২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বেনু খাঁন : একটি আস্থার প্রতীক

লেখক। - ছবি : নয়া দিগন্ত

বেনু খাঁন, পুরো নাম শামছুর রহমান খাঁন বেনু। ইন্টারমিডিয়েট ১৯৭২ সালে পাস করেছেন কায়েদ আযম কলেজ থেকে যার বর্তমান নাম শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ। এসএসসি পাস করেছেন ১৯৭০ সালে। ছাত্রজীবনে নাটকে অংশগ্রহণ করেছেন, কলেজ জীবন থেকেই সমসাময়িক সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল গঠন করলে তিনি যোগদান করে তারাবো ইউনিয়ন (বর্তমানে পৌর) ওলেমা দলের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা ওলেমা দলের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন। জেলা সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিনি রূপগঞ্জ উপজেলা ওলেমা দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

০৩-৯-২০২২ বেলা তখন প্রায় ১২:৩০-এ সময় আমি একটি একাডেমিক কাজে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এমন সময় তারাবো পৌর ওলেমা দলের সভাপতি কামাল খাঁন আমাকে ফোনে জানালেন যে, বেনু ভাই গুরুতর অসুস্থ, তিনি কথা বলতে পারছেন না। আমি বললাম, ভাইকে ঢাকা হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তার শারীরিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে, পরিবারের সদস্যরা বেনু ভাইকে ঢাকা হাসপাতালে আনতে রাজি হচ্ছিল না। ফলে আমার স্ত্রীকে পাঠাই তাকে ঢাকা এনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য। ইতোপূর্বে তিনি ওই হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছেন। অতঃপর পরিবারের লোকজনই বেনু ভাইকে মুমূর্ষ অবস্থাতেই ঢাকা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে আসে এবং প্রায় দুপুর ২টায় আমি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে দেখতে পাই যে, তিনি কথা বলতে পারছেন না এবং কাউকে চিনতে পারছেন বলে মনে হচ্ছিল না। পরের দিন (০৪-৯-২০২২) দুপুরে হাসপাতালে তার অবস্থা অপরিবর্তিতই দেখলাম। ওই দিন রাত্র ১১টায় হাসপাতালে দেখলাম একই অবস্থায়। ০৬-০৯-২০২২ বেলা ৩টায় আমি থাইল্যান্ডের ব্যাংকক বসে ফোনে জানতে পারলাম নিজ বাড়িতে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। ০৫-০৯-২০২২ তারিখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেনু ভাইকে রিলিজ করে দিয়েছেন বিধায় পরিবারের সদস্যরা তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন।

এই পৃথিবীতে মানুষের ‘জীবন’ কোনো স্থায়ী বিষয় নয়, বরং একটি ভ্রমণকাহিনী মাত্র। সংক্ষেপে যদি বলি তবে বলতে হয় যে, মানুষের জীবন কাহিনীর ছদ্মাবরণে কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে কাক্সিক্ষত স্থায়ী ঠিকানায় পৌঁছাতে হয়। একটি বিদ্যমান স্থায়ী প্রাকৃতিক শক্তি থেকে মানুষের রুহ বা প্রাণশক্তির সৃষ্টি, যা পর্যায়ক্রমে পিতার পাঁজরে, সেখান থেকে মায়ের গর্ভে, মায়ের গর্ব থেকে পৃথিবীতে, পৃথিবী থেকে কবরে, কবর থেকে সেই প্রাকৃতিক শক্তির সরাসরি নিয়ন্ত্রণে। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি মানুষ ও জিনকে বিচারের সম্মুখীন হয়ে কর্মফল মোতাবেক পুরস্কার বা শাস্তি নির্ধারিত হবে। অনেকে এটাও বিশ্বাস করে যে, কর্মফল অনুযায়ী মৃত মানুষটির পুনঃজীবন লাভ করে চলতি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীতে আগমন হবে। অন্য দিকে, নাস্তিকেরা বিশ্বাস করে যে, মৃত্যুর পর মানুষ মাটি বা ছাই হয়ে মাটিতে মিশে যাওয়া ছাড়া অন্য কিছুই হবে না। মৃত্যুসংক্রান্ত এসব আলোচনার বাহিরে বেনু ভাইকে নিয়ে মনের কিছু কথা প্রকাশ করতে চাই, যিনি ছিলেন একটি আস্থার প্রতীক এবং ন্যায়ের বার্তাবাহক। তার পূর্বাপর কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত হয়েছে, বিশ্বাস ও আস্থা রাখার মতো ব্যক্তি ছিলেন তিনি। ভ্রমণভিত্তিক এ জীবনে অনেক মানুষের সাক্ষাৎ হয়, বন্ধুত্ব হয়, বৈরিতা হয়, কিন্তু কিছু মানুষকে তার কৃতকর্মের জন্য মনে রাখতে হয় চিরকাল।

পৃথিবীতে আস্থার চেয়ে অনাস্থার পরিধি অনেক বড়, বিশ্বস্ততার পরিবর্তে বিশ্বাসঘাতকের ইতিহাস অনেক, বন্ধু সেজে এসে স্বার্থ হাসিলের পর চরম শক্রতা শুরু করে, লোকমুখে যাকে বলে ‘সুঁই হয়ে ঢুকে, কুড়াল হয়ে বেরিয়ে যায়’ বা ‘বিষ দিয়ে হত্যা না করে চিনি দিয়ে হত্যা করে’ প্রভৃতি প্রভৃতি। যদিও অল্পস্বল্প তথাপিও এ সমাজে এক শ্রেণীর মানুষের দেখা মেলে যারা সুখে দুঃখে একই আচরণ করে। আমাদের দেশে একটি চরম সত্য কথার প্রবাদ রয়েছে ‘সুসময়ে সকলেই বন্ধু বটে হয়, দুঃসময় আসলে কেউ কারো নয়’। বাস্তবতার কারণে এ প্রবাদটি আমাদের সমাজে বেদ বাক্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের দেশের স্বার্থন্বেষী মানুষের চরিত্র ‘মাছির’ চরিত্রের সাথে তুলনা করা চলে। যেমন মধু থাকলে ‘মাছিরা’ সারাক্ষণই চার পাশে ভন ভন করতে থাকে, স্বার্থ দিতে না পারলে তাদের আর দেখা যায় না। এ সমাজের অধিকাংশ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো সুসময়ে কানের সামনে ভ্যান ভ্যান করবে, দুঃসময়ে অপবাদ দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু বেনু ভাই ছিল এমন একজন মানুষ যিনি কাউকে বুক দিলে তার দুঃসময়ে পিঠ দেখাননি।

বেনু ভাই দীর্ঘদিন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। হার্টের রোগ ছাড়াও চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক হাঁটুতে নিক্যাপ পরে চলাফেরা করতে হতো। ঠিকমতো হাঁটতে পারতেন না। চোখেও ঝাপসা দেখতেন। তদুপরি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে দলীয় এমন কোনো কর্মসূচি ছিল না যেখানে তিনি লোকবলসহ অংশগ্রহণ করেননি। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচিতে পুলিশ বেনু ভাই এবং এটিএম কামালকে বেদম পিটিয়ে রক্ত ঝরিয়েছে। তার পরও বেনু ভাই আন্দোলন সংগ্রামে পিছপা হননি, বরং কোনো কর্মসূচির সংবাদ না দিলে তিনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন।

সাম্প্রতিকালে কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতাদের সহজাত প্রবৃত্তি হলো কর্মীদের নিকট থেকে উপঢৌকন নেওয়া বা কর্মীদের টাকায় ভূঁরিভোজ করা। এর ব্যতিক্রম ছিলেন বেনু ভাই। তিনি প্রায় প্রায়ই তার দলীয় লোকদের মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য দাওয়াত করতেন, আমি নিজেও কয়েকবার তার দাওয়াতে গিয়েছি এবং এটাই ছিল তার আনন্দ। তিনিই ছিলেন নেতা এবং তিনিই ছিলেন কর্মী এবং কর্মীদের অনুপ্রেরণা। ভ্যানে চরে দিনের বেলাতেই নিজ হাতে দলীয় পোস্টার লাগাতে তাকে দেখেছি। তারাবো পৌরসভার যাত্রামুড়া এলাকায় তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটি ছিল রাজনৈতিক দলের অফিস। অফিস ও পার্শ্ববর্তী এলাকাটি দলীয় পোস্টার ব্যানারে আচ্ছাদিত ছিল। স্থানীয় সাংসদের নির্দেশে সরকার দলীয় সন্ত্রাসীরা কয়েকবার তার অফিস ভাঙচুর করে, তার পরও তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেমে থাকেনি। পরের দিনই ঘটা করে দলীয় পোস্টার নিজ খরচে প্রস্তুত করে এলাকায় টাঙিয়েছেন।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য তিনি ব্যাপক আকারে ত্রাণসামগ্রী জোগাড় করলেন, আমাকে বললেন, ‘আপনি একটি বাসের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ আসা যাওয়ার জন্য একটি বাস ভাড়া করে দিলাম এবং তার উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে আমি নিজেও সীমান্ত এলাকায় গেলাম ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য। তিনি নিজে ছিলেন অত্যন্ত মানবিক এবং কর্মপ্রিয় মানুষ। আমাদের সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, বর্ণচোরায় সমাজ টইটুম্বর হয়ে গেছে। যে যত মিথ্যা বলতে পারে সে নাকি তত বড় রাজনীতিবিদ, যে অন্যকে ঠকাতে পারে সে নাকি বড় ধরনের বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধির মারপ্যাঁচেই অন্যকে ঠকানোর একটি বড় হাতিয়ার। অথচ আল্লাহ পাক মারপ্যাঁচ দিয়ে কোনো কথা বলা বা কোনো বিষয়ের মিথ্যা বা অনুমাননির্ভর ব্যাখ্যা দিতে নিষেধ করেছেন। বেনু ভাই ছিলেন এর ব্যতিক্রম। তিনি সক্রিয়ভাবেই রাজনীতি করতেন, কিন্তু মারপ্যাঁচ দিয়ে বলতে শুনিনি। সত্য কথা বলার সৎ সাহস তার ছিল। বর্ণচোরাদের মতো ক্ষণে ক্ষণে নিজের রূপ পাল্টাতেন না।

আমাদের সমাজে বা দেশে সবই আছে, অভাব শুধু ব্যক্তিত্ববান সৎ মানুষ, যারা ব্যতিক্রম তারা সংখ্যায় খুবই কম এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ। ফলে এই সমাজ সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাথে পেরে উঠছে না। রাজধানীতে কলার খোসায় পিছলে যদি কেহ আহত হয় তখন পত্রিকার পাতায় ফলাও করে প্রচার হয়। কিন্তু ভাগ্যোর নির্মম পরিহাস এই যে, রাজধানীর বাহিরে কোনো ন্যায়বান ব্যক্তিসম্পন্ন অনুকরণ করার মতো ব্যক্তির মৃত্যু হয় তখন পত্রিকার পাতায় তার স্থান হয় না, যদি না পরিবারের পক্ষ থেকে শোক সংবাদের বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা না হয়। রাজনৈতিক অঙ্গনেও বেনু ভাইয়ের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি, যেমন মূল্যায়ন হয়নি জাহাঙ্গীর আলম কমিশনার, রফিকুল ইসলাম কমিশনার, জামাল উদ্দিন কালু প্রভৃতি রাজপথের নেতার। তবে এলাকায় গণমানুষের শ্রদ্ধাবোধ তার প্রতি থাকবে অনন্তকাল। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ছাড়া দুর্যোগে, দুঃসময়ে মানুষ তাকে খুঁজবে একটি সহানুভ‚তি ও সাহায্যের প্রত্যাশায়।

বেনু ভাইয়ের বাড়ির সামনেই একটি সুইপার কলোনি অবস্থিত। স্বার্থান্বেষী মহল ওই সুইপার কলোনি উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে তিনি প্রতিরোধ করে তাদের উচ্ছেদ বন্ধ করেন। একদিন তিনি আমাকে বললেন, সুইপার কলোনিতে বিশুদ্ধ পানি পান করার ব্যবস্থা নেই। আপনি একটি টিউবওয়েল দিবেন। তিনি নিজ তত্ত্ববধানে সেই টিউবওয়েল স্থাপন করে সুইপারদের বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করেন। তারই মাধ্যমে সুইপারদের সাথে আমার গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং বেনু ভাইকে নিয়ে আমি প্রায়ই ওই কলোনিতে গেছি, গ্রহণ করেছি তাদের আতিথিয়তা। ১/১১ সরকারের সময় বিএনপির দুঃসময়ে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে কারাবরণ করেছেন, রাজপথে পুলিশি হামলার শিকার হয়েছেন, ১/১১ সরকার হটাও আন্দোলন অনশন কর্মসূচিসহ সব রাজনৈতিক কর্মসূচি তিনি পালন করেছেন। গণমানুষের সামাজিক সমস্যা বা রাজনৈতিক আন্দোলন অথবা দলের যেকোনো কর্মসূচিতে বেনু ভাই ছিলেন অগ্রভাগে, কোনো পিছপা দেন নাই, অথচ এ জাতীয় মানুষই জীবিতকালে যথাযথ মূল্যায়িত হন না, যখন মূল্যায়িত হন তখন করবে তার হাড্ডি মাংস মাটির সাথে মিশে যায়। তবে তাদের জীবনকাহিনী রচিত হয় গণমানুষের হৃদয়ে।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)


আরো সংবাদ



premium cement
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে পিকআপ-প্রাইভেটকার সংঘর্ষে নারী নিহত বাশারকে আশ্রয় দিলেও সব সম্পদ জব্দ করেছে রাশিয়া মণিপুরে হু হু করে ঢুকছে মিয়ানমারের পাচার হওয়া অস্ত্র! রিজওয়ানের নেতৃত্বে ইতিহাস পাকিস্তানের, ঘরের মাঠে ‘প্রথমবার’ চুনকাম দ. আফ্রিকা আজ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত হবেন উপদেষ্টা হাসান আরিফ ৪ বিলিয়ন ডলার আত্মসাত : টিউলিপকে জিজ্ঞাসাবাদ নিজের বিমানে ‘ঘুমিয়ে’ পড়েছিলেন বাইডেন! আড়ি পাতায় যুক্তরাষ্ট্রে দোষী সাব্যস্ত পেগাসাস চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারতের সব ম্যাচ দুবাইয়ে কুয়েত সফরে সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মানে ভূষিত মোদি তালাক নিয়ে যুক্তরাজ্যে যেতে চান বাশার আল-আসাদের স্ত্রী

সকল