তারি দু’চারিটি অশ্রুজল
- জয়নুল আবেদীন
- ২৯ অক্টোবর ২০২২, ১৯:৫৪
[পূর্ব প্রকাশের পর]
অসহায় ছাগশিশু সখেদে বলতে শুরু করে-
-হে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক, জগৎ স্রষ্টা, কেন তুমি আমায় সবার ভক্ষ্য করে পাঠালে? যে আমাকে সামনে পায় সেই আমাকে খেতে চায়।
-হে ক্ষুদ্র বৎস্য, আমার সৃষ্টিকে দোষ দিয়ে লাভ কী! তোমার ছোট্ট-সুন্দর কমলকান্ত চেহারার দিকে তাকালে আমি নিজেই বেসামাল হয়ে পড়ি।
এই অসহায় ছাগশিশুর মতো, এখান থেকে তাদের ক্ষীণ কান্নার আওয়াজ আর ওপরে পৌঁছে না। আজীবন বঞ্চনা, যন্ত্রণা, ক্ষোভ ও হতাশায় উৎপীড়িতের ক্রন্দন দূর আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয়। ফলে সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে রাষ্ট্রের চেহারা গোদ রোগীর মতো কিম্ভূতকিমাকার ধারণ করে। উদাহরণ হিসেবে সোমালিয়ার মতো দেশের কথা উল্লেখ করা চলে। দেশকে সোমালিয়া হওয়া থেকে বাঁচাতে হলে সবার আগে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সবার আগে- একজন বিচারককে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তিনি কে?
প্লেটোর দর্শনে সবার ওপরে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল বিচারককে। একজন বিচারককে অবশ্যই প্রজ্ঞাযুক্ত হতে হবে। প্রজ্ঞাহীন বিচারকের বিচ্যুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল তখনই। বিচারকের মনের দুশমন দূর করে প্রজ্ঞাবান ও বীর্যশালী করতে সভ্যতার উন্মেষকাল থেকেই সাধনা চলে আসছে। বিচারকের মনে প্রজ্ঞা প্রবিষ্ট করতে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকগণ কত উদ্ভট প্রস্তাব করতেন। সৈনিকদের ব্যারাক থেকে নিরোগ শক্তিশালী সৈনিক খুঁজে বের করে একই রকমের যুবতীদের সাথে মিলনের ব্যবস্থা করতে হবে। ওরা কোনোভাবেই যেন পরস্পরকে চিনতে না পারে। এ অশুদ্ধ মিলনের দ্বারা প্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় শিশুদের শৈশব থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত উন্নত পর্যায়ের দেহ-মন গঠনের জন্য দর্ম-দর্শনসহ সব রকম শিক্ষা দেয়া হবে। এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পালা। সব রকমের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ সাফল্যধারীই হবেন প্রজ্ঞার অধিকারী।
দর্শনের পরে আসে ধর্ম। ধর্ম সরাসরি নাকচ করে দেয় দর্শনের প্রস্তাবকে। তার পরিবর্তে- প্রত্যেক ধর্ম বিচারকের জন্য আলাদা পুরস্কার ও তিরস্করের ব্যবস্থা রেখেছে। একজন বিচারকের একটা ন্যায়বিচারের দ্বারা অর্জিত শ্রেষ্ঠতা, হাজার বছরের এবাদতের দ্বারা অর্জিত শ্রেষ্ঠতাকে পেছনে ফেলে দেয়। আর এর বিপরীত কর্মের দ্বারা সারা জীবনের অর্জন খুইয়ে নরকের সুন্দর পুচ্ছধারী মলমূত্রভূক পাখিতে পরিণত হতে হয়।
সিরডাপ মিলনায়তনে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় ‘আইনের শাসনের ভ‚মিকা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলে গেছেন, ‘দুর্নীতি এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তার লাভ করেছে। দেশের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, বিভাগ নেই যেখানে দুর্নীতির কালো থাবা গ্রাস করেনি। রাজনীতিবিদরা হয়েছেন ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ীরা হয়েছেন রাজনীতিবিদ। এ সবই ঘটেছে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে জনস্বার্থের বিপরীতে (দৈনিক আজকের কাগজ ২৯ জুলাই ২০০৭)
বারদী এলাকার এক মামলায় ঈশপের
গল্পের প্রতিফলন
ভিকটিম রহিমা, বয়স ৮ বছর। আসামিরা জুইত্তার শলা খুলতে না পেরে মাছের মতো টেনে রহিমাকে আসামিদের বাড়ি নিয়ে যায়। ডাকচিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এসে জুইত্তার শলা বিদ্ধ অবস্থায় রহিমাকে উদ্ধার করে। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক মাংস কেটে জুইত্তার শলা বের করে। অভিযোগপত্র দায়েরের পর অতিরিক্ত জেলা হাকিমের আদালতে বিচার হয়। বাদী, ভিকটিম (রহিমা), ডাক্তার ও তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনার সমর্থনে সাক্ষ্য প্রদান করেন। ভিকটিম রহিমা কোর্টে হাজির হয়ে সাক্ষ্য প্রদানকালে অনেক লোক রহিমার করুণ কাহিনী শোনেন। বিচারক মেয়েটির পরিধেয় কাপড় সরিয়ে স্বয়ং জখম পরীক্ষা করেন। জখমি স্থানের আশপাশে ছোট ছোট আরও জখমের চিহ্ন থাকার কারণ জানতে চান বিচারক। উত্তরে ভিকটিম,
- আমাকে বিবাদীদের বাড়িতে নিয়ে জুইত্তার শলায় বাঁধা রশি ছিঁড়ার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়ে ব্লেড দিয়ে মাংস কেটে শলা বের করতে চায়। আমি ব্যথায় ডাক-চিৎকারসহ বাম হাত দিয়ে ব্লেড ঠেকানোর চেষ্টা করি। এতে ব্লেড লেগে আমার হাতও কেটে যায় (বলেই বাম হাতের নিচের অংশ তুলে ধরে। আসামির নাম প্রকাশসহ কাঠগড়ায় শনাক্ত করে। বিচারক নিজেও সাক্ষীকে নানাভাবে পরীক্ষা করেন)।
এ মামলায় শাস্তি অনিবার্য জেনে আসামি পক্ষ থেকে আপসের প্রস্তাব আসে। বাদি গরিব। তাই আপসে আমরাও সম্মত হই। বিবাদিপক্ষ বাদিপক্ষকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২০ হাজার টাকা দিতে সম্মত হয়। বাদি এ টাকায় আপস করতে অস্বীকার করে বলে,
- মাইয়ার চিকিৎসা থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত আমার খরচই হয়েছে বিশ হাজার টাকার বেশি।
- আমরা ২০ টাকা থেকে এক টাকাও বেশি দেবো না (তর্কাতর্কি শুরু দুই পক্ষের মধ্যে। তর্কের একপর্যায়ে আসামিপক্ষ আপস মীমাংসার সভা থেকে উঠে যায়। যাওয়ার সময় বলে যায়, এই ২০ টাকা তোদের না দিয়ে আল্লাহর নামে খরচ করে দেবো)।
মামলার রায় ঘোষিত হলো। রায়ে সব আসামি বেকসুর খালাস। রায় শুনে সবাই বলাবলি করতে থাকে, আসামিরা আল্লাহর নামে খরচ করেছে, আল্লাহই আসামিদের খালাস দিয়েছে (বিচারের বাণী ১৫০-১৫১)
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার পর বিচারপতি মোস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষ বিচার কে চালাচ্ছেন, প্রশাসনের লোক না বিচার বিভাগের লোক, এত জটিলতায় যেতে চ্য়া না। তারা চায় হয়রানি না হোক, ঘুষ দুর্নীতি বন্ধ হোক, মামলার দ্রুত বিচার হোক ও ন্যায় বিচার হোক’ (দৈনিক প্রথম আলো ০১ নভেম্বর ২০০৭)।
অপরাধী অপরাধের চিহ্ন রেখে যায়
‘ঢাকা থেকে যে বিচারকের সাথে মাঝে মাঝে এক সাথে আসা-যাওয়া করতাম সে বিচারক একজন পাঠকও। আমার লেখা বইগুলো তিনি এ-টু-জেড পড়ে ফেলেছেন। দুই মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে তার ছোট্ট পরিবার। বড় মেয়ে জিপিএ ফাইভ পেয়ে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাস করেছে। মামলা মোকাদ্দমার বিষয়ে আলাপের চেয়ে বই পুস্তক বিষয়ে আলাপ বেশি হয়। কোর্ট চলাকালে কোনো কারণে তার কোর্টে প্রবেশ করলে তিনি কাজের ফাঁকে ইশারায় আমাকে সালাম জানাতেন। এত উকিল পেশকারের ভেতর এজলাস চলাকালে একজন বিচারক একজন উকিলকে ইশারায় সালাম নিবেদন করলে উকিলের বিব্রত হওয়ার কথা। আমিও বিব্রত হতাম।
আমাদের নারায়ণগঞ্জ কোর্টের ভালো ইংরেজি জানা একজন সিনিয়র আইনজীবীর বিপক্ষে ছানি মোকদ্দমার শুনানি তার কোর্টে চলছিল। সিনিয়রের অক্সফোর্ডের জ্বালাময়ী ইংরেজি ভাষার কাছে আমার শান্তিপুরের মমতাময়ী বাংলা ভাষা ন্যাড়া-ন্যাড়া ঠেকছিল। মনে হচ্ছিল, অত্যাধুনিক কামান-বন্দুকের সামনে ঢিল গুলতি হাতে লড়তে নেমেছি। আমার দিশেহারা অবস্থা লক্ষ্য করে শুনানির শেষ দিকে তিনি জানালেন-
-সিনিয়র যত ইংরেজিই বলুক, বাংলার জয় হবে।
আইনজীবীদের কেউ কেউ আমাদের আন্তরিকতার বিষয়টি জানতে পেরে কাজে লাগাত। বিচারকের সাথে পরিচয়টা অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসাবে ধরে তারা বেশ কিছু মামলায় আমাকে দিয়ে যুক্তিতর্ক ও জামিন শুনানি করায়। আমাদের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি কাজে লাগিয়ে অপরাপর আইনজীবীদের ফায়দা নেয়ার বিষয়টি টের পেয়ে সাবধান হয়ে পড়ি। মানুষ মাত্রই একটা স্থান আছে। লেখকের দুর্বল স্থান পাঠক। একজন ভালো পাঠক হিসেবে আমারও দুর্বলতা রয়েছে। ভালো পাঠক হিসেবেই বিচারকের সাথে সখ্য গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। এমনই ঘনিষ্ঠতাকালে একদিন আমার সহকারী দৌড়ে এসে,
-স্যার, শুনানির জন্য সময়ের আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে, ওই পক্ষের আইনজীবী সাহেব শুনানি শুরু করে দিয়েছেন- তাড়াতাড়ি যান।
‘আমার সহকারীর কাছে এ খবর শুনে আমি বিস্মিত হই। একটা আপিল মোকদ্দমা। মোকদ্দমায় আমি বাদি রেসপনডেন্ট। বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে শুনানির জন্য সবে মাত্র বদলি হয়েছে। মামলাটি বদলির পর আজই প্রথম তারিখ। এ সময় কোনো একপক্ষের দরখাস্ত নামঞ্জুর করে শুনানি করার ঘটনা বিরল। এ খবর শুনে ঝুলিয়ে রাখা গাউন টান মেরে কোর্টের উদ্দেশে রওনা হই। গাউন গায়ে চড়াতে চড়াতে আমি যখন সংশ্লিষ্ট আদালতের দরজা দিয়ে ঢুকছি তখন বিপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী সাহেব শুনানি শেষ করে আদালত কক্ষ থেকে বের হচ্ছেন। এজলাসে প্রবেশ করার পর আমাকে লক্ষ করে বিজ্ঞ বিচারক বলেন-
- জয়নাল সাহেব শুনানি করে ফেলেন, আপিলকারী পক্ষ শুনানি করে গেছে।
- স্যার, আমি সময়ের আবেদন করেছিলাম।
- নামঞ্জুর হয়েছে। দেখুন আমি আর অল্প ক’দিন আছি। রেডি কিছু মামলা শুনানি করে যেতে চাই। আপনি শুনানি করুন।
- স্যার, আপিল মামলা। আপিল দায়ের করার পর আপনার আদালতে সম্ভবত আজকেই প্রথম তারিখ। আপনার আদালতে দু’তিন বছরের আপিল মামলাও শুনানির অপেক্ষায় আছে। সেসব বিষয় ভেবে আজকেই শুনানি হয়ে যাবে, ভাবতে পারিনি। স্যার, আমার পক্ষও আসেনি, আর আমি প্রস্তুতি নিইনি। দয়া করে সময় না দিলে আমার পক্ষের অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হবে। স্যার, সময়ের আবেদন পুনঃবিবেচনার জন্য একটি দরখাস্ত দিচ্ছি, অনুগ্রহ করে মঞ্জুর করবেন।
- আমি হিয়ার্ড (শুনলাম) লিখে ফেলেছি। পুনঃবিবেচনার দরখাস্ত মঞ্জুর করা যাবে না। আপনি শুনানি করুন। আপনি শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়ে না থাকলে আগামীকাল শুনানি করে দিন, আমি আজকের তারিখেই হিয়ার্ড লিখে রাখছি।
নিরুপায় হয়ে তাই করলাম। আগামীকাল শুনানি করে দেবো, সম্মত হয়ে চলে আসি। ফোন নাম্বার খোঁজ করে পক্ষকে আসতে বলে শুনানির জন্য প্রস্তুত হই। পর দিন মোকদ্দমার পক্ষ আসে। শুনানি করার জন্য সবাই আগে সংশ্লিষ্ট কোর্টে প্রবেশ করি। বিজ্ঞ বিচারক আদালতে বসতে তখনো অনেক বাকি। কোর্টের পেশকার সাহেব আমাকে লক্ষ করে বলেন-
- কী জন্য এসেছেন?
- আপিল শুনানি করতে।
পেশকার সাহেব কজলিস্ট (প্রতিদিনের মামলার তারিখ সম্বলিত ডাইরি) আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলেন-
- আপনি কিসের শুনানি করবেন? আপনার গতকালের মামলায় আদেশ হয়ে গেছে।
কজলিস্টে চোখ রেখে দেখি, গতকালের তারিখে লাল অক্ষরে ‘আপিল মঞ্জুর’ শব্দ দুটো লেখা হয়ে গেছে। তা দেখে বিস্মিত ও আতঙ্কিত হয়ে জানতে চাই-
- বিজ্ঞ আদালত তবে যে আজকে শুনানি করতে বললেন?
- স্যারের বদলির আদেশ হয়ে গেছে; তাই এই ক’দিনে সব মামলা শেষ করে যেতে চান।
- তবে যে ৩-৪ বছর আগের আপিল রয়েছে সেগুলো শুনছেন না কেন?
- যেসব মামলায় পক্ষের আগ্রহ নেই সেসব মামলা শুনতে যাবেন কেন?
আমাদের কথোপকথনের সময় বিচারক তার খাস কামরায়ই ছিলেন, অনুমতি নিয়ে খাস কামরায় প্রবেশ করি। আদেশ জানার বিষয়টি গোপন রেখে-বিনীতভাবে প্রশ্ন করে জানতে চাই-
- স্যার, আপিল শুনানিটা কোর্ট বসার প্রথম দিকে শুনবেন না শেষ দিকে শুনবেন?
- প্রথম দিকেই করে দিন।
- স্যার, শুনলাম আপলি মামলায় আদেশ দিয়ে ফেলেছেন এবং তা কজলিস্টেও উঠানো হয়ে গেছে!
আমার এ কথায় বিচারক চমকে ওঠেন। একটু থামেন। তারপর বলেন-
- এরপরেও আপনি শুনানি করেন।
- হোয়াট? একটা মামলা আদেশ হয়ে যাওয়ার পরেও আমাকে শুনানি করতে বলেন? কিন্তু কেন?
- আপনি শুনানি করেন, দেখেন আমি কী করি।
বিচারকের এ কথায় একই আদালতে ইতোপূর্বেই একটা আপিল মামলার আদেশের কথা মনে পড়ে গেল। আগের শুনানিতেও আমি রেসপনডেন্ট পক্ষ ছিলাম। শুনানির পর আপিল নামঞ্জুর হয়। সংবাদ পেয়ে আমার পক্ষ আসে। মিষ্টি কিনে এনে আমাদের খাওয়ায়। মিষ্টি খাওয়ার তিন দিন পর কোর্টের পেশকার আমার সহকারীকে ডেকে নিয়ে জানায়-
- অপ্রণিধানবশত কজলিস্টে ভুল লেখা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আপিলটি মঞ্জুর হয়েছিল, কজলিস্টে নামঞ্জুর লেখা হয়ে গেছে। আমার পক্ষ এ সংবাদ শুনে ছুটে আসে, আমার চেম্বারে বসে অনেক কান্নাকাটি ও হৈচৈ করে। তখন কজলিস্টে ‘নামঞ্জুর’ লেখাছিল, সংশোধন করতে আমাদের অবগতির দরকার হয়েছিল। এখন ‘মঞ্জুর’ লেখা আছে। ‘মঞ্জুর’ শব্দ সংশোধন করতে কারো অবগতিরও দরকার হবে না। বর্তমান কজলিস্টের ‘মঞ্জুর’ এর আগে ‘না’ অক্ষরটি যোগ করে দিলেই হলো। তাই বদলানোর আগের খেলাটি মনে করে শুনানি করতে সম্মত হই।
- শুনানি করলাম- দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন ও টেনশনমুক্ত অবস্থায় শুনানি করলাম। আমি ধর্মীয় মাসলা-মাসায়েল মোটেও জানতাম না। তার পরেও মোকদ্দমার ঘটনা বর্ণনার এক পর্যায়ে (এক ইমাম সাহেব থেকে শোনা) বিশ্বনবীর মেরাজ থেকেও বর্ণনা করলাম। ‘বিশ্বনবী’ জিব্রাইলের সাথে মেরাজ দর্শনে গিয়ে স্বর্গ-নরক দেখেন। নরক দর্শন করার সময় দেখেন, সুন্দর পুচ্ছধারী কতগুলো পাখি মলমূত্র ভক্ষণ করছে। জিব্রাইলের কাছে এ অদ্ভুত ঘটনার কারণ জানতে চান বিশ্বনবী। জিব্রাইল আ: জানান-
- সুন্দর পুচ্ছগুলো জ্ঞানবুদ্ধির প্রতীক। আর মলমূত্র ভক্ষণ করা হলো অর্জিত জ্ঞানবুদ্ধি স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার প্রতীক। সৃষ্টিকর্তা কিছু মানুষকে অনেক জ্ঞানবুদ্ধি দেন। তারা জ্ঞানবুদ্ধির দ্বারা ভালোমন্দ বিচার করতে পারে। বিচার করার পরেও কেউ কেউ মন্দ কাজ করবে। এরই প্রতীকী দৃষ্টান্ত সুন্দর পুচ্ছধারী পাখি কর্তৃক মলমূত্র ভক্ষণ করা।
সব কিছু মিলিয়ে সুন্দর শুনানি করলাম। পরদিন,
- ভবিষ্যতে আমি আপনার ন্যায়সঙ্গত উপকার করতে চেষ্টা করব।
- স্যার আপনার আদালতে আমার আরো একটা মোকদ্দমা আছে। সে মোকদ্দমার পক্ষ একজন কোটিপতি। একজন কোটিপতির মোকদ্দমা কোনো কারণে খারিজ হলে চিন্তার কারণ নেই, ভালো উকিল রেখে উচ্চ আদালতে যেতে পারবে। একজন গরিব মানুষের মামলা শুনানির আগে আদেশ দিয়ে রাখলে তার পক্ষে ভালো উকিল রেখে উচ্চাদালতে যাওয়া কষ্টকর। উপকার করতে চাইলে গরিব মানুষের উপকার করা উচিত, বড় মানুষের নয়। (বিচারের বাণী পৃষ্ঠা ১৬৩-১৬৫)
‘একবার এক কোর্টে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করে শুনানির জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। মহিলা হাকিম। খাস কামরায় বসে রয়েছেন। এজলাসে উঠলেই শুনানি হবে। বিলম্ব দেখে পেশকারের কাছে জানতে চাই,
- ম্যাডাম কি অসুস্থ?
- জি না, ম্যাডাম সুস্থ আছেন।
- তবে কি কোনো মামলার রায় ডিক্রি লিখছেন?
- রায় ডিক্রিও লেখছেন না।
- কারণ কী?
- কারণটা ম্যাডামকেই জিজ্ঞেস করুন।
ম্যাডাম প্রতিদিন কোর্টে আসেন, হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন, কিন্তু এজলাসে বসেন না, অবিস্মরণীয় কাণ্ড। এক দিন, দুই দিন, মক্কেলের তাড়নায় তৃতীয় দিন অনুমতি নিয়ে খাস কামরায় প্রবেশ করি। আমার সমস্যার কথা বলে ম্যাডামকে এজলাসে বসতে অনুরোধ করি। অনুরোধ শুনে বলেন,
- আমি বসতে পারি, আপনি আপনার সমিতির লোকদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে হবে।
- আপনি আপনার এজলাসে বসবেন, এতে আইনজীবী সমিতির অনুমতি লাগবে কেন?
- আপনি পত্রিকা পড়েননি? পত্রিকায় আমার সম্পর্কে কিসব আজে-বাজে কথা ছাপা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে সব সাজানো ঘটনা। আমার পিয়নকেও চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আমাকেও এজলাসে বসতে দিচ্ছে না। এসব কারণে আমি এখান থেকে বদলি হয়ে গিয়েছিলাম। বদলি হয়ে যেখানে গিয়েছি সেখানকার আইনজীবীরাও আমার কোর্ট বর্জন করার হুমকি দিয়েছে। কারণ, পত্রিকার মিথ্যা খবর সেখানেও পৌঁছে গেছে। তাই সেখানে যোগদান না করে এখানে ফিরে এসেছি। আপনাদের সমিতির কর্মকর্তারা জানিয়ে দিয়েছে, আমি এজলাসে বসলে আমার কোর্ট বর্জনসহ তারা আবার আন্দোলনে নামবে। পত্র-পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে আবার লেখালেখি শুরু হবে। এসব ঝুট ঝামেলা এড়ানোর জন্য প্রতিদিন কোর্টে আসি, এজলাসে বসি না।
- ম্যাডাম কিছু মনে করবেন না, আসলে কী হয়েছিল আপনার?
- পত্রিকা পড়ে জেনে নিন।
সেদিনের পর ম্যাডামও আর এজলাসে বসেননি, পত্রিকায়ও লেখালেখি হয়নি। (বিচারের বাণী পৃষ্ঠা ১৯০-১৯১)
প্রধান বিচারপতি এম রুহুল আমিন বলেন, ‘আইনের অসম প্রয়োগ দুর্নীতি তৈরির অন্যতম কারণ। তাই আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। তাদের সবসময় এড়িয়ে চলতে হবে এবং তাদের জানিয়ে দিতে হবে আমরা তাদের গ্রহণ করতে রাজি না।’ একই সভায় এডিপির কান্ট্রি ডিরেক্টর হুয়া দু বলেন, ‘দুর্বল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারণে এ দেশে দুর্নীতি কমছে না ( দৈনিক আজকের কাগজ ২৯ জুলাই ২০০৭)।
এক ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ভাই বিমান বন্দরের হাজার হাজার যাত্রী থেকে অবৈধ পণ্যসহ স্বর্ণের কাঠিওয়ালা যাত্রী বের করেন কী করে? উত্তরে বলেছিলেন, খুব সোজা। এসব যাত্রীর হাঁটা-চলা, চাওয়া অস্বাভাবিক থাকে। ঠিক তেমনই, যেসব মামলায় অনিয়ম করা হয় সেসব মামলার রায়-আদেশ, কজলিস্ট, হাজিরা ইত্যাদি রেকর্ডপত্রে অনিয়মের নিদর্শন থাকবেই থাকবে। অনিয়মের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে কজলিস্টের পাতা উল্টালেই। বিচারকের পছন্দের মামলা আর সাধারণ মামলার তারিখ এক রকম নয়। সাধারণ মামলা যেখানে এক-দেড় মাস পরপর তারিখ, সেখানে পছন্দের মামলার তারিখ পড়ে ৩০ দিনে চার বার।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা