২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পুলিশ নিয়ে যত কথা

- ছবি : সংগৃহীত

পুলিশ বাহিনী আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অংশ। জনগণের জানমালের নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে মনে করা হয় এই বাহিনীকে। বস্তুত, পুলিশ রাষ্ট্র কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে আইন কার্যকর, সম্পত্তি রক্ষা, সামাজিক ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এবং জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত। তাদের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও জবাবদিহি চাকরিবিধি, প্রচলিত আইন এবং সংবিধান দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। সাধারণত পুলিশ বাহিনীকে সামরিক বা অন্যান্য বিদেশী আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে দেশ প্রতিরক্ষায় জড়িত প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। কারণ, এই বাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে- দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও জানমালের নিরাপত্তা বিধান। এ ক্ষেত্রে আমাদের পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও দেশাত্মবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম রয়েছে।
আমাদের দেশের পুলিশ অত্যন্ত পেশাদার ও সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই বাহিনী উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করে। কিন্তু এক শ্রেণীর অসাধু ও অপরাধপ্রবণ পুলিশ সদস্যের কারণেই সা¤প্রতিক বছরগুলোতে রাষ্ট্রের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বাহিনী দেশ-বিদেশে রীতিমতো ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে। এমনকি একশ্রেণীর পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রায়ই বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অপহরণ। কোনো কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে ভাড়াটিয়া মাস্তানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার গুরুতর অভিযোগও রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এসব অভিযোগের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। সদস্যদের এ ধরনের অপরাধে জড়ানো ঠেকাতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে পুলিশ সদর দফতর।

স¤প্রতি পল্লবী থানার সাদা পোশাকধারী এএসআই মাহবুবুল আলম একজন সোর্সের কাছ থেকে ইয়াবার প্যাকেট নিয়ে এক পথচারীর পকেটে ঢুকিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন। সেই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। চট্টগ্রামে টাকা না পেয়ে তিন যুবককে তুলে নিয়ে বর্বর নির্যাতন চালানোর অভিযোগের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তুচ্ছ ঘটনায় প্রথমে তুলে আনা হয় থানায়। মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে না পেয়ে চালানো হয় নির্যাতন। পরে ডাকাতির প্রস্তুতির সাজানো মামলায় পাঠানো হয় কারাগারে। তাদের তুলে আনা হয় এক জায়গা থেকে, মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় অন্য জায়গায়। এমন গুরুতর অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের ভুজপুর থানা পুলিশের বিরুদ্ধে। যা পুরো বাহিনীকেই গ্রহণযোগ্যতা সঙ্কটে ফেলেছে।

এদিকে জয়পুরহাটে ভ‚মিদস্যুদের হাতে অবৈধভাবে প্রভাবিত হয়ে নিরীহ ও নিরপরাধ আনসার ভিডিপির সদস্য গোলাম হাফিজ মীর্জা ও তার ছোট ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার ঘটনা ছাড়াই নিজের জমি থেকে তুলে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের মিথ্যা মামলা দায়ের করে কথিত অভিয্ক্তুদের জেলহাজতে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে সদর থানার এসআই আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে জয়পুরহাট পুলিশ সুপার বরাবর স্থানীয় পূর্ব সুন্দরপুর ও মুরারীপুর গ্রামের গ্রামবাসী সংশ্লিষ্ট এসআইয়ের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছে। এক প্রত্যয়নপত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সাইফুল ইসলামও অনুরূপ অভিযোগ করেছেন। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষে মাওলানা শামছুজ্জামান গত ২৭ আগস্ট জয়পুরহাট প্রেস ক্লাবে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন ও এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এবং মিথ্যা মামলার সুবিচার প্রার্থনা করে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিসহ সংশ্লিষ্টদের সহায়তা চেয়েছেন। এ বিষয়ক সংবাদ বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছে। বিষয়টি জেলা পুলিশ তদন্ত করছে বলে জানা গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তদন্তের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি।

মূলত, একশ্রেণীর পুলিশ সদস্যের অপরাধপ্রবণতা এখন প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও পুলিশের সব ইউনিট প্রধানের কাছে প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে অভিযোগ আসছে। গত সাড়ে চার বছরে ৬১ হাজারের বেশি অভিযোগ এসেছে বলে জানা গেছে। ২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক আইজিপি কমপ্লেন সেল চালু করার পর থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি আসছে। এসব অভিযোগ নিয়ে পুলিশ সদর দফতরে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পুলিশের অপরাধ রুখতে প্রতিটি জেলায় গোয়েন্দাদের নিয়ে বিশেষ টিম গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা পুলিশ সুপাররা টিম গঠন করার কাজ শুরু করে দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু আশাবাদী হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। যদিও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র বলছে, পুলিশের কোনো সদস্য অপরাধ করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সদর দফতর সূত্র জানায়, গত চার বছরে বিভিন্ন অভিযোগে সারা দেশে প্রায় ৬৫ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গড়ে মাসে এক হাজার ৩৫৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এদিকে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে পুলিশের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে। পুলিশ সূত্র বলছে, প্রতি বছরই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বাড়ছে। ২০১৮ সালে ১৪ হাজার ৪০২ জনের বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে। পরের বছর এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৫১২। ২০২০ সালে আরো বেড়ে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ হাজার ২১২। গত বছর ১৬ হাজার ৪১৮ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে।

২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শাস্তি পাওয়া পুলিশের সংখ্যা ১০ হাজার ৪২১ জন। ২০১৬ সালে ১৩ হাজার ৫৮৬; ২০১৫ সালে ১১ হাজার ১৬৭; ২০১৪ সালে ১৫ হাজার ২৯৭; ২০১৩ সালে ১৪ হাজার ৬০ এবং ২০১২ সালে ১২ হাজার ৯৯২ জন পুলিশ সদস্য অপরাধ করে শাস্তি পেয়েছেন। এর মধ্যে চাকরিচ্যুত বা বরখাস্ত হয়েছেন ৫০৬ জন। বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে ৩৬ জনকে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, পুলিশ আইন অনুযায়ী, কোনো সদস্য অপরাধে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দু’ধরনের বিভাগীয় শাস্তির (লঘু ও গুরু) বিধান রয়েছে। গুরুদণ্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদোন্নতি স্থগিত, বেতন বৃদ্ধি স্থগিত ও চাকরিকালীন সুযোগ-সুবিধা রহিত করা হয়। অপরাধ প্রমাণ হলে বরখাস্ত করা হয়। বিসিএস ক্যাডারের পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ (শৃঙ্খলা ও আপিল) অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে একটি সেল রয়েছে। গত ছয় মাসে এসব নানা অভিযোগে কমপক্ষে অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্র। কিন্তু একশ্রেণীর পুলিশ সদস্যের অপরাধপ্রবণতা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না; বরং যতই দিন যাচ্ছে ততই পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগ সূত্র বলছে, কেউ যদি ভুয়া পুলিশ কিংবা পুলিশ পরিচয়ে প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধের শিকার হচ্ছেন বলে সন্দেহ হয় সে ক্ষেত্রে সাথে সাথে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে স্থানীয় থানা পুলিশের সহায়তা নিতে হবে। এ ছাড়া দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের এ ধরনের ঘটনার সাথে যুক্ত হওয়ার তথ্য পেলে তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট অপরাধের মামলার পাশাপাশি বিভাগীয় মামলা, সাময়িক বরখাস্তসহ সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে চাকরিচ্যুত করার বিধান রয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, কোনো পুলিশ সদস্য এ ধরনের অপরাধ করলে বাহিনী তাদের দায় নেবে না। যথাযথ তথ্য প্রমাণ পেলে ও তদন্তে অভিযুক্ত প্রমাণিত হলে রেগুলার মামলার পাশাপাশি গ্রেফতার শেষে আইনের মুখোমুখি করা হবে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা মহানগর পুলিশ বাহিনী জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া ভুয়া পুলিশ পরিচয়ে যে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এ ক্ষেত্রে আমরা সাধারণ মানুষকে প্রতারণা থেকে রক্ষা করতে বিভিন্নভাবে সচেতন করার চেষ্টা করছি। পুলিশ সদর দফতর সূত্র আরো বলছে, পুলিশের অপরাধের বিষয়টি সবসময়ই সাধারণ মানুষের সামনে স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন করা হয়। পুলিশ সদস্যদের অপরাধের বিষয়ে সদর দফতরে বিভিন্ন সময়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে গোয়েন্দা বাহিনী, জেলা পর্যায়ে ডিসি ও মেট্রো এলাকায় বিশেষ টিম, একাধিক মনিটরিং টিম মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। এ ছাড়া সদর দফতরসহ বিশেষ টিম এ ধরনের অপরাধীদের শনাক্তে কাজ করছে। পাশাপাশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের মনিটর করা হচ্ছে।

অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত পুলিশ সদস্যদের কর্মকাণ্ড নজরদারি করে আইনের আওতায় আনা হয়। আর পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে করা অভিযোগের নিষ্পত্তি হয় মূলত প্রচলিত আইন অনুযায়ী। অভ্যন্তরীণ বা বাইরের কারো কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর প্রাথমিক তদন্ত শেষে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পরপরই ইউনিট প্রধান অভিযুক্ত সদস্যকে কল করেন। এতে করে যখন একজন অভিযুক্ত সদস্যের শাস্তি নিশ্চিত হয় তখন ডিপার্টমেন্টের বাকি সদস্যরা মেসেজ পেয়ে যায়। এটি তাদের জন্য এক ধরনের হুঁশিয়ার বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।

মূলত, সব নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আর সে শর্তেই নাগরিকরা রাষ্ট্রকে কর দেয় ও রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। রাষ্ট্রকে এই কাজে সার্বিক সহযোগিতা করে পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ক্ষেত্রে তাদের সাফল্যও নেহাত কম নয়। কিন্তু একশ্রেণীর মূল্যবোধহীন পুলিশ সদস্যের লাগামহীন অপরাধপ্রবণতার কারণে পুরো বাহিনীই এখন ভাবমর্যাদা সঙ্কটে পড়েছে। আর জনগণও হচ্ছে রাষ্ট্রের সেবা ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।

এ অবস্থায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য অপরাধপ্রবণ সদস্যদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করা দরকার। কিছু অপরাধপ্রবণের কারণে যেন পুরো বাহিনী ইমেজ সঙ্কটে না পড়ে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা জরুরি। অন্যথায় কিছু অসৎপ্রবণের কারণেই পুরো বাহিনীই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা সঙ্কটে পড়বে; ব্যাহত হবে সুশাসন।

[email protected]

 

 


আরো সংবাদ



premium cement