১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

শিক্ষা সংস্কারে শায়খ সুলতান যওক নদভির যুক্তিধারা

লেখক : ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন - ফাইল ছবি

আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভি এ দেশেরই এক কৃতী সন্তান। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। লেখক, কবি, মুহাদ্দিস ও ভাষাবিদ হিসেবে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। তার লিখিত বহু গ্রন্থ মাদরাসায় সিলেবাসভুক্ত। আরব ভূখণ্ডের বাইরে জন্ম লাভ করেও উপমহাদেশে যারা স্বীয় সৃজনশীল প্রতিভাবলে আরবি সাহিত্যকে পুষ্ট করেছেন- তিনি তাদের প্রথম সারির একজন নিঃসন্দেহে। আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজয়ী স্বভাবজাত কবি আল্লামা সুলতান যওক নদভির সম্পাদিত আরবি সাময়িকী ‘আস-সুবহুল জাদিদ’ ও ‘বালাগুশ শারক’ বিশ্বের আরবি ভাষাভাষীদের চেতনা ও মননশীলতায় চমক সৃষ্টি করেছে, এনেছে বাংলাদেশের জন্য বিপুল খ্যাতি। পশ্চাদমুখিতার যে পরিমণ্ডলে তিনি লালিত-বর্ধিত, আশ্চর্যজনকভাবে এর ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন। তার শৈল্পিক চেতনায়, সমৃদ্ধ চিন্তায় ও উপমা উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্বে একটি সর্বজনীনতার রূপ ফুটে উঠেছে- যা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বহু বছর আগে খ্যাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদ ‘খতিবে আজম’ মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ তার উপযুক্ত শিষ্য আল্লামা সুলতান লিখিত ‘কুল্লিয়াতে যওক’-এর ভ‚মিকায় এক চমৎকার কথা লিখেছেন, ‘আমার দেশে এমন সম্ভাবনাময়ী সন্তানের উত্থানে আমি গর্ববোধ করি, দোয়া আসে অন্তর থেকে- তুমি হাজার বছর বেঁচে থাকো, ওই বছরের প্রতিদিন হোক আবার হাজার বছর।’ আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভি প্রায় ৬০ বছর কওমি মাদরাসায় আরবি ভাষা, ব্যাকরণশাস্ত্র, সাহিত্য ও হাদিসের দারস দেন।

শিক্ষা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। চট্টগ্রাম পটিয়া আল-জামেয়া আল-ইসলামিয়ার আধুনিক আরবি ভাষা বিভাগের প্রধান ও মুহাদ্দিস হিসেবে বহু বছর কর্মরত ছিলেন। এরপর চট্টগ্রাম শহরে প্রতিষ্ঠা করেন দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া নামক আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ওই মাদরাসার তিনি প্রধান পরিচালক ও শায়খুল হাদিস। তিনি সবসময় শিক্ষা, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ, দেশ ও মিল্লাতের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও যুগচাহিদা নিয়ে ভেবেছেন, একটি রূপকল্প তৈরি করেন এবং যুক্তি দাঁড় করেছেন। সে চিন্তা থেকে তিনি চট্টগ্রাম শহরে ‘দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া’ নামে একটি ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কায়েম করেন।

এখানে উচ্চতর দ্বীনী তালিম বিশেষত তাফসির, হাদিস, আরবি ভাষা, সাহিত্য, ফিকহের পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, তথ্যপ্রযুক্তি ও সাংবাদিকতার কোর্স রয়েছে। এখানে নির্দিষ্ট কোর্স শেষ করে শিক্ষার্থীরা মিসরের আল-আজহার, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়, মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়, মদিনার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, জেদ্দার কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়, রিয়াদের ইমাম মুহাম্মদ বিশ্ববিদ্যালয় ও কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স, এমএ ও পিএইচডি পর্যায়ে অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করে। ১৯৮৩ সালে যুগের ডাকে সাড়া দিয়ে শিক্ষা পদ্ধতির পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনার ওপর তিনি প্রবন্ধ রচনা করেন, যা আরবি সাময়িকী ‘আস-সুবহল জাদিদ’-এর সম্পাদকীয় বিভাগে ছাপা হয়। মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রমকে ঢেলে সাজানোর তার যে চিন্তাদর্শন তার চুম্বকাংশ তুলে ধরছি-
‘বিশ্বের প্রতিটি জাতির জন্যই একটি নিজস্ব শিক্ষা পদ্ধতি থাকে- যা তাদের জাতীয় মৌলিক বিশ্বাস, মূলনীতি ও অতীত ঐতিহ্যের ছাঁচে ঢালাই করা হয়। এটি জাতীয় জীবনের এমন এক পোশাক যা গোটা জাতিসত্তাকে মাপজোক করে তৈরি করা হয়েছে- তা সঙ্কীর্ণ যেমন নয়, তেমনি ঢিলেঢালাও নয়।

কমিউনিস্টদের একটি নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। এটিই তাদের জাতীয় বিশ্বাস ও চিন্তাধারার প্রতিচ্ছবি এবং সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদের প্রবক্তাদের দৃষ্টিভঙ্গির আয়নাস্বরূপ। অনুরূপভাবে পুঁজিবাদী ও পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্যও স্বতন্ত্র শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, যা তাদের জাতীয় বিশ্বাস ও মূলনীতিকে জ্ঞানগত এবং চিন্তাধারার দিক থেকে অনুকরণ করে। বস্তুত প্রতিটি মানবগোষ্ঠীই নিজের জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যকে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে হেফাজত করার জন্য সচেষ্ট থাকে। সুতরাং কোথাও দেখা যাবে না যে, কমিউনিস্ট ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো বাইরে থেকে শিক্ষা পদ্ধতি আমদানি করেছে। তারা কোনো দেশ থেকে শিক্ষা পদ্ধতি ধার করতে রাজি হবে না যে সব দেশ তাদের বিশ্বাসে বিশ্বাসী নয় এবং তাদের মতবাদকে আঁকড়ে ধরে নেই এমন কি সর্বক্ষেত্রে সভ্যতা-সংস্কৃতির অবাধ বিনিময়কে তারা আকস্মিক বিপদ বলে গণ্য করে; বরং তাদের দৃষ্টিতে এটি এমন এক অবিচার যার কোনো ক্ষতিপূরণ নেই। যেখানেই এ ধরনের কোনো ধার করা ব্যবস্থা চালু করা হয় সেখানে সন্দেহ-সংশয়, ভাঙন, বিচ্ছিন্নতা, গৃহযুদ্ধ ও এ ধরনের আরো বহু ধ্বংসাত্মক কাজের অনুপ্রবেশ ঘটে।’

‘কিন্তু অতি দুঃখ ও আফসোসের বিষয়, আজ ইসলামী দেশগুলো তাদের নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থাকে হারিয়ে ফেলেছে। ফলে জীবন এক আশ্চর্যজনক সমর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদের প্রচেষ্টা বরাবরই ব্যর্থতার সম্মুখীন হচ্ছে। চলছে মুসলিম জাতির মৌলিক ভাবধারার মধ্যে পশ্চিমা জগৎ থেকে ধার করা দর্শন। আর এখানে মুসলিম যুবগোষ্ঠী লক্ষ্যহীনের মতো দিশেহারা হয়ে ঘুরছে। মুসলমানদের জন্য কোনোক্রমেই উচিত ছিল না পাশ্চাত্যের অনুকরণ করে চলা এবং অন্যের দুয়ারে জীবন-ব্যবস্থা ধার করার জন্য হাতপাতা। কারণ ইসলাম তো বৈরাগ্যবাদ নয়- এটি এক অর্থে ধর্ম, অন্য অর্থে মানুষের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা; বরং ইসলাম হচ্ছে বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয়। ইসলামী শিক্ষা ও সাহিত্য আল্লাহর দেয়া আসমানি পদ্ধতির অনুগত; এর সাথে কোনো মানবরচিত জীবনব্যবস্থার সম্পর্ক ও তুলনা নেই।

সত্যিকার ইসলামী জীবনই তো সর্বোত্তম চরিত্র, মূল্যবোধ ও আদর্শে ভরপুর থাকে। এ ধরনের আদর্শ জীবনই তো মানবীয় উন্নতি ও মর্যাদার প্রতিটি শাখায় সুসমৃদ্ধ থাকে। আমাদের অবাক লাগে, ইসলামের সন্তানদের অবস্থা দেখে। মনে হয়, তারা যেন আজ পাশ্চাত্যের কোলের সন্তান। তাদের কচি কচি সিংহ শাবক আজ মিশনারি স্কুলে শিক্ষা-দীক্ষা লাভ করছে। ইসলামের শত্রুদের দেশে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা সফরে গিয়ে তারা আনন্দ লাভ করছে। তাদের স্কুল-কলেজের জন্য বাইর থেকে শিক্ষা পদ্ধতি আমদানি করছে অথবা ওই শিক্ষা পদ্ধতিকে ইসলামী দেশগুলোর ভেতরে দুশমনদের নীলনকশা অনুযায়ী প্রবর্তন করছে- যে ব্লু-প্রিন্ট দুশমনরা ইসলামের জাগ্রত চেতনাকে জবাই করার জন্য এবং শাশ্বত ঐতিহ্যকে মিটিয়ে দেয়ার জন্যে তৈরি করেছে।’ (আস-সুবহুল জাদিদ)

‘মুসলিম যুবকদের অন্তরে পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতির ভালোবাসায় শিকড় গাড়ে তখন তারা আপন সত্তা ও ধর্মের প্রতি পূর্ণ মনোবল এবং আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নতের ওপর আস্থা ও নির্ভরতা হারিয়ে ফেলে। সর্বোপরি ইসলামের শাশ্বত আহ্বান ও সর্বকালে ইসলামের কার্যকারিতার বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে।’ আদর্শের সঙ্ঘাতের আগুন জ্বলছে এখন প্রতিটি মুসলিম দেশে প্রত্যেক শ্রেণীর মধ্যে। সঙ্ঘাত আজ শাসকগোষ্ঠী ও শাসিত বৃহত্তর জনগণের মধ্যে, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ও অশিক্ষার দ্বারা প্রভাবিত শ্রেণীর মধ্যে, আধুনিক সভ্যতায় অভ্যস্ত ও ইসলামী তাহজিব তামাদ্দুনের ঐতিহ্যধারী শ্রেণীর মধ্যে। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে সরকারি মাদরাসা ও কওমি মাদরাসার মধ্যে এক প্রকার সঙ্ঘাত চলেছে।

এটিই হচ্ছে বর্তমান যুগের একমাত্র সঙ্কট যে কারণে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের ওপর আজ অনিবার্য হয়ে পড়েছে এ দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তির পন্থা পর্যালোচনা করে দেখা এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের ইসলামের চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির পথে ফিরিয়ে আনার পথ রচনা করা। এ সঙ্কটের ভিন্ন ভিন্ন কোনো সমাধান নেই।

কারণ ইসলাম সব ধরনের পরিকল্পনা ও নীলনকশাকে অনুমোদন করে না; বরং একমাত্র ওই পদ্ধতিকেই অনুমোদন করে যা আল্লাহর কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহর সাথে একাত্ম, ইসলামের ভিত্তি ও মূলনীতির অনুগত এবং সরল সঠিক আসমানি নকশার ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত। বস্তুত এটিই হলো একমাত্র সমাধান- তা যতই কঠিন ও জটিল হোক না কেন এবং যত বেশি ধৈর্য, প্রচেষ্টা ও পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন হোক না কেন। এটি হচ্ছে শিক্ষা, দীক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও জীবনব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আমদানি করা বিদেশী মতবাদ ও পদ্ধতিকে পরিবর্তন করে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইসলামী জীবন ব্যবস্থা নতুন সাজে প্রবর্তন করা। এই জীবন ব্যবস্থা উৎসারিত হবে ওই আকিদা বিশ্বাস মূলনীতি ও মূলবোধ থেকে যা ঈমানেরই অংশ। (মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের ডাক, ঢাকা-১৯৮৫, পৃষ্ঠা : ৭-১০)

একটি সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভি বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, একটি মজবুত শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা- যা কুরআন, হাদিস ও ধর্মীয় গুরুত্বের মধ্যে এবং সত্যিকার কল্যাণময় আধুনিক জ্ঞান ও সাহিত্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে। এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রয়েছে যথেষ্ট তত্ত¡-তালাশ, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, ইসলাম ও আধুনিক জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের সঠিক পর্যালোচনা, আরো প্রয়োজন রয়েছে- এমন পরিপক্ব লোকদের দিয়ে ইসলামী মূলনীতির ভিত্তিতে সময়োপযোগী ব্যাপক রচনা ও সম্পাদনার কাজ আঞ্জাম দেয়া যেসব লোক হবেন অত্যন্ত সুদক্ষ, ঈমানে ও জ্ঞানে পরিপক্ব এবং ইসলামের আধ্যাত্মিক রসে পরিতৃপ্ত। এতদুদ্দেশ্যে- ক. বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন কায়েম করা; খ. সম্মেলন ও শিক্ষা প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা এবং গ. জ্ঞানে ও যোগ্যতায় সুদক্ষ ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করা। এসব কর্মতৎপরতা কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা উম্মতের কিছু সংখ্যক লোকের দ্বারা সুসম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়; বরং বেশির ভাগ কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য ইসলামী সরকারগুলোকেই বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে।

তখনই আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে এমন সব কৃতী সন্তান জন্ম নেবেন যারা সব ধরনের শূন্যস্থান পূর্ণ করবেন এবং সর্বক্ষেত্রে যোগ্যতার সাথে যেকোনো কাজ আঞ্জাম দিতে সক্ষম হবেন। তার পরই প্রকৃত স্বাধীন ইসলামী ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি হবে এবং প্রত্যেক মুসলমান সত্যিকার মুসলমান রূপে গড়ে উঠতে পারবে। এভাবে গোটা বিশ্বের মুসলমানরা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হবে ইনশা আল্লাহ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১১)

বর্তমান বাংলাদেশের মাদরাসাগুলোতে বিরাজমান সমস্যাবলির ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভি বলেন, ‘মূলত এটি এমন একটি বিপদ, যা দীর্ঘদিন থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আক্রান্ত করে রেখেছে। বস্তুত এসব মাদরাসার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক এই বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে আছেন যে, শিক্ষা পদ্ধতি মোটেই পরিবর্তনযোগ্য নয়। তারা এই স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছেন, পূর্ববর্তীদেরকে যে অবস্থায় পেয়েছেন অন্ধভাবে হুবহু তাকেই অনুসরণ করে যাবেন। অথচ এটি পৌরাণিকতার প্রতি অতিশয় অন্ধভক্তি, মূর্খতা ও অজ্ঞানতাকে আঁকড়ে ধরা ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে এটি ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য ক্ষতি করা ছাড়া আর কিছু নয়। স্বয়ং আল্লাহ পাকের নীতি হচ্ছে, মুসলমানদের সমস্যাদি কোনো একটি সীমারেখায় সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং একের পর এক নিত্যনতুন আসতে থাকবে। আর তা বান্দাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়তের আলোকে সমাধানযোগ্য। এ জন্যই কোনো শিক্ষার মৌলিক উপাদানও একটি বিশেষ ছাঁচে বা কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। ইসলামের একটি নিজস্ব বিশ্বাস ও মতাদর্শ রয়েছে যা মোটেও পরিবর্তনশীল নয়। কিন্তু ইসলামের কাছে এমন শিক্ষাব্যবস্থা অবশ্যই রয়েছে, যা পাথরের মতো জমাটবদ্ধ নয়; বরং উন্নতির পথে পরিবর্তনশীল। আর এটিই ছিল ইসলামের প্রভাতকাল থেকে চিরাচরিত নিয়ম। ইসলামের শুরুতে শিক্ষা-দীক্ষার মৌলিক উপাদান ছিল আল্লাহর কুরআনের কয়েকটি মাত্র আয়াত। অতঃপর হজরত নবী করিম সা:-এর প্রতি যতই ওহি নাজিল হচ্ছিল ইসলামী শিক্ষার উপাদানের পরিধিও তৎসঙ্গে বাড়ছিল। আর কোনো কোনো সময় কতক আয়াত ‘মানছুখ’ (রহিত) হতো এবং তদস্থলে নতুন আয়াত স্থলাভিষিক্ত হতো। এরপর হজরত রাসূলুল্লাহ সা:-এর পবিত্র হাদিস ইসলামী শিক্ষার মধ্যে সংযোজিত হলো এক নতুন উপাদান হিসেবে। এভাবে পরবর্তী সময়গুলোতেও সাহিত্য ও জ্ঞানের সুবিন্যস্ত বিষয়াদি নতুন উপাদান হিসেবে সংযোজিত হলো। তাহলে তারা এ সূত্র কোথায় পেলেন যে, শিক্ষার নিয়ম পদ্ধতি বা পাঠ্যতালিকা কমবেশি হতে পারবে না বা পরিবর্তন করা যাবে না। অথচ খোদ ঈমানের মানও কমবেশি হতে পারে বলে ইসলামী শরিয়তে স্বীকৃত হয়েছে। শরিয়ত কি নিজস্ব ধারায় ক্রমোন্নতি এবং সময়ের ডাকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সাড়া দেয়ার অনুমতি দেয়নি? বস্তুত সময় বিশেষে শিক্ষাপদ্ধতিতে কোনো উপাদান বৃদ্ধি করা বা কমানো বা প্রয়োজনবশত কোনো পুরনো কিতাবকে নতুনভাবে রচিত অধিক সুন্দর ফলদায়ক ও সময়োপযোগী কিতাব দিয়ে পরিবর্তন করার আবশ্যকতা দেখা দেয়। আর এ ধরনের বাস্তব সত্য থেকে চোখ বুঁজে থাকা কিভাবে জায়েজ হতে পারে? আমাদের বুঝে আসে না। শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে সামান্য অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিও এ সত্যকে অস্বীকার করতে পারবেন না, আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে যে ধরনের আরবি সাহিত্য পড়ানো হয় তা আরবি ভাষায় স্বাধীনভাবে কিতাব রচনা কিংবা কথাবার্তা বলার যোগ্যতা সৃষ্টি করতে অক্ষম; বিশেষ করে বর্তমান আধুনিক বিশ্বে যুগ-জিজ্ঞাসার আলোকে। এমনকি এসব পাঠ্যকিতাব বর্তমান আরব বিশ্বে প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির সাথেও কোনো রকম খাপ খায় না। দেশের বিদগ্ধ ও শিক্ষিত সমাজের কারো অজানা নয়, আমাদের বর্তমান দ্বীনী শিক্ষা পদ্ধতিতে বেশ কিছু দুর্বলতা ও ব্যর্থতার কারণ পাওয়া যাচ্ছে যা আজ ও গতকালের সৃষ্ট নয়; বরং বহুকাল কেটে গেছে এসব দুর্বলতা দেখা দিতে। ফলে আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি ক্রমে কর্মহীন ও অকেজো হয়ে পড়েছে। শিক্ষা যা সমাজ গঠনের মূল বা জাতির মেরুদণ্ড, তা আজ বেকার ও কর্মহীন হতে চলেছে। যুগ আমাদেরকে ডাক দিয়েছে, আমরা কর্ণপাত করিনি বা প্রয়োজনবোধ করিনি এই চিন্তামূলক আহ্বানকে গুরুত্ব দেয়ার। ধীরে ধীরে রোগ বেড়েই চলেছে, এমনকি চরম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ১২-১৩)

বাংলাদেশের বর্তমান যুগের ওলামা ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের উচিত, বিচার-বিবেচনা করে এমন এক শিক্ষা পদ্ধতি আবিষ্কার করা যা- ক. এখানকার মেজাজ অনুযায়ী হয়; খ. বর্তমান দ্বীনী মাদরাসাগুলোর ব্যর্থতার সঠিক চিকিৎসা হয় এবং গ. যেন মুসলিম জাতির দ্বীনী, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনাবলি পূরণ করতে সাহায্যকারী প্রমাণিত হয়। মাদরাসা প্রকৃতপক্ষে মানুষ তৈরির কারখানা। আল্লাহর নাম নেয়ার মতো লোকদের অস্তিত্ব এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে বাকি আছে; কিন্তু কেবল এর ওপর সন্তুষ্ট হওয়া কোনো মতেই উচিত নয়। কেননা এসব প্রতিষ্ঠানের আসল উদ্দেশ্য দুনিয়ার বুকে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করা।

ইসলামের বিজয় পতাকা উড়তে থাকুক পুরো পৃথিবীতে, আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক দৃঢ় হোক, এটিই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির উদ্দেশ্য। সালফে সালেহিনদের তরিকার হেফাজতের সাথে যদি সিলেবাসে প্রয়োজনীয় রদবদল করা হয় এবং ওই পদ্ধতিতে দাওয়াত ও প্রচারের মেজাজ প্রাধান্য থাকে, মাদরাসা ও খানকাহের সঙ্কীর্ণ মনোভাবকে দূরে রেখে আন্তর্জাতিক চিন্তাধারা ও দূরদর্শিতার সাথে কাজ করা হয় (লোকে যা বলুক না কেন) হয়তো এতে আল্লাহ ও রাসূল রাজি হবেন এবং ইসলামের মুজাদ্দিদিন ও মুজতাহিদিনদের রূহ সন্তুষ্ট হতে পারে। (মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের ডাক, ঢাকা-১৯৮৫, পৃষ্ঠা : ১৮-১৯)।

আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভির চিন্তাধারা শিক্ষা সংস্কারে আমাদের ভাবনাকে শাণিত করবে। তার মতে, বিজাতীয় সংস্কৃতির অন্ধানুকরণের প্রবণতা পরিত্যাগ করতে হবে। যুগচাহিদার প্রেক্ষাপটে মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা সিলেবাসে পরিবর্তন, মুসলমানদের লালিত ঐতিহ্যও কৃষ্টিকেন্দ্রিক পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করতে হবে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত এমন শিক্ষা দেয়া দরকার যাতে তাওহিদ ও রিসালাতের ভিত মজবুত থাকে। দারসে নিজামির মৌলভিত্তির ওপর এমন এক শিক্ষাক্রম তৈরি করতে হবে, যাতে মাদরাসায় পড়া জনগোষ্ঠী সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করতে সমর্থ হয়। শিক্ষার গোড়ায় যদি গলদ থেকে যায় নাস্তিক্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, এটিই শায়খ সুলতান যওক নদভির শঙ্কা ও উদ্বেগ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল