বাংলাদেশের শিশুশ্রমিক
- অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
- ০৬ নভেম্বর ২০২২, ১৯:২২, আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২২, ১৯:২৪
শিশুশ্রম একটি বৈশ্বিক সমস্যা। কোথাও আইনের ছত্রছায়ায় আবার কোথাও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এটি বিরাজমান। এটি নাগরিক জীবনেরই একটি অংশ। কোনো দেশের, কোনো জাতির আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, পরিবেশ ও সমাজ ব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে শিশুশ্রম, শিশুশ্রমের আধিক্য ও শিশুশ্রমিকের সংখ্যা। বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ২০০২-০৩ সালে ও ২০১৩ সালে আরেকটি পরিসংখ্যান দেখা যায়- এসব পরিসংখ্যান অনুসারে বাংলাদেশে সাত থেকে ১৪ বছর বয়সে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৫ লাখ, আর ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৮ লাখ। আইএলওর হিসাব মতে, বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। শিশুশ্রমিকের কোনো শ্রমঘণ্টা বাঁধা নেই। ১৪ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের কাজ করতে হয়। পরিবর্তে, মজুরি অনেক কম। ব্যাপারটি তদারকি করার দায়িত্ব কেউ নেন না।
আমাদের পুরো জনগোষ্ঠীকে ১৮ কোটির আদলে হিসাব করা হলে এর ৫০ লাখই হলো শিশুশ্রমিক। এটি কোনোক্রমেই আর্থসামাজিক ও উন্নয়নশীল ধারায় গ্রহণীয় অবস্থা নয়। শিশুশ্রমিকের উল্লেøখযোগ্য একটি অংশ লেদ মেশিনে, চামড়া শিল্পে, গাড়ি মেরামত ও গাড়ি চালানোর কাজ করে। সব চেয়ে মারাত্মক হলো, একটি অংশ জাহাজ ভাঙা শিল্পে নিয়োজিত। অথচ এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ যেটি বড়দের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। যারা এসব কাজ করে তারা বিভিন্ন ধরনের রোগে, অপুষ্টিতে ভোগে। তাদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। অনেকসময় এরা মাদকচক্রের সাথে জড়িয়ে পড়ে। যৌন হয়রানির শিকার হয়। বিশেষ করে মেয়ে শিশুশ্রমিক। অনেকসময় দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে অঙ্গহানি ঘটে ও সারা জীবনের জন্য পুঙ্গুত্ববরণ করে। জীবনহানিও ঘটে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। অঙ্গহানি, পঙ্গুত্ব বা জীবনহানির ক্ষেত্রে কেউ দায় স্বীকার করছেন এমনটি জানা নেই। বাংলাদেশের সংবিধানে ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজে নিয়োগ দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এটি আইনের খাতায়ই রয়ে গেছে। বাস্তব কোনো প্রয়োগ খুব একটা দেখা যায় না। এই বিশালসংখ্যক শিশু, যারা দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক, এরা বড় হয়ে উঠছে আইন ও শিক্ষার প্রতি অনীহা নিয়ে। সমাজ যেমন তাদের জন্য দায়বোধ বহন করে না; তারাও নিজেরা সমাজের প্রতি একইভাবে দায়বোধহীন। অভাব, দারিদ্র্য, অতিদারিদ্র্য ও শিক্ষার সুযোগের অভাবে শিশুশ্রমের পরিধি বাড়ছে। প্রতি বছরই বন্যা, ঝড় বা নদী শিকস্তি হয়ে যেসব পরিবার বাস্তুচ্যুত হয় এসব পরিবারের ক্ষেত্রেই শিশুশ্রমিকের হার বেশি। তারা পরিবারের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সাংসারিক ব্যয় জোগান দিয়ে থাকে। এটি তাদের এবং পরিবারের বেঁচে থাকার, টিকে থাকার একটি অবলম্বন। এসব আর্থসামাজিক কারণে বাধ্য হয়ে তারা শিশুদের শ্রমের কাজে পাঠায়।
শিশুশ্রমিকদের যেহেতু কম পারিশ্রমিক দিতে হয় ও এদের দীর্ঘ সময় খাটানো যায়; এরা কাজে অনুপস্থিত থাকে না; এই পরিপ্রেক্ষিতে শিশুশ্রমিক নিয়োগে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অতিউৎসাহী। তারা আইনের ফাঁকে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগায়; বিশেষ করে যারা বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। এদের কোনো নির্দিষ্ট বেতন নেই। এরা থাকা-খাওয়া ও কাপড়ের বিনিময়ে কাজ করে। এদের অস্তোদয় পরিশ্রম করতে হয়। গৃহস্বামী জাগার আগেই তাদের জাগতে হয়। তারা ঘুমাতে যাওয়ার পর তাদের ঘুমাতে হয়। সারা দিন সংসারের সব কাজ তাদের করতে হয়। একটি অসহনীয়, অমানবিক ও অবর্ণনীয় যন্ত্রণার পরিবেশে এই শিশুশ্রমিকরা বেড়ে উঠে। শিশুরা লেখাপড়া শিখে সংসারকে সাহায্য করবে, এটি একটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। অপর দিকে, তাকে কাজে লাগালে পরের দিনই সে পরিবারে আর্থিক অবদান রাখা শুরু করে। এটি ওই পরিবারের কাছে একটি বিরাট ব্যাপার। এ জন্য শিশুদের স্কুলে পাঠাতে রাজি হয় না। পড়াশোনার লাগামহীন খরচের কথা তারা ভাবতেও পারে না। দেশে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকারের অবর্ণনীয় অবস্থা তারা নিজেরা দেখে। পড়াশোনার পরিবর্তে শিশুদের লেদ মেশিন, গাড়ির হেলপার, জাহাজ ভাঙা, গাড়ি মেরামতের দোকানে লাগিয়ে দিয়ে মনে করে- এই পেশায় তারা ভবিষ্যতে দক্ষ হয়ে উঠবে। দক্ষ শ্রমিক হবে ও আয়ের পথ খুলে যাবে। করোনা মহামারী, বন্যা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে দরিদ্র ও অতিদরিদ্রের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়। রাতারাতি অনেকেই কর্মচ্যুত হয়ে বেকার হয়ে যায়। বেঁচে থাকার জন্য তারা বাধ্য হয়েই শিশুদের কাজে পাঠায়। শিশুদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ, তাদের দৈহিক ও মানসিক এবং বিকাশের কথা তাদের মাথায় আসে না। শিক্ষার জন্য দীর্ঘ সময় অভিভাবকরা দিতে রাজি হন না। শিক্ষাকে পেশাগত শিক্ষায় রূপান্তরিত করা গেলে এই শিশুরা লেখাপড়ার সাথে সাথে পেশাগত শিক্ষায় পারদর্শী হতে পারত। অভিজ্ঞ হতে পারত। অভিজ্ঞ শ্রমিক হিসেবে দেশে ও বিদেশে তাদের চাহিদা বাড়ত।
সরকার ১৯৯৩ সাল থেকে প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিক্ষাবৃত্তি শুরু করলেও এ দিয়ে পড়ার খরচ চলে না। বাধ্য হয়ে একদিকে স্কুলে নাম লেখাতে হয় শিক্ষাবৃত্তির জন্য; অপর দিকে নিজেকে কাজে নিয়োজিত করতে হয় আর্থিক সচ্ছলতার জন্য। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে চলে শিশুর জীবন। এতে শিশুদের নাম হাজিরা খাতায় থাকলেও বস্তুত তারা থাকে বিভিন্ন ধরনের কাজে নিয়োজিত। এই শিশুদের কাছে স্কুল বড় কথা নয়। তারা জানে, পড়াশোনার পরিবর্তে কাজ করলে তাদের কিছু আর্থিক সংস্থান হবে, সংসারের সাহায্য হবে। এ ক্ষেত্রে সমাজ, আইন, লেখাপড়া তাদের কাছে গৌণ। দৈহিক নিগ্রহ ও যৌন নির্যাতনের শিকারের ভয়ে মেয়ে শিশুদের অভিভাবকরা বেশি দিন ঘরে রাখতে চায় না। বাল্যবিয়ের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকে। দারিদ্র্য, শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ে একই সূত্রে একইভাবে চলমান। একটি থাকলেই আরেকটি এসে পড়ে। এই চক্র ভাঙার জন্য প্রয়োজন সরকারি ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ।
বর্তমানে কতজন শিশুশ্রমিক আছে ও তাদের কত অংশ ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত- এর পরিসংখ্যান দরকার। এর ওপর ভিত্তি করে সরকারি শিশুনীতি ও শ্রমনীতির পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। শিশুশ্রমের বয়সের কঠোর ও বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করা দরকার। সব শিশু সংগঠন, আইএলও, ইউনিসেফ ও দেশের ভেতরে যেসব সামাজিক সংগঠন রয়েছে; স্কুলের শিক্ষক, সামাজিক নেতা, মিডিয়া ও প্রচারযন্ত্র, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগকে একত্রিত করে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন যেন আন্তর্জাতিকভাবে ২০২৫ সালের মধ্যেই শিশুশ্রম শূন্যকরণের লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর জন্য করণীয়গুলো বারবার আলোচনা করা দরকার, পর্যালোচনা হওয়া দরকার ও এর ভিত্তিতে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা দরকার। নতুবা অদূর ভবিষ্যতে শিশুশ্রমিকের ভারে ভেঙে যেতে পারে আর্থসামাজিক ভিত্তি।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ রিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা