২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ঘাটতির চাপে পিষ্ট বৈদেশিক রিজার্ভ

ঘাটতির চাপে পিষ্ট বৈদেশিক রিজার্ভ - ছবি : সংগৃহীত

কয়েক মাস আগের প্রবন্ধে লিখেছিলাম, ‘দেশের অর্থনীতিতে অশনিসঙ্কেত’। তারপর লিখেছিলাম, অশনিসঙ্কেত পেরিয়ে অর্থনৈতিক সঙ্কট শুরু হয়ে যাওয়ার গল্প। এখন বোধ করি সময় এসেছে লেখার যে, অর্থনৈতিক সঙ্কট গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। দেশের সেপ্টেম্বর মাসের অর্থনৈতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, আমদানি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও একসাথে কমছে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়।

আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ঘাটতি বাড়ছে প্রতিদিন। ফলে চলতি হিসাবেও ঘাটতির আকার বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে প্রতিদিন। মুদ্রাবাজার এখন শুধুই অস্থিতিশীল নয়; বরং গত কয় মাসে অবমূল্যায়িত হয়েছে প্রতি ডলার ৮৬ টাকা থেকে ১০৬ টাকায়, অর্থাৎ ২৩ শতাংশেরও বেশি। দ্রব্যমূল্য বেড়েছে তার চেয়েও কয়েকগুণ। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মহাসঙ্কটে। সুতরাং এখন কেবল সঙ্কট মোকাবেলা নয়; বরং সম্ভাব্য মহামন্দা ও দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার আগাম প্রস্তুতি নেয়ার সময়।

এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, এতদিন যেসব বিশেষজ্ঞ এবং সরকারের উচ্চমহল থেকে ‘দেশের অর্থনীতি নিয়ে ভয়ের কিছু নেই’- এই গল্প শুনিয়েছিলেন, এখন তারাও দুর্ভিক্ষ আসার অশনিসঙ্কেত শুনাচ্ছেন। শুনাচ্ছে মহামন্দা আসার কথা। তাদের মধ্যেও এখন দুর্ভিক্ষের ভয় কাজ করছে; ভেতরে ভেতরে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার পথ খুঁজছেন। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছেন; আইএমএফের পেছনেও ছুটছেন। সাথে আগের নেয়া ঋণ পরিশোধের, এমনকি ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে কিস্তির আকার ছোট করার চেষ্টা করছেন।

মোটাদাগে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার উৎস তিনটি, যেমন- রফতানি খাত, প্রবাসী আয় এবং বৈদেশিক ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদান। তার পাশাপাশি বিলাস পণ্য, কম প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করা। আসুন দেখি, দেশের চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের অর্থনৈতিক রিপোর্টের ভিত্তিতে উল্লিখিত খাতগুলোর বর্তমান অবস্থা ও করণীয়।

বাংলাদেশের জন্য আশার বিষয় ছিল- দেশের বিশাল জনসংখ্যা যার প্রায় সোয়া কোটি বিদেশে কর্ম করে নিয়মিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায়; ফলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ সবসময়ই ছিল এবং এখনো আছে। তারপরও বলা হচ্ছিল- রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে এবং যাবে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্য বেঁধে দেন ব্যাংকাররা। যেখানে আগে প্রতি ডলার আনতে ব্যয় করা হতো ১১৪ থেকে ১১৫ টাকা, সেখানে হঠাৎ গত ১১ সেপ্টেম্বর রেমিট্যান্সের ডলার ১০৮ টাকা বেঁধে দেয়া হয়। আর রফতানির ডলার বেঁধে দেয়া হয় ৯৯ টাকা। এরপরও গত ২৬ সেপ্টেম্বর রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্য আরো ৫০ পয়সা কমিয়ে ১০৭ টাকা ৫০ পয়সায় নামিয়ে আনা হল। মূলত এর পর থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে দেখা যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে এক হাজার ৫৩৯ মিলিয়ন ডলার, যেখানে আগের মাস অর্থাৎ আগস্টে এসেছিল দুই হাজার ৩৬ মিলিয়ন ডলার। আগস্টের চেয়ে সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স কম এসেছে প্রায় সাড়ে ২৪ শতাংশ। আর গত বছরের সেপ্টেম্বরে এসেছিল এক হাজার ৭২৬ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রায় ১১ শতাংশ কম। ডলারের মূল্য কমানোয় আশঙ্কা করা হচ্ছিল- রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাবে। আর এটিই বাস্তব হলো বিদায়ী মাসে। কেন রেমিট্যান্সের দাম বেঁধে দেয়া হলো- এ বিষয়ে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, চাহিদার থেকে সরবরাহ কম থাকায় প্রতিনিয়তই ডলারের দাম বেড়ে যায়।

একসময় প্রতি ডলার ১২০ টাকা উঠে যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি জোরদার করা হয়। এতে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অনিয়মের চিত্র পাওয়া যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে শাস্তির আওতায় আনে। একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে ডলারের একক দর কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, যদিও তা আজো বাস্তবায়ন হয়নি। তবে রেমিট্যান্সের ডলার ও রফতানির ডলারের মূল্য কমিয়ে এনে বাজার স্থিতিশীল করার চেষ্টা করার আশ্বাস দেয়ায় মুচলেকা নিয়ে ব্যাংকগুলোর ওপর থেকে আরোপিত শাস্তি প্রত্যাহার করে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তা তেমন কাজ দেয়নি। গত মাসের শুরুতে মুদ্রাটির দর নির্ধারণের দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসার সাথে যুক্ত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) যৌথভাবে গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের দাম এখন ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা এবং পণ্য রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দাম ৯৯ টাকা দেয়া হচ্ছে।

রেমিট্যান্সের এ চিত্র চলমান পরিস্থিতিতে মোটেও সুখকর নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, হুন্ডি ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশী শ্রমের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে; অন্যথায় সরবরাহ পরিস্থিতি আরো খারাপ অবস্থানে চলে যাবে। তবে, বিপুল জনসংখ্যার এই দেশটির প্রবাসে শ্রমিক পাঠানোতেও রয়েছে অনেক অব্যবস্থা; এই অব্যবস্থা দূর করে, প্রশিক্ষণ দিয়ে স্কিলড শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর পরামর্শ বিভিন্ন মহল থেকে এলেও দুর্নীতিবাজদের জন্য সম্ভব হছে না।

বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় আশার খাতটি ছিল গার্মেন্ট শিল্পের রফতানি যা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং যার পণ্য রফতানির মাধ্যমে প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আসে। অথচ রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি, রফতানি আয়ও কমতে শুরু করেছে। ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৬.২৫ শতাংশ। টানা ১৩ মাস পরে রফতানি আয়ে বড় ধরনের ধাক্কা আসে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আগের বছরের জুলাইয়ের চেয়ে রফতানি আয় কমেছিল ৬ শতাংশের মতো। এর পর থেকে এক বছরের বেশি সময় ধরে রফতানি আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ; কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে এসে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যখন কমতির দিকে, তখন একসাথে কমল রফতানি ও প্রবাসী আয়। বৈদেশিক মুদ্রার দু’টি প্রধান উৎস থেকে আয় কমে যাওয়া নতুন করে দুশ্চিন্তা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সেপ্টেম্বর মাসের প্রবাসী আয় ও রফতানির হিসাব প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাসে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে, তা বিগত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই আয় আগের মাসের তুলনায় ২৪ শতাংশ কমেছে। গত বছরের একই মাসের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে, কমার হার প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাসে রফতানি আয়ে যে ধাক্কা লেগেছে, তা মূলত তৈরী পোশাক রফতানি কমার কারণে। গত মাসে ৩১৬ কোটি ডলারের তৈরী পোশাক রফতানি হয়েছে, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ কম। গত মাসে ওভেন ও নিট উভয় ধরনের পোশাক রফতানিই হ্রাস পেয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর মেয়াদে পোশাক রফতানিতে ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ; পাট ও পাটজাত দ্রব্যে ১৫ দশমিক ৭১ শতাংশ; প্লাস্টিক পণ্যে ৫৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও চামড়াজাত পণ্যে ২০ দশমিক ৮৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্য দিকে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে কম আয় হয়েছে একাধিক পণ্যে। কৃষিপণ্যে ১৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ, কেমিক্যাল পণ্যে ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ ও কাচজাত পণ্যে ৫২ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম আয় হয়েছে।

পোশাক রফতানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। রফতানি কমে যাওয়ার বিষয়ে তৈরী পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠনের (বিজিএমই) মতে, গত তিন মাস ধরে পোশাকের নতুন ক্রয়াদেশ আসার গতি কম। কয়েকটি বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান বেশ কিছু ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে। তাদের এখন খাদ্যের পেছনেই অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। সে কারণেই রফতানি আয় কমছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরো বলছেন, ইউরোপে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। এতে প্রবাসীরা কম পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠাতে পারছেন। একই কারণে কমেছে পণ্য রফতানির ক্রয়াদেশ। আবার যতটুকু ক্রয়াদেশ আছে, তার সবটুকুও গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে রফতানি করতে পারেননি উদ্যোক্তারা।

এ দিকে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ আরো এক ধাপ বেড়ে গেল বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস অর্থাৎ জুলাই ও আগস্টে রেমিট্যান্স এবং রফতানি আয় বৃদ্ধির পরও চাহিদা বেশি থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সুবাদে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৩৬ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসে, যেখানে গত বছরের আলোচ্য সময়ে রিজার্ভ ছিল ৪৬.২৮ বিলিয়ন ডলার। তবে এখানেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। রফতানি উন্নয়ন ফান্ড নামে সাত বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যবহার করা হয়েছে যা সহজে প্রাপ্য নয়। আইএমএফ এই সাত বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ হিসেবে বিবেচনায় নিতে রাজি নয়; সুতরাং রিজার্ভের পরিমাণ ৩০ বিলিয়নেরও নিচে। যদিও তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রা থাকে, তা সন্তোষজনক বলে গণ্য হয়। অবশ্য দুশ্চিন্তার বিষয় হলো- দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমছে। গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এতে ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলার সঙ্কট তৈরি হয়, দাম দ্রুত বাড়তে থাকে। ডলারের বাড়তি দাম আবার দেশের পণ্যের দর বাড়িয়ে দিচ্ছে। অর্থবছরের তৃতীয় মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রফতানি আয় কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চলমান চাপ আরো এক ধাপ বেড়ে যাবে। এই খাতটির ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে; নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে।

বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হচ্ছে। বেশির ভাগ পণ্যের আমদানিতে এলসি মার্জিন তুলে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ পণ্য আমদানিতে আমদানিকারকদের শতভাগ ব্যয় মেটাতে হচ্ছে। একই সাথে ৩০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদারকি করছে। এরপরও আমদানির ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি জুলাই-আগস্টে ১৭ শতাংশে রয়ে গেছে, যদিও গত জুনে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৪৫ শতাংশ। ফলে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পরও দুই মাসে রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত দুই মাসে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৪৫৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪২৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ সুবাদে দুই মাসে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে বাণিজ্য ঘাটতি আরো বেড়ে গেছে।

এক দিকে আমদানিতে কড়াকড়ি অন্য দিকে গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট। তার সাথে যোগ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কা। ফলে শিল্প স্থাপন ও সম্প্রসারণের নতুন উদ্যোগ নিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। দেশের ভবিষ্যৎ উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব পড়বে। সুতরাং দেশীয় প্রবৃদ্ধি অক্ষুণ্ণ রাখতে শিল্পায়ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

প্রবাসী আয় ও রফতানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়ে, যা দেশের সক্ষমতা বাড়ায়। শ্রীলঙ্কার সঙ্কটে পড়ার কারণ, দেশটির কাছে পণ্য আমদানি করার মতো ও বৈদেশিক দেনা পরিশোধের মতো বৈদেশিক মুদ্রা নেই। পাকিস্তানও একই কারণে বিপাকে রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রবাসী আয় যে কমেছে, তা সাময়িক। আগামী দিনগুলোতে বাড়তে পারে। বিগত কিছু দিন ব্যাংকে ডলারের দাম ১০৫ টাকার আশপাশে রয়েছে। ডলার নিয়ে সঙ্কটও কিছুটা কেটেছিল। এরই মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসে রফতানি ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার খবর এলো। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এক মাসের ওঠানামা দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। ধারাবাহিক তিন মাস যদি এমনটি হয়, সেটি তখন চিন্তার বিষয় হবে। প্রবাসী আয় ও রফতানি আয়ে ডলারের দামে বড় ব্যবধান তৈরি হওয়ায় অবৈধভাবে ডলার দেশে আসছে হয়তো। সাথে ডলারের দাম বাড়াতে প্রবাসী আয় সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার মজুদ করতে পারে। ইউরোপ ও আমেরিকা থেকেও প্রবাসীদের অর্থ পাঠানো কমতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, রেমিট্যান্স হাউজ এক মাসের বেশি ডলার মজুদ করতে পারবে না। তাদের বিক্রি করতেই হবে।

ডলারের রেটে স্থিতিশীলতা জরুরি। ব্যবসায়ীরা ডলার পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে স্থিতিশীল হবে, তার অপেক্ষায় রয়েছেন। কারণ, ডলারের দামের ওপর কেনাবেচা, পণ্যের দাম, আমদানি ও বিনিয়োগ পরিকল্পনা নির্ভর করে। ইতোমধ্যে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে নিত্যপণ্য, কাঁচামাল, শিল্পের সরঞ্জাম ইত্যাদিসহ প্রায় সব পণ্যের আমদানি ব্যয় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। নির্মাণ খাতের উপকরণ, খুচরা যন্ত্রাংশ ও শিল্পের কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। বিশ্বের প্রায় সব দেশের মুদ্রার মানের তুলনায়ও ডলারের দাম বেড়ে গেছে। তবে আমাদের দেশের টাকার মূল্য কেবল ডলারের বিপরীতেই নয়; বরং অনেক দেশের মুদ্রার বিপরীতেই কমেছে। দাম কমার চেয়েও বেশি সমস্যা হলো- মুদ্রার মান ব্যাপকভাবে ওঠানামা করা। তার চেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে ডলারের বিপরীতে টাকার মান জোর করে ধরে রাখা; বরং সাথে সাথে সমন্বয় করা দরকার ছিল। সেটি না করার ফলে এখন হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় সমস্যা হয়েছে। এক দিকে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি, অন্য দিকে ডলারের দাম বৃদ্ধি- এই দুইয়ের যৌথ প্রভাবে পণ্যের দাম আকাশচুম্বী। মুদ্রাস্ফীতি এখন দুই ডিজিটে।

তবে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে সরকারের রাজস্ব আয় বেড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব মতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে আমদানি শুল্ক আদায় ৩৪ শতাংশ এবং আমদানি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর ২২ শতাংশ ও সম্পূরক শুল্ক ৩৮ শতাংশ বেড়েছে। অন্য দিকে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য বিক্রির বিপরীতে ভ্যাট ১৯ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক ২৮ শতাংশ ও লেনদেন কর ৪৪ শতাংশ কমেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে এই কমার অর্থ- বাজারে উৎপাদন ও বেচাকেনা কমেছে। অর্থনীতিতে চাহিদা কমেছে, যা শুভ নয়। কারণ এতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমবে। দেশের এ অবস্থায় প্রয়োজন মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ডলারের স্থিতিশীল ও একক দাম নির্ধারণ।

সার্বিকভাবে, চলতি অর্থবছর দেশের অর্থনীতি নানা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংকের মতে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি যতটা কমবে দেশের বাস্তব অবস্থা আরো খারাপ হবে। একদিকে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, অন্য দিকে ইউরোপ-আমেরিকার সমস্যার কারণে তৈরী পোশাকের রফতানি কমছে। আবার পোশাক তৈরির খরচও বাড়ছে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত লাগছে। এর সাথে যোগ হচ্ছে দেশে ২০২৩ সালের নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি চ্যালেঞ্জিং অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

পরিশেষে বলতে হয়, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সবচেয়ে জরুরি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে সবাই মিলে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা। উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ নয়; বরং কেবল বিলাসবহুল পণ্য ও কম অথবা অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। রফতানি পণ্যের বিকল্প বাজার খুঁজে বের করা, দুর্নীতি ও অর্থপাচার রোধ করা, পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করা, শ্রমিকদের বিদেশ পাঠানো সহজ করা ও দুর্নীতিমুক্ত করা প্রয়োজন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশভ্রমণ বন্ধ করতে হবে। দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নতির মাধ্যমে বিদেশে চিকিৎসা কমিয়ে আনতে হবে।

উৎপাদনশীল খাতে বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে উৎপাদন ঠিক রাখা, বিশেষ করে কৃষি খাতে সব ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন নিশ্চিত করা। উল্লেখ্য, প্রায় সব ধরনের গবেষণার পূর্বাভাস হলো- বিশ্বে ধেয়ে আসছে মহামন্দা ও দুর্ভিক্ষ, সুতরাং খাদ্য উৎপাদনে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এটি এখন দেশের জন্য অনিবার্য ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, দেশে সরকারি পর্যায়ে খাদ্য আমদানি করে বাফার স্টক করতে হবে। সেই সাথে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। সর্বোপরি দেশের জনগণকেও তাদের সাধ্যমতো সঞ্চয় করতে হবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ই মেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement