০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

সঞ্চয় ভেঙে কি নিজেকেই খাচ্ছি

সঞ্চয় ভেঙে কি নিজেকেই খাচ্ছি - ছবি : সংগৃহীত

গতকাল রাত ৯টায় গিয়েছিলাম কাচাবাজারে। পালং শাকের ছোটো একমুঠো (আঁটি) কিনতে বাধ্য হলাম ৩০ টাকায়। অন্য শাকের আঁটি ২০ টাকার নিচে দোকানি বিক্রি করবে না। একটি ছোটো লাউয়ের (কদু) দাম কমপক্ষে ৫০ টাকা।

সবজি বাজারের এই অবস্থা আজকের না। তা চলছে জ্বালানির দাম বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে অনেক দিন আগে থেকেই। কাঁচা বাজারের সবচেয়ে দরকারি পণ্যের নাম চাল এবং আটা। ওই খাদ্যপণ্যের মান বেড়েছে কবে তা কি আমরা মনে রাখতে পেরেছি? আমার অন্তত মনে পড়ে না। কারণ কেন মনে রাখব? আর কতগুলোর দাম মনে রাখব? কাঁচাবাজার, খুচরোবাজার, পাইকারি বাজার, সর্বত্রই মূল্য-বাড়ার প্রতিযোগিতা চলছে বহুদিন থেকেই। প্রথম দিকে সাধারণ মানুষ ভেবেছে সরকারি চাপে মূল্য কমে আসছে। কিন্তু যখনই ভেবেছে এ-কথা, তখনি মনে পড়েছে এ-দেশে কোনো জিনিসের দাম একবার বাড়লে তা কমে না। সরকার চাইলেও কমে না। একটা উদাহরণ অবশ্য গত মাসে সৃষ্টি করেছে বিপিসি। জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছিল যে পরিমাণ, তা থেকে ৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। এতে অনেকেই নাখোশ হয়ে বলেছে, কি লাভ হলো দাম কমিয়ে? বাসের ভাড়া কি তাতে কমানো হয়েছে? ট্রাকের ভাড়া কি কমেছে? কেউ যদি বাস কনডাকটরকে বলে যে ভাড়া কমাওনি কেন? কনডাকটরের খিঁচানো হাসি কি যে কন, ৫ পয়সার কমানোতে আমরা কি কমামু?

এই পরিস্থিতি দেশের সর্বত্র। দিন এনে দিন খাওয়া (ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালা, ছোটো দোকানদার, চা বিক্রেতা আর হোমওয়ার্কারসহ) লোকেদের কি হাল তাহলে বুঝুন। আর যারা কম বেতনের চাকরিজীবী তাদের নাভিশ্বাস তো হিক্কা তোলার মতো হয়েছে। সরকারের কানে কি সেই হিক্কাশব্দ পৌঁছায়নি আজো? এই যে যাদের কথা বললাম তাদেরই একজন শাক-সবজি বিক্রেতা। কাঁচাবাজারের মাছ-গোশত বিক্রেতাদের দিকে তো গেলাম না। পানিতে ভেজা মাছের দামে আগুন। যারা চাষের মাছ খেতে চান না, তারা বাজার ঘুরে ঘুরে খুঁজে বেড়ান, কোথায় আছে নদীর বা হাওর-বাঁওড়ের সুস্বাদু মাছ। তাদের ট্যাকে বেশি পয়সা, তাই গায়ে লাগে না। কিন্তু আমরা যারা বেকার ও স্বল্প আয়ের মানুষ, তারা এখন চাষের মাছেই সন্তুষ্ট থাকি।

যাদের কথা বললাম, তাদের একজন রিকশাওয়ালা। তিনি তো দিন-রোজগারি। যেদিন রিকশা বাইতে পারেন না, সেদিন তাকে, তার পরিবারকে অর্ধাহারে থাকতে হয়। অত দাম দিয়ে চাল কেনার সামর্থ্য তার নেই। তবে তারা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। ৫ মিনিটে হেঁটে যাওয়া যায় এমন দূরত্বের জন্য ভাড়া হাঁকেন ৪০ টাকা/৫০ টাকা। তাদের দোষ দিয়ে কি করব? শাক-সবজি আর চালের/আটার দাম যদি আকাশ-ছোঁয়া হয়, তাহলে তারা কি দিয়ে তা কিনবে? তারা এখন রামপুরা থেকে প্রেস ক্লাব/সচিবালয়ে যেতে ভাড়া চান একশ পঞ্চাশ টাকা। কাকুতি-মিনতি করলে ২০ টাকা কমায় তারা। এই যে দাম বাড়ানো, এর পেছনের কারণ কী? আমরা তা জানি। কিন্তু নিজেরাই যেখানে চলতে পারি না, সেখানে ভাড়া বেশি দেবো কেমন করে?

খবর বেরিয়েছে পত্রিকায়, যারা ব্যাংকে নানা নামের সঞ্চয়পত্র কিনে বাড়তি আয়ের চেষ্টা করতেন, তারা সেগুলো ভেঙে খাচ্ছেন। ওই যে যাকে বলে সংসার, তার চাহিদা মেটানোর জন্য তারা সঞ্চয় ভাঙছেন। ডিপিএস, এফডিআর, জাতীয় সঞ্চয়পত্র নামের সঞ্চয়গুলোতে হাত দিয়েছেন তারা। এমনকি যারা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করে দুই পয়সা আয়ের চেষ্টা করতেন তারাও মূল্য হারিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছেন শেয়ার। কারণ শেয়ারের চেয়ে যে পেটের চাহিদা বেশি।

কেন? তারই ব্যাখ্যা আমরা পাবো সমকালের ১৯ অক্টোবরের রিপোর্টে। ওন রিপোর্টে দু’জনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। একজন যশোরের অন্যজন ঢাকার বাড্ডার। ওই সঞ্চয়গুলো থেকে তারা যা পাচ্ছেন তারচেয়ে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এই কাজটি করেছে। পাইকারি ও খোলাবাজারের অধিপতিরা কারো কথাই শোনেন না। তাদের চাই মুনাফা, আকাশচুম্বী মুনাফা। সেই মুনাফা আজ এতটাই তারা করছেন যে গরিব মানুষ হাহাকার করছে। তাদের তো নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়।

রোজ রোজ তো আর বেতন বাড়ে না। তাদের তো আয় বাড়েনি। যে টাকাটা তারা ডিপিএসের জন্য জমাতেন, সেই টাকা তো আর ব্যাংকে জমা দিতে পারছেন না এখন। খরচ করতে হচ্ছে সংসারের ব্যয় মেটাতে। প্রতি মাসের টাকাটা তারিখ মেনে জমা দিতে না পারলে তো মহা মুশকিল! টাকাটা আর ফেরৎ না-ও পেতে পারেন, এই ভয় জোঁকের মতো লেগে থাকে। তাই সঞ্চয় ভেঙে পকেটে রেখে দিচ্ছেন যাতে দুঃসময়ে খাদ্য কিনতে পারেন। সঞ্চয় ভেঙে রেখে দেবার পেছনে আরো বহু কারণের মধ্যে খাদ্যসঙ্কট একটি। এই খাদ্যসঙ্কটের কথা তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই বলেছেন। তিনি সবাইকে কৃচ্ছ্র সাধনের কথা বলেছেন। উৎপাদন বাড়ানোরও তাগিদ দিয়েছেন।

তিনি সবাইকে এই কৃচ্ছ্র সাধনের আহ্বান জানানোর আগেই আমরা জেনেছি ইউরোপের তরফে। আগামী বছর নাগাদ অর্থনৈতিক মন্দা আসছে, তাতে কোনো ভুল নেই, কারো দ্বিমতও নেই। কেন এবং কীভাবে মন্দা আসে? ইকনোমিস্টদের পরিভাষায় তা আমরা বলতে পারব না। তবে অতিরিক্ত ব্যয়ই এর প্রধান কারণ বলে মনে করা যেতে পারে। অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করলে প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় তো কমে আসবেই। প্রয়োজন ও অপ্রয়োজন কী কী, তা যদি নিরূপণ করা যায়, তাহলে এর মৌলিক সমস্যা-সঙ্কট চেনা সহজ হয়। সমাধানের পথও মেলে। কোভিড-১৯-এর বর্বর হামলার পর লাখ লাখ মানুষ মারা গেছেন। তখন এশটি বড় রকমের অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করতে হয়েছে পৃথিবীর ধনী-গরিব সব দেশকেই। সেই সূচনার পর দুই বছর প্রয়োজনীয় খাতে বিনিয়োগ হয়নি। যেখানে মানুষ বাঁচে কি মরে, সেই শঙ্কায় মূহ্যমান ৭০০ কোটি মানুষ, সেখানে ব্যবসা বাণিজ্য তো গতি হারাবেই। জিনিস কেনার মানুষের দেখা পাওয়াও কঠিন। কেবল খাদ্যবাজারে মানুষের উপস্থিতি ছিল, কম আর বেশি।

শিল্পোৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে। কৃষি সেক্টরটি সচল ছিল গোটা পৃথিবীরই, তাই খাদ্যাভাব প্রকট হয়নি। স্বাভাবিক অবস্থায়ই যেখানে খাদ্যসঙ্কট আফ্রিকায় নিত্যদিনের, কোভিডের সময় তা চরম আকার নেয়। আর আমাদের মতো লিস্ট ডেভেলপড দেশের অবস্থা কেমন হতে পারে, একবার ভেবে দেখুন। তো, এরকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে যখন আমরা তখন যদি দেশের সরকারপ্রধান বলেন যে কৃচ্ছ্র সাধন করতে হবে সবাইকে, মানে সাধারণ মানুষসহ সরকারের লোকদের, তখন কি ভয় আমাদের জড়িয়ে ধরবে না? কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যিনি কৃচ্ছ্র সাধনের কথা বললেন, তিনি এবং তার মন্ত্রীরা কি সেই কৃচ্ছ্র সাধনের আওতায় পড়েন না? নিশ্চয়ই পড়েন এবং তারই তো প্রধান দায়। আমরা যারা দিন এনে দিন খাই, যাদের চাকরি নাই, যারা অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে চাকরি হারাবেন এবং যাদের সঞ্চয় ভেঙে খাওয়াও শেষ হবে এবং যাদের এফডিআর/ডিপিএস নাই, তারা কি ভেঙে খাবেন? যারা খাদ্যশস্য উৎপাদন করেন, সেই কৃষক সমাজ কিন্তু সরকারের কৃচ্ছ্র সাধনের বাণীর জন্য বসে থাকে না। যখন সরকারপ্রধান কৃষককে মাগনা সার দিতে চেয়েছিলেন তখন তারা সে-কথা বিশ্বাস করেনি বলেই ওই বাণী নিয়ে রাজপথে নেমে আন্দোলন করেনি। এখন যে দেড় হাজার টাকা সারের এক বস্তার দাম, এখনো তারা দামের এই আকাশচুম্বী তা দেখে রাস্তা দখল করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন না। তারা প্রণোদনা না পেলেও মাঠে যাবেন না। যে কৃচ্ছ্রসাধনের কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি যদি তা করেন, তার সরকার যদি যত্রতত্র অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে টাকা না ঢালেন, তাহলেই দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা কমে আসবে। সাধারণ মানুষও তাকে অনুসরণ করবেন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে, সেটা তিনি স্বীকার করেই বলেছিলেন অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হবে না। এখন জরুরি নয় এমন প্রকল্প স্থগিত রাখতে হবে। দেখান তো একটা প্রকল্প,যা স্থগিত করা হয়েছে? দেখান তো কোন প্রকল্পটি অতীব জরুরি? নির্বাচনের জন্য ইভিএম কিনতে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা যে একনেক বরাদ্দ দিয়েছে, সেটা কি জরুরি প্রকল্প? ইভিএম ছাড়া কি অতীতে নির্বাচন হয়নি? এরকম বহু প্রকল্প আছে যাতে ব্যয় করে সরকার নিজেই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক করে ফেলেছেন এবং এখনো ফেলছেন। সরকার নিজেই যেখানে কৃচ্ছ্রতা সাধন করছেন না তখন কি জনগণ তার অনুরোধ শুনবেন? আর যারা নিজেদের জমানো টাকা/সম্পদ ভেঙে পেটের চাহিদা মেটাচ্ছেন, তারা আর কি কৃচ্ছ্রতা সাধন করবেন?

উদ্ধৃত করা যাক আলী রীয়াজের লেখার একটি অংশ।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি প্রত্যেক পরিবারকে অনুরোধ করব; তারা যেন যতটুকু পারেন, সঞ্চয় করেন এবং এটি আমাদের সরকারের জন্যও প্রযোজ্য। সরকার কোনো অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করবে না।’ কিন্তু কৃচ্ছ্রতার ক্ষেত্রে যা বলা হচ্ছে, আর যা করা হচ্ছে, তার মধ্যে ফারাক বিস্তর।

সাধারণ নাগরিকদের বলা হচ্ছে সঞ্চয় করার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেশের অধিকাংশ মানুষের এই পরামর্শ শোনার মতো অবস্থা নেই। জুলাই মাসের হিসাবে দেখা গেছে, মানুষ ‘সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে’, ‘কেউ সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছেন, কেউ সংসার চালাচ্ছেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা শেয়ার লোকসানে বিক্রি করে’ (প্রথম আলো, ১ আগস্ট, ২০২২)।

এই হিসাবের পর দেশে জ্বালানির দাম বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি ঘটেছে সরকারি হিসাবেই ৯.১ শতাংশের ওপর, আর বাজারের অবস্থা কী, সেটা বাংলাদেশে যারা আছেন, তারা আরো ভালো জানেন। আইএমএফের হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে বাংলাদেশে। (প্রথম আলো ১৯ অক্টোবর, ২০২২)

আমরা ভুক্তভোগী। আইএমএফ হয়তো পরিস্থিতি গোটা পৃথিবীতে জানিয়ে দিয়েছে। তাতে আমাদের কি আসে যায়? আমরা তো উন্নয়নের মহাসড়কে আছি। সেখান থেকে পেছনে ফিরব না।


আরো সংবাদ



premium cement