০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

বেঁচে আছি, শোকর আলহামদুলিল্লাহ

- ছবি : নয়া দিগন্ত

এই পৃথিবীতে জীবন-মৃত্যু বা বেঁচে থাকা কিংবা মরে যাওয়া সব কিছুই মহান আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভরশীল। তিনি কখন কার মৃত্যু কোথায় লিখে রেখেছেন তা কেউ এক সেকেন্ড আগেও জানতে পারে না। তবুও সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষায়, মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় আধুনিক সরকারব্যবস্থায় নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কেউ যদি কারো ওপর জুলুম করে রাষ্ট্র তার প্রতিবিধানে ব্যবস্থা করে। সেজন্য গড়ে তোলা হয়েছে পুলিশ বাহিনীসহ নানান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আদালত। আদালতের রায়ে নির্যাতনকারী ব্যক্তির সাজা হয়, তাকে জেলদণ্ড দেয়া হয়। এভাবে সমাজ চলে। মানুষ যখন কোনো অন্যায়ের শিকার হয় তখন সে দ্রুত পুলিশের কাছে যায়। সরকার তো থাকে বহু দূরে। তাদের সাথে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। ফলে, পৃথিবীতেই বিচার পেতেই মানুষকে পুলিশের দ্বারস্থ হতেই হয়। কিন্তু, সব ক্ষেত্রেই কি পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানুষের বিপদের বন্ধু? তা কিছুতেই নয়। সরকার কিংবা পুলিশকে তাদের কৃতকর্মের জন্য ইহলোকে যেমন ভুগতে হয় তেমনি পরকালেও রয়েছে তাদের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা। সে শাস্তিদাতা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। পৃথিবীর শাস্তি থেকে কেউ কোনোভাবে নিস্তার পেলেও আল্লাহ তায়ালার শাস্তি থেকে নিস্তার নেই। যদিও তিনি পরম দয়ালু ও সর্বজ্ঞ। অধিকাংশ মানুষ এ কথা জানেন কিন্তু পরকালের ভয় তাদের ভীত করে না। পৃথিবীতে অপরাধ চলে আসছে এবং ধারণা করি, কেয়ামতের আগ পর্যন্ত সে অপরাধ, পাপাচার, শঠতা, বঞ্চনা, নিপীড়ন চলতেই থাকবে। মানুষ বিচার চেয়ে ক্লান্ত হয়ে যাবে। আর বিচার চাইতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে নানা ধরনের হেনস্তার শিকার হবে।

এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। পুলিশ নাগরিকদের জিম্মি করে টাকা আদায় করছে। র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিচ্ছে প্রিয় স্বজনদের। টাকা দাবি করছে কিংবা একেবারেই গুম করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা অশ্রæ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সমবেত হচ্ছে। কেউ বলছে, আমার বাবাকে ফিরিয়ে দাও, কেউ বলছে, আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দাও, যদি খুন করে থাকো, তবে তার লাশ ফিরিয়ে দাও। কোথায় কবর দিয়েছ জানাও। অন্তত কবরের পাশে দাঁড়িয়ে যেন দোয়া করতে পারি। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র ‘আয়না ঘরের’ খবরও ফাঁস হয়ে গেছে। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই গুম খুনের প্রতিকার দাবি করছে।

কিন্তু, প্রতিকার তো দূরের কথা, আমার সন্তান হারিয়ে গেছে বা আমার সন্তানকে গুম করা হয়েছে এ অভিযোগ যারা করছেন তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কাছ থেকে এই মর্মে মুচলেকা নেয়ার চেষ্টা করছে যে, তাদের স্বজনরা আসলে গুম হয়নি, আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে আত্মগোপন করে আছে। অধিকাংশ পরিবারই এ ধরনের দলিলে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন তাদের পিতা-মাতা ও ভাইবোনদের ওপর নতুন নির্যাতন নেমে আসে। এই নির্যাতনের উদ্যোক্তা এখন রাষ্ট্র বা সরকার নিজেই। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছেন যে, তোমরা পিতার অপরাধে পুত্রকে, আর পুত্রের অপরাধে পিতাকে দোষী সাব্যস্ত করো না।’ এ ছাড়া হজরত মুহাম্মদ সা: বিদায় হজের ভাষণেও একই কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা দেখেছি সাংবাদিক কনক সারোয়ারের অনুষ্ঠানমালা সরকারের পছন্দ হয় না বলে বাংলাদেশে অবস্থানরত তার বোনকে সরকার আটক করেছে। একইভাবে যুক্তরাজ্য প্রবাসী রাষ্ট্রপতি ইয়াজুদ্দিনের উপ-প্রেস সচিব সামসুল আলম লিটনের বক্তব্য সরকারের পছন্দ হয়নি বলে বাংলাদেশে তার ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এটি অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। এটি নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও সরকার এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে।

এখন বাংলাদেশের নাগরিকদের বিপদে-আপদে কার্যত কোনো আশ্রয় নেই। মানুষ সাধারণত এসব বিপদে পুলিশের কাছে ছুটে যায়। কিন্তু সেখানে প্রতিকারের আশা খুবই কম। পুলিশ পারত পক্ষে মামলা গ্রহণ করে না। ঘুরায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎকোচ দাবি করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্ব্যবহার করে বিদায় করে দেয়। মামলা গ্রহণ করা মানে কাজ করা। যেহেতু সরকারের অতি প্রিয়, আর পুলিশের ধারণা তারাই এ সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে। সুতরাং কাজ কেন তারা করবে? যেভাবেই হোক তারা শুধু টাকা বানাবে। সেজন্যই পুলিশ মাঝে মধ্যেই ধরাও পড়ে। শাস্তি যেটুকু হয় তা অতি নগণ্য। শাস্তির নাম প্রত্যাহার।

অর্থাৎ কিছু দিন পুলিশ সদর দফতরে তাদের বসিয়ে রেখে আবার কোথাও না কোথাও পোস্টিং দেওয়া। এগুলো ডাল-ভাত। ফলে, পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এদের অধিকাংশই দলীয় কর্মী। ফলে, বিরোধী দলের মিছিল মিটিং-এ তারা একেবারে হত্যা করার উদ্দেশ্যে গুলি চালায়। সরাসরি মুখ বরাবর কিংবা বুকে। গত কয়েক দিনেই এ রকম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি। পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিএনপি কর্মী হত্যায় বিএনপির লোকরাই দায়ী- এমন স্টেটমেন্ট আদায় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি ক’দিন আগে মুন্সীগঞ্জে গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। শাওনের বাবা নয়া পল্টনের সমাবেশে হাজার হাজার মানুষের সামনে বলেছেন, পুলিশ তাকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছে যে, বিএনপির লোকদের ইটের আঘাতেই শাওনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া, শ্লীলতাহানির শিকার নারীরা পুলিশের কাছে বিচার চাইতে গিয়ে আরেক দফা শ্লীলতাহানির স্বীকার হয়েছেন, এমন অভিযোগও কম নয়।

সুতরাং পুলিশের কাছ থেকে আর বেশি কী আশা করা যায়? এখানে মৃত্যু অবিরাম হানা দিচ্ছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর রাতে ভৈরব থেকে ঢাকায় আসার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হন একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্তা আল মামুন। ভৈরব থেকে তিনি একটি প্রাইভেট কারে ঢাকা আসছিলেন। সেটি ছিল যাত্রীবাহী। গাড়িটি নরসিংদী আসার পর গাড়িতে থাকা ডাকাত দলের সদস্যরা তার হাত-পা ও চোখ বেঁধে ফেলে। তারা তার গলায় ছুরি ধরে পকেট থেকে মুঠোফোন ও মানিব্যাগ কেড়ে নেয়। মানিব্যাগে ব্যাংকের কার্ড ছিল। ডাকাতরা হত্যার হুমকি দিয়ে আল-মামুনের কাছ থেকে গোপন নম্বর নিয়ে নরসিংদীতে ডাচবাংলা ব্যাংকের বুথ থেকে দু’দফায় এক লাখ ৫১ হাজার টাকা তুলে নেয়। এক পর্যায়ে তার পকেটে ২০০ টাকা দিয়ে তারা আল মামুনকে বাবুরহাট এলাকার একটি হোটেলের সামনে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ফেলে পালিয়ে যায়। ছিনতাইকারীরা যখন তাকে রাস্তায় ফেলে দেয়, তখন গভীর রাত। তিনি কাছের একটি বাজারে গিয়ে এক নিরাপত্তা কর্মীর মুঠোফোন থেকে ৯৯৯-এ কল করেন।

এরপর নরসিংদী সদর ও মাধবদী থানার পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসেন। দুই থানার সদস্যরা কথা বলে তাকে মাধবদী থানায় নিয়ে যান। কিন্তু থানা তার অভিযোগ না নিয়ে, তাকে ঢাকার একটি বাসে তুলে দেন। ঘটনার চার দিন পর এ বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ নিয়ে তিনি আবার নরসিংদী থানায় যান। আল মামুন জানান, ‘অভিযোগ দেখে নরসিংদী সদর থানার ওসি বলেন, আপনি ব্যাংকে চাকরি করেন, এই ভুল কেমনে করলেন? বেঁচে আছেন শুকরিয়া করে চলে যান।

আল মামুন জানান, ৯৯৯-এ ফোন করলে মুঠোফোন কনফারেন্সে তার সাথে মাধবদী থানা ও নরসিংদী থানা পুলিশ সদস্যদের কথা বলিয়ে দেয়া হয়। আর কাছাকাছি সময়ে এই দুই থানার পুলিশ তার কাছে ছুটে আসে। তারা তাকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মাধবদী থানায় নিয়ে যান। আল মামুন বলেন, থানায় যাওয়ার পর পুলিশ আমার অভিযোগ না নিয়ে বলেন, ঘটনাস্থল তাদের এলাকায় নয়। তখন আমি পুলিশকে বলেছিলাম, এখন অনেক রাত, আমাকে থানায় থাকতে দিন, সকালে চলে যাব। কিন্তু পুলিশ ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ১০০ টাকা দিয়ে আমাকে গাড়িতে তুলে দেন। আল মামুন এর দু’দিন পর নরসিংদী পুলিশ সুপারকে ঘটনাটি খুলে বলেন। পুলিশ সুপার তাকে থানায় গিয়ে অভিযোগ করতে বলেন। পরদিন লিখিত অভিযোগ নিয়ে তিনি নরসিংদী থানায় যান। তখন ওসি তাকে শুকরিয়া করার পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানায় যেতে বলেন। এ বিষয়ে ওসি ফিরোজ তালুকদারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ঘটনাটি শুরু হয়েছে ভৈরব থানা এলাকা থেকে আর যেখানে তাকে ফেলে রেখে গেছে সেটা মাধবদী থানা এলাকায় পড়ে। এ জন্য অভিযোগ রাখা হয়নি।

এ রকম আজব সেবাই আমরা পুলিশের কাছ থেকে পেয়ে থাকি। এই যে সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত এখানে বেঁচে থাকা, প্রতিটি মানুষকে শুকরিয়া আদায় করতে হয়। কখন কোথায় কিভাবে সে ‘নাই’, হয়ে যাবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। আর তাই নরসিংদী থানার ওসি ফিরোজ তালুকদারের কথাই সত্য- বেঁচে যে আছি, সে তো আল্লাহ তায়ালার রহমত। তার কাছে হাজার শুকরিয়া।’

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement