১৩ বছর পর
- ড. মাহবুব হাসান
- ১৪ অক্টোবর ২০২২, ২০:১৯
নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ১৩ বছর পর নতুন বিএনপির চেহারা দেখা যাচ্ছে। মাঝের দুটি নির্বাচনে তাদের রাজনৈতিক ভূমিকায় পরিকল্পনার ত্রুটি ও অন্ধের মতো বিশ্বাস ছিল বলে তারা হেরে গিয়েছিলেন। ২০২৩-২৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে যাতে তারা অংশগ্রহণ করে সেজন্য গত দুই বছর ধরেই রাজনৈতিক খোঁচা দিচ্ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের মন্ত্রীরা। তারা কথায় কথায়ই বলতেন বিএনপি রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে, জনগণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, সাংগঠনিক শক্তি বলে কিছু নেই, আমাদের সঙ্গে পারবে না বলে ইলেকশনে আসতে চায় না, তারা এমন সরকারব্যবস্থা চায় যা অগণতান্ত্রিক ও অনির্বাচিত, তাদের সঙ্গে আঁতাত করে, মানে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় যেতে চায়, বিদেশীদের সহায়তায় ক্ষমতায় যেতে চায়, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকার পতন করতে চায়, ক্ষমতায় যেতে চায়, কারণ তাদের সঙ্গে জনগণ, ভোটার জনগণ নেই। আর শেখ হাসিনার সরকার উন্নয়নের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। চোখে দেখা যায় এমন উন্নয়নের নিশান তুলে এতদঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অগ্রগতিতে শীর্ষস্থানে উঠে গেছে। ২০২৬ সালে এই সরকার বা বাংলাদেশ লিস্ট ডেভেলপড দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মহাসড়কে ওঠে যাবে। অতএব হাসিনার সরকারেরই দরকার এ দেশের জন্য।
২.
সাধারণ মানুষ যখন রাজনৈতিক আলাপ শুরু করতেন, বলতেন বিএনপির রাজনৈতিক মিছিল মিটিং ইত্যাদি করার দরকার কী? বিএনপির রাজনীতি তো করছে সরকারি দলই। দশমুখে যখন বিএনপির নানান সমালোচনা করে বেড়ায় সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টারগণ নানা অছিলায়, তাতেই জনগণ বুঝে যায় যে সরকার কতটা ভীত বিএনপিকে নিয়ে। বিএনপি দল হিসেবে যে তৃণমূল পর্যন্ত তার চিন্তা ও রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে নিয়েছে, সেটা বোঝা যায় কৃষক-শ্রমিকের মধ্যে আনন্দ দেখে। প্রতীক ধানের শীষ উৎপাদক চেনে তাদের খাদ্য হিসেবে। তারা নৌকাও চেনে এবং তার কাজও তারা বোঝে। রাজনীতির সাথে সেগুলোর মনস্তাত্ত্বিক মিলও তারা নীরবে বুঝে নিয়েছে। ফলে ধানের শীষ ও নৌকা বা জাতীয় পার্টির লাঙল প্রতীক তাদেরই উৎপাদন জীবনের লোক-কারিগরি ও লোকজীবনের অংশ। তাই রাজনীতি তাদের প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের বিষয়। তারা ভোলে না। ভুলে যাওয়া সহজও নয়।
৩.
আওয়ামী লীগ যখন খুঁচিয়ে জাগিয়ে দিয়েছে একটি গণতান্ত্রিক রাজনীতির শক্তিশালী দলকে, তখন তার সাংগঠনিক শক্তির রূপ তো দেখে নেবেই ভোটার জনগণ এবং দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো। গত আগস্টের আগে পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে বিএনপি গোটা দেশেই রাজনীতি করে নিজেদের ঘর গুছিয়ে নিয়েছে। আগস্টের পর থেকে সেই তৈরি করা রাজনৈতিক ক্ষেতে ফসল বোনার কাজে তারা ব্যস্ত এখন। প্রতিটি উপজেলায়, প্রতিটি জেলায় রাজনৈতিকভাবে নিজেদের কর্মীবাহিনীকে উদ্দীপ্ত ও লক্ষ্য স্থির করে এগোবার মন্ত্রণা দেয়া হয়েছে। সেই মন্ত্রবলেই আজ দেখতে পাচ্ছি বিএনপি শুরু করেছে তাদের রাজনৈতিক বিভাগের সম্মেলন। আটটি বিভাগে রাজনৈতিক সম্মেলন করার পর আগামী ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে চূড়ান্ত রাজনৈতিক শো-ডাউন করবে বিএনপি, জানিয়েছে। গতকাল ১২ অক্টোবর, চট্টগ্রামে প্রথম সমাবেশ করেছে তারা। সরকারি পক্ষ নানাভাবে বাধা দিয়েছে। তার পরও তাদের কর্মীরা এসে জড়ো হয়েছে পলো গ্রাউন্ডের সমাবেশস্থলে এবং বিপুলভাবে উদ্বোধিত হলো সেই সমাবেশ।
এ নিয়ে সরকারি দলও বসে নেই। তারা নানাভাবে তাদের শক্তি দেখানোর আয়োজন করছে। সরকারের হাতে পুলিশ আছে, র্যাব আছে, আছে রাজনৈতিক কর্মীবাহিনী, যারা গত ১৪ বছরে নানাভাবে আয়-রোজগারের সম্পদও জড়ো করেছে। তারা তাদের সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে- এই ভয়ে নিজেদের শক্ত ঘাঁটি বেঁধে নিচ্ছে। একটা রাজনৈতিক কনফ্রনটেশনের দিকে যাচ্ছে এ দেশের রাজনীতি।
৪.
দু’টি চমৎকার কাজ করেছে বিএনপি। এক. সারা দেশে যখন মিটিং মিছিল করে জনগণকে সরকারের চেহারা কি তা দেখিয়েছে, তার পাশাপাশি তাদের সহায়-সম্পদ যে লুট হয়ে যাচ্ছে সে-কথাটাও নানাভাবে বুঝিয়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত, পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে ছাত্রদলের নেতাকে এবং আরো পাঁচজনকে হত্যা করেছে ছাত্রলীগের নও-জওয়ানরা। এর প্রতিবাদ করেছে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মী। কিন্তু তারা রাজনৈতিক সঙ্ঘাতে জড়ায়নি।
ঠিক এখানেই আরো একটি ভালো উদ্যোগ দেখা গেল বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে। তা হলো সরকারবিরোধী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা এবং তাদের সরকারের বিরুদ্ধে সংগঠিত করা। এমনকি জাতীয় সংসদে যে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল, তাদেরও নিজেদের পাশে আনতে সক্ষম হয়েছে। তারা তো সরকারের চৌদ্দ দলের অংশীজন ছিল। তারা এখন জোটমুক্ত। তারাও সরকারের নানা দোষ-ত্রুটির, লুটেরা কারবারের সমালোচনা করছে। সেই সাথে আগামী নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে- এই দাবিও জানাচ্ছে।
আর সরকারের এক কথা- দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন হবে এই সরকারের অধীনে এবং বর্তমান সংবিধানের অধীনেই। সরকার গোঁ ধরেছে তার অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। আর বিএনপি ও অন্যান্য দল চাইছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার। সরকারের যুক্তি কোনো অনির্বাচিত সরকারের অধীনে তারা নির্বাচন করবেন না। নির্বাচন হতে দেবেনও না। আর বিএনপিও একই কথা বলছে- তারা নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না এবং সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেবে না।
এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই নির্বাচন কমিশন অন্তত ১৫০টি আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এ ভোটগ্রহণের ঘোষণা দিয়ে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকারের কাছে ৮০০ কোটি টাকা দেবার প্রস্তাব পাঠায় এবং সরকার তা একনেকের মাধ্যমে অনুমোদনও করে। নির্বাচন কমিশনের এই তৎপরতা দেখেই বুঝতে কষ্ট করতে হয়নি যে সরকারকে বিশেষ সুবিধা দেবার জন্যই তড়িঘড়ি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারপ্রধানের অনুমোদন নিয়েই তো রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। দিবালোকের মতোই সত্য সিইসি কি করে সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবে? বিএনপি এই ইভিএমকে বলছে ষড়যন্ত্রের বাক্স। দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমবিরোধী- আওয়ামী লীগ ও তিনটি দল, তাদেরই জোটসঙ্গী আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে, বাকিরা ইভিএম প্রত্যাখ্যান করেছে।
এসব রাজনৈতিক চোরাস্রোতের মধ্যেই বিএনপি করণীয় বিষয়ের রূপরেখা তৈরি করেছে। আবার সেই রূপরেখা বাস্তবায়নের রোডম্যাপও তারা করেছে। অর্থাৎ আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো তাদের রাজনৈতিক চেতনার বাস্তবায়নের পদক্ষেপের বিষয়টি ভোটার জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছে। এর মধ্যেই সংবাদপত্রে যেসব রিপোর্ট বেরিয়েছে তাতে জানা যায় রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কার করবে বিএনপি। কারণ রাষ্ট্রযন্ত্রটি ঔপনিবেশিক প্রকরণে সজ্জিত বিধায় এই প্রশাসন জনগণকে সেবা দেয় না বা দিতে পারে না। তারা সেবা দেয় কেবল ক্ষমতাসীন দলকে। তারই একটি নগ্নদৃশ্য আমরা দেখেছি গত ৮ অক্টোবর। সিইসি ডেকেছিলেন দেশের জেলার প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ প্রধানদের (এসপি)। কমিশনার আনিসুর রহমান ডিসি ও এসপিদের সমালোচনা করায় তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায়। মূলত তারা যে সরকারের তল্পিবাহক, সরকারকেই সার্ভ করে নিজেদের দুর্নামের ভাগিদার করেছেন, সেই সত্য বলায় তারা প্রতিবাদ করে। পরে আরো হইচই হয়। আনিসুর রহমানের বক্তৃতা শুনতে চায়নি তারা। এই ঘটনা থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, ডিসি-এসপিরা নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মানবে না। সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তারা দলীয় কর্মীর মতোই আচরণ করবেন, তা বোঝা যায়। অবশ্য ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও তাদের তৎপরতা ছিলো সরকারের চাওয়ার পূর্ণতা দান। তার মানে ওই দু’টি বিতর্কিত নির্বাচনকে যে সিইসি বৈধতা দিয়েছিল বর্তমান সিইসিও সেই পথেই যে হাঁটবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কেন বিএনপি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার চায়- সেটা জনগণ বুঝলেও সরকারপ্রধান ও মন্ত্রীরা বুঝছেন না।
আপনাদের কি মনে আছে ওই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার কায়েমের আন্দোলন করেছিলেন আজকের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও জামায়াতে ইসলামী একযোগে। বেগম জিয়া যখন বলেছিলেন, ওই দাবি পাগল আর নির্বোধদের। কিন্তু তিনি সেই দাবি মেনে নিয়ে পরে নির্বাচন দিয়ে সরকার গঠন করে, সংবিধান সংশোধন করে ওই ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। সেই সরকারের অধীনে শেখ হাসিনা জিতে ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। ২০০১ সালের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসেন আবারও বেগম জিয়া। এরপর ১/১১-এর কীর্তির পর সামরিক বাহিনীর হাত ধরে ক্ষমতায় আসেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পরের ইতিহাস সবারই জানা।
যে আন্দোলন করে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় বসেছিলেন ২১ বছর পর, সেই ব্যবস্থাটিকে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে বাতিল করান তিনি। আবার অ্যামেন্ডমেন্ট করে সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যবস্থা পাকা করেন শেখ হাসিনা।
এখন সরকারি দলের সাথে বিরোধী রাজনীতিকদের মধ্যে মতবিরোধ নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে। বিএনপি মনে করে সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলে ভোট চুরি করে জয় ছিনিয়ে নেবে। আর সরকারি দল মনে করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে সরকারের ভরাডুবি নিশ্চিত। কারণ সরকারের লুটপাটের বিষয়টি জনগণের কাছে সুস্পষ্ট এবং পুলিশ ও ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে ক্ষমতার দণ্ড নিয়ে বসে আছে সরকার।
বিএনপির রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কার ও তার বাস্তবায়ন নিয়ে আরো ব্যাপক প্রচার করা উচিত। কারণ তারা কী সংস্কার করবে এবং কেমন হবে তার চেহারা সেটা আমজনতার কাছে পরিষ্কার করে তুলতে হবে।
আমরা গণতন্ত্র দেখতে চাই সরকারি ব্যবস্থায়। আমরা গণতান্ত্রিক রীতিপদ্ধতির প্রয়োগ দেখতে চাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। দেশের জনগণও সেটা দেখতে চায়। এই চাওয়া পূরণ করাই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান কাজ, প্রধান দায়িত্ব। সেটা করতে না পারলে জনগণের প্রতি ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ রচনার যে কথা বলা হচ্ছে, সেখানে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে সমাজের অরাজনৈতিক কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অধিকারী ন্যায়পরায়ণদের জায়গা দেয়া ভালো উদ্যোগ বলে বিবেচিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবস্থা দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট। সিনেট ও হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভস মিলে হচ্ছে কংগ্রেস। সিনেটর ও প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে আসেন। চেহারা দেখে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয় না।
সামনের দিনগুলো যে রাজনৈতিক মিটিং মিছিলে মুখরিত হয়ে উঠবে, তাতে কোনো ভুল নেই। সেই মুখরিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেন রক্তাক্ত না হয়ে ওঠে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা