রেগে গেলেন তো...
- ড. মাহবুব হাসান
- ০৪ নভেম্বর ২০২২, ২০:৪২
বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিগুলোর জন্ম হয় কেমন করে আমরা যারা আমপাবলিক তারা তা ধারণাও করতে পারি না। কিন্তু কিছু বিরোধ তো জলের সাথে জলতরঙ্গের মধ্যে হচ্ছেই, না হলে এমন চৌম্বক ঘূর্ণি উন্মাতাল করে দেয় কী করে? আবহাওয়াবিদরা বিষয়টি বিশদ জানেন। আর যারা রাজনীতি করেন, তারা জানেন রাজনৈতিক পরিবেশের ঘূর্ণি কেমন করে হয়। কেমন করে ঘূর্ণি তোলা যায় সেই কারিগরি কৌশলও তারা বোধ হয় বেশ ভালোভাবেই বোঝেন। চেনেন সেই ঘূর্ণিগুলোর কেন্দ্র কোথায়, কোথায় বাতাসের পকেট সৃষ্টি হচ্ছে অথবা পকেট তৈরি করা যায়, সেসবই তাদের কীর্তির অন্তর্গত। আমপাবলিক বা জামপাবলিক সেই সুতোর মাথা খুঁজে না পেলেও, কেউ কেউ যে তাদের ভাবনার অ্যান্টেনা আরো উঁচু দিগন্তে তুলে ধরতে পারেন, আমরা বিলক্ষণ বিশ্বাস করি। অনুমান থেকেই মান তৈরি হয়; কিংবা মানকে অণুতে রূপান্তরিত করতে পারলেই তার অ্যাটমিক পাওয়ার বোঝা যায়।
গত ৩ নভেম্বরের পত্রিকায়, অনলাইনে, টিভিতে দেখলাম স্ক্রল হচ্ছে- বিএনপি বেশি বাড়াবাড়ি করলে খালেদা জিয়াকে আবারো জেলে ঢুকিয়ে দেবো।
এ কথা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর। তিনি হঠাৎ ক্ষেপে উঠলেন কেন? বুঝতে পারছি না। খালেদা জিয়া তো অসুস্থ মানুষ। তাকে জেলে পাঠালে তো অবস্থা আরো খারাপ হবে, সেটিই কি বলতে-করতে চান তিনি? সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা এমনই খারাপ যে, বিছানাই তার সেরা জায়গা, যার চিকিৎসার জন্য বিএনপি নেতারা কম তদবির করেননি সরকারের কাছে, কোনো সুফল মেলেনি। কেবল প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দয়া আর মানবিকতার সুতো ধরে বেগম খালেদা জিয়া কারাগারের বাইরে বাসায় থাকতে পারছেন। নিতে পারছেন তার জন্য প্রযোজ্য শ্রেষ্ঠ দেশীয় চিকিৎসা। তিনি যদি এই বদান্যতা না দেখাতেন, তাহলে বিএনপি কী করতে পারত? রাজপথে আন্দোলন করে কি তারা বেগম জিয়াকে উন্নত দেশীয় চিকিৎসা দিতে পারত? কিংবা বিদেশে চিকিৎসার জন্য পারমিশনও দেয়নি সরকার। তাই এটি মানতেই হবে, প্রধানমন্ত্রীর এই রোষ ঢালার অধিকার আছে।
তো, সেই প্রায় অনড়, তিনবারের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী (আওয়ামী লীগ অবশ্য মানে না যে, তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন) এখন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। সেই আসামিকে যদি দয়াপরবশ হয়ে বাইরে নিয়ে আসতে পারেন রাজনৈতিক সরকারের বিশেষ ক্ষমতাবলে, তাহলে কেন অন্য সব রাজনৈতিক আসামি খালেদা জিয়ার মতো তার কাছে থেকে দয়া লাভ করেনি? শুধু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামিদের ক্ষমা করতে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা ছাড়া তো দিগন্ত উন্মোচনকারী কিছু দেখতে পাচ্ছি না আমরা।
এতিমদের জন্য রক্ষিত (ফান্ডটি কে ইনিশিয়েট করেছিলেন, তা কি আমরা জানি? হয়তো খালেদা সরকার কিংবা হাসিনা সরকার) যিনিই করুন টাকাটা এতিমদের জন্য রক্ষিত, সে টাকা মেরে খাওয়াটা চরমতম অন্যায়, অপরাধ। দুই কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে বেগম জিয়ার পাঁচ বছরের জেল হয়েছিল নিম্ন আদালতে, উচ্চ আদালতে তা বাড়িয়ে ১০ বছর করেছেন বিজ্ঞ বিচারক। সুবিশাল অঙ্কের ওই অর্থ মেরে খেয়েছেন সিটিং একজন প্রধানমন্ত্রী, এটি সহ্য করা সত্যিই কঠিন। তবে, আমরা তো হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করছি না, এমন কি রিজার্ভ থেকে হ্যাকাররা যে ৮০৮ কোটি মার্কিন ডলার চুরি করে নিয়ে গেছে, সেই অর্থ উদ্ধারের (১৪ বছরে ১১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে) তেমন কোনো তোড়জোড় নেই। না, বলতে চাই না তোড়জোড় নেই। তবে, সেই আয়োজন রাজনৈতিক কেওয়াজের ঘূর্ণিতে এতটাই নিচে ডুবে আছে যে, আমাদের মিডিয়ার সম্র্রাটরা তার হদিস নিতে ভুলে গেছেন।
এই রকম একজন বিশেষ সুবিধাভোগী আসামির (সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার) ওপর চরম রুষ্ট হলেন কেন? কারণ কি তিনি ও তার পুত্র তারেক রহমানের কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে মিডিয়ায়, এটিই অপরাধ? কিন্তু ওই নাম দু’টি তো আওয়ামী নেতা-নেত্রীরা প্রতিদিনই জপছেন, তাদের কুকীর্তির নামে, খাম্বাচোর বলে টিটকারীও দিচ্ছেন, কিন্তু একবারও উন্নয়নের পরিকল্পনার হরিলুটের ব্যাপারে মুখ খুলছেন না। এটি কি ঠিক হচ্ছে? মিডিয়ার লোকজনও কম যান না, তারা নির্বাচন কমিশনের প্রধানকে জিজ্ঞাসা করেছেন, বেগম জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন কি না। তো, সিইসি বলেছেন, সেটি এখন বলা যাবে না। সময়ই বলে দেবে, পারবেন কি পারবেন না।
এতেই কি প্রধানমন্ত্রী রাগ করেছেন? আমি বলতে পারব না। তবে, এতে তার তো রাগ হওয়ার কথা নয়, তারপরও আমরা ধারণা করি, মূলত দু’টিই তো পক্ষ রাজনীতিতে। এক. আওয়ামী লীগ, দুই. বিএনপি। তৃতীয়পক্ষ হিসেবে ‘ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার’ তকমা-আঁটা’ হিসেবে আছে জাতীয় পার্টি। আর খুচরো দলগুলো এ দু’টি দলের মিছিলে লেজুড় হিসেবে যুক্ত। সংসদে, জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হলেও, তারা যখন ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট ছেড়ে গোস্সা করে নিরপেক্ষ হয়ে বিএনপির ছাতার নিচে রেস্ট নিচ্ছিল, তখন আওয়ামী নেতা তাদের সম্পর্কে বললেন, ‘ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা’। এই বাচ্চাটি কিন্তু গত ১৪ বছর বেশ জমজমাট সার্ভিস দিয়েছে সরকারকে। এখনো দিচ্ছে।
তারা অবশ্য বেগম জিয়াকে নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। গত চার বছর ধরে বিএনপি প্রায় শুয়ে-বসে থেকে বেগম জিয়ার মুক্তির মিছিল, সংগ্রাম করে ক্লান্ত তখন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সহকারী সাধারণ সম্পাদকরা এবং কিছু প্রেসিডিয়াম সদস্য তারেক ও বেগম জিয়াকে নিয়ে নানা রকম কথা (কটূক্তি) বলে দলটিকে খোঁচা দিয়ে দিয়ে রক্তাক্ত করে জাগিয়ে দিচ্ছিলেন। সেই সূত্র ধরেই আজ বেগম জিয়া আবারো নির্বাচন করতে পারবেন কি না তা সরবে উঠে এসেছে মিডিয়ায়।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, এরশাদের পতনের পর তাকেও নির্বাচন করতে দিতে চায়নি বেগম জিয়ার দল বিএনপি। ক্ষমতার মদ-মত্ততায় তারা এতটাই উন্মাতাল হয়েছিলেন যে, খেয়াল করতে পারেননি- উচ্চ আদালতে তা টিকবে না। ক্ষমতা কি রাজনীতিকদের অন্ধ করে দেয়? ইতিহাস কী বলে? হাইকোর্ট তাকে (এরশাদকে) সেই অধিকার দিয়েছেন আইনের সহযোগিতায়। তাহলে কি ভয় এখানেই যে, বেগম জিয়া জেলে কিংবা বাইরে থাকুক, সেটি বড় বিষয় নয়, তিনি নির্বাচন করতে পারলে, জনগণের ভালোবাসা পাবেন। এটিই কি বড় ভয়? রাজনৈতিক ভয়কে জয় করতে রাজনীতিকরা পারদর্শী। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে না, বেগম জিয়ার মতো একজন নেত্রী মাত্র দুই কোটি টাকা মেরে দেবেন। সিটিং প্রধানমন্ত্রী একবার ডাইনে আরেকবার বাঁয়ে তাকিয়ে টাকা কথাটি উচ্চারণ করলে যেখানে শত কোটি টাকা এসে হাজির হতো, (এখন প্রধানমন্ত্রীও যদি তাই করেন, তা হলেও একই ব্যাপার ঘটবে নাকি!) তার পক্ষে কি এতিমের টাকা লুটে নেয়া সম্ভব?
এরশাদ যেমন জেলে বসেই রংপুরের চারটি নির্বাচনী আসনে জিতেছিলেন, যদি বেগম জিয়া জেলে থেকেও নির্বাচনে অংশ নেন বা নিতে পারেন, তাহলে ভোটারদের ভোটের সোহাগ পাবেনই তিনি, এতে কোনো সংশয় নেই। আর তিনি যতবার নির্বাচন করেছেন চার আসনেই জিতেছেন। তার হেরে যাওয়ার কোনো নজির-রেকর্ড নেই। একজন জেনারেলের গৃহবধূ, যিনি রাজনীতি থেকে বহু দূরে ছিলেন, তিনি কোন মন্ত্রে ভোটার জনগণ ও সাধারণ মানুষের মন জয় করলেন? এটি বিস্ময়কর। অন্তত আমাদের দেশের রাজনীতিতে। জেনারেল জিয়া, একজন সেনাশাসক হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। আর সেনাশাসক হয়েও দেশের রাজনীতিকে গণতন্ত্রের আবহাওয়ায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। তার কি বাহার ছিল যে, জনগণ তাকে বিশ্বাস করেছে? ধরুন, জনগণ তাকে ভালোবাসেনি, তিনি ও তার দল রিগিং করে ক্ষমতায় গেছেন এবং ক্ষমতায় গিয়ে দল গড়েছেন, ক্ষমতার রসে সিক্ত হয়ে তাকে নেতা হিসেবে মেনেছে। তিনি যদি পুরোপুরিই রিগিংয়ের ফসল হতেন, তাহলে তার হত্যাজনিত মৃত্যুর পর ১০ লাখেরও বেশি মানুষ কেন তার নামাজে জানাজায় জড়ো হয়েছিল? আসলে জনগণ তো বোকার হদ্দ... সব রাজনীতিককেই বিশ্বাস করে। তাদের কথা শোনে।
অন্য দিকে, যার নামে দেশটির মানুষ স্বাধীনতাযুদ্ধ করে পাকিস্তানি সেনাশাসকদের উৎখাত করে দিয়েছিল ১৯৭১ সালে, সেই মহান গণনায়ক বঙ্গবন্ধুকে উৎখাতে তার পার্শ্বচররা ষড়যন্ত্র করে হত্যা করেছিল। সেই ষড়যন্ত্রের পেছনের কী কী কারণ ছিল, তা খুঁজে দেখতে হবে। তা না হলে তার হত্যা ও জাতির চার নেতার হত্যারহস্য বোঝা কঠিনই হয়ে থাকবে। ৩ নভেম্বর ক্যুদেতা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দেশের বাইরে যেতে দিলেন? কেন তাদের কথা শুনে তাদের দেশের বাইরে যেতে দিলেন? কেন জেলখানার নিরাপত্তা অরক্ষিত ছিল? আর একজন হত্যাকারী মোশতাকের টেলিফোনে করা অর্ডার শুনতে গেল জেলার? আর জেলার ও ডেপুটি জেলার কেন সশস্ত্র হত্যাকারীদের ভেতরে ঢুকতে দিলেন? বন্দীদের হত্যা করার পর কিভাবে আবার নির্বিঘ্নে বেরিয়ে গেল তারা?
আজ আমরা যতই কান্নকাটি করি না কেন, সত্যের গোড়া খুঁজে বের না করলে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র থামবে না। কেন না, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিকরা জনগণ চেনেন না, তারা কেবল ক্ষমতার মসনদটির আরাম দেখতে পান দিবাস্বপ্নে। সেই আরাম যে হারাম সেটি কেউ উপলব্ধি করতে পারেন না।
প্রধানমন্ত্রী তার শপথের পরিপন্থী আজ। কেননা... তিনি শপথ করে বলেছেন, ‘রাগ-অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী’ হবেন না কোনোভাবেই। প্রতিটি নাগরিকের প্রতি তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠার ওয়াদাবদ্ধ সরকারের প্রধান নির্বাহী, শপথকারী। বেগম জিয়ার ওপর রাগ করে এমন কথা বলে তিনি তারই শপথের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানকে নাজুক করে ফেললেন। জনগণের নেত্রীর পক্ষে কি এটি ঠিক হলো? নাকি শোভন হলো?
কথায় আছে- ‘রাগ করলেন তো হেরে গেলেন’। হেরে যাওয়ার চেয়ে মানবিকতাই শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সেই সম্পদের ব্যবহারই আমরা দেখতে চাই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা