০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

ইমাম কারাজাওবির ইন্তেকাল

আল্লামা ইউসুফ আল-কারাদাওবি - ছবি : সংগৃহীত

আল্লামা ইউসুফ আল-কারাদাওবি বা কারাজাওবি, মুসলিম বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে পরিচিত সমসাময়িক আলেম। তিনি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব মুসলিম স্কলারস এবং ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফতোয়া অ্যান্ড রিসার্চের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। গত মাসের ২৬ সেপ্টেম্বর দোহা, কাতারে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তার নিজস্ব আরবি ভাষার ওয়েবসাইট রয়েছে এবং জনপ্রিয় সাইট Islamonline.net ইংরেজি ও আরবিতে, নিজে তত্ত্বাবধান করেন। তিনি ইসলামের ওপর ১২০টিরও বেশি বই লিখেছেন। তার সহকর্মীদের মধ্যে, শাইখের খ্যাতি অত্যন্ত সম্মানের সাথে উচ্চারিত হয় : প্রসিদ্ধ মুস্তাফা আল-জারকা ঘোষণা করেছিলেন যে, তার আল-হালাল ওয়াল-হারাম ফিল-ইসলামের একটি অনুলিপির মালিক হওয়া প্রতিটি মুসলিম পরিবারের দায়িত্ব। বিখ্যাত আবু আল-আলা আল-মওদূদী তার ফিকহ আল-জাকাকে ইসলামী আইনশাস্ত্রে এই শতাব্দীর সেরা বই হিসাবে বর্ণনা করেছেন। আল-জাজিরা আরবি চ্যানেলে সম্প্রচারিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান আল-শরিয়াহ ওয়াল-হায়াত নিয়মিত উপস্থিতির জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন।

আল-কারাদাওবি মিসরে নীল নদের ব-দ্বীপের একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তারা বাবা মাত্র দুই বছর বয়সে মারা যান, মায়ের সাথে মামা আহমদের বাড়িতে বড় হয়েছিলেন। মামা দরিদ্র ভাড়াটে কৃষক হলেও তাকে পুত্র বলে মনে করতেন। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘বেশির ভাগ লোকের কেবল একটি বাড়ি থাকে, তবে আমার দুটি বাড়ি। একটি চাচার অপরটি মামার।’ তার চাচা আহমাদ দিনে পাঁচবার মসজিদে সালাতে যেতেন, এমনকি তাহাজ্জুদের নামাজের জন্যও এবং তার আরেক চাচা কুরআনে হাফেজ ছিলেন।

সরকারি বিদ্যালয়ে পড়া শুরু করার আগেই কুট্টাব বা কোরানিক স্কুলে যোগ দেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি কোরআনে হাফেজ হন। তার চাচা ব্যবসা করার উপদেশ দিলেও তিনি তান্তায় আজহারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেন। সেখানে মুসলিম ব্রাদার্সের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম নেতা হাসান আল-বান্নার কথা শোনার সুযোগ পেতেন। হাসান আল-বান্নাকে তিনি তার আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখেছিলেন এবং এটি ছিল ইসলাম সম্পর্কে পরবর্তীকালের বিস্তৃত ধারণা, যা ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাজনীতিকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, যা জনজীবনে ইসলামের ভূমিকা সম্পর্কে আল-কারাদাওবির উপলব্ধিকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৪ বছর বয়সে, আল-কারাদাওবি ইতোমধ্যে রমজানের মতো অনুষ্ঠানে তার গ্রামের মসজিদে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি তার গ্রামে ইসলামী আইনশাস্ত্রের বা ফিকহর পাঠ দিতে শুরু করেন। আজহারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়, তিনি ছাত্রনেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন।

আলজাজিরা আরবিতে কারাদাওবির নিজস্ব শো হোস্ট করেছেন, ‘আশ-শরিয়াহ ওয়াল-হায়াত বা শরিয়াহ এবং জীবন’ নামে; আল-হায়াত টিভি, বিবিসি আরবি, ফিলিস্তিনি টিভি, আলফারিন টিভি, আল-হিওয়ার টিভিতে তিনি নিয়মিত উপস্থিতি থেকে ইসলামী বিষয় ও মুসলিম উম্মাহর সমস্যা ও জিজ্ঞাসা নিয়ে কথা বলেছেন।

আল-কারাদাওবির সাপ্তাহিক প্রাইম-টাইম ধর্মীয় অনুষ্ঠান শরিয়াহ এবং জীবন, প্যান-আরবি চ্যানেলের সবচেয়ে জনপ্রিয় শোগুলোর মধ্যে একটি। লাখ লাখ দর্শক সাপ্তাহিক এই অনুষ্ঠান দেখতেন। ১৯৯৬ সালে এই শো যাত্রা শুরু করেন। সোশ্যাল মিডিয়া টুইটার এবং ফেসবুকে ৪০ লাখের বেশি অনুসরণকারী রয়েছে।

আল-কারাদাওবি বিশ্বের সর্বাধিক দেখা আরবি নিউজ নেটওয়ার্কে তার নিজস্ব টিভি শোসহ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ ছিলেন এবং তিনি তার অনেক লেখার মধ্যে যে ধারণাগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলেন তা প্রচার করার জন্য আধুনিক এই প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করেছিলেন। মিসরে না থাকলেও মিসরবাসীর জন্য তার অনলাইন নির্দেশনা ও বক্তৃতা বারুদের মতো কাজ করত।

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৩০ বছরের নির্বাসন শেষে তিনি মিসরে ফিরে আসেন মুবারকের পদত্যাগের এক সপ্তাহ পর তাহরির স্কয়ারে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতেতে জুমার নামাজের নেতৃত্ব দেন। জুমার খুৎবায় তিনি বলেছিলেন, ‘কেউ যেন আপনার কাছ থেকে এই বিপ্লব চুরি না করে- মুনাফিকরা তাদের জন্য উপযুক্ত নতুন মুখ খুঁজে বের করবে।’ সামরিক বাহিনী মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর আল-কারাদাওবি তাকে ‘অভ্যুত্থান’ হিসেবে বর্ণনা করেন ও তীব্র নিন্দা জানিয়ে ফতোয়া জারি করেন। ফতোয়ায় বলেন যে, মুরসিকে সমর্থন করা মিসরের জনগণের জন্য বাধ্যবাধকতা রয়েছে, কেননা এখানে ইসলামের স্বার্থ জড়িত রয়েছে। মিসরীয় জনগণ ও সেনাবাহিনীর কাছে তিনি বৈধ নেতৃত্ব ফিরিয়ে দিতে লবিং শুরু করেন। ২০১৩ সালে পুনরায় নির্বাসনে বাধ্য করা হয়েছিল এবং ২০১৫ সালে মিসরের একটি ফরমায়েশি আদালত ব্রাদারহুডের অন্য নেতাদের সাথে আল-কারাদাওবিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

আল-কারাদাওবির লিখিত শৈলী সহজতর ছিল। তিনি প্রাক-আধুনিক ইসলামী আইনি ম্যানুয়ালগুলোর অপেক্ষাকৃত অস্পষ্ট ভাষা থেকে দূরে সরে গিয়ে সাধারণ পাঠক পড়তে ও বুঝতে পারে, সে দিকে বেশি জোর দিয়েছিলেন।

তিনি ধর্মীয় এনডাওমেন্টস মন্ত্রণালয় এবং আল-আজহারের সাংস্কৃতিক বিভাগে সংক্ষিপ্তভাবে কাজ করেছিলেন এবং ১৯৬২ সালে এই প্রতিষ্ঠান তাকে কাতারে পাঠিয়েছিল তার কেন্দ্র পরিচালনার জন্য। দোহায় তিনি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ এবং ইসলামী আইন ও ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি আল-আজহার থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন, ‘সামাজিক সমস্যার সমাধানে আইনি দীক্ষা জাকাতের ভূমিকা’র ওপর থিসিস করে।

এরপর থেকে তিনি অসংখ্য বই লিখেন। ইসলামী সমাজে তার অসংখ্য অবদানের জন্য বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান আল-কারাদাওবি পুরস্কার ও স্বীকৃতি প্রদান করে। এর মধ্যে রয়েছে ইসলামী অর্থনীতিতে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) পুরস্কার- ১৯৯১, ইসলামিক স্টাডিজের জন্য কিং ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার-১৯৯৪, সুলতান হাসান আল বলকিয়াহ (ব্রুনাইয়ের সুলতান) ইসলামী আইনশাস্ত্রের জন্য পুরস্কার ১৯৯৭, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জনের জন্য সুলতান আল ওয়াইস পুরস্কার-১৯৯৮-১৯৯৯, দুবাই ইন্টারন্যাশনাল হলি কুরআন অ্যাওয়ার্ড ফর ইসলামিক পার্সোনালিটি অব দ্য ইয়ার-২০০০ The State Acknowledgement Award for Contributions in the field of Islamic Studies from the Government of Qatar–2008। কাতার ফাউন্ডেশন ফর এডুকেশন, সায়েন্স অ্যান্ড কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টের অংশ, ২০০৯ সালে ‘শেখ ইউসুফ আল কারাদাওবি স্কলারশিপ’ প্রতিষ্ঠা করে। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট অধ্যয়নের জন্য প্রতি বছর পাঁচজন শিক্ষার্থীকে তাদের পুরস্কার করে। এটি তার প্রতিষ্ঠিত গবেষণা কেন্দ্রের নামকরণও করেছিল।

কারাদাওবি সেন্টার ফর ইসলামিক মডারেশন অ্যান্ড রিনিউয়াল। ইসলামিক স্টাডিজের জন্য স্টেট মেরিট প্রাইজ ৩ নভেম্বর ২০০৯ সালে কাতারের সংস্কৃতি, কলা ও ঐতিহ্য মন্ত্রণালয় কারাদাওবিকে প্রদান করে।

তিনি অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজের ট্রাস্টি এবং ব্যারি অসবোর্ন প্রযোজিত ‘মোহাম্মদ’কে নিয়ে বহু মিলিয়ন ডলারের ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্রের জন্য প্রযুক্তিগত পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন। ২০০৮ সালের ফরেন পলিসি অনলাইন জরিপে তাকে বিশ্বের শীর্ষ ২০ জন বুদ্ধিজীবীর তালিকায় ৩ নম্বরে রাখা হয়। আল-কারাদাওবি ১২০টিরও বেশি বই লিখেছেন এবং তার একাডেমিক শৈলী এবং উদ্দেশ্যমূলক চিন্তাভাবনা তার কাজের কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে মনে করা হয়। অনেক বই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। যেমন ফিকহ আল-যাকাত, এই বইটিকে যাকাতের সবচেয়ে ব্যাপক কাজ হিসেবে বিবেচনা করে অনেকে বলেন যাকাতের বিশ্বকোষ। বাংলা ভাষায়ও বইটি অনূদিত। এমন আরেকটি বই ফিকহ আল-জিহাদ, এই বইটি নিয়েও ইসলামী বিশ্বে প্রচুর প্রশংসা রয়েছে।

পরবর্তী দশকগুলোতে অবৈধ সহিংসতা এবং এর কারণ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি সূক্ষ্ম এবং প্রভাবশালী সমালোচনা লিখেছিলেন, ১৯৮২ সালে লিখেন, ইসলামিক জাগরণ : প্রত্যাখ্যান এবং চরমপন্থা, ৯/১১-তে আল-কায়েদা, আইএসআইএল বা আইএস যে সহিংসতা চালিয়েছে, তার বিষয়ে দ্ব্যর্থহীন নিন্দা জানান। মূলধারার মুসলমানরা এ ধরনের গোষ্ঠীকে প্রত্যাখ্যানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর হিসেবে কারাদাওবিকে অনুসরণ করে।

১৯৬১ সালে আল-কারাদাওবি একজন শিক্ষক হিসেবে কাতারে যান, যাতে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যদের মতো নিপীড়ন থেকে বাঁচতে পারেন। কাতারে তিনি আমির শেখ আহমদ বিন আলি আল থানির সাথে ঘনিষ্ঠ হন যিনি ১৯৭৭ সালে মারা যান। আমির তাকে উচ্চ মর্যাদায় ধরে রাখতে চেয়েছিলেন এবং তাকে কাতারের নাগরিকত্ব প্রদান করেছিলেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে মিসরের শাসকদের তখন প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব হতো। বিক্ষোভ মারামারি ধাওয়া নিয়মিত চলত। এর ফলে ১৯৪০ এবং ৫০ এর দশকে কারাদাওবি বারবার কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, তার কারারক্ষীদের হাতে তিনি নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।

সৌদি সরকারী পত্রিকা আরব নিউজ বলেছে : ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের অন্যতম উৎসস্থল। এটি একটি ধর্মীয়-রাজনৈতিক সংগঠন। কিছু উপসাগরীয় দেশ এবং অনেক পশ্চিমা দেশে এই দল অননুমোদিত ও নিষিদ্ধ।’ ২০১৩ সালে কায়রো এই আন্দোলনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করে। এই সম্পর্ক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের হত্যার আদেশ দেয়া (সিসির বানোয়াট অভিযোগ), মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে তার সম্পর্ক, ইসলামী বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় ঘৃণাকে উস্কে দেওয়া, রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য সহিংসতার একটি কাল্ট প্রচার, এসব অভিযোগ আনা হয়েছিল। পত্রিকার ভাষায় ‘তিনি আত্মঘাতী বোমা হামলাকে সমর্থন করেছিলেন, বারবার একটি সম্প্র্রদায় হিসেবে ইহুদিদের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন এবং মহিলাদের অবজ্ঞা করে, এমন ফতোয়া জারি করেছিলেন। কারাদাওবি ইসলামী আধিপত্যের একটি বিষাক্ত উত্তরাধিকার রেখে গেছেন।’ ওই নিবন্ধে কারাদাওবির কিছু ফতোয়া তুলে ধরে বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়। কতটুকু বিতর্কিত পাঠকমণ্ডলী নিজেরাই বিবেচনা করতে পারবেন।

২০০৩-২০০৫ : ইসরাইল এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধে জিহাদের আহ্বান জানিয়ে বেশ কয়েকটি ফতোয়া জারি করেছিলেন, যেখানে তিনি ফিলিস্তিনে বসবাসকারী সব প্রাপ্তবয়স্ক ইহুদিকে ‘দখলদার’ এবং যোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, যা তাদের যুদ্ধের বৈধ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। ২০০৪ : ইরাকে মার্কিন উপস্থিতির বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থানকে ন্যায়সঙ্গত করে এবং যারা লড়াই করে তাদের হত্যার অনুমতি দেন। ২০১০ : দাবি করা হয় যে, আত্মঘাতী বোমারুরা আসলেই আত্মহত্যা করে না, বরং তাদের অপারেশন চালানোর একটি আকস্মিক পরিণতি হিসেবে মারা যায়, যা পবিত্র যুদ্ধে একটি গৌরবোজ্জ্বল আত্মত্যাগ হিসাবে গণনা করা হয় এবং তাদের শহিদ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। তিনি ইসরাইলি লক্ষ্যবস্তুতে ফিলিস্তিনি আত্মঘাতী বোমা হামলাকেও সমর্থন করেন। ২০১৩ সালে হামাসের ক্ষমতাসীন ইসলামী গোষ্ঠী শাসিত গাজায় সফরকালে কারাদাওবি বলেন, ‘আমাদের উচিত ফিলিস্তিনকে, পুরো ফিলিস্তিনকে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে মুক্ত করার চেষ্টা করা।’ ২০১৩ : আরব বসন্তের সময় মিসরে হোসনি মুবারকের সরকারকে উৎখাত করার পক্ষে ছিলেন। ২০১৫ : মোহাম্মদ মুরসি মিসরে ক্ষমতা গ্রহণের পর যে কেউ দেশের বৈধ নেতার বিরুদ্ধে গিয়েছিল তাকে ‘খাওয়ারিজ’ বা ইসলামের শত্রু বলে অভিহিত করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেছিলেন : ‘আমি প্রায় এক-চতুর্থাংশ শতাব্দী ধরে চরমপন্থা ও চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি দীন ও দুনিয়া (ধর্ম ও সমসাময়িক জগৎ), ব্যক্তি ও সমাজের প্রতি এর হুমকি দেখেছি এবং আমি আমার কলম, জিহ্বা এবং চিন্তাধারাতে সংযমের আহ্বানকে শক্তিশালী করেছি এবং অতিরঞ্জন এবং অবহেলা প্রত্যাখ্যান করেছি, তাবলিগ এবং দাওয়াহ (নির্দেশনা ও প্রচার)-এর ক্ষেত্রেও।’ তিনি ফতোয়ায় বলেন, ‘শাহাদাত হচ্ছে জিহাদের একটি উচ্চতর রূপ।’ ২০০৪ সালে বিবিসির নিউজনাইট প্রোগ্রামে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ইসরাইলি অধিকৃত ফিলিস্তিনে আত্মঘাতী বোমা হামলাকে আল্লাহর নামে শাহাদাত হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ‘আমি শাহাদাত অভিযানকে সমর্থন করেছি, এবং আমিই একমাত্র নই।’

কারাদাওবি মুসলিম ব্রাদারহুডের অন্যতম বুদ্ধিজীবী নেতা। তিনি ১৯৭৬ এবং ২০০৪ সালে তাদের সরাসরি নেতা হওয়ার প্রস্তাব দুইবার প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে পছন্দ করতেন। এই আওয়াজ যখন বুলন্দ হতে শুরু করে তখন তিনি ১৯৯৭ সালের গোড়ার দিকে মিডিয়ায় বলেছিলেন যে, তিনি ব্রাদারহুডের সদস্য নন। জীবনের শুরুর দিকে, মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্কের জন্য তাকে তিনবার কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৭০ দশকে তার মিসরীয় নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছিল। মিসরে নিষিদ্ধ সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে যুক্ত আরো ১০০ জনেরও বেশি মিসরীয়র সাথে মিসরের একটি আদালত কারাদাওবিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। মজার বিষয়, ইন্টারপোল ২০১৭ সালে তাদের ‘ওয়ান্টেড’ ও কালো তালিকা থেকে কারাদাওবিকে বাদ দেয়। নতুবা বিন লাদেন, আলজাওয়াহিরির মতো ভাগ্যবরণ করতে হতো। কারাদাওবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘৯/১১’ হামলার প্রকাশ্যে নিন্দা করতেন।

কারাদাওবি আরব বসন্তের গণঅভ্যুত্থানের একজন বিশিষ্ট সমর্থক ছিলেন, লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যা এবং সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছিলেন ফলে উপসাগরীয় দেশগুলোতে রাজনৈতিক মেরুকরণ ও ভারসাম্য উভয় দিকে যথেষ্ট সাপোর্ট পেয়েছিল।

তিনি ধর্ম থেকে শুরু করে রাজনীতি, পশ্চিমা গণতন্ত্র এবং জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্যালেস্টাইনসহ মুসলিম বিশ্বের মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য ইসলামকে ‘ব্যবহার’ করেছিলেন। এর ফলে তিনি গ্লোবাল মুফতি উপাধি অর্জন করতে পেরেছিলেন যার কারণে নিন্দুকরা আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছিল। তিনি কখনো তার দৃষ্টিভঙ্গি বা মতামত পরিবর্তনকে দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করতেন না। তার ফতোয়াগুলোতে অপরিসীম জ্ঞান ও বিচার বিশ্লেষণে সূক্ষ্মতা ছিল। তার ইন্তেকাল উম্মাহর শতাব্দীর বিয়োগান্ত ঘটনা।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement