ঝড় বয় ভয় হয়, যত ভয় তত নয়
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ২৬ অক্টোবর ২০২২, ২০:১৮, আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২২, ০৫:২৯
বাংলাদেশ গানের দেশ, নদীর দেশ ও ঝড়ের দেশও বটে। প্রতি বছর ঝড়ঝঞ্ঝা, প্লাবন, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা যেন অবধারিত বিষয়। বিদেশে বাংলাদেশের আরেক নাম দুর্যোগের দেশ। পাকিস্তান আমলে দুর্যোগ প্রস্তুতি ছিল অনিশ্চিত ও অসম্পূর্ণ। স্বাধীন দেশ হওয়ার কারণে দুর্যোগ প্রস্তুতি গুরুত্ব অর্জন করে। বিশেষত সেই প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের মানুষ দুর্যোগ মোকাবেলায় যে কৌশল ও কর্মসূচি অনুসরণ করত তা হালনাগাদ করা হয়। জাপানের মতো আরেকটি দুর্যোগপূর্ণ দেশের সহায়তায় তা আধুনিকতার পরশ পায়। পরে বাংলাদেশের দুর্যোগ প্রস্তুতিতে বিভিন্ন দেশের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা পাওয়া যায়।
জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ উপকূলীয় এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার তথা আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। একসময় মজিব টিলার কথা শোনা যায়। এটি হচ্ছে ছোট পাহাড়ের মতো। অনেকটা জায়গাজুড়ে উঁচু টিলায় শক্ত স্থাপনা ও গবাদিপশু রাখার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীকালে বাস্তব কারণে এ প্রকল্প পরিত্যক্ত হয়। দেখা যায়, একেকটি রেজিমে একেকটি ডিজাইন নেয়া হয়। যখনই জলোচ্ছ্বাস বা বন্যা হয় তখনই হাঁকডাক শোনা যায়। এরপর ১২ বছরেও খবর থাকে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- ২০০৭ সালে যখন সিডর ও ২০০৮ সালে যখন আইলা নামে জলোচ্ছ্বাস আসে তখন ত্রাণপরবর্তী সময়ে আশ্রয় কেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়। কিছু আশ্রয় কেন্দ্র নির্মিত হয়। তবে তা একান্তই অপ্রতুল। সরকারের সরাসরি দায়িত্বে যেসব আশ্রয় কেন্দ্র নির্মিত হয় তা ছিল নিম্নমানের। অপর দিকে, এনজিও বা অন্য সংস্থাগুলো যেসব আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করেছিল সেগুলোর মানও ভালো ছিল না। বহির্বিশ্বে সুনাম অর্জনকারী এনজিও ব্র্যাক কিছু আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করে। আমাদের গ্রামেও একটি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ব্র্যাকের সুনামের বিপরীতে এর ডিজাইন ও নির্মাণশৈলী ছিল নিম্নমানের।
এই সাইক্লোন শেল্টারের চার পাশে মাটি উঁচু করার জন্য যে খাদ তৈরি করা হয়, তা সে রকমই রয়ে যায়। এটি আশ্রয় কেন্দ্র না হয়ে মরণ কেন্দ্র হতে পারে। এ বিষয়ে ব্র্যাকপ্রধান স্যার মরহুম ফজলে হাসান আবেদের কাছে বিষয়টি উপস্থাপিত হলে তিনি তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, সরকার ১৬টি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের দায়দায়িত্ব ব্র্যাককে দেয়। সে অনুযায়ী তারা অর্থ সরবরাহে ব্যর্থ হয়। ব্র্যাক তাদের নিজেদের তহবিল থেকে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে মানবিক কারণে এর নির্মাণকাজ শেষ করে। সামরিক সমর্থিত সরকার হওয়ার কারণে শেষ দিকে এসে বিদেশের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যায়। এখন ওই সব সাইক্লোন শেল্টার প্রায়ই অকেজো হয়ে পড়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে এখনো এমন এলাকা আছে যেখানে আদৌ কোনো আশ্রয় কেন্দ্র বা সাইক্লোন শেল্টার নেই। এসব কথা মনে হলো গত মঙ্গলবারের ঝড় সিত্রাংয়ের আঘাত প্রসঙ্গে। অবশেষে যে প্রলয়ের কথা আবহাওয়া অফিস আশঙ্কা করেছিল তা ঘটেনি, তবে ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়নি।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং উপকূলে আঘাত হানে সোমবার বিকেল থেকেই। আরো প্রচণ্ডতা নিয়ে মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে সকালের মধ্যে বরিশাল ও খুলনা উপকূল অতিক্রম করবে সিত্রাং- এ সতর্কবাণী দিয়েছিলেন আবহাওয়াবিদরা। তবে যে প্রচণ্ডতা নিয়ে আঘাতের আশঙ্কা ছিল অবশেষে তা প্রশমিত হয়। উপকূলে অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, ৯টার পরই ঝড় থেমে যায়। আবহাওয়াবিদ ও অভিজ্ঞরা বলছিলেন, হঠাৎ করে ঝড় থেমে যাওয়া আরো প্রচণ্ড বেগে ঝড় আঘাত হানার পূর্ব লক্ষণ; কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। উপকূলের সর্বত্র ঝড়ো হাওয়া থাকলেও একেক পয়েন্টে তার তীব্রতা ছিল একেক রকম।
আবহাওয়া অফিস বলছিল, নিম্নচাপটি বারবার দিক পরিবর্তন করছে। আবহাওয়াবিদদের ব্যাখ্যা মোতাবেক সিত্রাং নিম্নচাপটি অবশেষে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ বাংলাদেশের উপক‚লের দিকে ধেয়ে আসে; অপর অংশ ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের বিশাখাপত্তম বন্দরের দিকে এগোচ্ছিল। বাংলাদেশে এটি দুর্বল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। তখন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরের জন্য চার নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়। এ সময় ঝড়ের গতিবেগ ছিল ৯০ থেকে ১১০ কিলোমিটার। বেশ থেমে থেমে দমকা হাওয়ার মতো শোঁ শোঁ করে বাতাস বইছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল বৃষ্টিপাত। এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়ে সাধারণত বৃষ্টি কম থাকে। ঝড়ো হাওয়ার প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। এবার বৃষ্টি হয়েছে মুষলধারে। ইংরেজিতে একে ‘ক্যাটস অ্যান্ড ডগস’ বলা হয়। যা হয়েছে তাতে গণ্ডার ও হাতি বলা উচিত। উপকূলীয় অঞ্চলে এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের সাথে জলোচ্ছ্বাস স্বাভাবিক।
এবার বলা হয়েছিল- স্বাভাবিকের চেয়ে আট থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। বাস্তবে এমন হয়নি। এসব এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে জলোচ্ছ্বাস ব্যাপক ক্ষতিকর। জলোচ্ছ্বাস হলে উপক‚লীয় এলাকায় বাঁধ-বেড়িবাঁধ, রাস্তাঘাট, ঘের-পুকুর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাই হোক, সিত্রাংয়ের খবরের উৎস জাপানের কৃত্রিম উপগ্রহ। উপকূলীয় অভিজ্ঞ লোকরা বলছেন, সিত্রাং সাইক্লোনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে অসঙ্গতি প্রমাণিত হয়েছে। প্রথম ও শেষ বিশ্লেষণের সামঞ্জস্য ছিল না। শেষ সময়টি ছিল অতিরঞ্জিত। রেডক্রসের সেচ্ছাসেবীরা আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে বলছিল। সরকারের তরফ থেকে বারবার বন্যা প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছিল। উপক‚লীয় জেলাগুলোতে জেলা প্রশাসক জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সভা করেছিলেন। সব মিলিয়ে একটি আশ্বস্ত পরিবেশের পরিবর্তে ভীতির অবস্থা সৃষ্টি হয়।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে অবশ্য ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি। এ পর্যন্ত ৩৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের মিরসরাই। গাছপালা ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে। অনেক জায়গায় নৌকাডুবি হয়েছে। ঘের ও পুকুরে বন্যার পানি প্রবেশ করায় মাছ চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে জনজীবন অচল হয়ে পড়ে। সব অফিস ও কর্মপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের সব প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ সব যানবাহন তথা নৌপথ বন্ধ করে দেয়। উপকূলীয় জেলাগুলোর সাথে রাজধানীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিদ্যুৎব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। গোটা উপকূলবর্তী এলাকা অন্ধকারে চলে যায়। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলের বেশির ভাগ জায়গাই বিদ্যুৎব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত হয়নি।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও কক্সবাজার বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়া হয়। গাছগাছালির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পটুয়াখালীর দক্ষিণ অংশ বিশেষত দ্বীপ সমন্বয়ে গঠিত রাঙ্গাবালীর ছোট ছোট ঘরবাড়িরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে বন্যা মোকাবেলার প্রস্তুতি যতটা ছিল ততটা ত্রাণতৎপরতা ছিল না। অবশ্য রাঙ্গাবালী উপজেলার চেয়ারম্যান ডাক্তার জহির উদ্দীন আহম্মেদ ওই এলাকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চালিতাবুনিয়া পরিদর্শন করে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন। বিপর্যস্ত জনপদে আরো ত্রাণ ও অর্থসাহায্যের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
আগেই বলা হয়েছে- বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগপূর্ণ এলাকা। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলীয় এলাকা আরো নাজুক হয়ে পড়েছে। বঙ্গোপসাগরে প্রতি বছর সাত-আটবার নিম্নচাপ তৈরি হয়। এর মধ্যে কোনো কোনোটি ব্যাপক ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়। বিশ্ব আবহাওয়াবিদরা বলেন, আবহাওয়ার চক্রে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রবণতা কোনো কোনো কালে হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে। পাকিস্তান আমলে দেখা যায়- ১৯৫৫, ১৯৬০, ১৯৬৫ ও ১৯৭০ সালে প্রতি পাঁচ বছরে একটি প্রলয়ঙ্করী ঝড় বয়ে যায়। সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ১৯৭০ সালের ঝড়। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা কমে গেলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি ১০ বছরে একবার ঘূর্ণিঝড় হওয়া যেন রুটিন ওয়ার্ক। আর ঘূর্ণিঝড়ের সময়টি হলো- অক্টোবর, নভেম্বর ও মে, জুন মাস। দীর্ঘকাল ধরে ঝড়ের এসব প্রবণতা লক্ষ করা গেলেও প্রশাসনের তরফ থেকে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। আবহাওয়া অধিদফতরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার প্রতি বছর ঝড় হবে- এটি ধরেই প্রস্তুতির তাগিদ দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, বৈশ্বিক আবহাওয়ার দরুন ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির ক্ষমতা ও বায়ুপ্রবাহসহ আবহাওয়াগত নানা বিষয় একত্র হয়ে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এই প্রভাবকগুলো কোনো কোনো দশকে আরো প্রবল হয়ে উঠে ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। এমনকি এটি অনেক ক্ষেত্রে স্থায়ী রূপ নিতে পারে। বিষয়টি সাংবাৎসরিক হয়ে উঠতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে দেশের সব উপকূলীয় এলাকাকে এখন থেকেই প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এবারের ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ব্যক্তিগত অবস্থানের কারণে সরকার ও জনগণের মধ্যে প্রক্রিয়া ও পরিকল্পনায় দূরত্ব লক্ষ করা গেছে। গতানুগতিক ও আধুনিক প্রতিরোধব্যবস্থার সমন্বয়ের মধ্যেই মুক্তি নিহিত। ছোট সময়ের ছড়া মনে পড়ছে- ‘শন শন ঝড় বয়, ভয় হয়-যত ভয় তত নয়, ভয় নয় ভয় নয়।’ সুতরাং ভয়কে জয় করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা