঙ্কারি একজনকে সারা জীবনের জন্য পথে বসিয়ে দেয়। ফৌজদারি কেলেঙ্কারির বিষয়টি জানাজানি হলেও দেওয়ানি কেলেঙ্কারি ফল্গুধারার মতো বয়েই চলছে। এখানেও রয়েছে বিপথগামী আইনজীবী, যারা বিচারকদের বিপথগামী করে। এসব বিপথগামী আইনজীবীদের কারণে সাধারণ আইনজীবীগণ মানসিক অশান্তিতে আছেন।

রায় পাইয়ে দেয়ার ব্যবসা
জনপ্রশাসন, বিচারালয়, পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ায় একসময় নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতেও এর প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায় যার মধ্যে কয়েকজন ছিলেন খুবই ট্যালেন্ট ও কঠোর পরিশ্রমী। সিনিয়র আইনজীবীগণও তাদের কোর্টে প্রবেশের আগে সাতবার ভাবতাম। অসাবধান ও অপ্রস্তুত থাকার কারণে পরিচ্ছদ নিয়ে আমিই বেশি বিড়ম্বনায় শিকার হয়েছি। আমার দিকে তাকিয়েই, খবধৎহবফ, ফৎবংং ঈড়ফব? ‘ঝড়ৎৎু’ বলে রেহাই পেতাম। তার পরেও তাকেই আদর্শ বিচারক হিসেবে সম্মান করতাম। তিনি কোনো অন্যায় সুপারিশও বরদাশত করতেন না। যথেষ্ট অভিজ্ঞতার অভাবে জুনিয়ার মহিলা বিচারকদের কেউ কেউ সিনিয়র পেশকার-সেরেস্তাদারের সাহায্য নিয়ে থাকেন। যাদের সাহায্য নিতেন তাদের কেউ কেউ রায় পাইয়ে দেয়ার ব্যবসা পেতে বসার বিষয়টি অনেক বিচারকই টের পান না। সংবিধানের ৩৫(৩) অনুযায়ী ও ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারী হইবেন’ উল্লেখ থাকলেও যেনো সর্বত্রই এর উল্টো চিত্র। বাস্তবে, আদালতের দুর্বাও পয়সা খায়।

প্রধান ‘বিচারপতি মো: রুহুল আমিন বলেন, ‘আমাদের সামাজিক সংস্কৃতি ও আচরণ দুর্নীতির বিকাশ ও পৃষ্ঠপোষকতার জন্য দায়ী। আমাদের মধ্যকার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোকের ভেতর দুর্নীতিকে ‘না’ বলার মানসিকতা অনুপস্থিত। আমরা বেশির ভাগই দুর্নীতিগ্রস্ত লোকের সান্নিধ্য পরিত্যাগ করিনি। যদিও আমরা দুর্নীতিগ্রস্ত লোকের অনুপস্থিতিতে তারই দুর্নীতির বিষয়ে আমরা আলোচনায়মুখর হয়েছি। কিন্তু তার উপস্থিতিতে (তিনি নারী বা পুরুষ যিনিই হোক না কেন) আমরা বরং তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছি (প্রথম আলো ৫ জুলাই ২০০৭)

রাষ্ট্রের জন্য অশনিসঙ্কেত
১৬ জুলাই ২০২০ বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত হয়, ‘সারা দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭২৮টি। একই সময়ে ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০টি। দুই বছরে মামলা বেড়েছে তিন লাখ ৩০ হাজার ২২৮টি। ৪ জুন ২০২২ ‘সময়ের আলো’ অনলাইন সংস্করণের শিরোনাম ছিল, ‘মামলার মহাজটে বিচারাধীন ৪০ লাখ মামলা’। অর্থাৎ দুই বছরে তিন লাখ ১৫ হাজার ২৭২টি। বিষয়টি সরকারের জন্য উদ্বেগসহ রাষ্ট্রের জন্য অশনিসঙ্কেত।

গত ১৫ অক্টোবর ২২ রাজধানীর একটি হোটেলে ‘ডিসকাশন অন মিটিং দ্য নিডস এন্ড জাস্টিস সিকারস’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘বিভিন্ন কারণে দেশের প্রচলিত আদালতগুলোতে মামলাজট তৈরি হয়েছে। এসব আদালতে মামলার চাপ কমাতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতির প্রয়োগ বাড়াতে হবে এবং দ্রুত স্বল্প ব্যয়ে এ সেবা দিতে হবে।’ এর আগেও গত ৮ জুন ২০১৩ বিকল্প পদ্ধতিতে দেওয়ানি বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে রাজধানীর একটি হোটেলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে মতবিনিময় সভা হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জ জেলা থেকে উপস্থিত ছিলাম আমিও। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। সভার প্রকাশিত বক্তব্য থেকে জানা যায়, দেশে বর্তমানে ২৪ লাখ ৫৪ হাজার মামলা বিচারাধীন আছে। আইনমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, প্রচলিত আইনে যুগের পর যুগ অপেক্ষার পর আদালতে বিচার নিষ্পত্তি হলেও বিরোধ নিষ্পত্তি থেকেই যায়। আর মেডিয়েশন (এডিআর) পদ্ধতিতে বিচার এবং বিরোধ দু’টিই নিষ্পত্তি হয়। দুই পক্ষই নিজেদের বিজয়ী মনে করে কোলাকুলি করে বাড়ি আসে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই পদ্ধতি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর তিন জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে। পরে মুন্সীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জকে আওতায় আনা হবে। সফল হলে সব জেলায় এই পদ্ধতি বাধ্যতামূলকভাবে করা হবে। এ বিষয়ে, ‘বিকল্প পদ্ধতিতে দেওয়ানি মামলার বিরোধ নিষ্পত্তি’ শিরোনামে নয়া দিগন্ত ১৩ জুন ২০১৩ সংখ্যায় একটি প্রবন্ধও প্রকশিত হয়েছিল।

এক মামলাই ৭০ বছর
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ‘এক মামলাই ৭০ বছর’ শিরোনামে দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, খাজনার দায়ে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের মেছের আলীর জমি নিলাম হয় ১৯৫২ সালে। মেছের আলী মৃত্যুবরণ করায় তার উত্তরাধিকারী আবদুল হামিদ শেখগিং। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতায় দুই পক্ষই ত্যক্ত বিরক্ত। আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত। প্রয়াত বিবাদি মজিবুর রহমানের ছেলে এনামুল হক মোবাইল ফোনে হতাশ কণ্ঠে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। আমরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করছি।’ ৭০ বছর পর এই এডিআর-এ সম্মত হওয়ায় সেই পুরনো প্রবাদ, ‘যদি সেই নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি’ বাক্যটি মনে পড়ে গেল। যে এডিআরকে প্রত্যেক সরকারের আমলে সম্মানিত আইন মন্ত্রীরা প্রাধান্য দিয়ে আসছেন সেই ‘এডিআর’ শব্দটি দেওয়ানি মামলার কজলিস্টের শোভা বর্ধন ছাড়া কোনো কাজে আসতে দেখা যায়নি গত তিন যুগেও। দেওয়ানি আদালতে ভালো এবং নির্ভেজাল মামলা একতরফা নিষ্পত্তির জন্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। আদালতের দিক থেকে একতরফা মামলার প্রতিই বেশি অবহেলা করা হয়। দুই কথার একতরফা মামলাও পার হয়ে যায় এক যুগ।
(দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল)

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement