২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ঢাকা শহরে রিকশা : সমস্যা ও সম্ভাবনা

ঢাকা শহরে রিকশা : সমস্যা ও সম্ভাবনা - ছবি : সংগৃহীত

১৯৩৮ সালে শৌখিনতার ধারক হিসেবে যাত্রা শুরু যে ত্রিচক্রযানের, তাই কালের পরিক্রমায় এখন কারো জীবিকা, কারো জীবনে গতির সঞ্চালক। এর সাহায্য ছাড়া নাগরিক জীবন মোটামুটি অচল। বাধাগ্রস্ত হয় জীবনের স্বাভাবিক দৈনন্দিন প্রবাহ। ঢাকা শহরে তো বটেই, অন্যান্য শহর এমনকি গ্রামীণ জনপদেও এর অপ্রতিরোধ্য ভূমিকা অপরিসীম। অবশ্য সময়ের সাথে সাথে চেহারাটা বদলেছে। প্যাডেলের পরিবর্তে যোগ হয়েছে বিদ্যুতায়িত ব্যাটারি। ১৯৪১ সালে ৩৭টি রিকশার জায়গায় এখন প্রায় ১২ লাখ রিকশা এই রাজধানী শহরে চলাচল করে। ঢাকা শহরে ৬৬ শতাংশ নাগরিকের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে রিকশা। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রিকশার কারণে ঢাকা শহরে বছরে ৩৭৪ বিলিয়ন টাকার এক বিরাট কর্মযজ্ঞ চলে। বস্তুত কোনো প্রান্তিক মূলধন ছাড়া এ বিশাল অর্থযজ্ঞ অর্থনীতি শাস্ত্রে এক বিস্ময়ের ব্যাপার। যাতায়াত নাগালের মধ্যে, ব্যয়সাধ্য, পরিবেশবান্ধব এই বাহনটি কমবেশি সবারই পছন্দের।

রিকশা পছন্দের বাহন হলেও বিভিন্ন কারণে এটি বিরক্তিকরও বটে। রিকশাচালকদের শতভাগই গ্রাম থেকে আসা। ট্রাফিক আইন, রাস্তা চলার নিয়ম, দূরত্বের ভাড়া সব কিছুই তাদের অজানা। যাত্রীদের সাথে অশালীন ভাষা ও বাজে ব্যবহার বিরক্তির আরেকটি কারণ। সুনির্দিষ্ট রিকশাস্ট্যান্ড না থাকার কারণে রাস্তার মোড়ে মোড়ে এমনকি বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। দেখা যায় উল্টো দিকে রিকশা চালিয়ে যেতে। আবার হঠাৎ বিকল হয়ে যাওয়া রিকশা মেরামতের জন্য দেখা যায় মূল সড়কে মেরামতের ব্যবস্থা। ঢাকা শহরে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয়ার যথেষ্ট ব্যবস্থা না থাকায় যত্রতত্র রিকশাচালকদের এসব কাজের জন্য দৃষ্টিকটু, অস্বাস্থ্যকর ও দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ নাগরিক জীবনের যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয়। ঢাকা শহরের জন্য বরাদ্দ পানি, খাদ্য ও বিদ্যুৎব্যবস্থার ওপর এরা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। অনেকে মনে করেন, নাগরিক জীবনের ওপর এরা একটি বোঝা। বিশেষ করে যানজটের ব্যাপারে। রাস্তায় রিকশার চাপে পথ চলা দায়। অবস্থাটা এমন যে, মনে হয় এই বুঝি গায়ের ওপর রিকশা এসে পড়ল। মনে হয়, রিকশার জন্যই ঢাকা শহর।

রিকশাচালকরা ভাসমান জনগোষ্ঠী হওয়ায় প্রায়ই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় তারা রিকশা চালায় ও বিয়ে করে সংসারী হয়। কিছু দিন পর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়-পরিবার পরিজন ছেড়ে উধাও হয়ে যায়। এভাবেই তারা একটি সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে। সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হচ্ছে- এরা প্রায় সবাই রাস্তার পাশে ছোটখাটো ঝুপড়ি হোটেলে খাওয়ার জন্য নির্ভরশীল। সাধারণ স্বাস্থ্য নিয়মের বালাইহীন এসব হোটেলে খাওয়ার কারণে এরা হেপাটাইটিস, আমাশয়, টাইফয়েডসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগে ভোগে এবং সর্বত্র ছড়ায়। এরা একই সাথে একাধিক রোগে ভোগে। চিত্তবিনোদনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এরা জুয়া ও নেশায় আসক্ত হয়ে ওঠে। নিষিদ্ধ পল্লীতে যাতায়াত এদের বিনোদনের আরেকটি মাধ্যম। ফলে বিভিন্ন ধরনের রোগে নিজেরা ভোগে ও পরিবার-পরিজনের ভেতর ছড়ায়। এসব কারণে বিভিন্ন সময় দাবি ওঠে রিকশা বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপারে। এটি সঙ্গত কারণেই একজন দাবি করতে পারেন। কিন্তু রিকশা উঠে গেলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? যাতায়াত ব্যয় কি নাগালের ভেতর এসে যাবে? রাস্তাগুলো কি যানজট মুক্ত হয়ে যাবে?

রিকশাজনিত যে বিশাল অর্থযজ্ঞ তা থেকে সরকার বা সিটি করপোরেশন লাভবান হয় না। অথচ পুরো ব্যাপারটিকেই একটি চমৎকার রাজস্ব আহরণের ভেতরে আনা যায়। তা হলো- প্রথমত : রিকশা অবশ্যই বৈধ প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদিত হতে হবে। এটি সিটি করপোরেশন হতে পারে, ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ হতে পারে। সিটি করপোরেশন রিকশার কোনো অনুমোদন দেয় না। ১৯৮৯ সালে মাত্র ৯০ হাজার রিকশার অনুমোদনের পর থেকে সিটি করপোরেশন অজানা কারণে এটি বন্ধ করে দেয়।


বর্তমানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে রিকশার অনুমোদন দিচ্ছে। ফলে রিকশার প্রকৃত সংখ্যা অজানাই থেকে যাচ্ছে। বৈধ কর্তৃপক্ষ রাজস্ব হারাচ্ছে। শহরে বিভিন্ন স্থানে রিকশাস্ট্যান্ডের ব্যবস্থা করলে যত্রতত্র রিকশাস্ট্যান্ড তৈরি হবে না। রিকশা অনুমোদনের সময় চালকদের দুই বা তিন দিনের জন্য মৌলিক সড়ক আইন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। মূল সড়ক বা রিকশা নিষিদ্ধ সড়ক সম্পর্কে তাদের ধারণা দেয়া দরকার। দরকার তাদের জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষার বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা। যতটুকু সম্ভব শ্রম আইন সম্পর্কে সচেতন করা। সাপ্তাহিক বা দৈনিক বিশ্রাম, পুষ্টিসম্পন্ন খাবার ও মৌলিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পর্কে চালকদের প্রশিক্ষিত করতে পারলে শহরের রাস্তাগুলো কিছুটা হলেও পথচারীবান্ধব হবে। সরকারি কোষাগারে বাড়বে রাজস্ব আয়। রিকশাচালকরা পাবে স্বস্তির জীবন। নাগরিক জীবনও হয়ে উঠবে অনেকটাই স্বাচ্ছন্দ্যের। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.comp


আরো সংবাদ



premium cement