০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

ইমরান খানের মন্তব্য বনাম ক্ষুব্ধ সেনানেতৃত্ব

- ছবি : সংগৃহীত

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খান সম্প্রতি যে মন্তব্য করেছেন তাতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বলেছে, তারা এতে ‘ভীতবিহ্বল’। ইমরান খান ফয়সালাবাদে এক জনসমাবেশে সরকারের সমালোচনা করে বলেন, ‘সরকার নিজেদের পছন্দের সেনাপ্রধান নিয়োগ করার জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দিচ্ছে।’ বিধি ও নিয়ম ভঙ্গ করে যদি কিছু করা হয় তবে তিনি বর্তমান শাসকদের ছেড়ে দেবেন না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিডিয়া উইং জানায়, সেনাবাহিনী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যখন ‘প্রতিদিন জাতির নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য’ জীবন দিচ্ছে, তখন সেনাবাহিনীর সিনিয়র নেতাদের মানহানি ও কলঙ্কিত করার এই চেষ্টা দুর্ভাগ্যজনক। সেনাপ্রধান নিয়োগ প্রশ্নে সিনিয়র রাজনীতিবিদরা বিতর্ক উসকে দিচ্ছেন। এটি দুর্ভাগ্য ও হতাশাজনক। আইএসপিআর জানায়, সেনাবাহিনীর সিনিয়র নেতৃত্ব সর্বোচ্চ মানদণ্ড ও মেধা অনুসরণ করে থাকে। তারা দেশপ্রেম ও পেশাদারিত্ব অনুসরণ করে চলে। এতে উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিনিয়র নেতৃত্ব ও সেনাপ্রধানের নিয়োগপ্রক্রিয়াকে কলঙ্কিত করা পাকিস্তান রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান- কারো জন্যই কল্যাণকর হবে না। (জিও নিউজ, নিউজ ইন্টারন্যাশনাল, নয়া দিগন্ত অনলাইন, ৬ সেপ্টেম্বর-২০২২) রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের অভিযোগ সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিয়া নওয়াজ শরিফেরও।

পাকিস্তানের ৭৫ বছরের ইতিহাসে জনগণের নির্বাচিত কোনো সরকার তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। বারবার তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক সঙ্কট ও অচলাবস্থা। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে রয়েছে সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষ, সুশাসনের অভাব, দারিদ্র্য, শিক্ষার হারের কমতি ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার অভাব। রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপের কারণে পাকিস্তানে আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, শান্তিপূর্ণ পন্থায় নির্বাচিত দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশেষ করে হরতাল, ধর্মঘট, আন্দোলন চলমান থাকায় সে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড মজবুত হতে পারেনি। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা শিল্পায়নের জন্য পাকিস্তানের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও সুপেয় পানির অভাবে জনগণের অবস্থা নাকাল। মুদ্রাস্ফীতির কারণে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীর দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এখন বাংলাদেশী এক টাকায় পাকিস্তানি দুই রুপিরও বেশি পাওয়া যায়। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটিয়েছে। এ পর্যন্ত সে দেশে তিন লাখ ২৩ হাজার মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয় এবং মারা গেছে ছয় হাজার ৬৫৪ জন। বিরোধীদলের অভিযোগ, আদালতের ওপর রয়েছে সেনাকর্তাদের অন্যায্য হাত। এক বিচারক সেমিনারে বলেন, তাকে সেনাসদস্যরা বন্দুকের মুখে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী রায় দিতে বাধ্য করেন। ইমরান খান যুবকদের জন্য এক কোটি চাকরির ব্যবস্থা ও গৃহহীনদের জন্য ৫০ লাখ বাড়ি নির্মাণ করে দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা-ও পূরণ করতে পারেননি।

২০২১ সালের ১৬ অক্টোবর পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালায় এবং ২৫ অক্টোবর বেলুচিস্তানের কোয়েটায় অনুষ্ঠিত ‘পিডিএম’-এর সরকারবিরোধী মানুষের বিশাল সমাবেশে লন্ডন থেকে ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে প্রদত্ত ভার্চুয়াল ভাষণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিয়া নওয়াজ শরিফ ২০১৮ সালে কারচুপির করে তার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইমরান খানকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করেন এবং সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার নাম নেন ১১ বার। তিনি আইএসআই প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদকেও অভিযুক্ত করেন। তিনি উল্লেখ করেন, সেনাবাহিনী তাদের শপথ ভঙ্গ করে চলেছে। তিনি বলেন, ১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও সেনাকর্মকর্তারা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। বাধ্য হয়ে বাঙালিরা সশস্ত্রযুদ্ধে নেমে পড়ে। ফলে পাকিস্তান দু’টুকরো হয়ে যায়। তিনি অর্থলিপ্সু জেনারেলদের বিচার দাবি করেন এবং বলেন, একদিন তাদের জবাব দিতে হবে। এর আগে কোনো রাজনৈতিক নেতা সেনাবাহিনীর জেনারেলদের উচ্চাকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে এমন জোরালো বক্তব্য দেননি। এর পরিণতি সম্পর্কে মিয়া নওয়াজ শরিফ নিশ্চয় সচেতন। ২০১৯ সালে আদালত আট সপ্তাহের জন্য জামিন মঞ্জুর করলে নওয়াজ শরিফ (৭২) উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য গমন করেন। নির্ধারিত সময়ে ফিরে না আসায় তার বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। মুসলিম লীগ (নুন) নেত্রী মরিয়ম নওয়াজ ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা নই। সেনাসদস্যরা আমাদের ভাই। তারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে পাকিস্তানের সংহতি ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা বজায় রাখতে অত্যন্ত সচেষ্ট ও নিবেদিতপ্রাণ। আমরা তাদের স্যালুট করি। কিন্তু যেসব উচ্চাভিলাষী সেনাকর্মকর্তা বুটের তলায় ব্যালটকে পদদলিত করে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বর মাসে ইমরান সরকারকে উৎখাত ও পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাহস্তক্ষেপ বন্ধে মুসলিম লীগের (নুন) সভাপতি মিয়া নওয়াজ শরিফ, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সভাপতি মাওলানা ফজলুর রহমান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টিপ্রধান বিলাওয়াল ভুট্টোর নেতৃত্বে কয়েকটি দলকে সাথে নিয়ে গঠন করেন পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)। এই বিরোধী মোর্চায় দলের সংখ্যা ১১।

ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! পাকিস্তানে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যেসব রাজনীতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তারা পছন্দের ও বিশ^স্ত জেনারেলকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করে থাকেন। কিন্তু দেখা গেল, অনেক সেনাপ্রধান শপথ ভঙ্গ করে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো কয়েকজন জেনারেলকে ডিঙিয়ে জিয়াউল হককে সেনাপ্রধান করেন বিশ্বাস স্থাপন করে। সময় ও সুযোগ বুঝে তিনি ভুট্টোকে কেবল ক্ষমতাচ্যুত করেই ক্ষান্ত হননি; বরং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জিঘাংসা মনোবৃত্তি চরিতার্থ করেন। জেনারেল মোশাররফ ও জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়াকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন নওয়াজ শরিফ আপন ভেবে। কিন্তু তারাই নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। জেনারেল মোশাররফ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে নেন এবং নওয়াজ শরিফকে সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠান। অপর দিকে, জেনারেল বাজওয়া ইমরান খানকে বসান নওয়াজ শরিফকে গদিচ্যুত করে। জেনারেলরাই পাকিস্তানের ইতিহাসে নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতাদের পুতুল হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। ঠিকমতো নাচাতে না পারলে ক্ষমতাচ্যুত করে অন্যজনকে বেছে নেন এবং গাদ্দার উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরোর (এনএবি) মাধ্যমে গারদে ঢুকিয়ে প্রতিশোধ নেন।

১৯৪৭ সালে একটি আদর্শকে সামনে রেখে ভারতবিভক্তি সম্পন্ন হয়। আলোচনা এবং আপস-মীমাংসার মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু’টি রাষ্ট্র সৃষ্টি হলেও রক্ত ঝরেছে বিপুল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, খুনাখুনি, লুটপাট, স্বজন হারানোর বেদনায় তৎকালীন সময় ও পরিবেশ বিষিয়ে উঠেছিল। এতে ২০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায় এবং ১৪ লাখ বাস্তুভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। কংগ্রেস নেতারা প্রথম দিকে ভারতবিভক্তির বিরোধিতা করলেও সর্বশেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেন ও মিসেস এডউইনা সিন্থিয়া মাউন্টব্যাটেনের প্রচেষ্টায় একটা সময়ে এসে নেহরু-প্যাটেলের মতো নেতারা দেশবিভক্তি মেনে নেন। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদ স্বেচ্ছায় জওয়াহেরলাল নেহরুর অনুক‚লে ছেড়ে দেন। এতে নেহরুর পক্ষে সরাসরি ব্রিটিশ বড়লাটের সাথে দেশ বিভাগ নিয়ে আলোচনা করতে কোনো বেগ পেতে হয়নি। মহাত্মা গান্ধী মাওলানা আজাদকে দুঃখ করে বলেন, কংগ্রেসের সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়ে আপনি ‘হিমালয় পর্বত পরিমাণ ভুল’ করেছেন। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ লিখিত ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ গ্রন্থে এসব তথ্য বিদ্যমান রয়েছে।

দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পেছনে উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর আন্দোলন ও সমর্থন ছিল জোরালো, নিখাদ ও স্বতঃস্ফ‚র্ত। কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন অবিসংবাদিত নেতা। ভারতের প্রখ্যাত বুজুর্গ ও আলিমে দ্বীন হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী কায়েদে আজমকে নসিহত করে চিঠি লেখেন এবং পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। রেকর্ডসংখ্যক মানুষ বিশেষ করে ব্যবসায়ী, অফিসার, রাজনীতিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও মেধাবী ওলামায়ে কেরাম ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে পাড়ি জমান। মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা মুহাম্মদ শফি দেওবন্দী, গবেষক আলিম মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, মুহাদ্দিস আল্লামা ইদরিস কান্ধলভী, ইতিহাসবিদ আল্লামা সাইয়েদ সোলায়মান নদভী, লাহোর জামিয়া আশরাফিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল আল্লামা মুহাম্মদ হাসান অমৃতসরীসহ অনেক বিদগ্ধ আলিম পাকিস্তানে এসে থিতু হন। থানভীপন্থী ওলামা মাশায়েখদের প্রত্যক্ষ আন্দোলন ও সহযোগিতা না থাকলে জিন্নাহ সাহেবের একার পক্ষে পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি করা সম্ভব হতো কি না সন্দেহ। একটি ঐতিহাসিক সত্য কথা জেনে রাখা দরকার, ১৯৪৭ সালে পূর্ববাঙলা যদি পাকিস্তানের অংশ না হতো, আজ বাংলাদেশ হতো কাশ্মির ও হায়দ্রাবাদের মতো ভারতবর্ষের অংশ।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করেন আল্লামা শিব্বির আহমদ ওসমানী ও ঢাকায় আল্লামা যফর আহমদ ওসমানী। মুসলমানদের একটি ইনসাফভিত্তিক দেশ হবে, ইসলামী আদর্শের বাস্তবায়ন হবে, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, আইনের শাসন সমুন্নত থাকবে, এগুলোই ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের স্বপ্ন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের তরুণ নেতা। ১৯৫৬ সালের সংবিধানও এই আলোকে রচিত হয়।

’৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম হওয়ার পরপরই জেনারেলদের মধ্যে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলের মানসিকতা তৈরি হয়। পাকিস্তানের আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেন। ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইউব খান ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে ক্ষমতার মসনদে আসীন হন। ১০ বছর পর জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতা কেড়ে নেন এবং দুই বছর রাজত্ব করেন। অতঃপর জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সরিয়ে জেনারেল জিয়াউল হক মসনদে বসেন ১৯৭৭ সালে এবং ১১ বছর শাসন করেন। এরপর আসেন জেনারেল মোশাররফ। তিনি ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৯ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। পাঁচজন জেনারেল ৩২ বছর রাজত্ব করেন। চিরায়ত নিয়মে ক্ষমতা দখল করে তারা বলেন, ‘স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতা হাতে নিতে বাধ্য হয়েছেন এবং নির্বাচন দিয়ে সেনারা ব্যারাকে ফিরে যাবে।’ অথচ ইতিহাস সাক্ষী, তারা ক্ষমতার আসনকে আস্তে আস্তে পাকাপোক্ত করতে থাকেন। জেনারেল জিয়াউল হক সংবিধানের ধারা সংশোধন করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পথ সুগম করেন। The article 58 (2) (b)-তে বলা হয়েছে- জাতীয় সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে পারবে। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন ও তাদের সংসদীয় নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেন।

ফাঁকে ফাঁকে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলেও নানা বিষয়ে সেনা হস্তক্ষেপের কারণে কোনো সরকার সুষ্ঠুভাবে দেশ চালাতে পারেনি। কিছু দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিক ও আমলা সেনাশাসন এবং রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপকে সমর্থন জোগায় প্রতিটি আমলে। জেনারেলদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ, করপোরেট বাণিজ্য ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য ও পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সেনাবাহিনীকে পাশ কাটিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটের পক্ষে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ নেই। বিগত আট দশকে সেনাবাহিনী অলিখিত ও অদৃশ্য রেওয়াজ গড়ে তোলে। সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ যে বা যারা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেবেন, তারাই মসনদে আসীন হবেন। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা এ কাজগুলো সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সংগোপনে। পাকিস্তানের সিভিল প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া গোয়েন্দা সংস্থার নিয়ন্ত্রণে। স¤প্রতি পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালায় ও কোয়েটায় অনুষ্ঠিত ‘পিডিএম’-এর সরকারবিরোধী সমাবেশে লন্ডন থেকে ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে প্রদত্ত নওয়াজ শরিফের ভাষণ কোনো টিভি চ্যানেল সম্প্রচার করতে পারেনি। অঘোষিত সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়।

পাকিস্তানের জনগণ নানা ধর্মীয় চিন্তাদর্শন ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত। সুন্নি, শিয়া, দেওবন্দী, বেরলভি, আহলে হাদিস, কাদিয়ানি, মাজারপন্থীদের মধ্যে সময়ে সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐক্য গড়ে উঠলেও পারস্পরিক দ্ব›দ্ব-সঙ্ঘাত ও হানাহানি বেশ প্রকট। প্রশাসন, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী ও সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল পদে কাদিয়ানি ও শিয়া মতাবলম্বীদের অবস্থান মজবুত। এ পর্যন্ত বহু খ্যাতনামা আলেম অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে শাহাদত বরণ করেন। কোনো ঘাতকের বিচার হয়নি। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কী, কেউ জানে না। এটি কেবল রহস্যজনক নয়, রীতিমতো উদ্বেগজনকও বটে। সাবেক বিচারপতি শায়খুল ইসলাম আল্লামা তকি ওসমানী বিশ্ববরেণ্য এক ইসলামী স্কলার। মধ্যমপন্থী হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা দুনিয়াজুড়ে স্বীকৃত। কিছুদিন আগে সশস্ত্র দুর্বৃত্ত তার গাড়িতে গুলিবর্ষণ করে। এতে ড্রাইভার মারা গেলেও তিনি অলৌকিকভাবে প্রাণে রক্ষা পান। পাকিস্তানকে ইসলামী স্কলারশূন্য করার কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সে দেশের এজেন্টরা সক্রিয় কি না আজো তদন্ত হয়নি বা তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পায়নি। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক ও প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন চাপা পড়ে গেছে, কোনো অপরাধীর বিচার হয়নি। আন্তর্জাতিক ঘটনার বিশ্লেষকদের মতে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি পাকিস্তানকে ধীরে ধীরে ব্যর্থরাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। যেসব খ্যাতনামা আলেম সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের হাতে শাহাদতবরণ করেন তাদের মধ্যে রয়েছেন মাওলানা হক নওয়াজ জঙ্গভী, মাওলানা আলী শের হায়দরী, মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকী, মাওলানা আজম তারিক, ড. হাবিবুল্লাহ মোখতার, মুফতি শামযী, মাওলানা এহসান এলাহী জহির, সিনেটর মাওলানা ছমিউল হক, ড. আদিল খান প্রমুখ। আজ পর্যন্ত কোনো ঘাতকের বিচার হয়নি। সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগকে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরোর কাছে জবাবদিহি থেকে ইন্ডেমনিটি দেয়া হয়েছে। আইনের শাসনের স্বার্থে ইন্ডেমনিটি বাতিল হওয়া দরকার। রাজনীতিক, মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তারা জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকলে অন্যরা থাকবেন না কেন? এই প্রশ্ন স্বাভাবিক। রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে পাকিস্তানে যদি রাজনীতিকরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন, জনমত গঠন করতে পারেন এবং জনগণের সহায়তা ও ম্যান্ডেট নিয়ে সংবিধানের ধারা পরিবর্তন করতে পারেন, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন ইতিহাস তৈরি হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। একটি নির্বাচিত সরকারের পালাবদল ঘটবে আরেকটি নির্বাচিত সরকার দিয়ে। কোনোক্রমেই সেনাশাসন বিকল্প হতে পারে না বা সেনা হস্তক্ষেপ কাম্য হতে পারে না। এ সংস্কৃতিই সুশাসন, উন্নয়ন ও অগ্রগতির সোপান।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement